ফিচার I ব্যাঞ্জো
বাদ্যযন্ত্র পরিবারের গুরুত্বপূর্ণ এক সদস্য ব্যাঞ্জো। জন্ম মূলত ক্যারিবিয়ান অঞ্চলে। আফ্রিকান-আমেরিকান সংগীতের মধ্যমণি এই যন্ত্র আফ্রিকার বাইরে অন্যান্য দেশে বেশ জনপ্রিয়। একে আমেরিকার ওল্ড টাইম মিউজিক ইনস্ট্রুমেন্টও বলা হয়ে থাকে।
সপ্তদশ শতাব্দীর শেষ দিকে পশ্চিম আফ্রিকায় প্রথম ব্যাঞ্জোসদৃশ একধরনের বাদ্যযন্ত্র দেখা গিয়েছিল। পরে অষ্টাদশ শতাব্দীতে ব্যাঞ্জো উত্তর আমেরিকায় বেশ পরিচিত হয়ে ওঠে। সে সময় আঞ্চলিক গান বা আফ্রিকান ফোক গানে এটি ব্যবহৃত হতে শুরু করে। তবে বাণিজ্যিকভাবে এর সহজলভ্যতা কিংবা প্রসার ঘটতে আরও প্রায় অর্ধশতাব্দী লেগে গিয়েছিল। এর নামকরণ নিয়ে একাধিক মত রয়েছে। কারও মতে, কিমবুন্দু শব্দ ‘বাঞ্জা’ থেকে এই ব্যাঞ্জো শব্দের উৎপত্তি। আবার কারও মতে, পর্তুগিজ শব্দ ‘ব্যানডারিয়া’ থেকে এই নাম এসেছে। মজার ব্যাপার হলো, এরই মতো দেখতে বেশ কয়েকটি বাদ্যযন্ত্র বিভিন্ন অঞ্চলে প্রচলিত। জাপানিজ ‘শামিজেন’, পার্সিয়ান ‘টার’ কিংবা মরক্কোর ‘সিন্তির’ প্রভৃতি বাদ্যযন্ত্রের কথা এ ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য। সেনেগাম্বিয়ার জোলা আদিবাসীরা ‘অ্যাকোনটিং’ নামের একটা যন্ত্র বাজাত, যা অনেকটা ব্যাঞ্জোর মতো। পরে আফ্রিকায় গোলাকার বডি এবং কাঠ ও স্টিলের নেক লাগানো হয় এই যন্ত্রে। বাংলাদেশের কিছু অঞ্চলে এ ধরনের একটি বাদ্যযন্ত্র প্রচলিত, যাতে ফ্রেটবোর্ডের উপরে কি-বোর্ডের মতো রিড ব্যবহৃত হয়। এটি ব্যাঞ্জোর আরেকটি আঞ্চলিক রূপ।
সাধারণত চার ধরনের ব্যাঞ্জো দেখা যায়। যেমন প্লেকট্রাম, টেনর, সেলো ও লো। এগুলোর মধ্যে প্লেকট্রামকে স্ট্যান্ডার্ড হিসেবে ধরা যায়। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে কিছু হাইব্রিড ভার্সন। যেমন—বেজ ও কন্ট্রাবেজ ব্যাঞ্জো। স্ট্রিংয়ের ওপর ভিত্তি করেও এর জাতভেদ করা যায়। যেমন ফোর স্ট্রিং, ফাইভ স্ট্রিং ও সিক্স স্ট্রিং। ইউকেলেলের পথ ধরে ব্যাঞ্জোতে রয়েছে ব্যাঞ্জো লেলে।
প্লেকট্রাম ব্যাঞ্জোয় চারটি তার। এতে ফ্রেট ২২টি। নেকের দৈর্ঘ্য ২৬-২৮ ইঞ্চি। এর টিউনিং হয় সি৩-জি৩-বি৩-ডি৪। এটিকে গিটারের ওপরের চার স্ট্রিংয়ের মতো করেও টিউন করা যায়। স্ট্যান্ডার্ড ব্যাঞ্জোর মূল বডি কাঠের তৈরি। গোলাকার ফ্রেমে পাতলা রেজোনেটর স্কিন কিংবা চামড়া লাগানো থাকে। এর ওপরে বসানো হয় ব্রিজ। হালের অ্যাকুইস্টিক ফর্মুলা ছাড়িয়ে বাদ্যযন্ত্রটির প্লাগড ভার্সন চলছে।
টেনর ব্যাঞ্জো হলো শর্ট ভার্সন। এর নেক ১৭-১৯ ইঞ্চির মধ্যে হয়ে থাকে। বাকি সবকিছু প্লেকট্রামের মতোই থাকে। এর ফ্রেট ১৭টি। ১৯১০ সালের দিকে এর প্রচলন শুরু হয়।
লো কিংবা সেলো ব্যাঞ্জো বাজানোর ধরন একটু আলাদা। একে ব্যাঞ্জোলিন বলা হয়ে থাকে। সেলো ব্যাঞ্জোর টিউনিং হয় সি২-জি২-ডি৩-এ৩। ব্যাঞ্জো অর্কেস্ট্রাতে এটি ব্যবহৃত হয়।
বেজ ও কন্ট্রাবেজ বডির ক্ষেত্রে টোন ভারী হয়ে আসে। এর বডি সবচেয়ে বড়। টিউনিং করা হয় ই-এ-ডি-জি। এই ব্যাঞ্জোগুলো তিন ও চার তারের হয়ে থাকে। ডাউন অক্টেভে টিউনিং হয় সি-জি-ডি-এ।
সিক্স স্ট্রিং ব্যাঞ্জোর প্রচলন মূলত ইংরেজদের হাত ধরে হয়। উইলিয়াম টেমলেট নামের একজন ব্যাঞ্জো নির্মাতা ও বাদক এই ভার্সন নিয়ে আসেন। তিনি ১৮৪৬ সালে লন্ডনে একটি মিউজিক শপ খোলেন। ১৮৮০ সালের দিকে এই বাদ্যযন্ত্র বাজারজাত করেন জিথার ব্যাঞ্জো নামে। সাধারণত ব্যাঞ্জোর গোলাকার অংশটির পেছনের দিকটা খোলা থাকে। কিন্তু জিথারের পেছনের দিক বন্ধ।
ব্র্যাকেট, আইবানেজ, রগ, মরগ্যান মনরি, এপিফোন, ফেন্ডার, মার্টিন স্মিথ, সাগা, লুজি প্রভৃতি ব্র্যান্ড এই বাদ্যযন্ত্রের জন্য বেশ পরিচিত ও বিশ্বমানের। বাংলাদেশে ১২ হাজার টাকা থেকে শুরু করে মোটামুটি ২ লাখ টাকা দামের ব্যাঞ্জো পাওয়া যায়। বিশ্ববিখ্যাত ব্যাঞ্জো প্লেয়ারদের মধ্যে রয়েছেন টড টেইলর, অবি বার্থম্যান, স্টিভ মার্টিন, রয় ক্লার্ক, ডেভ হিউম প্রমুখ। এশিয়ায় এই যন্ত্রের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া শুরুতে কিছুটা কঠিন ছিল। ইদানীং তা বেশ মানানসই হয়ে উঠেছে। বিশেষত ইন্ডিয়ান ফিউশন মিউজিকে এর ব্যবহার চোখে পড়ার মতো। পাকিস্তানি কোক স্টুডিও, ইন্ডিয়ান কোক স্টুডিও, মোজো মিউজিক, ফিউশন লাউঞ্জ, কিংবা অন্য ফিউশন স্টুডিওগুলোতে আলাদা আবহ তৈরি হচ্ছে এই বাদ্যযন্ত্রের গুণেই।
তাওসিফ আহমেদ
ছবি: ইন্টারনেট