ফোকাস I প্রাকৃতিক পরিচর্যায় কোমল ও মসৃণ ত্বক
শুষ্কতা ত্বককে নিষ্প্রাণ করে। আর সেটা বছরের যেকোনো সময়ই হতে পারে। বিশেষ করে মুখত্বক। আর শরীরের এই দর্পণকে তো কখনোই মলিন হতে দেওয়া যাবে না; বরং একে আরও নজরকাড়া, কোমল আর সতেজ করে তুলতে প্রতিদিনকার পরিচর্যায় প্রয়োজন বিশেষ কিছু। ফেসওয়াশ এ ক্ষেত্রে হতে পারে উত্তম। তবে তারও রকমফের আছে। কারণ, কৃত্রিম রাসায়নিক উপাদানে তৈরি হলে সেই ফেসওয়াশ ব্যবহার করা আর ক্ষারযুক্ত সাবান ব্যবহার করা এক হয়ে যায়। তবে উপাদানগুলো প্রাকৃতিক হলে কথাই নেই। তাহলে বলাই বাহুল্য, ত্বক হয়ে উঠবে লাবণ্যদীপ্ত, প্রাণময়। এ ক্ষেত্রে দুটি উপাদান হতে পারে ভীষণই কার্যকর। অ্যালোভেরা আর নিম। এ দুটি প্রাকৃতিক উপাদানের নির্যাস ত্বকের গভীর থেকে পরিষ্কার করার পাশাপাশি বাড়তি তৈলাক্ততা দূর করবে। ব্রণের উৎপাত থেকেও রেহাই দেবে। দূর করবে মালিন্য। এমন ফেসওয়াশ প্রতিদিনকার পরিচর্যায় ব্যবহার করা গেলে বাড়তি পরিশ্রম ছাড়াই সব সুবিধা উপভোগ করা যাবে সহজে। তাহলে নির্দ্বিধায় বলা যায় ত্বক হয়ে উঠবে সজীব, পুষ্ট ও পেলব; প্রতিদিনকার প্রকৃতিপ্রাণিত পরিচর্যায়।
নিম
এটি আয়ুর্বেদের জনপ্রিয় উপাদান। প্রচুর অ্যান্টি-ব্যাকটেরিয়াল উপাদান থাকার কারণে সৌন্দর্যচর্চাতেও রয়েছে এর নানা ব্যবহার। বিউটি প্রডাক্ট তৈরিতে সারা বিশ্বেই নিমের কদর আছে।
অ্যান্টি-ফাঙ্গাল, অ্যান্টি-ব্যাকটেরিয়াল ও অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি গুণাগুণসমৃদ্ধ। ত্বকসংক্রান্ত যেকোনো সংক্রমণ কমাতে এর জুড়ি নেই। ফলে ত্বককে গভীর থেকে পরিষ্কার করতে সাহায্য করে। কিন্তু কোমলভাবে। তাই ত্বকের কোনো ক্ষতি সাধিত হয় না এতে। ত্বক হয়ে ওঠে ঝকঝকে পরিষ্কার। মৃতকোষ সরাতেও কার্যকর নিম। সেই সঙ্গে ত্বকের বাড়তি তেল দূর করতে সাহায্য করে, কিন্তু এর সহজাত স্বাভাবিক তেল স্তরে ক্ষতি করে না। ফলে ত্বকে বাড়তি ধুলা-ময়লা টিকে থাকতে পারে না। প্রাকৃতিক রূপচর্চার উপাদান হিসেবে সারা বিশ্বে নিম জনপ্রিয়। কারণ, এতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট এবং ন্যাচারাল অ্যান্টিসেপটিক। আর্দ্রতা ধরে রেখে ত্বক কোমল করে তোলে। নিম অ্যান্টি-অ্যাকনে প্রপার্টিজ সমৃদ্ধ। ফলে কমায় ব্রণপ্রবণতার হার। অ্যান্টি-ব্যাকটেরিয়াল হওয়ায় নানান প্রাকৃতিক দূষণকেও পরিষ্কার করতে সাহায্য করে নিমের নির্যাস। ফলে ত্বক দেখায় তরতাজা ও উজ্জ্বল।
বিশ্বের সবচেয়ে ভালো ন্যাচারাল টোনার হচ্ছে এই নিম সেদ্ধ পানি। রাতে ঘুমাতে যাবার আগে এতে একটি কটন বল চুবিয়ে সারা মুখে ছোপ ছোপ করে লাগিয়ে মুছে নিলেই হলো। রাতভর এটি কাজ করবে ত্বকে থাকা ব্রণ, মেছতা এবং ব্ল্যাক হেডসের বিরুদ্ধে।
আরও বলতে হয়, নিমে থাকা প্রচুর অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট ফ্রি র্যাডিকেলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে ত্বক সুরক্ষায় সহায়তা করে। এতে ত্বকের মৃত ভাব কাটে, সূক্ষ্ম দাগ, বলিরেখা ইত্যাদি কমে গিয়ে হয়ে ওঠে তারুণ্যময়। আর অ্যান্টিসেপটিক উপাদানগুলো যেকোনো ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণ কমাতে সাহায্য করে। এটি ব্যবহারে অতিমাত্রায় সংবেদনশীল ত্বকেও কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হবার আশঙ্কা থাকে না।
শুষ্ক ত্বক এমনিতেই সমস্যাবহুল, কিন্তু কারও কারও ক্ষেত্রে সেই শুষ্কতার পরিমাণ থাকে বাড়াবাড়ি পর্যায়ের। এ ধরনের ত্বকের নাম এক্সেসিভলি ড্রাই স্কিন। শুষ্কতার কারণে ত্বক চুলকানিপ্রবণ হয়ে ওঠে, বলিরেখা পড়ে তাড়াতাড়ি প্রাণহীন হয়ে যায়। জন্মগতভাবে অতিমাত্রায় শুষ্ক হয় কারও কারও ত্বক। তাদের জন্য নিম মহৌষধ। সুফল পাওয়ার জন্য বানিয়ে নিতে হবে নিমপ্যাক। দুই টেবিল চামচ নিমপাতা গুঁড়ার সঙ্গে মেশাতে হবে কয়েক ফোঁটা গ্রেপ সিড অয়েল। নরম পেস্টের মতো হয়ে এলে সেটি মুখত্বকে সমানভাবে লাগিয়ে অপেক্ষা করতে হবে পনেরো মিনিট। তারপর ধুয়ে ফেলতে হবে বরফঠান্ডা পানি দিয়ে। সপ্তাহে একবার বা দুবার করলেই যথেষ্ট। পরিবর্তন টের পাওয়া যাবে এক সপ্তাহের মধ্যে। ত্বকে উজ্জ্বলতা আসবে, যা নামীদামি বিউটি প্রডাক্টেও পাওয়া অসম্ভব বটে।
ব্ল্যাকহেডস, হোয়াইটহেডস ও লোমকূপ অতিমাত্রায় বড় হয়ে গেলে এ-সংক্রান্ত সমস্যা কমানোর জন্য নিম দিয়ে তৈরি হতে পারে চমৎকার একটি মাস্ক। নিমপাতা বাটা, কমলালেবুর খোসা বাটা, কয়েক ফোঁটা মধু, সয়া মিল্ক আর পরিমাণমতো দই। সবকিছু একসঙ্গে মিশিয়ে মিশ্রণটি সারা মুখে হালকা ম্যাসাজ করে লাগিয়ে রাখতে হবে পনেরো মিনিট। তারপর ধুয়ে ফেলতে হবে ত্বক। ত্বকে কেবল ব্ল্যাকহেডস থাকলে আক্রান্ত স্থানে সামান্য নিম তেল লাগিয়ে রাখলেই হবে।
অ্যালোভেরা
মিরাকল প্ল্যান্ট হিসেবে এর সুনাম রয়েছে। তা এর ভেতরে থাকা নিরাময়জনিত নানা উপাদানের বদৌলতেই। বাংলায় ঘৃতকুমারী। অ্যালোভেরা নামেই পরিচিত শহুরে সবার কাছে।
শারীরিক সুস্থতায় নানাভাবে সাহায্য করা ছাড়াও বিউটি ট্রিটমেন্টেও অ্যালোভেরার বিবিধ ব্যবহার রয়েছে। ত্রিশের পর থেকে তারুণ্য ধরে রাখার কাজে অ্যান্টি-এজিং ক্রিমের বিকল্প হিসেবে এটি ব্যবহৃত হতে পারে। ত্বক ও চুলের যত্নে নানাভাবে কাজ করে বলে বিভিন্ন ধরনের বিউটি প্রডাক্টে অ্যালোভেরা ব্যবহৃত হয়। সৌন্দর্য বিশেষজ্ঞদের মতে, ত্বক পরিষ্কার করার জন্য এর চেয়ে ভালো ক্লিনজার আর কিছু হতে পারে না। শাওয়ারের আগে ত্বকে কিছুক্ষণ অ্যালোভেরা জেল লাগিয়ে রাখুন। লোমকূপের ভেতরে থাকা সব ময়লা পরিষ্কার তো হবেই, পাশাপাশি ত্বকও হয়ে উঠবে কোমল। এর মধ্যে থাকা বিটা ক্যারোটিন, ভিটামিন সি এবং ই ত্বকের তৈলাক্ত ভাব দূর করার পাশাপাশি বলিরেখা কমানো এবং সজীবতা ধরে রাখতে সহায়তা করে।
প্রাচীন চিকিৎসাবিজ্ঞানে অ্যালোভেরার উল্লেখ আছে ত্বকের পরিচর্যা এবং সৌন্দর্যরক্ষায় কার্যকর ও সহজ এক দাওয়াই হিসেবে। অতীতে যখন এত সৌন্দর্যপণ্য আবিষ্কৃত হয়নি, তখন সৌন্দর্যসচেতন অভিজাত নারীমাত্রই রূপচর্চায় এটি ব্যবহার করতেন। মিসরীয় লোককাহিনির নানা জায়গায় অ্যালোভেরার বিচিত্র ব্যবহারের কথা বলা আছে। প্রতিদিন গোসলের পর এই চমৎকার উদ্ভিদের স্নিগ্ধ ছোঁয়ায় সতেজ হয়ে উঠতেন রাজকন্যারা। ঘৃতকুমারীর পাতা ছেঁচে তার রস দিয়ে নিজেদের সৌন্দর্য বাড়াতেন রাজা-রানি।
মূলত অ্যালোভেরার মধ্যে থাকা অ্যান্টি-অ্যালার্জিক নানা উপাদান ত্বকজনিত বিভিন্ন সমস্যা, যেমন—ব্রণ, ত্বক চুলকানো, লাল হয়ে যাওয়া ইত্যাদির প্রতিরোধক হিসেবে কাজ করে। হাইপার সেনসেটিভ ত্বক যাদের, তারা সাধারণত সৌন্দর্যচর্চায় বাজারে তৈরি কেমিক্যাল প্রডাক্ট ব্যবহার করতে পারেন না। তাদের জন্য অ্যালোভেরা মহৌষধ। ত্বকের শুষ্কতা দূরীকরণ, ঔজ্জ্বল্য বৃদ্ধি আর দাগ হ্রাসেও জুড়িহীন অ্যালোভেরা। ত্বকের উজ্জ্বলতায় ব্যবহার করতে পারেন অ্যালোভেরা মাস্ক। এটি তৈরির জন্য প্রয়োজন হবে দুটি অ্যালোভেরা পাতা এবং আধখানা লেবু। ধারালো ছুরি দিয়ে পাতার উপরটা আঁচড়ে জেল বের করে একটি বাটিতে নিন। এর সঙ্গে মেশান লেবুর রস। মিশ্রণটিকে ব্লেন্ডারে এক মিনিট ধরে ব্লেন্ড করে মুখে লাগিয়ে বিশ মিনিট অপেক্ষা করুন। তারপর পরিষ্কার ঠান্ডা পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলুন।
সবচেয়ে ভালো হয় অ্যালোভেরা জেল সরাসরি ত্বকে লাগাতে পারলে। এটি সানবার্ন থেকে রেহাই দেবে। প্রতিদিন দুবার অ্যালোভেরা মুখের ত্বকে লাগালে কয়েক সপ্তাহের মধ্যে ধীরে ধীরে উজ্জ্বল হয়ে উঠবে চেহারা। রঙ তো বদলে যাবেই। এ জন্য অ্যালোভেরা জেলের সঙ্গে সমপরিমাণ গোলাপজল মিশিয়ে লাগান। মেছতা দূর করতেও এটি কার্যকর। ঘুমানোর আগে আঙুলের ডগায় খানিকটা জেল নিয়ে দাগের উপর ধীরে ধীরে ম্যাসাজ করুন। পরদিন সকালে ধুয়ে ফেলুন। এভাবে কয়েক সপ্তাহ লাগালে মেছতার দাগ কমে যাবে। বলিরেখা দূর করার জন্য শুকনো কমলালেবুর খোসার গুঁড়া, চালের গুঁড়া, মধু ও তুলসী পাতার মিশ্রণের সঙ্গে অ্যালোভেরা মিশিয়ে প্যাক তৈরি করুন। ত্বকে লাগিয়ে রাখুন কিছুক্ষণ। শুকিয়ে গেলে ঠান্ডা পানির ঝাপটায় ধুয়ে ফেলুন। ব্রণের দাগ দূর করার জন্য এটি রসের সঙ্গে মুলতানি মাটি ও চন্দন পাউডার মিশিয়ে মুখে লাগান। স্ক্রাব হিসেবেও এটি ব্যবহার করতে পারেন। বিশেষ করে শুষ্ক ত্বকের জন্য এটি খুবই কার্যকর।
এই দুটি ঔষধিগুণসম্পন্ন প্রাকৃতিক উপাদান কোনো ফেসওয়াশে থাকা মানেই তো সোনায় সোহাগা। কারণ, একের ভেতর দুই—তাও আবার নানা গুণে পূর্ণ। ফলে মুখত্বকের জন্য এর থেকে আদর্শ আর কী হতে পারে।
ছবি: ক্যানভাস