ছুটিরঘণ্টা I গ্রীষ্ম প্রাসাদ
রাজকীয় পুরোনো প্রাসাদ। নদীতীরে। জলটুঙ্গি। নিসর্গ মনোরম নিভৃতি। লিখেছেন মঈনুস সুলতান
ভিন দেশে বেড়াতে এসে ইদানীং আমরা যে সমস্যার মোকাবিলা করছি সেটা হচ্ছে, হঠাৎ করে পাওয়া অখন্ড অবসর। রান্নাবান্না গৃহকাজের কোনো ঝামেলা নেই; নেই নিত্যদিন অফিস গমন বা ফাইলপত্রে সইসাবুদের কোনো প্রয়োজনও। আমরা বেড়াতে এসেছি লাওস থেকে প্রতিবেশী রাজ্য থাইল্যান্ডে। আয়ুথায়া নামের একটি ঐতিহাসিক নগরে থানা গেড়ে আছি— হলো দিন কয়েক। নগরীটি প্রাসাদ, মন্দির ও পুরাতাত্ত্বিক ভগ্নস্তূপের জন্য প্রসিদ্ধ। আমরা এসেই দিন দুয়েকের মধ্যে পর্যটকপ্রিয় সবকিছুই দেখে নিয়েছি। এবার কী করি, যাই কোথায়? কোনো কোনো পর্যটক ধানক্ষেতের উপর ফিঙ্গে শালিকের ওড়াউড়ি বা ফেরিঘাটে যাত্রী পারাপার দেখে পক্ষকাল কাটিয়ে দিতে পারেন। আমার সঙ্গী হলেন সে গোত্রের। সে গোদারা নৌকা চড়তে পারলেই ভাবে, দেশভ্রমণের মনস্কাম হাসিল হলো। আমি তার সঙ্গে মিলে গতকাল চায়ে ডিম সেদ্ধ করে চারপাশে তারকাকৃতির আনারসের টুকরা দিয়ে নকশা করা খাবার ফুটপাতে বিক্রি হতে দেখেছি। কিন্তু এ ধরনের আটপৌরে দৃশ্যে আমার মন ভরে না। প্রায়ই মনে হয়, হাটে-বাজারে বেচাকেনা দেখার জন্য এত দূরে আসার দরকার কী? আমাদের কন্যা কাজরি অনেকটা আমার মতো। তার চাই প্রতিদিন, প্রতিবেলা নতুন একটা কিছু দেখার উত্তেজনা। আয়ুথায়ায় এসে সে ইতিমধ্যে হতাশ হতে শুরু করেছে। আমাকে প্রায়ই বলছে, রাজা-রানিদের ঘরবাড়ি এ রকম ভাঙাচোরা, নোনাধরা, ইটখসা কেন? পঞ্চবর্ষীয়াকে পুরাতত্ত্ব সম্পর্কে জ্ঞানদানের পদ্ধতি আমার জানা নেই। তবে ভাবি, এমন কোন স্থানে গেলে হয় না, যেখানে দর-দালানে এখনো জলজ্যান্ত রাজকুমার-কুমারীরা বসবাস করে। অর্থাৎ রয়েল ভদ্রাসনটি এখনো ইতিহাস হয়ে ওঠেনি। বিস্তর পর্যটন তথ্য ঘেঁটে, হোটেল রিসেপশনে নানাজনের সঙ্গে কথাবার্তা বলে হলেন অবশেষে এ সমস্যাটির সমাধান করে। সে আমাকে জানায় যে, আয়ুথায়া থেকে পনেরো বা বিশ কিলোমিটার দূরে হাল জামানার থাই রাজার গ্রীষ্ম প্রাসাদ। সময়টা আবহাওয়ার দিক থেকে ভীষণ গরম, তাই সেখানে যেতে আমার কোনো আপত্তি থাকে না। কাজরি আজকাল রূপকথার বইপুস্তকে নানাবিধ প্রাসাদ ও জাদুবলে প্রস্তরীভূত রাজপুত্র-রাজকন্যাদের ছবি দেখছে। একটি সত্যিকারের প্রাসাদে যাওয়ার সম্ভাবনা তাকে কৌতূহলী করে তোলে।
যে যানযোগে আমরা প্রাসাদে আসি, তা হচ্ছে মোটরসাইকেল ও রিকশার সংমিশ্রণে সৃষ্ট একটি বাহনবিশেষ। রাজা-রানি রাজধানী ব্যাংককে আছেন, তাই প্রাসাদের দুয়ার সর্বসাধারণের জন্য, বিশেষভাবে পর্যটকদের জন্য খোলা। আমরা সপরিবার টিকিট কেটে রাজকীয় চত্বরে ঢুকি। প্রথমেই যা চোখে পড়ে তা হচ্ছে একটি বৃহৎ সাজানো সবুজ মাঠ। এক পাশে হ্রদ। হ্রদের মাঝবরাবর এক সারি ফোয়ারা। আমরা জলের পাড় ঘেঁষে বৃক্ষছায়ায় হাঁটি। এখানে বেশ কিছু পর্যটকের সমাগম হয়েছে। আমাদের ঠিক সামনেই চার পর্যটকের একটি ক্ষুদে দল। দলের জনাতিনেক পুরুষের দুজন বোধ করি পাশ্চাত্য কোনো দেশ থেকে আগত। তৃতীয়জনের জাতীয়তা— তার নাকের উচ্চতা ও চোখের আকৃতির জন্য জাপান কিংবা কোরিয়া বলে মনে হয়। সবচেয়ে দৃষ্টি কাড়েন চতুর্থ পর্যটক, যিনি এক থাই নারী এবং অসম্ভব রকমের আকর্ষণীয়া।
এ রমণী গোলাপি রঙের থাই পাসিন্ বা স্কার্ট পরে আছেন। তার ঊর্ধ্বাঙ্গে জড়ানো হালকা গোলাপিতে সোনালি চারকোনা নকশার স্যাশ। মহিলা হাঁটতে হাঁটতে খানিক থেমে গ্রীবা বাঁকিয়ে তার পরদেশি পুরুষ সাথিদের ইংরেজিতে প্রাসাদের বর্ণনা দিচ্ছেন। আমি হলেনকে ফিসফিস করে তার রূপের প্রশংসাসূচক মন্তব্য করে বলি, ‘মেয়েটিকে কি তোমার ট্যুর গাইড বলে মনে হয়?’ ঠিক তখনই লম্বামতো, চুল পরিপাটি করে কামানো সাথিটি তার কাঁধে হাত রেখে কী একটা জিজ্ঞাসা করে। হলেন সম্ভবত এ আচরণ লক্ষ করে বলে, ‘এদের বডি ল্যাঙ্গুয়েজ ঠিক ট্যুরিস্ট ও ট্যুর গাইডের মতো না। সম্ভবত এরা সকলে বন্ধু।’ ততক্ষণে আমরা জলের পাড়ে একটি মন্দির মতো স্থানে এসে পৌঁছেছি। থাই নারী তার বন্ধুদের স্থাপত্যের ভূমিকা ব্যাখ্যা করছেন। আমরা জানতে পারি, এখানে প্রাসাদের ‘গার্জিয়ান স্পিরিট’ সুপ্ত হয়ে আছে। ঈষৎ দূর থেকে শোনা এ আলাপচারিতার সময় আমি তাকে আবার পূর্ণাঙ্গভাবে সামনাসামনি দেখি। তার চুল গোলাকার ঊর্ধ্বমুখী করে বাঁধা। একটি প্রাচীন শ্বেত চম্পক গাছের প্রেক্ষাপটে তার ছবি তুলতে ইচ্ছা হয়। আমি হলেনকে জিজ্ঞেস করি— ছবি তোলা রুচিসম্মত হবে কি না। সে আমাকে নির্দিষ্ট করে কিছু পরামর্শ দিতে পারে না। ততক্ষণে কাজরি এগিয়ে গেছে সরাসরি তার কাছে। মেয়েটির সামনে দাঁড়িয়ে সে অতি শিষ্টাচারসম্মতভাবে জিজ্ঞেস করে, ‘এক্সকিউজ মি, মাই বাপি থিংক ইউ আর ভেরি প্রিটি। ক্যান হি টেইক আ পিকচার অব ইউ?’ মহিলা কাজরির প্রশ্নে লজ্জিত হাসেন। এগিয়ে এসে আমাকে বলেন, ‘ইটস অল রাইট, ইউ মে টেইক আ পিকচার ইফ ইউ ওয়ান্ট।’ আমি যখন শাটার টিপতে যাচ্ছি, কাজরি ‘ওয়েট আ মিনিট’ বলে চিৎকার করে ওঠে। সে ইতিমধ্যে গোটা কতক শ্বেতচম্পক কুড়িয়ে নিয়েছে। তার ধারণা, মেয়েটির হাতে এক গুচ্ছ শ্বেতচম্পক থাকলে ছবিটি আরও মনোজ্ঞ হবে। আমি ভিউ ফাইন্ডারে তার বসনহীন সুচারু বাহুমূলে পাতার ফাঁক দিয়ে এসে পড়া আলোর চিত্রালি দেখি।
ছবি তোলা হলে আমরা পর্যটক দলের সঙ্গে খানিক ব্যবধান রেখে হাঁটি। মূল প্রাসাদ প্রাঙ্গণে ঢোকার পথে হ্রদটির পাড়রেখা বিবর্তিত হয়ে গোলাকার পুষ্করিণীর আকার নিয়েছে। এখানে হ্রদ পারাপারের জন্য আছে গোটা দুই পুল। একটি পুলের রেলিংয়ের উপর বসানো গ্রিক পুরাণের শ্বেত মার্বেলের ছোট্ট ছোট্ট মূর্তি। পর্যটক দলের জাপানি বা কোরিয়ান সদস্যটি নানা ভঙ্গিতে শরীর বাঁকিয়ে, রেলিংয়ের উপর উঠে দাঁড়িয়ে মহা উৎসাহে ছবি তুলতে শুরু করে। সে লেন্স বদলাতে বদলাতে চিৎকার করে তার থাই সঙ্গিনীকে জিজ্ঞেস করে, পুলটির কোনো নাম আছে কি না। মেয়েটি জবাব দেয় ‘ডলস ব্রিজ’। আমি কাজরিকে জিজ্ঞেস করি, ডলস ব্রিজের বাংলা কী? সে বলে ‘পুতুল ব্রিজ’। আমরা ব্রিজের উপর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে শব্দটির খানিক পরিমার্জনা করি ‘পুতুল সাঁকো’ বলে। পুতুল সাঁকো থেকে তীব্রভাবে যা নজরে পড়ে তা হচ্ছে, পুকুরের ঠিক মাঝামাঝি শ্বেত বর্ণের সিমেন্টের প্ল্যাটফর্মের ওপর গড়া থাই স্থাপত্যের একটি পরিশীলিত প্রতীক। জলটুঙ্গি এ গৃহ আকারে বৃহৎ না হলেও বর্ণে উজ্জ্বল ও রূপে অনন্য। চারকোণের এ জলটুঙ্গির ছাদ বহুতলবিশিষ্ট, সোনালি, ঈষৎ রক্তিম এবং সবুজ রঙে রাঙানো। ছাদের প্রান্ত টিয়া পাখির ঠোঁটের মতো বাঁকানো। তার ঠিক মধ্যিখানে বসানো ধাতব সোনালি ছত্রী। আমরা জলটুঙ্গির সামনে খানিক সময় মুগ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকি। পুকুরের অন্য পাড়ে আরেকটি বৃহৎ গৃহ। গৃহটির নির্মাণে ফরাসি আদল সুস্পষ্ট। খানিক দূরে আরও কয়েকটি রাজসিক ইমারত আমাদের নজরে পড়ে। হলেন অট্টালিকাগুলোর দিকে তাকিয়ে বলে, ‘এগুলো ফ্রেঞ্চ কিংবা অস্ট্রিয়া থেকে মনে হয় তুলে এনে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে।’ আমরা কাজরিকে নিয়ে ফরাসি ধাঁচের ইমারতের দিকে যাই। এ অট্টালিকার বারান্দা থেকে সিঁড়ি সরাসরি নেমে গেছে জলে। সেখানে প্রচুর মাছ। পর্যটকেরা রুটি ছুড়ে দিয়ে মৎস্য সম্প্রদায়কে তুষ্ট করছেন। আমাদের কন্যাও রুটি ছোড়ার খেলায় মত্ত হয়। আমি ও হলেন সিঁড়ি থেকে জলটুঙ্গির প্রতিফলন দেখি। পর্যটকদের দল বারান্দায় এসে দাঁড়ায়। সবার হাতে আইসক্রিম। তিন ভিনদেশি যুবকদের মধ্যমণি হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা থাই রূপসীকে জলটুঙ্গির মতো মনোহর লাগে।
গ্রীষ্ম প্রাসাদ প্রাচ্য রীতিতে অন্দর ও বাহির মহলে বিভক্ত। তক্তার বেড়া দেওয়া একটি পুলের ওপর দিয়ে আমরা ভেতরের মহলে ঢুকি। স্থানে স্থানে বন্দুকধারী প্রহরীরা দাঁড়িয়ে আছে বটে, তবে আমাদের কোনো বিঘœ ছাড়াই হাঁটতে দেওয়া হয়। আমরা একটি ইউরোপীয় ধাঁচের ঝাড়বাতিতে ঝলমলে প্রাসাদের সামনে দিয়ে এগিয়ে যাই। অনতিদূরে পর্যবেক্ষণ মিনার। হ্রদের জলে মিনারের সুগোল হরিৎ রক্তিমে রঞ্জিত টাওয়ারের ছায়া পড়ে। এ গরমে কন্যাকে নিয়ে টাওয়ারের চূড়ায় উঠতে আমাদের সাহস হয় না। আমরা আরেকটি ব্রিজ পাড়ি দিয়ে চীনা ধাঁচের অন্য একটি প্রাসাদের আঙিনায় ঢুকি। এটি সম্পূর্ণ কাঠে তৈরি। পর্যটকদের জুতা খুলে করিডোর দিয়ে হাঁটতে দেওয়া হয়। আমরা সিংহাসন কক্ষের পাটাতনে রক্ষিত উটের হাড়ে তৈরি ড্রাগনের রূপ দেখে আশ্চর্য হই। মনে হয় এ প্রাসাদের প্রতিটি আসবাবে ‘মাদার অব পার্ল’ বা মুক্তা ফলানো ঝিনুকের রামধনু রঙের রুপালি খন্ডাংশ দিয়ে বিচিত্র সব নকশা আঁকা হয়েছে। ইমারতের চারপাশে গোলাকার জলে পূর্ণ পরিখা। পাড়ে গুচ্ছ গুচ্ছ বাঁশবন। আঙিনা থেকে ঈষৎ দূরে দেখা যায় নানা আকৃতির একপাল সবুজ হাতি। আমাদের মেয়েটি ওদিকে ধাবিত হয়। ‘টোপিয়ারি’ বা একধরনের লতানো পত্রবহুল বৃক্ষকে ছেঁটে বেঁধে হাতির রূপ দেওয়া হয়েছে। আমরা পিতা-কন্যায় মিলে সবুজ হস্তীমূর্তির আড়ালে খানিক লুকোচুরি খেলি। একটি সোনাঝরা গাছের তল উজ্জ্বল বর্ণালি পত্রে ছেয়ে আছে। হলেন খান কতক পাতা কুড়ায়। কোথায় যেন একটি পাখি টিটটিট করে ডেকে ওঠে।
প্রাসাদ প্রাঙ্গণের প্রান্ত ঘেঁষে চাও-প্রাইয়া নদী। নদীতে পর্যটকদের জন্য বোটযোগে ভ্রমণের বন্দোবস্ত হয়েছে। আমরা বোটে ওঠার সময় ব্রিজে চার পর্যটকের ক্ষুদে দলের সাক্ষাৎ পাই আবার। থাই মেয়েটি এবার ভারী কাচের চশমা পরা খয়েরি শশ্রুমন্ডিত পর্যটকের কিঞ্চিৎ বাহুলগ্না হয়ে হাঁটছে। তাদের সাথি লম্বা মতো পর্যটকটির মুখ অত্যধিক গরমের আঁচে লাল হয়ে উঠেছে। সে হাঁটতে হাঁটতে ঘাড়ে ও মুন্ডিত চাঁদিতে আইসক্রিম ঘষে। আমরা বোটের ডেকে পাশাপাশি বসি। নৌকা চলতে শুরু করতেই জাপানি বা কোরিয়ান পর্যটকটি রেলিংয়ের পাশে ঝুঁকে প্রাসাদের দেয়ালঘেরা একটি অংশের ছবি তুলতে শুরু করে। সে ব্যাকপ্যাক থেকে আরেকটি ক্যামেরা বের করে নিপুণ হাতে হাইস্পিড ফিল্ম লোড করে। প্রাসাদের প্রাচীরঘেরা মহলটি সম্পর্কে আমি খানিক কৌতূহলী হয়ে উঠে থাই মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করে বসি, ‘এ এলাকায় পর্যটকদের ঢুকতে দেওয়া হয় না কেন।’ তার জবাব থেকে জানতে পারি, উনিশ শতকের শেষ দিকে রানি সুনন্দা কুমারীরত্ন গ্রীষ্ম প্রাসাদে আসার পথে চাও-প্রাইয়া নদীতে নৌকাডুবিতে মারা যান। সে যুগের রাজা চুলালুংক্রণের একাধিক মহিষী থাকা সত্ত্বেও মোটেই বেদরদ ছিলেন না।
তিনি কুমারীরত্নের স্মৃতিতে দেয়ালঘেরা আঙিনায় একটি মন্দির গড়ে তাতে স্থাপন করেন মার্বেল ফলকে উৎকীর্ণ স্বরচিত গাথা। এ প্রসঙ্গে হলেন জানতে চায়, ‘গ্রীষ্ম প্রাসাদের বেশির ভাগ স্থাপত্য ইউরোপীয় ধাঁচের কেন?’ থাই নারী সহাস্যে জবাব দেন, ‘রাজা চুলালুংক্রণ— যিনি এ দেশের পঞ্চম রামা নামে পরিচিত, বার কয়েক ইউরোপে যান। তার আমলে এখানে নির্মিত হয় পাশ্চাত্য ঢঙের দর-দালান। রাজা অভিজাতবর্গের মধ্যে কাঁটাচামচ দিয়ে খাওয়ার প্রথা প্রচলন করেন। এমনকি থাই প্রজাদের গৃহে চেয়ারের সংযোজন হয় তার জামানায়।’ তিনি আরও যোগ করেন, ‘এখানে প্রথম প্রাসাদ গড়ে ওঠে সতেরো শতকে। পরিচর্যার অভাবে কালক্রমে আদি ভবনগুলো ভগ্নস্তূপে রূপান্তরিত হয়। উনিশ শতকের দিকে রাজা পঞ্চম রামা বা চুলালুংক্রণ এখানে আসতে শুরু করেন গ্রীষ্ম অবকাশের জন্য। তিনি ইউরোপ থেকে মিস্ত্রি ও স্থপতি এনে এ নবতর হর্ম্যরাজি তৈরি করান।’ আমরা জনক-জননী মিলে থাই তরুণীর সঙ্গে খোশগল্প করবো এবং সে একা বসে নদীর জল দেখবে— এ পরিস্থিতি কাজরির পছন্দ হয় না। সে আমাদের আলাপচারিতায় বাদ সেধে তাকে বলে, ‘ক্যান ইউ হেল্প মি ডু মাই হেয়ার? আই ওয়ান্ট টু হ্যাভ হেয়ার লাইক ইউ।’ মেয়েটি তার অনুরোধে ছোট্ট একটি কাঁকই দিয়ে কাজরির চুল আঁড়চাতে শুরু করে।
নদীর জলে কচুরিপানা ভেসে যায়। এক পাড়ে প্রাসাদ, অন্য পাড়ে চায়ের চামচের মতো এক চিলতে দ্বীপ। দ্বীপে বাতিঘর। বোট বাতিঘরের প্রান্ত ঘেঁষে চক্রাকারে দ্বীপ প্রদক্ষিণ করে প্রাসাদের জেটিতে ফিরে আসে। দ্বীপে একটি গথিক স্থাপত্যের চার্চ দেখে আমরা ভারি অবাক হই। ততক্ষণে কাজরির চুল বাঁধা হয়েছে। তার ঠোঁট রঞ্জিত হয়েছে থাই রমণীর লিপস্টিকে। আমরা সবাইকে বিদায় জানিয়ে নৌকা থেকে নেমে পড়ি। নদীর পাড়ে হাঁটতে হাঁটতে হলেন মন্তব্য করে, ‘এ প্যালেস কমপ্লেক্সে সবই আছে, কেবল নেই বৌদ্ধমন্দির।’ আমরা ভাবি ওপারের দ্বীপে চার্চটি দেখতে যাওয়া যায় কি না। নদীর উপরে দুটি লোহার দড়িতে ঝুলতে ঝুলতে আসা-যাওয়া করছে একটি বাক্স আকৃতির ক্যাবল কার। তাতে বসা পর্যটক দেখে আমরা দ্বীপে যাওয়ার সম্ভাবনায় খুশি হই। অবশেষে এসে দাঁড়াই ক্যাবল কারের মঞ্চে। গৈরিক পরা মুন্ডিত মস্তক এক ভিক্ষু আমাদের ক্যাবল কারে উঠে বসতে সাহায্য করেন। লোহার দড়িতে ঝুলন্ত বাক্সটি হিল হিল করে ওপারের দিকে ছোটে। আমি বাক্সে বসে প্রাসাদ প্রাঙ্গণের দিকে তাকাই। হ্রদের জল সূর্যালোকে ঝিকিয়ে ওঠে। কিন্তু কাউকে দেখা যায় না। হলেন উত্তেজিতভাবে বলে ওঠে, ‘লুক চার্চের প্রেমিসে দুজন বৌদ্ধ ভিক্ষু দাঁড়িয়ে আছে।’ আমরা সাবধানে ক্যাবল কার থেকে নেমে ভিক্ষুদের পাশ দিয়ে চার্চের দোরগোড়ায় এসে দাঁড়াই। এতক্ষণ তীব্র সূর্যালোকে থাকার জন্য ভেতরের সবকিছু অন্ধকার মনে হয়। কাজরি সহসা বলে ওঠে, ‘বাপি, আই সি আ বিগ বুদ্ধ ইন দিস চার্চ।’ আমরা তার বাক্য অনুসরণ করে গির্জামতো স্থাপত্যের বেদিতে স্বর্ণপত্রে সজ্জিত বুদ্ধমূর্তি দেখে অবাক হই!
mainussultan@hotmail.com
ছবি: লেখক