ফিচার I বৃষ্টির সুপেয় পানি
পানযোগ্য পানির উৎস দিন দিন সংকুচিত হয়ে আসছে। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর দ্রুত নেমে যাচ্ছে। এ পরিস্থিতি সামলে ওঠার জন্য বৃষ্টির পানি হতে পারে চমৎকার বিকল্প
নদীমাতৃক বাংলাদেশ। নদীর পানি পানযোগ্য হওয়ারই কথা। কিন্তু দূষণের ফলে তা আজ আর সে-অবস্থায় নেই। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ঢাকার চতুর্দিকে নদী থাকা সত্ত্বেও এ শহরে পানযোগ্য পানির তীব্র সংকট রয়েছে বহুদিন করে।
দেশের ভূগর্ভস্থ পানির স্তর প্রতিবছর তিন মিটার নিচে নেমে যাচ্ছে। শুধু ঢাকা নয়, দেশের ৬৪ জেলার মধ্যে ৪৫টিরই এই অবস্থা। ফলে মাটির নিচে মজুত থাকা পানিতে ভবিষ্যৎ ছেড়ে দেওয়া বুদ্ধিমানের কাজ না-ও হতে পারে। উপায় একটাই— বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ।
পানি দিয়ে দুই-তৃতীয়াংশ বেষ্টিত এ গ্রহের ৯৭.৫ শতাংশই লবণাক্ত তথা সামুদ্রিক। এ পানি পানের অনুপযোগী বলে পরিশুদ্ধ করে খেতে হয়। বাকি আড়াই ভাগ পানি ব্যবহারের উপযোগী। তবে ব্যবহারের জন্য প্রস্তুত নয়। এর ৭৪.৫ ভাগ আছে বরফ আকারে। ০.৩ ভাগ পাওয়া যায় নদীসহ অন্যান্য জলাশয়ে। মাত্র ১ ভাগ থাকে ভূতলে। অর্থাৎ, পৃথিবীর মোট ব্যবহারের উপযোগী পানির মাত্র ১.৩ শতাংশ পাওয়া যাবে হাতের নাগালে। অথচ পৃথিবীর বর্তমান জনসংখ্যা প্রায় ৭০০ কোটি। দিন গড়াচ্ছে, ততই বাড়ছে জনসংখ্যা। ফলে সুপেয় পানির চাহিদা বাড়ছে। হয়তো এ জন্যই আশঙ্কা করে বলা হয়, তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণ হবে পানিসংকট। আশঙ্কা মোকাবিলায় ভরসা রাখতে হবে বৃষ্টির পানিতে। কীভাবে? সেই দৃষ্টান্ত মেলে উত্তর আটলান্টিকের দেশ বারমুডায়।
২০১২ সালের সমীক্ষা অনুযায়ী জনসংখ্যার ঘনত্বের দিক দিয়ে বিশ্বে বারমুডার অবস্থান অষ্টম। মোট জনসংখ্যা ৬৪ হাজার। দেশের আয়তন মাত্র ৫৩ বর্গকিলোমিটার। এ দেশে স্বাদুপানির কোনো প্রবাহ নেই। নদী নেই। মহাসাগরের মধ্যে অবস্থিত বলে এর ভূগর্ভস্থ পানির বেশির ভাগই লবণাক্ত। এ কারণে দেশটির বাসিন্দাদের নির্ভর করতে হয় বৃষ্টির ওপর। সারা বছরই বৃষ্টিপাত হয় এখানে। মাসে ১২০ মিলিমিটার। বার্ষিক বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ১৫০০ মিলিমিটার। দেশটির সরকার বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ বাধ্যতামূলক করেছে।
বারমুডার বাড়িগুলো এমন আদলে তৈরি, যাতে পানি সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করা যায়। প্রতিটি বাড়ির ছাদ হয়ে উঠেছে পানির ধারক। ছাদে শক্ত কাঠের ফ্রেমের উপর একের পর এক চুনাপাথরের ব্লক বসিয়ে সিঁড়ির আকার দেওয়া হয়েছে। ব্লকের উপর সাদা সিমেন্টের আস্তর দেওয়া হয়। সাদা রঙও করা হয়। ছাদের চারদিকে ছোট ছোট চ্যানেল থাকে। যাতে বৃষ্টির পানি ছাদ বেয়ে এসে ট্যাংকে জমা হতে পারে। প্রায় তিন শ বছর ধরে এভাবে নিজেদের পানির চাহিদার ৫৬ শতাংশ পূরণ করে আসছে বারমুডা। বাকিটা নিচ্ছে ভূগর্ভ থেকে। পরিশুদ্ধ করে।
বারমুডার চেয়ে বাংলাদেশে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বেশি। বার্ষিক ২০০০ মিলিমিটার। এরপরও ওই দেশের অনুকরণ সম্ভব নয়। কেননা, আমাদের দেশে সারা বছর বৃষ্টি হয় না। ৮০ শতাংশই হয় বর্ষায়। তারপরও যদি বারমুডার বৃষ্টি সংরক্ষণ পদ্ধতি বাংলাদেশ গ্রহণ করে, তা বৃথা যাবে না। কেননা, বৃষ্টির পানি জমিয়ে রাখা যায়। কেন্দ্রীয় কোনো আধারে মজুত করে পরে তা বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করলেই হলো।
বাংলাদেশে যে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ হচ্ছে না, তা নয়। দেশের উপকূলীয় অঞ্চলে অনেক আগেই তা শুরু হয়েছে। তবে এ পদ্ধতি জনপ্রিয়তা পেয়েছে উত্তরাঞ্চলীয় জেলা শেরপুরের নালিতাবাড়ীতে। সেখানকার বাসিন্দারা কৃষিকাজে সংরক্ষিত পানি ব্যবহার করে।
সুপেয় পানির সংকট গ্রামের চেয়ে শহরে বেশি। পানির অপচয় বেশি এখানেই। একটি শহুরে পরিবার দৈনিক মোট খরচের ৪১ শতাংশ পানি ব্যয় করে গোসলে। ২২ শতাংশ কাপড় ধোয়া এবং টয়লেট ব্যবহারে। একবার কমোডের ফ্ল্যাশে সর্বোচ্চ ১৫ লিটার পানি খরচ হয়। পাঁচ সদস্যের একটি পরিবার শুধু কমোড ফ্ল্যাশ করেই দৈনিক সর্বোচ্চ ৩৭৫ লিটার পানি খরচ করে। ৫৮৬টি গভীর নলকূপের মাধ্যমে প্রতিদিন ২২০ কোটি লিটার পানির জোগান দিতে হচ্ছে এ শহরে। ৮৪ শতাংশ পানি উত্তোলন করা হচ্ছে ভূগর্ভ থেকে। তেজগাঁও, খিলগাঁও, বনানী ও রমনা এলাকায় ভূগর্ভের দ্বিতীয় স্তর থেকে পানি সরবরাহ হচ্ছে। বর্তমানে এ স্তরের পানি প্রায় ৮০ মিটার নিচে নেমে গেছে! অন্যদিকে রাজধানীর প্রান্তীয় এলাকায় পানির স্তর মাত্র ১৫ থেকে ২৫ মিটার নিচে। ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনে গভীর নলকূপ স্থাপনের আধিক্য দেখা যায় মিরপুরে। তাই এখানকার পানির স্তর অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় বেশি নেমে গেছে। ভূগর্ভ ছাড়াও ঢাকার ১৩ শতাংশ পানির চাহিদা মেটে ভূ-উপরিভাগ থেকে। পানি শোধন ও নদীর পানি ব্যবহারের মাধ্যমে। অথচ সমীক্ষায় দেখা যায়, এ শহরে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ২ হাজার ২০০ মিলিমিটার। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বৃষ্টির মাত্র ৬০ শতাংশ সংরক্ষণ করা গেলে নগরবাসীর পানির চাহিদার ৮০ শতাংশ মেটানো সম্ভব। বৃষ্টির পানি ধরা গেলে গড়ে প্রতিদিন ২০০ কোটি লিটার ব্যবহারের উপযোগী পানি পাওয়া যাবে ঢাকায়।
বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের জন্য পদক্ষেপ নিয়েছে বাংলাদেশ। মাটির নিচের পানির চাহিদা কমাতে বাড়ির ছাদে বৃষ্টির পানি ধরে তা ব্যবহার বাধ্যতামূলক করতে যাচ্ছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)। এই বিধান কার্যকর হলে এমনভাবে ভবনের নকশা করতে হবে, যাতে বৃষ্টির পানি ধরে রাখা যায়। এ ছাড়া ভূগর্ভস্থ পানির লেভেল ঠিক রাখার জন্য বাড়ির আশপাশে খোলা জায়গা রাখার কথাও ভাবা হয়েছে। কেননা, নগরীর বেশির ভাগ অংশই কংক্রিটে আচ্ছাদিত। রাস্তা ঢাকা পিচে। ফলে বৃষ্টির পানি মাটির তলায় যেতে পারছে না।
ইতিমধ্যে খুলনা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষও নতুন ভবনে পানি সংরক্ষণ পদ্ধতি নির্মাণ বাধ্যতামূলক করেছে। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনে ৩ লাখ ২০ হাজার বাড়ির মধ্যে পৌনে তিন লাখই আবাসিক ভবন। প্রতিটি বাড়িতে যদি বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ ব্যবস্থা বাস্তবায়ন করা যায়, তাহলে ঢাকা শহর ভরে উঠবে তরল সম্পদে।
এই পানি ধরার তিনটি ধাপ— পানি ধরা, বহন করা এবং সঞ্চয় করা। ছাদ কিংবা যেখানে পানি ধরার ব্যবস্থা থাকে, সেটিকে ক্যাচমেন্ট বলে। পানি নল বেয়ে ট্যাংকে যায়। এ পদ্ধতিকে বলে পরিবহন। যেখানে সঞ্চয় হয়, তা সঞ্চয় ট্যাংক নামে পরিচিত।
পানি ধরার জন্য ছাদ পরিষ্কার রাখা জরুরি। যাতে ধুলা ও পাখির মল না জমে, সে জন্য পানি ধরার আগে ছাদ পরিষ্কার করে নেওয়া ভালো। আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে, বিশেষ করে শহর অঞ্চলে বৃষ্টি শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পানি না ধরে মিনিট দশেক পর থেকে ধরা প্রয়োজন। কেননা, বৃষ্টির প্রথম বিন্দুগুলো বাতাসের ধূলিকণা বহন করে পতিত হয়। শহুরে আকাশ তো ধুলাময়লায় ভরা। অবশ্য এসব ময়লা দূর করার জন্য বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ পদ্ধতিতে ‘ফার্স্ট ফ্লাশ ডাইভার্টার’ নামের ব্যবস্থা থাকে। ধরা পানি বিশুদ্ধ করার জন্য ফিল্টার ছাড়াও ওজোন ও ইউভি আলোর ব্যবহার করা হয়। পানি বণ্টনের জন্য পাম্প ও প্রেশার ট্যাংক থাকে। বাড়িতে সংরক্ষণ ছাড়াও শহুরে ডোবাগুলো পরিষ্কার করে এবং দেশব্যাপী পুকুর কেটে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করা যেতে পারে।
শিবলী আহমেদ
ছবি: ইন্টারনেট