এডিটরস কলাম I মানুষই জিতে যায়
গোটা দুনিয়াকে জানিয়ে দিতে পেরেছি নিজেদের সামর্থ্য ও শ্রেষ্ঠত্ব। বুঝিয়ে দিয়েছি—কেবল সস্তা শ্রম, টাকা পাচার, দুর্নীতি, ঘূর্ণিঝড়, অপরাজনীতি, ধর্মান্ধতা ইত্যাদি ঋণাত্মক বৈশিষ্ট্যের বাইরে আমাদের অর্জন ও গৌরবের বহু কিছু আছে
ক্রিকেটের মহোৎসব চলছে যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন শহরে। দেশটি হয়ে উঠেছে ক্রীড়ামোদীদের আগ্রহ ও বিনোদনের কেন্দ্র। ১০টি দেশের ক্রিকেটার ও সংশ্লিষ্টরা সেখানে জড়ো হয়েছেন। প্রতিদিন একটি-দুটি করে খেলা হচ্ছে। এর স্পন্দন বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে, বিশেষত সেই সব দেশের মানুষের মধ্যে, এই খেলার প্রতি যাদের অনুরাগ রয়েছে। ক্রিকেট আমারও প্রিয়, সময় পেলেই উপভোগ করি। বাংলাদেশ বিশ্বকাপে অংশগ্রহণের যোগ্যতা অর্জনের পর থেকে এই খেলার প্রতি আমার আগ্রহ অনেক বেড়েছে। ১৯৯৯ সালের ক্রিকেট বিশ্বকাপে বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো অংশ নিয়েছিল এবং হারিয়ে দিয়েছিল বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন পাকিস্তানকে। সেদিনই মনে হয়েছিল, আমাদের বিশ্বকাপ কেবল অংশগ্রহণ আর দুর্বল দলের বিরুদ্ধে জয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না। তা থাকেওনি। ২০০৭ সাল থেকে বিশ্বকাপে সেমিফাইনালের স্বপ্ন নিয়ে খেলা দেখে আসছি। সেটি পূরণ আজও হয়নি; কিন্তু গোটা দুনিয়াকে জানিয়ে দিতে পেরেছি নিজেদের সামর্থ্য ও শ্রেষ্ঠত্ব। বুঝিয়ে দিয়েছি—কেবল সস্তা শ্রম, টাকা পাচার, দুর্নীতি, ঘূর্ণিঝড়, অপরাজনীতি, ধর্মান্ধতা ইত্যাদি ঋণাত্মক বৈশিষ্ট্যের বাইরে আমাদের অর্জন ও গৌরবের বহু কিছু আছে।
যখন খেলা দেখি, পক্ষ-প্রতিপক্ষ, জয়-পরাজয় সম্পর্কিত ভাবনায় আমি আচ্ছন্ন হই না। এটা একরকম সামগ্রিকতা নিয়েই হাজির হয় আমার কাছে। ক্রিকেটে তা একদমই আলাদা। ওয়ান ডে ম্যাচে দুটো দল কমপক্ষে ৮ ঘণ্টা মাঠে থাকে, দর্শকেরা তো আছেই। গ্যালারিতে, স্টেডিয়ামের বাইরে, টিভির সামনে, রেডিওর সঙ্গে। রাস্তায়, রেস্তোরাঁয়, শপিং মলে, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে, অফিসে খানিক পরপর প্রশ্ন—কত রান হলো, কত ওভার গেল, উইকেট কি পড়ল আরেকটা? এই জিজ্ঞাসা যাকে করা হচ্ছে, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সে অপরিচিত। পাড়ার মুদিদোকানি, যার সঙ্গে খরচাপাতির বাইরে কোনো প্রসঙ্গই ওঠে না সারা বছর, রেডিও শুনছে দেখে ক্রেতা জানতে চায় তার কাছে—কী অবস্থা? দোকানিও বুঝে যায় প্রশ্নটি রাজনৈতিক কিংবা দ্রব্যমূল্য-সংক্রান্ত নয়। এসব উদাহরণ উল্লেখের মাধ্যমে বোঝাতে চাইছি, খেলা কেবল মাঠের ভেতর দুই দলের লড়াই নয়, এর বহুদিকের আবেদন আছে, প্রভাব আছে, অর্থ আর সৌন্দর্য আছে। ক্রিকেটে তা সম্ভবত সবচেয়ে বেশি। কেননা, দিনমান এই খেলা চলে। আলোচনার পরিধি এর চেয়ে ব্যাপক, এতে বয়স-শ্রেণি-পেশা-অবস্থান বলে কিছু নেই, সব সীমারেখা টুটে সবাই এক হয়ে যায়। যা কিছু মানুষকে পরস্পর সম্পৃক্ত করে, সেগুলোর মধ্যে আবেগের শক্তি সবচেয়ে বেশি। ক্রিকেটের আবেগ আমাদের এক করে দেয়। এর একটা সৌন্দর্য আছে।
অস্ট্রেলিয়া-বাংলাদেশের খেলা যারা দেখেছেন, একটা দৃশ্য বোধ করি কেউই ভুলবেন না। তা হলো, জেতার পরও বাংলাদেশের সেঞ্চুরিয়ান মুশফিককে অস্ট্রেলিয়ার খেলোয়াড়দের অভিবাদন। বিজয় উদ্যাপনের পরিবর্তে মুশফিক-মাহমুদউল্লাহকে নিয়ে তারা ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। ডেভিড ওয়ার্নার তার গ্লাভস উপহার দিলেন মুশফিককে। দেখে মন ভরে গেল।
নিউজিল্যান্ড-ওয়েস্ট ইন্ডিজের খেলা কেমন লাগল? খুব শ্বাসরুদ্ধকর, তাই না? কিন্তু আমার থেকে থেকে মনে পড়ছে ব্রাথওয়েটের কথা, টেল এন্ডার হিসেবে ব্যাট করতে নেমে সেঞ্চুরি হাঁকিয়েছিলেন। হেরে গিয়ে তিনি মাঠে বসে কাঁদতে লাগলেন। বিজয়ের আনন্দ ভুলে নিউজিল্যান্ডের খেলোয়াড়েরা তাকে ঘিরে বসে পড়লেন। একেকজনের মমতার স্পর্শ তার কাঁধে, পিঠে আর মাথায় এসে পড়ছে। দেখে, আমার মতো অনেকেই হয়তো জয়-পরাজয়ের কথা ভুলে গেছেন। ভেবেছেন নিশ্চয়ই, মানবিক হয়ে ওঠাই ক্রিকেটের ধর্ম।
২০০৭ সালের বিশ্বকাপে ভারত-বারমুডা ম্যাচের কথা মনে আছে? ভারতের বিরুদ্ধে বল করে বারমুডা একটিমাত্র উইকেট পেয়েছিল, সিøপে ক্যাচ ধরে ওই খেলোয়াড়ের সে কী দৌড়, মাঠজুড়ে! তারপর শুয়ে পড়া। মিনিট তিনেক খেলা বন্ধ রাখতে হয়েছিল। ছোট দল, কিন্তু আনন্দটা তাদের বড়। তাতে বাদ সাধেননি বিপক্ষের খেলোয়াড়েরা, আম্পায়ারও। এর চেয়ে উপভোগ্য আর কী হতে পারে!
খেলার এই ঘটনা-বিষয়গুলো আমার বেশি প্রিয়। এসবের মধ্যে আমি চিত্তের জাগরণ, আবেগের ঐশ্বর্য, জীবনের সৌন্দর্য দেখি। দেখে আপ্লুত হই। জয়-পরাজয় খেলার একমাত্র দিক নয় আমার কাছে। সমস্ত উচ্ছ্বাসের পর উপলব্ধি করি, মাঠের ভেতরে ও বাইরে শেষ পর্যন্ত মানুষই জিতে যায়। জেতে জীবন। খেলা একটা উপলক্ষ মাত্র।