ফিচার I চায়নিজ বিউটি
প্রাকৃতিক উপাদান নিয়েই গড়ে উঠেছে সৌন্দর্যচর্চার প্রচলিত চীনা পদ্ধতি। এতে ত্বকের সুস্থতার সঙ্গে দেহ ও মনের সম্পর্ককে বড় করে দেখা হয়
চীনাদের সুন্দর ত্বক ও স্বাস্থ্যসচেতনতার কথা সবারই জানা। এটাও অজানা নয়, স্বাস্থ্যরক্ষায় তারা প্রাকৃতিক উপাদানের ওপর নির্ভরশীল।
ট্র্যাডিশনাল চায়নিজ মেডিসিন এক্সপার্টরা ত্বক ভালো রাখার ক্ষেত্রে শরীর ও মন উভয়ের সুস্থতার ওপর জোর দেন। প্রচলিত চীনা পদ্ধতিতে সঠিক চিকিৎসা নেওয়ার পরও যদি কেউ আশানুরূপ ফল না পেয়ে থাকেন, তবে তার মানসিক অবস্থার খোঁজ নেওয়া হয়। কেউ কোনো কারণে আপসেট থাকলে বা অনিদ্রায় ভুগলে তার ত্বকে বিরূপ প্রভাব পড়ে। তখন তাকে মানসিক চিকিৎসা দেওয়া হয়।
ত্বকের সমস্যা শনাক্ত করতে ঐতিহ্যবাহী চীনা চিকিৎসায় কিছু উপায়ের কথা বলা হয়েছে। যেমন, মুখত্বকের বেশির ভাগ সমস্যাই ঘটে লিভারের ভারসাম্যহীনতার কারণে। মানসিক অস্থিরতাও এর জন্য দায়ী। দৈহিক স্বাস্থ্য ও মানসিক অবস্থা ত্বকের সমস্যার সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত। এ ক্ষেত্রে মানবদেহের নিজস্ব ইমিউন সিস্টেমের সামঞ্জস্য ও বিকাশের দিকে বিশেষ দৃষ্টি দেওয়া হয়। প্রতিরোধ ব্যবস্থার ওপর জোর দেওয়ার পাশাপাশি ডায়েটিং ও মেডিসিনের সঙ্গে আকুপাংচার, ম্যাসাজ, ব্যায়ামসহ বিভিন্ন উপায়ের চিকিৎসা প্রদানের পদ্ধতি এতে ব্যবহৃত হয়।
ঐতিহ্যবাহী চীনা ভেষজের বিশাল অংশ বর্তমানে নানান প্রসাধনীতে ব্যবহার করা হয়। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক উভয় ক্ষেত্রেই অসংখ্য বিউটি ব্র্যান্ডের পণ্যে ব্যবহৃত উদ্ভিজ্জ উপাদানগুলো ট্র্যাডিশনাল চায়নিজ মেডিসিন থেকেই নেওয়া। এগুলোর মধ্যে বেশির ভাগই হলো জিনসেং, পেয়োনিয়া, দারুচিনি, সাদা চা, সেন্টেলা এশিয়াটিকা, অ্যাঞ্জেলিকো রুট, রোডিওলা, পেরিলা। এর মধ্যে জিনসেং ও পেয়োনিয়া অ্যান্টি-এজিং ও হোয়াইটনিংয়ে বেশ কার্যকর। চীনাদের ব্যক্তিগত যত্ন ও প্রসাধনীর জগতে দুটোরই চাহিদা ব্যাপক।
হাজার বছরের বেশি সময় ধরে চলছে চীনা ভেষজের চর্চা। তা মূলত সুন্দর ত্বক ও সুস্বাস্থ্যের জন্য। চায়নিজ হারবাল মেডিসিন, চায়নিজ গ্রিন টি বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয়। পাশাপাশি আকুপাংচারের মতো চিকিৎসা স্বাস্থ্যসেবা ও সৌন্দর্য বৃদ্ধির কাজে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। রয়েছে কসমেটিক আকুপাংচার, তুই না, কাপিং ইত্যাদিরও কদর। বড় বড় খেলোয়াড় ও সেলিব্রিটি এই প্রাচীন চায়নিজ পদ্ধতিগুলো গ্রহণ করে থাকেন। নামি তারকারা ফেশিয়াল আকুপাংচার গ্রহণ করেন বেশি। এই পদ্ধতি মুখের পেশিগুলোকে ভেতর থেকে রিল্যাক্স ও দৃঢ় করে তুলতে সাহায্য করে। মুখত্বকের শক্তি বৃদ্ধি করে এবং রক্তসঞ্চালন বাড়ায়। এটি কোলাজেন ও ইলাস্টিসিটির উৎপাদন বৃদ্ধি করে প্রাকৃতিকভাবে, ত্বক টান টান করে এবং বলিরেখা কমিয়ে দেয়। পদ্ধতিটি প্রাকৃতিক। ত্বকের উজ্জ্বলতা বাড়াতে এবং স্বাভাবিক তারুণ্য ধরে রাখতে সাহায্য করে।
চীনা হারবাল থেরাপি শারীরিক ও মানসিক সমস্যার ক্ষেত্রে বেশ কার্যকর। তবে এগুলোর সঠিক পরিমাণ ও প্রয়োগে নিয়ম জেনে নেওয়াটা জরুরি।
চায়নিজ হার্ব প্রাকৃতিক ও নন-টক্সিক। ট্র্যাডিশনাল চীনা চিকিৎসা পদ্ধতির ধারণাই এমন যে সৌন্দর্য আসে ভেতর থেকে। এতে প্রাথমিকভাবে নজর দেওয়া হয় লিভারের ওপর। ত্বকের সমস্যা থেকে মুক্তির জন্য প্রথমেই দরকার লিভারকে ভালোভাবে কাজ করতে সহায়তা করা। আমাদের রক্ত অক্সিজেনের পাশাপাশি পুষ্টি, বিষাক্ত বর্জ্য পরিবহনের জন্য দায়ী। লিভার যদি অলস হয়ে পড়ে, তবে সঠিকভাবে কাজ না করে রক্ত অতিরিক্ত বিষাক্ত পদার্থে পূর্ণ হয়। এমনটা হলে রক্ত ত্বকের ওপর নির্ভর করে বিষাক্ততা নির্মূলের জন্য। ত্বকের মাধ্যমে বিষাক্ত পদার্থ বের হওয়ার উপায় খুঁজলে র্যাশ ও অন্যান্য ত্বকের সমস্যা বাড়তে পারে। তাই সুস্থ ত্বকের চাবিকাঠি হলো সমস্যামুক্ত ও সক্রিয় লিভার। এর জন্য অ্যালকোহল বা অ্যালকোহল জাতীয় খাবার বা পানীয় যতটা সম্ভব বাদ দেওয়া এবং প্রক্রিয়াজাত খাবার এড়িয়ে যাওয়া জরুরি।
চীনা নারীরা তাদের হাত-পায়ের যত্ন নেওয়ার ব্যাপারে বেশ সতর্ক। কারণ, এই দুটো অংশে রয়েছে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ আকুপয়েন্ট এবং এগুলোর উদ্দীপনা পুরো শরীরে প্রভাব ফেলতে পারে। প্রতিদিন হাত-পায়ে ময়শ্চারাইজার এবং নিজেকে রিল্যাক্সড রাখার জন্য ফুট ম্যাসাজ নিন।
আমাদের কিডনি বর্জ্য পদার্থ ফিল্টার বা ছেঁকে নেয় এবং শরীরে পানির ভারসাম্য বজায় রাখে। যদি এটি ভালোভাবে কাজ না করে তবে যে কেউই ক্লান্তি, আলসেমি, মুটিয়ে যাওয়া ও ফুলে যাওয়ার মতো সমস্যায় পড়তে পারেন। চায়নিজ মেডিসিনে চোখের নিচে ডার্ক সার্কেল মানে হচ্ছে কিডনির ভারসাম্যহীনতার উপসর্গ। চেষ্টা করা হয় দ্রুত সারিয়ে তোলার। ডার্ক সার্কেলের চিকিৎসার জন্য জেনে নিন কীভাবে কিডনির যথাযথ পুষ্টি বিধান করা যায়। লবণ খাওয়া কমিয়ে পর্যাপ্ত ঘুম এবং প্রক্রিয়াজাত খাবারের পরিবর্তে পুষ্টিকর হোল ফুড গ্রহণ করার মাধ্যমে কিডনিকে সাহায্য করাটা এ ক্ষেত্রে জরুরি।
একটি অ্যাডাপটোজেন হারবাল ফর্মুলা গ্রহণ করা যেতে পারে। অ্যাডাপটোজেনগুলো হলো আয়ুবর্ধক ভেষজ, যা সেট্রসের সঙ্গে মানিয়ে নিতে, স্বাভাবিক কাজকর্ম চালিয়ে নিতে এবং শরীরের ভারসাম্য রক্ষা করতে সহায়তা করে। অ্যাডাপটোজেন হার্বের এমন কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যা সৌন্দর্য টনিক হিসেবে দারুণ কাজ করে এবং তারুণ্য ধরে রাখতেও কার্যকর। ত্বক নরম, আর্দ্র ও উজ্জ্বল রাখতে এটি কয়েক শতাব্দী ধরে ব্যবহৃত হয়ে আসছে।
চীনাদের সৌন্দর্যচর্চার একটি জনপ্রিয় উপকরণ হলো পার্ল পাউডার। এটি ঝিনুকের খোসা থেকে তৈরি হয়। এতে বিদ্যমান অ্যামিনো অ্যাসিড ত্বক পুনরুজ্জীবিত করতে সাহায্য করে। এশিয়ান নারীরা তাদের ত্বক সুস্থ ও সুন্দর করে তুলতে বহু শতাব্দী ধরে পার্ল পাউডার ব্যবহার করে আসছে। গবেষণায় দেখা গেছে, পার্ল পাউডার জ্বলুনিকে প্রশমিত করতে, ত্বকের লালচে ভাব এবং র্যাশ কমাতে সাহায্য করে।
একেবারে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এই চিকিৎসা পদ্ধতি দিন দিন আরও জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। তবে গ্রহণ করার আগে অভিজ্ঞ কারও পরামর্শ নেওয়া প্রয়োজন।
আহমেদ বুবলি
মডেল: মিমি
মেকওভার: পারসোনা
ছবি: ক্যানভাস