ফিচার I নবাবি স্মৃতির মেটিয়াবুরুজ
আওধ বা অযোধ্যার নবাব ওয়াজেদ আলী শাহ নির্বাসিত হয়ে কলকাতায় এসেছিলেন। হুগলি নদীর পারে গড়ে তুলেছিলেন ছোট একটি নবাবি শহর, যার নাম মেটিয়াবুরুজ। সেখানে গড়ে তোলা ইমামবাড়ায় আজও নবাবি ইতিহাস বাঙ্ময়। বর্ণনা দিয়েছেন অতনু সিংহ
কলকাতায় ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা-বসন্তে ভিড় জমান বহিরাগত পর্যটক থেকে শুরু করে খোদ কলকাতা ও শহরাঞ্চলের মানুষ। ভিক্টোরিয়ান স্থাপত্য ও চিত্রকলার রসাস্বাদন আর ইতিহাস ছুঁয়ে দেখতে জমে ওঠে দর্শকের ভিড়। কিন্তু রানি ভিক্টোরিয়ার স্মৃতিগৃহ থেকে অল্প দূরে মেটিয়াবুরুজ সবার অলক্ষ্যে স্থিত এমন একটি জায়গা, যা শুধু কলকাতা নয় বরং নিখিল বাংলা তথা গোটা ভারতবর্ষের পরিচিতিকে মহিমান্বিত করে রেখেছে। ভারতবর্ষের সংগীত, সাহিত্য, নৃত্যকলা, স্থাপত্যের বহুবর্ণময় ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় সেখানে বাঙ্ময়।
১৮৫৬ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি ব্রিটিশরা আওধের (অযোধ্যা) নবাব পদ থেকে আবুল মনসুর মীর্জা মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলী শাহের সঙ্গে হঠাৎ চুক্তিভঙ্গ করে। নবাব ক্ষমতাচ্যুত হন। সেখানেই থেমে থাকেনি ব্রিটিশরা। লক্ষ্ণৌ থেকে চিরনির্বাসিত করা হয় ওয়াজেদ আলী শাহকে। উত্তর ভারতের লক্ষ্ণৌ থেকে পালিয়ে তিনি আসেন কলকাতায়। মেটিয়াবুরুজ (গার্ডেনরিচ) এলাকায় গড়ে তোলেন বসত। ওই নবাবের কল্যাণেই হুগলি নদীর (গঙ্গা) পূর্ব পারে মেটিয়াবুরুজ এলাকায় গড়ে ওঠে বসতি।
নবাব নিজের আস্তানার পাশাপাশি সংগীত-নৃত্য ও নাট্যকলার দরবার ‘সুলতানখানা’, চিড়িয়াখানা, ইমামবাড়া ও মসজিদ গড়ে তোলেন। মেটিয়াবুরুজ এলাকাটি সাজিয়ে তোলেন। যদিও ১৮৮৭ সালে নবাবের মৃত্যুর পর এসবের অধিকাংশই ধ্বংস হয়ে যায়। বেশ কিছু ধ্বংস হয় ব্রিটিশদের জন্য, আর কিছু সংরক্ষণের অভাবে। তবে ইমামবাড়া ও মসজিদ ধ্বংস করেনি ব্রিটিশরা। ধর্মীয় উপাসনালয় হিসেবে এগুলো অক্ষত রাখা হয়। এই ইমামবাড়া ও মসজিদ ধরে রেখেছে নবাবের স্মৃতি ও ইতিহাসের একটি অধ্যায়। ইমামবাড়াতেই চিরনিদ্রায় শায়িত নবাব। এখানে ছড়িয়ে রয়েছে নবাবের পারিবারিক নানা স্মৃতিচিহ্ন, যা আজও ধারণ করে রেখেছে শিল্পকলা ও নন্দনতত্ত্বের ব্যাপারে নবাব ও তার পরিবারের রুচির পরিচয়। আর যে কথাটা সব থেকে বেশি করে উল্লেখযোগ্য, তা হলো অসাম্প্রদায়িক চেতনায় সমৃদ্ধ এই নবাবের পার্সিয়ান-হিন্দুস্তানি নন্দনতত্ত্বের যুগলবন্দির কিছু নিদর্শন হিসেবে অম্লান হয়ে আছে মেটিয়াবুরুজের এই ইমামবাড়া। এটির স্থাপত্য থেকে শুরু করে তার ভেতরকার আলোকসজ্জা, আসবাব, চিত্রকলা, নবাবের পারিবারিক ধাতব রাজচিহ্ন— এ সবকিছুই ওয়াজেদ আলী শাহর শিল্পচেতনা ও রুচির পরিচয়বাহী।
লক্ষেèৗ থেকে বেশ কজন সংগীতশিল্পী, সংগীতজ্ঞ, নৃত্যশিল্পী ও নাট্যকারকে কলকাতায় নিয়ে এসেছিলেন নবাব। হিন্দুস্তানি ধ্রুপদি সংগীতের লঘু একটি সাংগীতিক আঙ্গিক ঠুমরির প্রচলন হয়েছিল আওধের নবাবের হাত ধরেই। শুধু তা-ই নয়, হিন্দুস্তানি পারফর্মিং আর্টের অংশ কত্থক নৃত্যের প্রচলনও শিল্পরসিক নবাবের সৌজন্যে। বহু ঠুমরি গান রচনা ও রাধাকৃষ্ণের রাসলীলাকে কত্থক ফর্মে নৃত্যনাট্যে রূপ দেওয়ার মতো চিরস্মরণীয় কাজ করে গেছেন তিনি।
মেটিয়াবুরুজের এই ইমামবাড়ার তত্ত্বাবধায়ক সৈয়দ ওয়াসিফ হোসেনের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। তিনি ভারতের প্রতিরক্ষা বিভাগের সাবেক এক আধিকারিক। লক্ষ্ণৌ থেকে ওয়াজেদ আলী শাহ কলকাতায় আসার সময় শিল্পের নানা ক্ষেত্রের লোকজনের পাশাপাশি তার বিশ্বস্ত বেশ কিছু পরিবারকে সঙ্গে করে কলকাতায় নিয়ে আসেন। সৈয়দ ওয়াসিফ হোসেনের পূর্বপুরুষ ছিলেন এমনই এক পরিবারের কর্তা। ইমামবাড়া এ মুহূর্তে ওয়াজেদ আলী শাহ ট্রাস্টের নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত। ওয়াজেদ আলী শাহর বংশের সদস্যদের পাশাপাশি পশ্চিমবঙ্গ সরকারের প্রশাসনিক কিছু কর্তা এই ট্রাস্টের সদস্য। আশপাশে দোকানের ভাড়া, দর্শক ও ভক্তদের দান থেকেই এই ইমামবাড়া রক্ষণাবেক্ষণের খরচ চলে। এর কমিটি আলাদা। মসজিদের সঙ্গে ইমামবাড়ার কোনো প্রশাসনিক সম্পর্ক নেই। ওয়াসিফ জানাচ্ছিলেন, নবাব পরিবারের সদস্যরা ছড়িয়ে রয়েছেন মেটিয়াবুরুজ বা গার্ডেনরিচ, রিপন স্ট্রিট, পার্ক সার্কাস, পার্ক স্ট্রিট প্রভৃতি জায়গায়। তাদের কেউ কেউ পেশায় ব্যবসায়ী, কেউ অধ্যাপক, কেউ পশ্চিমবঙ্গ সরকারের আধিকারিক, কেউ আবার আইনজীবী। তারা ইমামবাড়ায় সমবেত হন নানা উৎসবে। তা সে মুহররমের মতো শোকের উৎসব হোক অথবা ঈদে মিলাদুন্নবী, ঈদুল ফিতর অথবা ঈদুল আজহায়।
মুহররমের সময় চল্লিশ দিন ধরে কারবালার শহীদ ইমাম হুসেইনের স্মরণে চলে শোকের উৎসব। মুহররমের দিন দেড় শ বছরের তাজিয়া নিয়ে রাস্তায় চলে শোকের মিছিল, চলে মাতম। তাজিয়াসহ কারবালার যুদ্ধের স্মৃতি ও শাহাদতের বেদনা প্রকাশের মিছিলে ব্যবহার করা হয় ওয়াজেদ আলী শাহর নবাবি আমলের ধাতব রাজচিহ্নের রেপ্লিকা। মুহররমের সময় যে চল্লিশ দিন ধরে এই ইমামবাড়ায় শোক পালিত হয়, তখন সেখানে ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে সব মানুষকে দেওয়া হয় ডাল-রুটির সেবা। নবাব ওয়াজেদ আলী শাহর প্রজাকল্যাণ নীতিকে স্মরণে রেখেই সব মানুষকে রুটি ও ডাল খাইয়ে আজও প্রতীকীভাবে রাজকর্তব্যের নিদর্শন রাখে এই ইমামবাড়া। মুহররমের অনুষ্ঠানে লক্ষ্ণৌ থেকে ইমামকে আনা হয় এই ইমামবাড়ায়। এ ছাড়া ঈদে মিলাদুন্নবীর অনুষ্ঠানে নবী মোহাম্মদ (সা.) কে স্মরণ করা হয়, ওই দিনও সাধারণ মানুষের জন্য থাকে বিরিয়ানির ব্যবস্থা। ইমামবাড়া ও মসজিদের উদ্যোগে দুটি ঈদে বড় করে ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হয় মসজিদ-সংলগ্ন এলাকায়। রমজান মাসে মসজিদে ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে সব মানুষের জন্য থাকে ইফতারির ব্যবস্থা। এখানে ধর্মীয় এই অনুষ্ঠানগুলো বাদে ১৫ আগস্ট ভারতের স্বাধীনতা দিবস ও ২৬ জানুয়ারি ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের প্রজাতন্ত্র দিবসও উদযাপিত হয় একসময়ে এই পরিবারের ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে জিহাদের ইতিহাসকে স্মরণে রেখে।
নবাবের বংশের জীবিত সদস্যদের মধ্যেও নবাবিয়ানার পাশাপাশি শৌখিনতা, সৌন্দর্যবোধ এসব আজও অটুট। আসিফ আলী মির্জা, শাহেন শাহ মীর্জা, কোয়াকফ কোওয়াদার প্রমুখের সঙ্গে সাক্ষাৎ হলেই এটা বোঝা যাবে। ক্লাসিক্যাল মিউজিক, পেইন্টিং, থিয়েটার, কবিতা— এসবের চর্চার চল রয়েছে নবাবের বংশপরম্পরায়। এই পরিবারে অদ্ভুত কিছু নিয়ম আছে বলে জানা গেল আসিফ আলী মির্জাদের সঙ্গে কথা বলে। নবাবি পরিবারে কোনো পুত্রসন্তান জন্ম নিলে তার হাতে প্রথম জন্মদিনে একটি লাল সুতা গেরো দিয়ে বেঁধে দেওয়া হয়। যত বয়স বাড়বে সেই সুতায় গেরোর সংখ্যাও বাড়বে।
দক্ষিণ কলকাতায় আওধি খানার একটি রেস্তোরাঁ রয়েছে আসিফ আলী মীর্জা, শাহেন শাহ মীর্জাদের। তাদের কথা থেকে জানা গেল, পারিবারিক রেসিপির পুরোটা নবাব পরিবারের মেয়েদের শেখানো হতো না, কারণ বিয়ের পর অন্য পরিবারে তারা চলে যাবেন, তাদের হাত দিয়ে নবাবি বংশের বাইরে যাতে রান্নার রেসিপি না যেতে পারে। কেবল বাড়ির বউদের রেসিপি শেখানোর চল রয়েছে। আসিফ আলী মীর্জা জানাচ্ছেন, নবাব পরিবারের রান্নার মধ্যে ইউনানি বা হেকিমি ছোঁয়া রয়েছে কিছুটা। ওই রেস্তোরাঁয় নবাবি রেসিপির সবটা যে নেই তা বলাই বাহুল্য। পারিবারিক রান্নার স্বাদ পুরোটা অন্যত্র ছড়িয়ে দিতে নারাজ এই পরিবার। তবে নবাবি পরিবারের হাত ধরেই কলকাতায় এসেছে লক্ষ্ণৌ বিরিয়ানি, কাবাব, কুলচা পরোটার মতো নানা খাবার। কারণ, নবাবের সঙ্গে লক্ষ্ণৌ থেকে কলকাতায় এসেছিলেন অনেক বাবুর্চিও।
ইমামবাড়ায় রয়েছে ওয়াজেদ আলী শাহর প্রতিকৃতি। যেটি তার জীবিতাবস্থায় এঁকেছিলেন কোনো এক চিত্রশিল্পী। শুধু তা-ই নয়, নবাব ছাড়াও এখানে রয়েছে বেগম হজরত মহলসহ অনেকের ছবি। এই সেই হজরত মহল, যিনি সিপাহি বিদ্রোহের গুরুত্বপূর্ণ বিদ্রোহী নেত্রী। বলে রাখা দরকার, ঝাঁসীর রানী লক্ষ্মীবাইয়ের নাম ভারতের ব্রিটিশবিরোধী সংগ্রামের ইতিহাসে গুরুত্বের সঙ্গে উচ্চারিত হয়, অথচ বেগম হজরত মহলের নাম অধিকাংশ ক্ষেত্রে অনুচ্চারিত থাকে। সিপাহি বিদ্রোহের এই নেত্রী ও আওধের নবাবের বেগম ছিলেন ব্যক্তিত্বময়ী, সুন্দরী ও শৌখিন। তামাকের গড়গড়ার নল হাতে বেগমের একটি প্রতিকৃতি রয়েছে ইমামবাড়ার দোতলায়। রয়েছে নবাব ও বেগমের বীর সন্তান বিরজিস কোওয়াদারের প্রতিকৃতি। উল্লেখ্য, বেগম ও তার সন্তানের সমাধি রয়েছে নেপালে। এ ছাড়া রয়েছে সফদর জং, সুজাউদৌল্লা, সাদাত আলী খান, ওয়াজির আলি খান, নাসীরউদ্দিন হায়দার, আমজাদ আলী শাহ প্রমুখের প্রতিকৃতি। এই পরিবারের ইতিহাস, ঐতিহ্য আর পরিচিতি তৈরি হয়েছে এদের সুবাদেই।
ইমামবাড়ার বাইরে রয়েছে দোকানপাট, কলকারখানা, ব্যস্ত মেটিয়াবুরুজ, ব্যস্ত কলকাতার বন্দর এলাকা। ইতিহাস হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা এই ইমামবাড়ার ভেতরে স্মৃতিচিহ্ন আঁকড়ে সময় স্থির হয়ে থাকে, আর অদূরে নদীর বহমানতায় সময় প্রবহমান। ইমামবাড়ার ঘণ্টার ধ্বনিতে স্থির সেই সময় নড়েচড়ে ওঠে, মনে হয় কোথাও বেজে উঠবে, ‘বাবুল মোরা নৈহার ছুটহী জায়।/ অঙ্গনা তো পর্বত ভয়ো/ ঔর দেহরী ভয়ো বিদেশ/ লে বাবুল পিয়া কী দেশ/ সঙ্গ চলহী জায়।/ চার কহার মিল ভুলিয়া মঙ্গাবে/ অপনা বেগানা ছুটহী জায়…’। বিষাদপূর্ণ এই ঠুমরির কথা লিখেছিলেন ওয়াজেদ আলী শাহ। লক্ষেèৗ ছেড়ে কলকাতায় আসার সময়। আজও কলকাতায় শায়িত রয়েছেন নবাব। কিন্তু অনেক কলকাতাবাসীই তা জানে না। ইতিহাস কথা বলে ইমামবাড়ার ভেতরে, মেটিয়াবুরুজে, হুগলি নদীতে, নবাবের কলকাতায়।
ছবি: মাসুদুর রহিম রুবাই