সাক্ষাৎকার I মানুষ প্রকৃতিতে ফিরতে চাইছে —জসমিন্দার সিং
এই ক’বছরেই বাংলাদেশকে ভালোবেসে ফেলেছেন হিমালয়ার প্রেসিডেন্ট অ্যান্ড ডিরেক্টর জসমিন্দার সিং। তাঁর সঙ্গে সম্প্রতি আলাপচারিতায় মেতেছেন শেখ সাইফুর রহমান
১৯৩০ সাল। এক ভারতীয় তরুণ কোনো কাজে বার্মা গেছেন। সেখানে একদিন দেখলেন, ক্লান্ত হাতিকে কর্মোদ্যম করতে স্থানীয়রা কোন গাছের শিকড় খেতে দেন। মুহূর্তেই হাতি উদ্যমী হয়ে কাজ শুরু করে। দৃশ্যটি মনে ধরল তরুণের। মাথায় ঘুরপাক খেতে শুরু করল নতুন কিছু উদ্ভাবনের তাগিদ। দেশে ফিরলেন। আর সে বছরই জন্ম হলো হিমালয়া ড্রাগ কোম্পানির। মানবসেবায় ভারতীয় আয়ুর্বেদশাস্ত্রের আধুনিক প্রচলনের শুরু সেই থেকে। এর নেপথ্যে থাকা সেই তরুণ হলেন মিরাজ মানাল। এরপর পরিচালনায় প্রজন্মান্তর ঘটেছে। বর্তমানে তৃতীয় প্রজন্মের নেতৃত্বে ভুবন মাতাচ্ছে এই প্রতিষ্ঠান। শুরুর দিকে যেসব ওষুধ বাজারে ছাড়া হয়েছিল, তা আজও চলছে সমান সুনামে। ১৯৫৫ সালে এই প্রতিষ্ঠান বাজারে আনে লিভারের ওষুধ লিভ-৫২; যা আজও এই কোম্পানির সর্বাধিক বিক্রীত ঔষুধ। তবে এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সম্পৃক্তদেরই কেবল প্রজন্মান্তর হয়নি, বরং এর পণ্যেরও প্রজন্মান্তর ঘটেছে। ড্রাগ কোম্পানি থেকে ওয়েলনেস কোম্পানিতে রূপান্তরিত হয়েছে হিমালয়া। পারসোনাল কেয়ারের পাশাপাশি যোগ হয়েছে বেবিকেয়ার, মাদার কেয়ার। এ ছাড়া আছে অ্যানিমেল হেলথকেয়ার এবং ওয়েলনেস প্রডাক্ট। হিমালয়া নিম ফেসওয়াশ কেবল ভারতে নয়, বাংলাদেশেও সমগোত্রীয় অন্য সব ফেশওয়াসকে ছাপিয়ে গেছে। বতর্মানে বিশ্বের ৯৪টির বেশি দেশে রয়েছে হিমালয়ার উপস্থিতি। বাংলাদেশের বাজারে হিমালয়ার আনুষ্ঠানিক প্রবেশ ২০০৬ সালে। তবে নিবন্ধিত হয় ২০১৩ সালে। ইতিমধ্যে জামালপুরে ফ্যাক্টরিও গড়ে তুলেছে। সম্প্রতি এসব নিয়ে সবিস্তার আলোচনা হয় কোম্পানির বাংলাদেশ, ইন্দোনেশিয়া ও থাইল্যান্ডের প্রেসিডেন্ট অ্যান্ড বিজনেস ডিরেক্টর জসমিন্দার সিংয়ের সঙ্গে। হিমালয়ার পারসোনাল কেয়ার ডিভিশন, টু-এর বাংলাদেশের কান্ট্রি ম্যানেজার শান্তনু ব্যানার্জি সেতু হয়ে এই আলাপচারিতার উদ্যোগ নেন।
হিমালয়ার সঙ্গে জসমিন্দার সিংয়ের সম্পর্ক দেড় দশকের বেশি। এরই মধ্যে দেশের বাজার বিস্তারে কেটেছে অর্ধেকটা সময়। এরপরই এশিয়ার দক্ষিণ আর দক্ষিণ-পূর্বে একাধিক দেশের দায়িত্ব বর্তেছে তাঁর ওপর। বাংলাদেশে আসছেন সেই ২০১২ সাল থেকে। নিয়মিত আসতে আসতে এ দেশের প্রতি বেশ একটা টান অনুভব করেন এখন। তাঁর সময়েই বাংলাদেশে কোম্পানি হিসেবে নিবন্ধিত হয়েছে, অফিস হয়েছে। সীমাবদ্ধ পরিসরে হলেও জামালপুরে ফ্যাক্টরি হয়েছে। তবে আইনগত কিছু জটিলতার কারণে অনেক প্রডাক্ট এখনো বাংলাদেশে তৈরি করা সম্ভব যেমন হচ্ছে না, তেমনি সরাসরি আমদানিও করা যাচ্ছে না। এই যেমন হারবাল মেডিসিন। এসব সীমাবদ্ধতা ছাপিয়ে বাংলাদেশের বাজারে দৃঢ় অবস্থান তৈরির চেষ্টা করে চলেছে তাঁর নেতৃত্বে একদল তরুণ। বন্ধুবৎসল মানুষটি বাংলাদেশকে বেশ আপন করে নিয়েছেন। তাই ক্রিকেটে ভারতের কাছে বাংলাদেশের পরাজয় তাঁকে আহত করে। কারণ, তিনি হয়ে উঠেছেন বাংলাদেশের সমর্থক। আগের রাতেই এবারের বিশ্বকাপের গ্রুপ পর্বে ভারতের কাছে হেরেছে বাংলাদেশ। পরদিন সকালে আলাপনের শুরুতেই সেটা উল্লেখ করতে ভুললেন না তিনি।
মাত্র ৬-৭ বছরের উপস্থিতিতে বাংলাদেশের বাজারে হিমালয়া তার প্রডাক্টের গুণবিচারে ভোক্তার হৃদয় অধিকার করতে সক্ষম হয়েছে বলেই অভিমত জসমিন্দারের। বলছিলেন, বাজারে প্রতিদ্বন্দ্বী থাকবে। আর লড়াই করেই নিজের জায়গা তৈরি করে নিতে হবে। আমরা সেটাই করছি। বাংলাদেশে এই কয় বছরের মধ্যে আমরা অন্তত একটা প্রডাক্টে শীর্ষ আসন দখলে নিতে পেরেছি। এটা নিঃসন্দেহে বড় ঘটনা। অবশ্য এ জন্য ভোক্তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাতে ভোলেননি তিনি। বিগত বছরগুলোয় বাংলাদেশে দারুণ পরিবর্তন লক্ষ করেছেন তিনি। ভালো-মন্দ উভয়ই। তবে তিনি মনে করেন, মন্দ কমে এসেছে। এখন ভালোরই দিন। আর এই সময়টা ব্যবসার দিক থেকে তাঁরাও উপভোগ করছেন। কারণ, ২০১২ সালে তাঁর প্রথম ঢাকায় আসা। এর আগে হিমালয়ার পণ্য একজন আমদানি করে আনতেন আর বিক্রি করতেন। সেই মডেলটাই চলছে, তবে অন্যভাবে। কারণ, প্রথম এসে তিনি বিপণনের দায়িত্ব দেন একজনকে। এর পরের বছর বাংলাদেশে কোম্পানি হিসেবে নিবন্ধন করেন। আর সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ করতে লেগে যায় আরও বছরখানেক। তারপর সেই পুরোনো মডেলেই শুরু হয় নতুন করে ব্যবসা। অর্থাৎ সেই থেকে এই নতুন কোম্পানির অধীনেই পণ্য আমদানি হচ্ছে। আরও সায়েন্টিফিক্যালি পরিচালনার জন্য এখানে অফিস করা হয়েছে। বিভিন্ন প্রডাক্ট রেঞ্জের জন্য রয়েছে পৃথক কান্ট্রি ম্যানেজার আর পরিচালন কর্মকর্তা। এখন মার্কেটিং সাপোর্ট, মার্কেটিং ফেসিলিটি আর প্রডাকশন ফেসিলিটি সংযুক্ত করা হয়েছে— বললেন জসমিন্দার। সঙ্গে যোগ করতে ভোলেননি— এ ক্ষেত্রে সমস্যা যে নেই তা নয়। বিশেষত চোরাই পথে পণ্য আসা। তবু এর মধ্যেই এগিয়ে যাচ্ছি। তবে স্থানীয় বিধিনিষেধের কারণে আমরা বাংলাদেশে ওষুধ বাজারজাত করতে পারছি না। পক্ষান্তরে স্থানীয়ভাবে উৎপাদনও সম্ভব হচ্ছে না। ফলে বাংলাদেশের বাজারে রয়েছে কেবল পারসোনাল কেয়ার, বেবিকেয়ার এবং অ্যানিমেল হেলথ কেয়ার পণ্য।
এবার আমাদের আলোচনা অন্য খাতে বয়ে চলে। দৃষ্টি ফেরাই ব্যবসার দিকে। মধ্যবর্তী সময়ে যে প্রবৃদ্ধি, তাতে তিনি সন্তুষ্ট। এখানকার সম্ভাবনাময় বাজার তাকে আরও আশাবাদী করছে। পাশাপাশি তাঁকে আত্মবিশ্বাস জোগাচ্ছে গুণগত মানসম্পন্ন ভারতীয় পণ্যের প্রতি ভোক্তার আস্থা। অবশ্য বাংলাদেশের ভোক্তাদের অদ্ভুত এক সাইকোলজির কথাও জানান তিনি। বলেন, একই কোম্পানির একই মানের ভারতে তৈরি পণ্যের প্রতি যে আগ্রহ থাকে, সেটা বাংলাদেশে তৈরি হলে থাকে না। এটাও জসমিন্দারের কাছে এক বড় চ্যালেঞ্জ বৈকি। আর তা মোকাবিলার চেষ্টাও তাঁরা চালিয়ে যাচ্ছেন। সবক্ষেত্রে বাংলাদেশ এগোচ্ছে। ফলে নিজের দেশের পণ্যের প্রতি ভোক্তার আস্থা আপনাআপনিই তৈরি হয়ে যাবে বলেই দৃঢ়বিশ্বাস তাঁর। প্রতিদ্বন্দ্বিতার কথায় ঝরেছে আত্মবিশ্বাস। কারণ, জসমিন্দার জানিয়েছেন, হিমালয়ার সঙ্গে অন্যদের তুলনা হয় না। তা সে স্থ’ানীয় কোম্পানিই হোক বা বহুজাতিক। কারণ, তাদের মতো এত বেশি প্রডাক্ট রেঞ্জ নিয়ে কেউ কাজ করে না। তা সত্ত্বেও সীমান্তের উভয়পারেই তিনি প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবছেন ইউনিলিভারকে। এরপর অবশ্যই গার্নিয়ের। তবে আশার কথা হলো, বাংলাদেশে আমরা মাত্র ছয়-সাত বছরে ইউনিলিভারকে ফেসিয়াল কেয়ারে টপকে গেছি; বেবিকেয়ার পণ্য বাংলাদেশে বছরখানেক হলো শুরু করা হয়েছে। আর এই অল্প সময়েই দারুণভাবে বাজার পেয়েছে। এর আগে বাজারের সিংহভাগ দখলে ছিল জনসন অ্যান্ড জনসনের। সেখানে ভাগ বসিয়েছে হিমালয়া। পাশাপাশি এনেছে মমকেয়ার, যেটা আর কারও নেই। আমরা অবশ্য মায়েদের আরও সচেতন করতে চেষ্টা চালাচ্ছি।
দেখতে দেখতে আট দশকের বেশি সময় পার করেছে হিমালয়া। এর মধ্যে বাজার বেড়েছে ব্যাপকভাবে। তাই এই চাহিদা প্রাকৃতিক উপাদানে তৈরি পণ্যে মেটানো সম্ভব কি না— কোনো দ্বিধা ছাড়াই বললেন, অসম্ভব নয়। চাহিদা থাকলে সরবরাহকে শক্তিশালী করতে হবে। আমরা সেই প্রয়াস অব্যাহত রেখেছি। ভারতের নানা জায়গা থেকে যেমন সংগ্রহ করা হচ্ছে, তেমনি আরও ১৬ দেশ থেকে আসছে আমাদের কাঁচামাল। ফলে সমস্যা হচ্ছে না। অন্যদিকে আমরা চাষিদের নানা সাহায্য-সহযোগিতায় উৎপাদন অব্যাহত রাখার প্রক্রিয়া চালিয়ে যাচ্ছি। পরিবর্তিত বৈশি^ক পরিস্থিতি মাথায় রেখে আমরা মনোযোগ দিচ্ছি প্রকৃতিবান্ধব পণ্য আর সেগুলোর আধার তৈরির ব্যাপারে। বিশেষত পুনর্ব্যবহারের উপযোগী উপাদানে হচ্ছে কিছু প্যাকেজিং— স্পষ্ট করলেন জসমিন্দার। সঙ্গে অকপটে জানালেন, হিমালয়া তার সিংহভাগ পণ্যে হারবাল অ্যাকটিভ ব্যবহার করে থাকে। সেগুলো অর্গানিক নয়। অবশ্য অর্গানিক প্রডাক্ট তাদেরও আছে। এসব পণ্য বিক্রি হয়ে থাকে হিমালয়ার বুটিক স্টোরগুলোতে। বাংলাদেশে এখনো এই রেঞ্জের প্রডাক্ট বাজারজাত হয়নি। আগামী বছরে হয়তো আসতে পারে— জানিয়ে দিলেন জসমিন্দার।
তাঁর দায়িত্বে থাকা অন্য দুটি দেশ থাইল্যান্ড আর ইন্দোনেশিয়ার বাজারসম্পর্কিত অভিজ্ঞতা জানতে চাই। সবকিছুই তাঁর নখদর্পণে, সেভাবেই উত্তর দেন তিনি। বলেন, থাইল্যান্ডের নিজস্ব প্রডাক্ট আছে। তবে ভারতীয় পণ্যের প্রতি তাদের আগ্রহের মূল কারণ বৌদ্ধধর্মের প্রতি অনুরাগ। এ জন্যই বুদ্ধগয়ায় রয়েছে হিমালয়ার উপস্থিতি, এ পর্যন্ত বলে থামলেন তিনি। এরপর আরও যোগ করলেন, এর বাইরে আরও যেটা বলতে হয় সেটা হলো— থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়ার মতো আশিয়ান দেশের মানুষের বিশেষ দুর্বলতা কিন্তু প্রাকৃতিক উপাদানে তৈরি পণ্যে। হিমালয়ার প্রতি তাদের আগ্রহ সৃষ্টিতে এটা বিশেষ ভূমিকা রাখছে। ফলে আমাদের নতুন করে বোঝাতে হয়নি। অবশ্য এই বাজারে ভালো প্রডাক্ট দেওয়ার চ্যালেঞ্জ যেমন আছে, তেমনি আছে অপরচুনিটিও। উপরন্তু কোনো কোনো ক্ষেত্রে আমাদের দেশের চেয়ে তাদের কাছে হিমালয়াকে জনপ্রিয় করা সহজ মনে হয় আমার।
শেষে এসে আলো ফেলার অনুরোধ করি তাদের ভুবনময় উপস্থিতি আর সাফল্যের সরণিতে। সেখানে উৎসাহিত জসমিন্দার ব্যাখ্যা করে বলেন, বৈশি^ক বাজারে হিমালয়ার পদচারণা প্রায় ছয় দশকের। দারুণভাবে আদৃত এর পণ্য। তবে দেশভেদে প্রডাক্ট মিক্স আলাদা। ভারতীয় উপমহাদেশ ছাড়া মধ্যপ্রাচ্যে হিমালয়ার বাজার যথেষ্ট ভালো। এরপর আমেরিকায়। অন্যান্য দেশে ধীরে ধীরে বাড়ছে বাজার। দূরপ্রাচ্যের মধ্যে মালয়েশিয়ায় হিমালয়ার পদচারণা শুরু অন্তত ২৫ বছর আগে। এখানে অনেক ফ্লেক্সিবিলিটি আছে। ১৫টার মতো বুটিক স্টোর আছে মালয়েশিয়ায়। আর সিঙ্গাপুরও মুক্তবাজার। দেশভেদে আবার নানা সীমাবদ্ধতা থাকে। থাকে বাধানিষেধ। যেমন কিছুটা আছে বাংলাদেশে। ফলে অনেক পদক্ষেপ আমরা এখানে নিতে পারি না, অন্যখানে পারি, বললেন তিনি। দেশ-বিদেশের বাজার নিয়ে কাজ করতে গিয়ে নানা অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছেন। হচ্ছেন প্রতিনিয়ত। এর মধ্য দিয়ে হিমালয়াকে এগিয়ে নিয়ে চলেছেন। আর প্রকৃতির কাছে ফেরার যে তাগিদ মানুষের মধ্যে নতুন করে দেখা যাচ্ছে, সেটাকেই ইতিবাচক মেনে বর্তমানের প্রেরণায় ভবিষ্যতে নাও ভাসাতে চান এই বর্ষীয়ান করপোরেট ব্যক্তিত্ব।
ছবি: ক্যানভাস