ফিচার I সবুজ আর চৌকস শহর
প্রকৃতি ও প্রযুক্তির জীবনবান্ধব ব্যবহারের উদ্দেশ্যই ভবিষ্যৎ নগরব্যবস্থার মূলে। উন্নত দেশগুলো সেদিকেই যাচ্ছে
উন্নত জীবনযাপনের উদ্দেশ্যে মানুষ নগরমুখী হয়। ২০৫০ সাল নাগাদ পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার ৭০ শতাংশের বাসস্থান হবে শহরে। অর্থাৎ, মোট স্থলভাগের মাত্র ২ শতাংশ হবে পৃথিবীর ৭০ শতাংশ মানুষের আবাসস্থল। বিপুল এ জনগোষ্ঠী কিছু সুবিধার সঙ্গে অসুবিধাও বয়ে আনবে। অসুবিধাকে বাড়তে দিলে আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের জন্য হয়তো এ পৃথিবী বসবাসের উপযোগী থাকবে না। সমস্যার সমাধানকল্পে শহরমুখী মানুষদের গ্রামে ফেরত পাঠানো কিংবা পৃথিবীর প্রতিটি গ্রামকে শহরে রূপান্তর করা হয়তো সম্ভব নয়। ফলে মাথা ঘামাতে হবে শহর নিয়েই। টিকে থাকার লড়াইটা হবে শহরকে ঘিরে।
শহর বলতে শুধু একখ- ভূমিকেই বোঝায় না, সেখানে বসবাসরত মানুষ নিয়েই শহর। শহরকল্যাণ বলতে তাই আমরা ভূমির পাশাপাশি মানুষের জীবনযাত্রার উন্নতিকেই বুঝি। ‘গ্রিন সিটি’ আপাতত সে রকম একটি ধারণা। যদি ভবিষ্যতের দিকে তাকাই, তাহলে শুধু গ্রিন সিটির ওপর আস্থা রাখলে চলবে না। এগোতে হবে স্মার্ট সিটির দিকে। নিজেদের এবং আগামী প্রজন্মের জন্য শহরকে বাসযোগ্য করার চেষ্টাই হচ্ছে গ্রিন সিটির মূল কনসেপ্ট। এর সঙ্গে উন্নত প্রযুক্তির মিশেলে শহুরে মানুষের জীবনকে সহজ করার প্রয়াস স্মার্ট সিটির লক্ষ্য। এক লাখ বছর আগে পৃথিবী পুরোপুরি সবুজই ছিল। ধারণা করা হয়, হোমো সেপিয়েন্সদের কাল থেকে এটি নষ্ট হতে শুরু করে।
সবুজ নগরী বা গ্রিন সিটি বলতে আমরা পরিবেশ বাঁচিয়ে জীবন-যাপন পদ্ধতিকে বুঝি। সমাজের সবাই মিলে স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ নিশ্চিত করা এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য শহরকে একটি সুবিধাজনক অবস্থায় রেখে যাওয়াই এর উদ্দেশ্য। এ উদ্দেশ্যে নগরকে পরিকল্পিতভাবে তৈরি করতে হয়, যাতে শহরজুড়ে আলো-বাতাসের চলাচল নিয়মিত থাকে। আবর্জনা অপসারণ পদ্ধতি যেন সহজ হয়, সেদিকেও নজর রাখে গ্রিন সিটি। বায়ুম-লের উষ্ণতা কমিয়ে আনতে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার যথাসম্ভব কমিয়ে আনা, ডিসপোজেবল উপাদান দিয়ে বাড়িঘর নির্মাণ, দেয়ালের জায়গায় উল্লম্ব বাগান করা, ছাদবাগান করা, দৃষ্টিসীমার মধ্যে যত দূর সম্ভব গাছপালায় ভরিয়ে তোলাই গ্রিন সিটির মূল কাজ। প্রাকৃতিক শক্তির অপচয় রোধও এর আওতায় পড়ে। যেমন বার্লিন শহরের কেন্দ্রে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করে সেটি পুনরায় ব্যবহার করা হয়। ফলে খনিজ পানি রক্ষার পাশাপাশি নদীর পানি পরিশোধনের খরচও বাঁচে।
এই কাজ গ্রিন সিটির আওতায় পড়ে। আরও কিছু উদাহরণ দেওয়া যায়। সুইডেনের স্টকহোমের বাসিন্দারা জ্বালানি সাশ্রয়, কার্বন নিঃসরণ কমানো এবং যানজটমুক্ত শহর নিশ্চিত করতে নিজেদের গাড়ি বের না করে গণপরিবহনে চলাচল করছে। জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমিয়ে বায়োমাস ও জিওথার্মাল উৎস থেকে উৎপন্ন জ্বালানি ব্যবহার করছে ইতালির সিয়েনা। নিজেদের বন রক্ষায় তারা বদ্ধপরিকর। আইসল্যান্ডে হাইড্রোজেন জ্বালানি ব্যবহার করা হচ্ছে। ফ্রান্সের নঁতে শহরে চলাচলের জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে ট্রাম। ইংল্যান্ডের ডিডকট শহরে আবর্জনা থেকে উৎপন্ন গ্যাস দিয়ে ঘর গরম রাখা হচ্ছে। এসবই গ্রিন সিটির উদাহরণ। কিন্তু অদূর ভবিষ্যতে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাপ সামাল দিতে শুধু গ্রিন সিটিতে কাজ হবে না। প্রয়োজন হবে স্মার্ট সিটির। সে জন্য ইন্টারনেট অব থিংস এবং আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সি সম্পর্কে জানা চাই। কেননা স্মার্ট সিটির মূল উপাদানই হচ্ছে প্রযুক্তি। বিশেষ করে ইন্টারনেট। নিরবচ্ছিন্ন ইন্টারনেট ব্যবস্থা শহুরে জীবনকে সহজ করবে। প্রযুক্তি ও প্রকৃতির সমন্বয়েই তৈরি হবে আগামীর স্মার্ট সিটি। মোদ্দাকথা, এটি এমন এক নগরব্যবস্থা, যেখানে তথ্যপ্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে জীবনযাত্রার মান উন্নত করা যাবে, প্রশাসনিক কর্মকা- ও সেবা ত্বরান্বিত হবে। আজকের এবং আগামী প্রজন্মের পরিবেশগত, সামাজিক ও অর্থনৈতিক চাহিদা নিশ্চিত হবে। এমন শহরের দালানগুলো হবে কাঠ অথবা দ্রুত পাচ্য ও পুনর্ব্যবহারযোগ্য উপাদানে নির্মিত। কাঠামো হবে ডিজিটাল। ভূমিকম্প প্রতিরোধ, উন্নত অগ্নিনির্বাপণব্যবস্থা, বাড়ির ভেতরে পর্যাপ্ত আলো-বাতাসের চলাচল থাকবে। বিজ্ঞানীরা এখন ‘মানুষের শরীরসৃষ্ট তাপ’ ব্যবহার করার দিকে মনোযোগ দিচ্ছেন। অর্থাৎ, বেশ কিছু মানুষ একটি জায়গায় সমবেত হলে সেখানে যে তাপ উৎপন্ন হয়, সেটিকে বিদ্যুৎ শক্তিতে রূপান্তরের চেষ্টা করছেন বিজ্ঞানীরা। এটি করা গেলে নিজ বাড়ির বিদ্যুতের চাহিদা হয়তো পরিবারের সদস্যরাই মিটিয়ে নিতে পারবে। যে শহরে এ ব্যবস্থা করা হবে, সেটি নিঃসন্দেহে স্মার্ট সিটি হবে। এ ছাড়া বিদ্যুতের জোগান দিতে স্মার্ট সিটিকে সৌরশক্তি এবং ব্যাটারি স্টোরেজের দিকে ঝুঁকতে হবে।
বর্জ্যরে মধ্যেও সম্ভাবনা লুকিয়ে আছে স্মার্ট সিটির জন্য। আবর্জনা শহরের বাইরে নিয়ে যাওয়ার জন্য থাকবে স্মার্ট ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম। ডাস্টবিন আর উপচে পড়বে না। ভরে গেলে ডাস্টবিন নিজেই সংকেত পাঠাবে কর্তৃপক্ষকে। আন্ডারগ্রাউন্ড টানেলের মধ্য দিয়ে রোবটিক কায়দায় ময়লা চলে যাবে শহর ছেড়ে দূরে। এসব আবর্জনা থেকে তৈরি হবে তাপশক্তি। তা রূপান্তরিত হবে আরও অনেক শক্তিতে। চীনে বর্তমানে ‘মানি ফর গার্বেজ’ নামে একটি পদ্ধতি চালু আছে। নির্দিষ্ট পরিমাণে আবর্জনা ফেললে টাকা পাবেন আপনি। যদিও সেই অর্থের পরিমাণ খুব বেশি নয়। তবে এটি একটি স্মার্ট উদ্যোগ।
চালকবিহীন গাড়ির কথা হয়তো অনেকেই শুনেছেন। এগুলো থাকবে স্মার্ট সিটির পথে পথে। এসব গাড়ির সহজ চলাচলের সুবিধার্থে স্মার্ট সিটির পথগুলো হবে বাঁকহীন ও সোজা। এমন পরিকল্পনাই করছেন ভবিষ্যৎ নগর-পরিকল্পনাবিদেরা। ট্রাফিক কন্ট্রোলের জন্য স্মার্ট সিটিতে স্পিড রিডিউসার হিসেবে থ্রিডি স্পিড ব্রেকারের কথা চিন্তা করা হলেও, চালকবিহীন গাড়ি চলাচল শুরু করলে এসব স্পিড ব্রেকার হয়তো অর্থহীন হয়ে পড়বে। গাড়ি চলাচলের জন্য যে পরিমাণ শক্তি বা জ্বালানি প্রয়োজন, সেটি গাড়ি নিজেই তৈরি করতে পারবে। চলার সময় চাকার সঙ্গে রাস্তার ঘর্ষণের ফলে যে শক্তি উৎপন্ন হবে, সেটিই হবে ওসব গাড়ির চালিকাশক্তি। যাতায়াতে হাইপারলুপ সিস্টেম হতে পারে স্মার্ট সিটির সেরা রসদ। এ পদ্ধতি প্রয়োগ করা গেলে বিমানের গতিকে মাটিতে নামিয়ে আনা সম্ভব হবে। মাটির নিচের টানেলের মধ্য দিয়ে যানবাহন চলবে ঘণ্টাপ্রতি ৭৫৯ মাইল বেগে।
পার্কিং সমস্যা নিয়েও ভাবছে স্মার্ট সিটি। আমাদের দেশে না হলেও উন্নত দেশের শহরগুলোতে পার্কিং খুবই বড়সড় একটি সমস্যা। কখনো কখনো ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয় গাড়ি পার্ক করার জন্য। এ সমস্যা দূর করতে আলট্রাসনিক সিস্টেম থাকবে স্মার্ট সিটিতে। দূর থেকেই বোঝা যাবে কোথায় পার্কিংয়ের জায়গা আছে, কোথায় নেই।
বিল্ডিং কিংবা মার্কেটে চলন্ত সিঁড়ির পাশেই জায়গা পাবে সাবওয়ে স্লাইড। বাচ্চাদের খেলাধুলার স্লিপারের আদলে তৈরি এ স্লাইড বেয়ে শিশু ও বয়স্করা সিঁড়ি এড়িয়ে নামতে পারবেন।
স্মার্ট সিটি মানেই তথ্যনির্ভর সিটি। পুরো শহর থাকবে ওয়াই-ফাই ও ফাইভ-জি কভারেজের আওতায়। প্রতিটি ল্যাম্পপোস্ট হবে তথ্য সংগ্রহ এবং প্রদানের মাধ্যম। দিনের আলো কমে গেলে বাতিগুলো নিজেই জ্বলে উঠবে। ভোরবেলা নিভে যাবে আপনা থেকেই। এ ছাড়া শহরের কোন জায়গায় কতগুলো গাড়ি চলছে এবং আবহাওয়ার তথ্যাদি দেওয়ার কাজ করবে পথবাতিগুলো। বায়ু ও শব্দদূষণের মাত্রা নির্ণয় করে স্মার্টফোনে ডেটা পাঠিয়ে দেবে এ বাতি। শহরে মানুষের আনাগোনা এবং দুর্ঘটনার সংকেত পাঠাতে পারবে। ফলে কোথায় নিরাপত্তা জোরদার করা দরকার, আর কোথায় নিরাপত্তা কিছুটা কমিয়ে আনলেও চলবে, এ বিষয়ে সদা ওয়াকিবহাল থাকতে পারবে সংশ্লিষ্টরা। ফলে নিরাপত্তাব্যবস্থার সুষম বণ্টন হবে।
রাস্তা পারাপারের জন্য এখন হয়তো মানুষকে লাল বাতি জ্বলার জন্য অপেক্ষা করতে হয়। যদি এমন হয়, পথিক নিজেই লাল বাতি জ্বেলে রাস্তা পার হতে পারে? সেদিকেই এগোচ্ছে স্মার্ট সিটি। এ ছাড়া রাস্তা ঘেঁষে থাকবে ইলেকট্রিক ডিভাইস চার্জার। ফলে গ্যাজেট যতই হোক, চার্জের চিন্তা করতে হবে না স্মার্ট সিটির বাসিন্দাদের।
স্মার্ট সিটি যে শুধু স্থলভাগেই স্থাপিত হতে পারে, তা নয়। পানির উপর ভাসমান শহরকেও এর আওতায় ধরা হচ্ছে। বাজার-সদাইয়ের ডেলিভারি গ্যাজেট হিসেবে আকাশে উড়বে শত শত ড্রোন।
কৃষিতেও আসবে নতুনত্ব। স্মার্ট সিটির ভবনগুলোর ছাদে বাগানের পাশাপাশি পশু পালনের ব্যবস্থা থাকবে। বর্তমানে ছাদগুলো নন-প্রোডাক্টিভ। শীতাতপ নিয়ন্ত্রণের যন্ত্রপাতি ছাড়া সেখানে আর কিছুই রাখা হয় না। স্মার্ট সিটিতে সবকিছুকেই প্রোডাক্টিভ করার প্রয়াস থাকবে। উন্নত দেশগুলো স্মার্ট সিটি নির্মাণের দিকে অনেকটাই এগিয়ে গেছে। যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, জার্মানি, সিঙ্গাপুর, দুবাইসহ পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেও স্মার্ট সিটি গড়ার কাজ এগিয়ে চলছে।
শিবলী আহমেদ
ছবি: ইন্টারনেট