skip to Main Content

বিশেষ রচনা I ঝলসানো মাংসের স্বাদ

পুরান ঢাকার তস্য গলি থেকে পারস্যের কেবাবখানায়। কাবাবের জয়চিহ্ন সর্বত্র। মানুষের এই মাংসরসনার সূচনাপর্ব থেকে বর্তমানের দ্রুতরেখ চিত্র এঁকেছেন আশফাকুর রহমান

‘আশ্বাসঃ পিশাচো হপি ভোজনেন’
পিশাচও ভোজনে বাগে আসে
-কালিদাস

‘Sometimes I wonder what my grandfather would think of what I do, he spent his whole life in the kebab business, was buried with all his equipment, probably turning in his grave.’
-Milton Jones

গুলিস্তানের গোলাপ শাহ মাজারের যে পাশে ঘোড়ার গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে, সেই রাস্তা দিয়ে সদরঘাট যাওয়া যায়। যে রাস্তার কথা সবাই চেনেন— তাতে ট্রাক, বাস, গাড়ি, রিকশা, সাইকেল আর ঘোড়ার গাড়ির সঙ্গে হেঁটে মানুষও যাওয়া-আসা করে। দিনের যেকোনো সময় ওই রাস্তা দিয়ে কে যে কার আগে যায় বা পরে, বোঝার কোনো উপায় নেই। আর সদরঘাট যেমন পুরান ঢাকার শেষ প্রান্তর, তেমনি বুড়িগঙ্গা দিয়ে এলে ওই ঘাট দিয়ে ক্রমেই ছড়িয়ে যাওয়া ঢাকায় ঢুকতে হয়।
গুলিস্তান থেকে চলে এলাম ঠাটারীবাজারের এক রাস্তায়। নাম তার বিসিসি রোড। মানুষ আর রিকশা লাইন ধরে অনেকক্ষণ হয় দাঁড়িয়ে আছে। একটু সুযোগ পেলেই যে যার মতো করে নড়েচড়ে উঠবে। এ রাস্তার শেষ মাথায় আছে প্রায় তিন শ বছরের পুরোনো জয়কালী মন্দির। অবশ্য ঠাটারীবাজার নামটি কেমন করে হলো, তা এখনো জানা যায়নি। ১৮৫০ সালের পর থেকে এটি একটি আবাসিক এলাকা হিসেবে গড়ে উঠতে শুরু করেছিল। এই এলাকা এখন বাণিজ্য ও বসতি মিলে ভিন্ন এক চেহারা নিয়েছে। বিসিসি রোডেই ঢাকা শহরের নানা স্থানে থাকা স্টার হোটেলের প্রথম পত্তন হয় ১৯৬৮ সালে। অবশেষে এই হোটেলের সামনে এসে দাঁড়ালাম কিছুক্ষণের জন্য। অপেক্ষায় আছি সেই বন্ধুর, যার সঙ্গে নিব কাবাবের স্বাদ, যিনি থাকেন এই বিসিসি রোডে। এই স্টার হোটেলের এক পাশে গ্রিন সুইটমিট। এ মিষ্টির দোকানের মালিকদের আদি নিবাস ভারতের উত্তর প্রদেশে। তারা তিন প্রজন্ম ধরে দিয়েছে শুকনা মিষ্টির ‘ঢাকাইয়া’ চেহারা। এই দোকানের মিষ্টি চেখে দেখব কি দেখব না, এমন ভাবতে ভাবতে আমার বন্ধু মীর শাবাব আহমেদ চলে এসেছে। এখন আমাদের গন্তব্য স্টার হোটেল লাগোয়া বশীর কাবাব হাউসে।
বিসিসি রোডের এমাথা থেকে ওমাথা পর্যন্ত এই কাবাবের দোকানের কথা স্টার হোটেলের মতো একনামে চেনে সবাই। ৯৯, বিসিসি রোড, ঠাটারীবাজার হাবিব খান মার্কেট। এই কাবাবের দোকানের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ বশীর মিয়া। খুবই ছোট আর অনাকর্ষণীয় একটা দোকান। মাত্র কয়েক দিন হয় সাইনবোর্ড টাঙানো হয়েছে। এ ঠিকানায় কাবাবের দোকানটি এসেছে আজ থেকে প্রায় ২৫ বছর আগে। ১৯৭২ সালে ঠাটারীবাজারের বটতলার কোনায় রাস্তায় মো. বশীর মিয়া কাবাব বিক্রি শুরু করেন। কোথায় তিনি কাবাব বানানো শিখলেন, সেটি জানা না গেলেও এটা নিশ্চিত যে তিনি কাজ করেছেন বিভিন্ন খাবার হোটেলে। পরে তার প্রয়াত বড় মেয়ে রিজিয়া বেগমের কথায় নিজেই চালু করেছিলেন এ কাবাবের দোকান। ধীরে ধীরে এর সুনাম ছড়িয়ে পড়ে। স্টার হোটেলের মালিক মৃত মীর মমতাজ উদ্দীন এ কাবাবের স্বাদ নিয়েছেন বলে জানা যায়। একসময় বশীর মিয়ার দুই ছেলে মো. সাব্বির আহমেদ ও মো. ছগীর আহমেদ বাবার সঙ্গে কাবাব বানানোর কাজে জড়িয়ে পড়েন। বর্তমানে সাব্বির ক্যাটারিং সার্ভিস আর ছগীর বাবার গড়া প্রতিষ্ঠান বশীর কাবাব হাউসের দায়িত্ব নিয়েছেন। বাবার মতো এখনো নিজের হাতে মসলার প্রক্রিয়া থেকে মাংস কাটা পর্যন্ত পুরোটাই তদারক করেন তিনি। বাবার কাছ থেকে তিনি কাজ শিখলেও এখন দোকানে রয়েছে কয়লায় কাবাব তৈরির কারিগর।
ছেলেদের হাতে এ দোকানের ভার বুঝিয়ে দিয়ে কিছুটা অসুস্থ অবস্থায় নিখোঁজ হয়ে যান কাবাবশিল্পী মো. বশীর মিয়া। প্রায় ১০টি পত্রিকায় নিখোঁজ বিজ্ঞপ্তি দিয়েও বাবার কোনো খোঁজ পাননি ছেলেরা। তারপরও বশীর কাবাব হাউসের কর্মব্যস্ততা নেই থেমে। বশীরের সেই কাবাবের স্বাদ আজও অমলিন। এসব কথা বলতে বলতে চোখের পলক ফেলার আগেই শাবাবের সঙ্গে চলে এলাম বশীর কাবাবে। লোকজন দাঁড়িয়ে আছে এলোমেলোভাবে। কে কার আগে এসেছে, কার আগে কে কাবাব খাবে— এ নিয়ে কারও তেমন কোনো মাথাব্যথা নেই, নেই তাড়াও। বলতেই হয়, টকটকে লাল হয়ে যাওয়া কয়লার তাপে প্রচন্ড গরমের মধ্যেও মাংসের পোড়া গন্ধের কাছে এরই মধ্যে সবাই বশ মেনে গেছে। ছয়-সাত বছর বয়সে হাফপ্যান্ট পরে শাবাব তার বাবা মৃত মীর হোসেন আহমদ চৌধুরীর সঙ্গে ১৯৯৩-৯৪ সালে এসেছিলেন সেই প্রথম এই কাবাব খেতে। এরপর কত কত বছর হয়ে যাওয়ার পরও শাবাব নিয়মিত কাবাবের স্বাদ নিতে আসেন এখানে। কাবাবের দোকানের লোকজন তাকে চেনেন ঠিকঠাকমতো। শাবাব তাদের কথা বলতে বলতে একসময় আমাদের বসার সুযোগ মিলল। গরুর শিক ও ছাগলের খিরির সঙ্গে পরোটার অপেক্ষায় আছি আমরা। কাবাব এল প্লেটে আমাদের সামনে। হাতের আঙুলে অনুভব করা প্রচন্ড গরম সহ্য করে গরুর কাবাবের টুকরা মুখে দিতেই ঘটল এক অবাক কান্ড! চারপাশের ধোঁয়ার গরমে নয়— মরিচের ঝালে কপাল আর মাথার তালুতে ছোট-বড় ঘামের ফোঁটা পটপট করে ভেসে উঠতে থাকল। শিরায় শিরায় পৌঁছে গেল ঝালের অনুভূতি। এমন অবস্থা যে, একটু আগের কথাও আর মনে করা সম্ভব হচ্ছে না।
বশীর মিয়া কাবাব বানানোর সময় ব্যবহার করতেন গোলমরিচ। তবে তার ছেলে ছগীর আহমেদ কাবাবে লাল মরিচের ব্যবহার শুরু করেন। মানুষ ঝাল খেতে চায়। বদলে দিতে চায় শরীরে অনুভব করার শক্তি। তরঙ্গে তরঙ্গে চায় ভাসতে। বশীর কাবাবের লাল মরিচের ঝাল এমনই, যা মানুষ আসলেই চায়। মরিচ বা লঙ্কা ভারতবর্ষে নিয়ে এসেছিল পর্তুগিজরা। আর গোলমরিচের ব্যবহার তো এখানে ছিল আগে থেকেই। তবে পোড়া মাংসে লাল মরিচের ঝালে মজে গেলে কেউ যে রক্ষা পায় না, সেটা সবারই এতক্ষণে বোঝা হয়ে গেছে। এ ঝালের ঝাঁজে মজতেই হয় সবাইকে।
এমন অনেক ধরনের স্বাদের কাবাব পাওয়া যায় ঢাকার নানান জায়গায়। পারসান্দের শিক কাবাব ‘ঢাকাইয়া’ কাবাব হিসেবে বিখ্যাত মোগল আমল থেকে। ‘সুতলি কাবাব’ এটির আরেক নাম। সুতায় মাংসের কিমাকে জড়িয়ে এ কাবাব তৈরি করা হয়। যার এক-একটি শিকের ওজন ১০-১৫ কেজি। চকবাজারে প্রতি রমজান মাসে এখনো এ কাবাব পাওয়া যায়। এর বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে হাকিম হাবিবুর রহমান ‘ঢাকা পাচাশ বারাস প্যাহলে’তে লিখেছেন, ‘এই কাবাবের পরিচয় এই যে গোস্ত সেদ্ধ হয়ে যাবে, কিন্তু ভঙ্গুর এবং শুকনো হবে, পচপচে ভাব হবে না, কেননা খোলা বা ভাঙ্গার সময় চুরচুর হয়ে যাবে এবং আস্ত বের করা সম্ভব হবে না। এই কাবাবে গোস্ত ছাড়া আর কিছু যেমন বেসন বা অন্য কিছু মিশানো হয় না।’
এ ছাড়া ঢাকায় হতো আস্ত মুরগির মোসাল্লাম কাবাব। যতই ঢাকা বিস্তৃত হয়েছে ততই আরও নতুন স্বাদের কাবাবের খোঁজ পেয়েছে কাবাবপ্রেমীরা। ঢাকার যেদিকেই যাই না কেন, সেটা হোক মোহাম্মদপুর বা মিরপুর— পোড়া মাংসের গন্ধের আসক্তি থেকে থেকে আমাদের মুক্তি নেই— মিলবেও না কোনো দিন।
ভারত ভাগের কারণে ১৯৪৭ সালের পর ঢাকায় গড়ে উঠেছে মোহাম্মদপুর নামের আবাসিক এলাকা। বাস্তুচ্যুত অবাঙালিরা এখানে আশ্রয় নিতে শুরু করে ওই সময় থেকেই। মোহাম্মদপুরে এ ‘উদ্বাস্তু’ ৬০-৭০ হাজার মানুষ এখন থাকে জেনেভা ক্যাম্পে। সেই মোহাম্মদপুর এখন অনেক ঝলমলে। জেনেভা ক্যাম্পের পাশে ১৯৮৯ সালে স্থাপিত হয় মোস্তাকিমের কাবাব। এর ১০ বছর আগে ১৯৭৯ সালে মোহাম্মদপুরের সলিমুল্লাহ রোডে ১১, জামে মসজিদ কমপ্লেক্স মার্কেটে চালু হয় সেলিম কাবাব ঘর। কলকাতার মেটিয়াবুরুজ থেকে ১৯৪৭ সালে আসা কাবাবশিল্পী সেলিম খান এটি চালু করেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের আগে তিনি করতেন ঢাকা থেকে করাচিতে পান রপ্তানি। পরে ভারতে তার ওস্তাদের (নাম জানা যায়নি) কাছে কাবাব তৈরি শিখে শুরু করলেন এ দোকান। ইচ্ছা ছিল তার ছেলে হবে ডাক্তার বা উকিল। ১৯৯৪ সালে তার মৃত্যু হলে ছেলে মোহাম্মদ লিয়াকত খান এ দোকানের হাল ধরেন।
এ কাবাব দোকানের ৮-১০ জন কারিগর-কর্মচারী সবাই থাকেন জেনেভা ক্যাম্পে। সবাই কথা বলেন বাংলা-উর্দু-হিন্দি মিলিয়ে। কাবাব কারিগরের সহযোগী ইমরান আলী প্রতিদিন বিকেলে কয়লার চুলার আগুনের তাপ সহ্য করে কাবাবপ্রেমীদের আনন্দ দিলেও পড়াশোনা করছেন হিসাববিজ্ঞানে।
সেলিমের কাবাবের স্বাদ কীভাবে আলাদা? ভারতে মরিচ বা লঙ্কার ব্যবহার শুরুর আগে থেকে পাঁচ হাজার বছরের বেশি সময় ধরে রান্নায় ব্যবহার হওয়া মসলা আদা এ কাবাবের মূল উপাদান। সেলিম কাবাব ঘরের বর্তমান কর্ণধার লিয়াকত খান কারও কাছে বলতে চান না তার কাবাব বানানোর প্রণালি। জিজ্ঞাসা করতেই বলেন, ‘সিক্রেট রেসিপি।’ ‘বিজনেস সিক্রেট।’ তিনি আরও বললেন, ‘তার বাবার কাবাব বানানোর রন্ধনপ্রণালি তিনি অনুসরণ করছেন।’ তবে আদার ঝাঁজই হলো তার কাবাবের প্রাণভোমরা। মুখে দিতেই এ ঝাঁজ শরীরকে ঝাঁকুনি দেয়। নতুন এ স্বাদকে আমন্ত্রণ জানিয়ে আন্তরিকভাবেই গ্রহণ করতে হয়। এমনকি কয়লা পোড়া এ মাংসের স্বাদের কথা নতুন করে বলার সুযোগও হয়ে যায় হাতছাড়া। এ যে প্রতিনিয়ত চিরনতুনের মুখোমুখি হওয়ার মতো কিছু একটা।
লিয়াকত খানের আত্মীয়ের আরেক দোকান আছে মিরপুরের বেনারসিপল্লির কালভার্টের কাছে। সবার কাছে সেটি কাল্লুর চাপের দোকান নামে পরিচিত। যদিও ঢাকাবাসীর কাছে মিরপুর বেনারসিপল্লির শেষ দিকে কাঁঠালগাছের নিচে বস্তা বিছিয়ে চালু হওয়া শওকতের কাবাব সুপরিচিত অনেক বেশি। শওকত আলী আনসারির বাবা বাবুর্চি আব্দুর রাজ্জাক এই কাবাব বানানো শেখেন বিদেশি দূতাবাসে কর্মরত অন্য বাবুর্চির কাছ থেকে। তেলে ভাজা মিরপুরের এই চাপ কাবাব খাদ্যপ্রেমীদের প্রশংসা কুড়িয়েছে। তবে কাল্লুর চাপ কাবাব ভোজনরসিকদের কাছে অন্য রকম গুরুত্ব পেয়েছে।
এমন অনেক কাবাব কারিগরশিল্পী প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে নতুন নতুন উপায় খুঁজেছেন মানুষের স্বাদেন্দ্রিয়কে তৃপ্তি দিতে।

‘কচি ছাগ মৃগ মাংসে ঝাল ঝোল রসা।
কালিয়া দোলমা বাগা সেকচী সমুসা ॥
অন্নমাংস সিকভাজা কাবাব করিয়া।’
-অন্নদামঙ্গল, ভারতচন্দ্র

আঠারো শতকে ভারতচন্দ্রের লেখায় কাবাবের কথা বলা হলেও এর স্বাদকে বিচিত্রভাবে অদলবদল করে দিয়েছে ভারতবর্ষ। এই অঞ্চলে অনেক আগে থেকেই কাবাব পাওয়ার কথা জানা যায়। সংস্কৃত ভাষায় লেখা রন্ধনশৈলীর পুঁথি ‘ক্ষেমকুতূহলম্্’-এ কাবাবের উল্লেখ রয়েছে। সপ্তম শতাব্দীতে ভট্টিকাব্যে লেখা হয়েছে, ‘বুভুজে দেবাসাৎ কৃত্বা মূলমুখ্যঞ্চ হোমবান’। এ শ্লোকের অর্থ এমন: ‘হোমকার্য্য সমাপনপূর্বক (শ্রীরামচন্দ্র) শূলে এবং উখায় (স্থালীতে) সংস্কৃত বা পক্ব মাংস দেবতাদিগকে নিবেদন করিয়া (স্বয়ং) ভোজন করিলেন।’ এ ছাড়া পাণিনির সূত্রে আছে, ‘শুলোখাদ যৎ’। যা হলো, ‘শূলে সংস্কৃতং শূন্য; মাংসম্। উখ্যম্।’ আর মোগল আমলের আগেই ১২ শতাব্দীতে এই ভূ-ভারতে কাবাব পাওয়ার কথা ভারত ভ্রমণের বইতে উল্লেখ করেছেন ইবনে বতুতা। তিনি সুলতানি আমলে দিল্লির বাবুর্চিদের হাতে কাবাব তৈরি হতেও দেখেছেন। গল্পে গল্পে জানা যায়, আলেকজান্ডারকে কাবাব দিয়ে আপ্যায়ন করেছিলেন মহারাজ পুরু। অন্যদিকে হরপ্পা সভ্যতায় পাঁচ হাজার বছর ধরে উপমহাদেশে তন্দুর চুলার ব্যবহার হচ্ছে। যাতে কয়লা ভরে রান্না হয় তন্দুরি চিকেন কাবাব।
কাবাব যে নানা রকম হয়, তার প্রমাণ আছে শব্দটির মধ্যেই। আদি আরবি ভাষায় ‘কাব্বাবা’ বা অতি প্রাচীন অ্যাকখাডীয় ভাষা ‘কাবাবু’ থেকে ফারসি শব্দ কাবাবের উৎপত্তি। যার বাংলা অর্থ ভুনা মাংস। এই শব্দ তৈরি হয়েছে দুই ফারসি শব্দ দিয়ে। ‘কুম্’ মানে অল্প এবং ‘আব্’ হলো পানি। মানে অল্প পানি ব্যবহারে রান্না করা লোভনীয় খাবারটির নাম হয়েছে কাবাব। এটি কয়লায় পুড়িয়ে বা তেলে ভেজেও রান্না করা যায়। পোড়া মাংসের এ স্বাদকে অতুলনীয়ভাবে সূক্ষ্ম করে তুলেছে মোগলরাই। অবশ্য ইতিহাস সাক্ষ্য দিচ্ছে, শিকে গেঁথে বা শুধু মাংস পুড়িয়ে এর স্বাদ মানুষ আগুন আবিষ্কারের সঙ্গে খুঁজে নিয়েছে।
এক দেশ থেকে আরেক দেশে, এক মহাদেশ থেকে আরেক মহাদেশে— এক রন্ধনশিল্পী থেকে অন্য রন্ধনশিল্পীর সূত্রে কত নামের কাবাব পাওয়া যায়, সে হিসাব রীতিমতো মানব সভ্যতার চলমানতার মতোই বিস্ময়কর। ভারতের এক পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনে নদিয়ার রন্ধনশিল্পী শামস পারভেজ বলছেন, ‘শেষ পর্যন্ত কাবাব আসলে দুই ধরনেরই। এক শিক, অন্যটি শামি। আর বাকি সব এই দুই ভাগেরই বিচিত্র পরিবর্তিত রূপ।’ কাবাবকে দুনিয়ায় জনপ্রিয় করতে তুর্কিদের অবদান অনস্বীকার্য। তুরস্ক-পারস্যে কাবাবের রন্ধনপ্রণালি গ্রিস-স্পেন থেকে শুরু করে ভারতে পর্যন্ত পৌঁছেছে। শামি কাবাবের উদ্ভাবন করেন মোগল রন্ধনশালার সিরিয়ান রাঁধুনিরা। সিরিয়ার আদি নাম ছিল বিলাদ-আল শাম। অবশ্য ইংরেজি ভাষাভাষী দেশগুলোতে কাবাব শিস কাবাব বা সাসলিক নামে পরিচিত। শিস শব্দটি এসেছে তার্কিশ ভাষা থেকে। যার অর্থ শিক। লোহার শিকে গাঁথা কাবাবকে তুর্কিরা শিস কাবাব বলে; যা ভারতবর্ষে শিক কাবাব নামেও পরিচিত। আবার আফ্রিকায় কাবাবের নাম হলো সুয়া ও সত্তসাটি। এর সূত্র ধরে বিভিন্ন কাবাব হয় আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে। আর শিক কাবাব ভাজতে চুলার সন্ধানও পাওয়া গেছে খ্রিস্টপূর্ব সতেরো শতকে বর্তমান গ্রিসে।
এদিকে মোগল সম্রাটদের রন্ধনশালায় তৈরি কাবাব ছিল বিচিত্রমুখী। ষোড়শ শতকে মোগল সম্রাট নাসির-উদ-দিন মুহাম্মদ হুমায়ূনের রন্ধনশালায় বানানো নান-ই-টাঙ্ক রুটিতে মোড়ানো ভেড়ার মাংসের কাবাবের কথা জানা যায়। সতেরো শতকে মোগল সম্রাট হিসেবে দায়িত্ব নেওয়া নুর-উদ-দিন মুহাম্মদ জাহাঙ্গীরের (সেলিম) পছন্দের কাবাব হলো ভেড়ার মাংসের ইয়াখনি কাবাব। একই শতকেরই আরেক মোগল সম্রাট তাজমহলের অমরস্রষ্টা গিয়াস-উদ-দীন মুহাম্মদ শাহজাহানের (খুররম) রন্ধনশালায় বানানো হতো ভেড়ার মাংসের সাসলিক কেবাব-ই-দারইয়াই। এ ছাড়া উনিশ শতকে মোগল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরের রন্ধনশালায় কড়াইতে হতো মুরগির পাত্তেলি কাবাব।
বাংলা ভাষায় কাবাবের রন্ধনপ্রণালির অনবদ্য বিবরণ পাওয়া যায় শরৎচন্দ দাস কর্তৃক সংগৃহীত ও সম্পাদিত এবং ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে (১৩৩৬ বঙ্গাব্দ) প্রকাশিত দ্বিতীয় সংস্করণ ‘বিশুদ্ধ পাক-প্রণালী’তে। বইটিতে ‘ছাগ মাংসের কাবাব’ বানানোর প্রক্রিয়ার কথা লেখা হয়েছে এভাবে, ‘উৎকৃষ্ট মাংস এক সের, পিঁয়াজ বাটা আধ ভরি, গরম মসলা বাটা আধ ভরি, আদা বাটা আধ ভরি, লবণ এক কাঁচ্চা, ঘৃত আধ সের।
‘কাবাবের মাংস উত্তমরূপে থুড়িয়া পরে বাটিতে হইবে। বাটা যত ভাল হইবে কাবাব ততই ভালো হইবে। মাংস বাটিবার এক প্রকার কল আছে। উহা দেখিতে হামান দিস্তার মতো। উহার ভিতর থোড়া মাংস দিয়া কল ঘোরাইলে উহা উৎকৃষ্ট রূপে বাটা হইবে।
‘যে যাহা হউক মাংসকে ঐরূপে বাটিয়া সমুদয় মসলা মাখাইবে। পরে একটি বাঁশের খোলে পুরিয়া দুই মুখ কলাপাতা দিয়া বন্ধ করিয়া দিবে। পরে ঐ চোঙ্গের উপর পাতলা করিয়া মৃত্তিকার প্রলেপ দিয়া জ্বলন্ত অঙ্গারের উপর দিয়া দগ্ধ করিবে। দগ্ধ করিবার সময় বাঁশের চোঙ্গকে ক্রমাগত ঘুরাইয়া দিতে হইবে। নতুবা সকল মাংস সমভাবে সিদ্ধ হইবে না। খানিক পরে ঐ চোঙ্গকে তুলিয়া আস্তে আস্তে ফাটাইয়া মাংস বাহির করিবে। পরে চাকা চাকা করিয়া কাটিয়া ঘৃতে বাদামি ধরনের ভাজিয়া লইবে। তাহা হইলেই উৎকৃষ্ট কাবাব প্রস্তুত হইবে।’
আবার পূর্ণিমা ঠাকুরের লেখা ‘ঠাকুর বাড়ির রান্না’ বইয়ে মাছের শিক কাবাবের রন্ধনপ্রণালির কথা জানা যায়। ইন্দিরা দেবীর সংগ্রহ ও হাতে লেখা বিভিন্ন রেসিপির একটি খাতা এই বইয়ের উৎস। যেখানে মাছের শিক কাবাবের রান্নার বিবরণ লেখা হয়েছে এমন করে, ‘পাকা রুইমাছ— ২৫০ গ্রাম / পেঁয়াজ— ৩টা/আদা খানিকটা/রসুন— পাঁচ কোয়া/শুক্নো লঙ্কা— দুই-তিনটি/গরমমশলা গুঁড়ো—/ গোলমরিচ গুঁড়ো একটু— /নুন/সামান্য ঘি/দই— ১০০ গ্রাম।
‘মাছ কাঁটা বেছে ডুমো ডুমো করে কেটে রাখবে। দুটি পেঁয়াজ কুচি করে ভালো করে ভাজবে ও তুলে রাখবে। বাকি সব মসলা একসঙ্গে বাটবে। এবার এই বাটা ও গুঁড়া মসলা দই ও মাছ মাখো। নুন দাও।
‘একটি পরিষ্কার লোহার শিক লাগবে। এই শিকে মাছগুলো গেঁথে নিয়ে কাঠকয়লার আগুনে ভালো করে সেঁকে নেবে। ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে সেঁকবে আর উপর থেকে চামচ করে সামান্য ঘি মাখিয়ে দেবে। মাছ হয়ে গেলে শিক থেকে নামিয়ে নেবে।’
কাবাব তৈরির প্রণালি লেখা হয়েছে নানা ভাষায়। মাছ-মাংসের বাইরে ভেজিটেরিয়ানদেরও নিরাশ করেনি কাবাবের দুনিয়া। রন্ধনশিল্পী দেভিন্দের কুমার ‘জাস্ট কাবাব’ বইতে ১২০ রকমের ভেজিটেরিয়ান কাবাবের রেসিপি উল্লেখ করেছেন।

‘An evening without kebab is a bird without wings.’
– Salvador Dali

পোড়া মাংসের স্বাদ এমনই যে সময়ের সঙ্গে নানা রূপ ধারণ করলেও তাতে ঠিকই সমর্পিত হন কাবাবপ্রেমীরা। তাদের কাছে প্রতি টুকরা কাবাবের স্বাদ অমূল্য। ঠিকই তারা কাবাবের কারণে সম্পর্ক গড়ে নেন অপর-অচেনা ভূগোলের সঙ্গে। এ কারণেই হয়তো ‘পারস্যে’ বইয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখলেন, ‘বাগানে গাছতলায় দীপের আলোকে সকলের সঙ্গে খেতে বসলুম। এখানকার দেশি ভোজ্য। পোলাও কাবাব প্রভৃতিতে আমাদের দেশের মোগলাই খানার সঙ্গে বিশেষ প্রভেদ দেখা গেল না।’ মানুষের সঙ্গে মানুষের ঐক্যের ভাষা-স্বাদ-গন্ধ কাবাবেই আছে।

লেখক: সাংবাদিক
ছবি: ইন্টারনেট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top