ফিচার I টেকসই ফ্যাশন
ফ্যাশনে ব্যবহৃত উপাদান থেকে যে দূষণ ঘটে চলেছে বিশ্বজুড়ে, তা নিয়ে বাড়ছে উদ্বেগ। সমাধানও পাওয়া গেছে। শুরু হয়েছে অনুশীলন
ফ্যাশনও পরিবেশ ধ্বংসের কারণ হতে পারে। পরনের বসনখানা কতটা পরিবেশবান্ধব কিংবা পরিবেশবান্ধব প্রক্রিয়ায় তৈরি, তা আমাদের বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই অজানা থাকে। তবে এটি সাধারণ মানুষের দেখার বিষয়ও নয়। দেখবে প্রস্তুতকারক, সরকার, বিভিন্ন অডিট ফার্ম। কিন্তু আমাদের যে সচেতন হতে হবে না, তা নয়। বলা হচ্ছে, পরিবেশ রক্ষায় সাসটেইনেবল ফ্যাশন পরিবেশ বাঁচাতে ব্যাপক ভূমিকা রাখে। আবার ঠিক বিপরীত অনুশীলনে পরিবেশ হয় ধ্বংস। বিশ্বজুড়ে তাই এ নিয়ে চলছে বিচিত্রমুখী তৎপরতা। প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশ এর কোন পর্যায়ে রয়েছে?
সাসটেইনেবল ফ্যাশন কী
‘সাসটেইনেবল ফ্যাশন’ টার্মটি শুনে মনে হতে পারে, অনেক দিন টিকবে এমন জামাকাপড়ের ধারণা থেকে এর উদ্ভব। আসলে, এটি একটি প্রক্রিয়া, যা পরিবেশবান্ধব, সমাজনিষ্ঠ ও ন্যায়সম্মত ফ্যাশন প্রডাক্ট তৈরির কাঁচামাল ব্যবহার করে এবং একই সঙ্গে তা তৈরির প্রক্রিয়ায় এসবের অনুশীলন করে। যেমন অর্গানিক প্রসেসে ও অর্গানিক র ম্যাটেরিয়াল ব্যবহার করে কোনো পোশাক তৈরি করা। পানির যথাসম্ভব কম ব্যবহার এবং তা পুনর্ব্যবহার করাও এই প্রক্রিয়ার অংশ। সাসটেইনেবল কিছু সাধারণ চর্চা নিয়ে আলোকপাত করা যাক-
রিসাইক্লিং
পরিত্যক্ত বা পুরোনো দ্রব্য কাজে লাগিয়ে নতুন ও ব্যবহারযোগ্য জিনিসপত্তর তৈরি করাই রিসাইক্লিং। রিসাইকেল অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে মঙ্গলজনক প্রভাব বিস্তার করে। একইভাবে পরিবেশদূষণ, পানির অপচয় রোধ ও ক্ষতিকর পরিস্থিতি থেকে রক্ষা করে। উদাহরণ হিসেবে বেঁচে যাওয়া টুকরো কাপড় থেকে বানানো যেতে পারে হাতব্যাগ, শপিং ব্যাগসহ অন্যান্য দৈনন্দিন অনুষঙ্গ।
আপসাইক্লিং
একধরনের রিসাইক্লিং। কিন্তু এখানে প্রডাক্টের সরাসরি পুনর্ব্যবহার ঘটে। ব্যবহৃত পোশাক আগের চেয়ে ভালো মানের করে তোলা এবং নতুনভাবে ব্যবহার করাই সাইক্লিং। এখান থেকেই বের হতে পারে মূল্যবান ফ্যাশন ভাবনা ও সৃষ্টিশীল ডিজাইন। উন্নত বিশ্বে যেমন এই চর্চা বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে। যেমন ডেনিমের ব্যবহার। হতে পারে ফিউশন ডিজাইন। তবে তা অবশ্যই নতুন পোশাকের স্তরে উন্নীত হতে হবে। অনেকের ধারণা, এমন আপসাইক্লিংয়ের জন্য দামি যন্ত্রপাতি প্রয়োজন। আসলে কি তাই? মোটেই নয়। হ্যাঁ, মেশিনের কিছু আপসাইক্লিং হয় জমকালো পোশাক তৈরির কাজে। কিন্তু প্রতিদিন এমন পরিধেয়র প্রয়োজন নেই। প্রয়োজন একটু গন্ডির বাইরে চিন্তা করা, পুরোনোকে নতুন করে দেখতে শেখা। যেমন ব্যবহৃত ডেনিম প্যান্ট দিয়ে নতুন ব্যাগ বানানো। এমনকি বড়দের ব্যবহৃত শার্ট বা টি-শার্টে ছোটদের জামা তৈরি হতে পারে। তবে আপসাইক্লিংয়ের শ্রেষ্ঠ উদাহরণ সম্ভবত আমাদের কাঁথা, বিশেষত নকশিকাঁথা।
ক্ষতিকর উপাদানের ব্যবহার কমানো
এই রঙ আসলে কিসের? কীভাবে আসে? এই রঙে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মেশানো হয় বিভিন্ন রাসায়নিক উপাদান। কাজ শেষে যেসব ফেলা হয় নদী, খাল, বিল কিংবা ফাঁকা জায়গায়। ফলে সরাসরি মাটি ও পানি দূষিত হয়। সারা বিশ্ব এখন কেমিক্যালের এই ব্যবহার নিয়ে উদ্বিগ্ন। বিভিন্ন দেশে নেওয়া হচ্ছে নানান উদ্যোগ। ক্ষতিকর কেমিক্যাল ব্যবহার কমানোর পরিচিত একটি উপায় হচ্ছে অর্গানিক ডাইয়িং এজেন্টের ব্যবহার। তা হতে পারে পরিত্যক্ত প্রাকৃতিক জিনিস থেকেই। যেমন ফেলে দেওয়া পেঁয়াজের খোসা বা বিয়ের ফুল দিয়ে তৈরি হতে পারে সুন্দর রঙ, যা কাপড় ডাইংয়ে ব্যবহার করা সম্ভব। বিভিন্ন গাছের ফল, যেসব খাওয়া যায় না, এমনিতেই ঝরে যায়- সেগুলো থেকে রঙ তৈরি হতে পারে।
পানির সঠিক ব্যবহার
সাসটেইনেবল ফ্যাশনে এটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, পৃথিবীজুড়ে ব্যবহার্য ও পানের উপযোগী পানি কমছেই। কটন প্রসেস বা ডাইং কিংবা ওয়াশিংয়ে যত কম পানি ব্যবহার করা যায়, পরিবেশ এবং আমাদের জন্য তত ভালো। উন্নত বিশ্বে ব্যবহৃত পানিকে টয়লেটের ফ্ল্যাশ বা অন্য কাজে লাগাতে দেখা যায়।
এথিক্যাল স্পেন্ড
নৈতিক, মানবিক ও সামাজিক মূল্যবোধের দিক থেকে কল্যাণকর তৎপরতা সাসটেইনেবল ফ্যাশনের অংশ। যেমন মুনাফার একাংশ দিয়ে গাছ লাগানো, গ্রিন অফিস ও ফ্যাক্টরি গড়ে তোলা, পরিবেশ উন্নয়নের জন্য সহায়তা ইত্যাদি।
স্বচ্ছতা
এই যুগে এসে সাধারণ মানুষ সর্বদা বিভ্রান্ত থাকে। অনেক সময় আসল জিনিস সম্পর্কেও দ্বিধাদ্বন্দ্ব থাকে এবং প্রতারিত হওয়ার আশঙ্কা কাজ করে। তাই নিজের ব্যবসা এবং প্রডাক্টের ব্যাপারে ক্রেতাদের স্বচ্ছ ধারণার আওতায় আনাও সাসটেইনেবল ফ্যাশনের দায়বদ্ধতার একটি দিক।
এই চর্চা বাড়ছে না কমছে
সম্প্রতি জনপ্রিয় মার্কিন ম্যাগাজিন ফোর্বসে প্রকাশিত এক ফিচারে বলা হয়েছে, এই চর্চা কমছে। গত ১৯ মে প্রকাশিত ক্যালিগ মুরের লেখা নিবন্ধে গবেষণা-পরবর্তী একটি রিপোর্টের ভিত্তিতে এই তথ্য দেওয়া হয়েছে। বোস্টন কনসাল্টিং গ্রুপকে সঙ্গে নিয়ে গ্লোবাল ফ্যাশন অ্যাজেন্ডা ও সাসটেইনেবল অ্যাপারেল কোয়ালিশন রিপোর্টটি তৈরি করেছে। যেখানে ফ্যাশন প্রতিষ্ঠানগুলোকে যাচাইয়ের জন্য পালস ইনডেক্স নামের স্কোরিং সিস্টেম ব্যবহৃত হয়েছে, যা সাসটেইনেবিলিটির টার্গেট বাস্তবায়নে কারা কতটা সক্রিয় তা নির্ণয় করে। গবেষণায় এমনও দেখা গেছে, কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান ২০১৭ সালে তার স্কোরবোর্ডে ছয় পয়েন্ট যোগ করতে পারলেও তা ২০১৮ তে নেমে দাঁড়িয়েছে মাত্র চারে।
অন্যদিকে, অধিকাংশ গবেষণা বলছে ফ্যাশনে সাসটেইনেবিলিটি চর্চায় মানুষ আগের থেকে অনেক সচেতন। নামী প্রতিষ্ঠানগুলোর ওয়েবসাইটে ঢুঁ মারলেও একই বার্তা পাওয়া যায়। যেখানে পানির অপচয়রোধের কন্টেন্ট দেখানো হচ্ছে, ছবি ও ভিডিও রয়েছে অজস্র। এসবে গোপনীয়তাও রয়েছে। তবে সমগ্র বিশ্বে ব্যাপক হারে বেড়েছে আপসাইক্লিং ফ্যাশন চর্চা। তবু সার্বিক অগ্রগতি সারা বিশ্বেই ঝাপসা এখনো।
এবার আসা যাক এই অনুশীলনের দায় এড়ানোর প্রসঙ্গে। চীনে গার্মেন্ট ফ্যাক্টরির সংখ্যা কমছে দিন দিন। প্রধান কারণ— নিজেদের পরিবেশে আঁচড় লাগতে না দেওয়া। এই সুযোগে ফ্যাক্টরি বাড়ছে আমাদের মতো গরিব দেশে। তাতে বাংলাদেশই এগিয়ে। শুধু চীন নয়, অন্য অনেক দেশই এখন ঝামেলা আমাদের কাঁধে দিতে নিজেদের অর্থায়নে ফ্যাক্টরি করছে বাংলাদেশে। যেমন হোপ লুন, শান্তা।
বাংলাদেশে সাসটেইনেবিলিটি চর্চা
আমাদের দেশে অনেক গোল্ড সার্টিফিকেট প্রাপ্ত ফ্যাক্টরি আছে, যেগুলো সাসটেইনেবল ফ্যাশন চর্চা করে এই স্বীকৃতি অর্জন করেছে। তবে অডিট বা অন্য ব্যাপারে একদম যে ফোকর নেই, তা নিশ্চিত করে বলা কঠিন। একটা প্রতিষ্ঠান শতভাগ সাসটেইনেবল চর্চায় আছে কি না, তা যাচাই করতে দরকার পুরোপুরি নজরদারি, যা কখনোই সম্ভব নয়। কিন্তু চর্চায় না থাকলে সময়মতো ধরাও খেতে হয়। তাই যাদের এই সম্মাননা দেওয়া হয়েছে, তারা এযাত্রায় সাধু। অন্যদিকে, বাকি ফ্যাক্টরির কথা অফিশিয়ালিই বলা আছে যে এসবে সাসটেইনেবল প্র্যাকটিস নেই। তবে বায়ারদেরও আছে প্রডাক্টের সাসটেইনেবিলিটি ঠিকঠাকভাবে পরীক্ষা করে নেওয়ার দায়। সেখানে কোনো সময় থার্ড পার্টি অডিট করে, কোনো সময় নিজেদের এমপ্লয়ি চেক করে। তাতে প্রডাক্ট যে একেবারেই সাসটেইনেবল ফ্যাশন না মেনে ডিসপাসড হয়, তা মোটেই নয়। কিন্তু পানির অপচয় রোধ বা ক্ষতিকর বর্জ্য অপসারণে অনেক ফ্যাক্টরিই সচেতন নয়, তা নিশ্চিত হয়েই বলা যায়। কীভাবে? শিল্পকারখানা এলাকার নদী-খাল-বিল এসবের দিকে তাকালেই সব উত্তর বেরিয়ে আসে। তবে কিছু ফ্যাক্টরিতে পানির পুনর্ব্যবহারও হয়, আবার কোথাও কোথাও ব্যবহৃত ডাইংয়ের তরল টয়লেট বা অন্যত্র ব্যবহৃত হতেও দেখা যায়। এভাবেই ভালো-মন্দ মিলিয়ে চলছে আমাদের রপ্তানিনির্ভর পোশাকশিল্প।
অন্যদিকে, হাতে গোনা দু-একটা প্রতিষ্ঠান বাদে, আর কোথাও এসবের নামগন্ধ নেই। তবে এই উদ্যোগ শুরু করতে তাদের বড় কোনো সমস্যায় পড়তে হয় না। বিভিন্ন উৎসব সামনে রেখে তারা নিতে পারে এসব উদ্যোগ। কারণ, ঈদ, পূজা কিংবা বৈশাখের মতো উৎসবে বিশাল পরিমাণে কেনাবেচা হয়। তাই এভাবে ছোট ছোট করে আগানো সমগ্র ইন্ডাস্ট্রির জন্যও আরামের হবে।
সাসটেইনেবল ফ্যাশন প্র্যাকটিস কয়েক বছর আগে বেশ সাড়া ফেলে শুরু হয়েছিল। কয়েক বছর যেতেই শিথিল হয়ে গেল সব তৎপরতা। তবে কি চর্চার সঠিক পদ্ধতি এখনো খুঁজে পাননি অভিজ্ঞরা? নাকি উন্নত বিশ্বের দায় এড়ানোর ঘটনাই গ্লোবাল সিস্টেম? এটা তো সত্য, বৈশ্বিক তাপমাত্রা বাড়ছে, খাওয়ার পানি কমছে, খনিজ দ্রব্য কমছে, বাতাসে মিশ্রিত হচ্ছে ক্ষতিকর গ্যাস, কমছে অক্সিজেন, ভেঙে যাচ্ছে ওজোন স্তর, হচ্ছে অ্যাসিড বৃষ্টি। সময় যে আর নেই!
আব্দুল্লাহ আল-কেমি
মডেল: পলাশ ও মৌসুম
মেকওভার: পারসোনা
ওয়্যারড্রোব: আশ্রয় ইনডিজেনাস ক্রাফট
ছবি: সৈয়দ অয়ন