skip to Main Content

ফিচার I করপোরেট কমিউনিকেশন

করপোরেট কালচারের আবশ্যকীয় অংশ করপোরেট ভাষা। বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোর অভ্যন্তরীণ ও পারস্পরিক যোগাযোগ এর ওপরই বর্তায়। লিখেছেন আফতাব মাহমুদ খুরশিদ

‘সাঁইত্রিশ মাসে উনত্রিশ হাজার ছিয়াশি একক বার্লি’—কুশিম।
উপরের বাক্য থেকে কি কিছু বোঝা গেল? এর অর্থ ‘সাঁইত্রিশ মাসে মোট উনত্রিশ হাজার ছিয়াশি বস্তা বার্লি রাজার সংগ্রহশালায় জমা হয়েছে।’ যাতে স্বাক্ষর করেছেন ‘কুশিম’। পাঁচ হাজার বছর আগে উরুক শহরের একজন অফিস কর্মকর্তা মাটির ফলকে এই বাক্য লিখেছিলেন। সেই কর্মকর্তার নাম অথবা পদবি ছিল কুশিম। ইতিহাসে পাওয়া মানুষের লিপিকর্মের প্রথম নিদর্শন এটি, যা কোনো দার্শনিকের নয়। সেটা ছিল একটি ব্যবসায়িক নথি, কর আদায়সংক্রান্ত তথ্য, মোট ঋণের হিসাবসংক্রান্ত ভাষা তথা ‘করপোরেট ল্যাঙ্গুয়েজ’। সুতরাং, করপোরেট ল্যাঙ্গুয়েজের ঐতিহাসিক মর্যাদা আছে। যদিও তখন করপোরেট ভাষা ছিল কেবল হিসাব সংরক্ষণের উপায় বা মাধ্যম। এখন তা ‘প্রাতিষ্ঠানিক ভাষা’।
বর্তমানে প্রতিটি করপোরেট প্রতিষ্ঠানেরই রয়েছে নিজস্ব ভাষা। স্বাস্থ্যসেবা, অর্থনীতি কিংবা ব্যবসা—প্রতিটি বিভাগেরই আছে আলাদা ভাষা। কোনো করপোরেট কালচার থাকলে এর অংশ হিসেবে তেমন একটি ভাষা অনিবার্য—লিখিত ও মৌখিক। শারীরিক অভিব্যক্তিও করপোরেট ভাষার বাইরে নয়।
বাড়িতে বা পথে যে ভাষায় আমরা কথা বলি, পেশাদার দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে করপোরেট অফিসে তা প্রয়োগ না করাই ভালো। সেখানে ফরমাল ল্যাঙ্গুয়েজ ব্যবহারই শ্রেয়। তা হতে হয় প্রতিষ্ঠানের কর্মপরিবেশ অনুযায়ী। কিন্তু আমরা অনেকেই এ বিষয়ে গুরুত্ব দিই না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে প্রাত্যহিক ভাষাই ব্যবহার করি। তবে এমন অফিসও আছে, যেখানে পেশাগত প্রয়োজন মেটাতে ক্যাজুয়াল ল্যাঙ্গুয়েজ ব্যবহৃত হয়। যেমন ক্রিয়েটিভ সেক্টরে। করপোরেটে সেই সুযোগ নেই। যেখানে প্রতিনিয়ত বড় বড় লেনদেন হয়, ক্লায়েন্টের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হয়। ফলে সেখানকার ভাষা করপোরেট হওয়াই বাঞ্ছনীয়। বিশেষ করে লিখিত ও মৌখিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে। কাগজে হোক কিংবা ই-মেইলে। বর্তমানে এসএমএস, হোয়াটসঅ্যাপসহ অন্যান্য প্রযুক্তি মাধ্যমের প্রচলন ঘটলেও করপোরেট ল্যাঙ্গুয়েজের বেসিক স্ট্রাকচার বা মৌলিক কাঠামোয় পরিবর্তন হয়নি।
মূলত ইংরেজি ভাষাতেই ই-মেইলের আদান-প্রদান হয়। করপোরেট ভাষার বাইরে গিয়ে এসব ই-মেইল লেনদেন হলে অফিসের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হতে পারে। অন্যদিকে এমনটি পেশাদারত্বের পরিচয় বহন করে না। একই অফিস বা ভিন্ন ভিন্ন অফিসের দুজন কর্মীর সঙ্গে যতই ইনফরমাল যোগাযোগ থাকুক, তারা যখন কোনো প্রতিষ্ঠানের হয়ে যোগাযোগ করবে, তখন সেই ভাষা করপোরেট হওয়া চাই।
একসময় ই-মেইল ছিল না। এখন ই-মেইলের পাশাপাশি এসএমএসও এসেছে। আগেই বলা হয়েছে, তাতে করপোরেট ভাষার কোনো পরিবর্তন হয়নি। শুধু চিঠি আদান-প্রদানের মাধ্যমটা বদলে গেছে। তবে ই-মেইল আর এসএমএস এক বিষয় নয়। ই-মেইলে একটা চিঠি লিখলে তা ফরমালভাবে লেখাই করপোরেট কর্তব্য। ‘টু’ যাকে দিতে হবে, তাকে টু-তেই রাখা উচিত। যারা সেই ই-মেইলের সঙ্গে সম্পৃক্ত নন, তাদের সিসিতে রাখা নিষ্প্রয়োজন। সাবজেক্ট লাইনে সঠিক ও পূর্ণাঙ্গভাবে সাবজেক্ট লেখা ভালো। ই-মেইলে যদি কারও নাম ব্যবহার করা হয়, সেই ব্যক্তিকে অবশ্যই সিসিতে রাখা উচিত। ই-মেইলের মাধ্যমে যে কমন ম্যাসেজটি সবাইকে পাঠানো হয়েছে, সেটির রিপ্লাই ‘অল’ করার দরকার নেই। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের রিপ্লাই করলেই চলে।
আজকাল অনেক অফিসই হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ তৈরি করে। সেখানে একেকজনের শব্দচয়ন ও ভাষা একেক রকম হতে পারে। একটি শব্দের কারণেও কিন্তু একটি বার্তার অর্থ বদলে যেতে পারে। ভুল হওয়ার আশঙ্কাও থাকে। তাই হোয়াটসঅ্যাপে কী লেখা হয়েছে, পাঠানোর আগে আরেকবার পড়ে নেওয়া উচিত। নয়তো হিতে বিপরীত হতে পারে। তাই করপোরেট ল্যাঙ্গুয়েজ কিংবা বিজনেস কমিউনিকেশন বিষয়ে ধারণা নেওয়া প্রয়োজন। কারণ, এগুলোর সঙ্গে যোগ রয়েছে চিঠি, করসপন্ডিং, কমিউনিকেশন, মেমো, প্রোপোজাল রিপোর্ট, মিটিং মিনিটস ইত্যাদি লেখা। প্রতিটিই ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ।
আজকাল অনেকেই উদ্যোক্তা হচ্ছেন। তাদের বেশির ভাগ ক্ষুদ্র ও মাঝারি। আবার অনেকেই উঠে আসছেন স্টার্টআপ হিসেবে। অন্যদিকে, অনেকেরই ব্যবসাসংক্রান্ত অভিজ্ঞতা থাকে না। পেশাদারি বোধও থাকে না। এ জন্য তারা করপোরেট ল্যাঙ্গুয়েজ-বিষয়ক বই পড়ে অথবা কোর্স করে নিজেদের উপযুক্ত করে তুলতে পারেন।
পারিবারিকভাবে যারা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন, তাদেরও উচিত করপোরেট ল্যাঙ্গুয়েজ আয়ত্ত করা। কেননা, তারা এই কালচারের মধ্যেই আছেন। অফিসের বাইরে কাউকে চাচা বা মামা ডাকা যায়, কিন্তু সেভাবেই তাকে সম্বোধন করা উচিত। একই ব্যক্তি যখন অফিসের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, তখন তিনি এমডি হলে এমডি বা ডিরেক্টর হলে ডিরেক্টরই। কোনো চিঠি বা বার্তায় চাচা বা মামা লেখা অশোভন।
পেশাদারির চর্চা করলে ডাউন দ্য লাইনে যারা আছেন, তারাও করপোরেট ল্যাঙ্গুয়েজ শিখতে পারবেন। বস যদি সঠিকভাবে লেখেন, তাহলে অধস্তনদের শেখার সুযোগ তৈরি হয়। কীভাবে সম্বোধন করতে হয়, কার বরাবরে লিখতে হয়, কাকে ‘স্যার’ বলতে হয়, কাকে বলতে হয় না—এগুলো শিখতে পারবে। আমাদের মধ্যে অনেকেই একটা সাধারণ ভুল করে থাকেন—আগে ব্যক্তির নাম লিখে তারপর ‘স্যার’ লেখেন। এটা ঠিক নয়। নাম না লিখে ‘ডিয়ার স্যার’ লেখা ভালো। স্যার তখনই ব্যবহার করতে হবে, যার টাইটেল স্যার। অর্থাৎ, যিনি স্যার উপাধি পেয়েছেন। তার নামের আগে স্যার হবে। যদি কোনো প্রটোকল থাকে, সেই ক্ষেত্রে স্যার ব্যবহার করা যেতে পারে। অন্যথায় নামের পরে স্যার লেখা ঠিক নয়।
ই-মেইল কিংবা চিঠির নিচে লেখার ব্যাপারে, যদি প্রাপক অপরিচিত হন, তাহলে ‘ইয়োর ফেইথফুলি’ লিখতে পারেন। ‘সিনসিয়ারলি’ লিখতে হয় আপনি যার অনুগত তার ক্ষেত্রে। যখন কোনো সাফল্য বা শুভেচ্ছা জানিয়ে কাউকে ই-মেইল করবেন, তখন ‘ওয়ার্ম রিগার্ডস’ লিখতে পারেন। কোনো কোম্পানির সঙ্গে রিলেশনশিপে যাওয়ার ক্ষেত্রেও ওয়ার্ম রিগার্ডস লিখতে পারেন। প্রতিষ্ঠান বুঝে কোথাও সালাম দিতে হবে, কোথাও গ্রিটিংস বলতে হবে, কোথাও গুডমর্নিং বলতে হবে। এমনও হয়ে থাকে—অনেকে অভ্যন্তরীণ সহকর্মীকে মেইল দেওয়ার ক্ষেত্রে প্রতি ই-মেইলে ‘গুড ডে’ লেখেন। এর প্রয়োজন নেই। তার কাছে মূল বার্তাটি পৌঁছে দেওয়াই জরুরি। তবে বিশেষ দিনে, যেমন কোনো সহকর্মীর জন্মদিনে তাকে শুভেচ্ছা জানানো যেতেই পারে।
প্রতিটি অফিসের কিছু ফাংশনাল টার্মিনোলজি থাকে। তাই করপোরেট ল্যাঙ্গুয়েজ কোম্পানি ভেদে ভিন্ন। যেমন মেডিকেলের কিছু টার্ম আছে। সেটাকে করপোরেট ল্যাঙ্গুয়েজের মধ্যে স্থাপন করতে হয়। একে টেকনিক্যাল ল্যাঙ্গুয়েজও বলা হয়ে থাকে। কিন্তু মূল কাঠামোটা থাকতে হবে প্রফেশনাল। এ কাজের জন্য প্রতিষ্ঠানে করপোরেট অ্যাফেয়ার্স ডিপার্টমেন্ট অথবা করপোরেট ব্র্যান্ড কমিউনিকেশন ডিপার্টমেন্ট থাকে। এখানে যারা কাজ করেন, তারা অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক যোগাযোগের ই-মেইল বা চিঠি চেক করে দেন। এর পাশাপাশি কিছু লিগ্যাল টার্ম থাকে। ওই টার্মগুলো তারা দেখে দেন। পুরো কাজটি সুপারভাইজ করে ব্র্যান্ড কমিউনিকেশন। তবে মানুষ তো ভুলের ঊর্ধ্বে নয়। যদি ভুল বার্তা চলে যায়, তাহলে বার্তা প্রদানকারী প্রথমে একটা অ্যাপোলজি চেয়ে মেইল করতে পারেন। ‘প্লিজ, ইগনোর দিস ম্যাসেজ’-এ রকম একটা নোট দিয়ে তিনি আরেকটি মেইল করতে পারেন। আজকাল টেকনিক্যালি মেইল ব্যাক করা যায়। তিনি চাইলে মেইল ফিরিয়ে নিতে পারেন।
ভাষা পরিবর্তনশীল। তবে ভাষা বদলে যাচ্ছে বলে যদি আমরা ইনফরমাল হয়ে যাই, তাহলে করপোরেট কালচার থাকবে না।
করপোরেট ল্যাঙ্গুয়েজ ব্যাকরণসম্মত হওয়া দরকার। ব্যাকরণগত ভুল থাকলে যত্নের অভাব ও সিরিয়াসনেসের ঘাটতি প্রকাশ পায়। করপোরেট ল্যাঙ্গুয়েজ চর্চার বিষয়। এটা শিখে নিতে হয়। বড় বড় কোম্পানির নিজস্ব লেখার স্টাইল পর্যন্ত থাকে। গাইডলাইন থাকে। কীভাবে এসএমএস লিখতে হবে, মেইল, ফ্যাক্স, মেমো, সংবাদ বিজ্ঞপ্তি ও মিটিং মিনিট লিখতে হবে, সেই বিষয়ে গাইডলাইন থাকে। ওই স্টাইল কোম্পানিকে রিপ্রেজেন্ট করে।
ব্যবসা সফল করতে হলে করপোরেট ল্যাঙ্গুয়েজের ওপর গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। কাস্টমার বা অপর প্রান্তের পার্টনারের আত্মবিশ্বাস বাড়ানোর জন্য এটি দরকার। ভাষা প্রয়োগের সঙ্গে মেধার সম্পর্ক রয়েছে। বিশ্বব্যাপী ব্যবসায়িক যোগাযোগে অ্যাডভান্সড করপোরেট ল্যাঙ্গুয়েজ খুব জরুরি। তাই কর্মীদের মধ্য থেকে উপযুক্ত মেধা চিহ্নিত করে ভাষাবিষয়ক উন্নয়নের কাজে তাদের নিয়মিত করা যেতে পারে। সে জন্য অফিসে এমন একটি ডিপার্টমেন্ট থাকা প্রয়োজন। মনে রাখতে হবে, প্রতিটি করপোরেটই ‘কোম্পানি’; কিন্তু সব কোম্পানি ‘করপোরেট’ নয়। এখানে করপোরেট কালচার বিশেষ ভূমিকা রাখে।

ছবি: ইন্টারনেট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top