skip to Main Content

ফিচার I নির্ভার জীবনের গল্প

শীতাতপনিয়ন্ত্রিত রুমে বসে কাজ, বেলা শেষে আড্ডা, মাস শেষে মোটা অঙ্কের বেতন। এই করপোরেট জগতে যারা আছেন, তাদেরও সামলাতে হয় মানসিক চাপ। কীভাবে? লিখেছেন রুম্পা সৈয়দা ফারজানা জামান

বাইরে ফিটফাট, ভেতর সদরঘাট—হেসে জানায় ক্রিয়েটিভ করপোরেট তরুণ অপূর্ব। কাজের কারণে তাকে প্রায়ই যেতে হয় ঢাকার বাইরে। করপোরেট এবং শিক্ষার এক অদ্ভুত মিশেলে তার চাকরি। কাজটা মজার, কিন্তু ক্লান্তিরও বটে। শিশুরা যখন হেসে ওঠে, তখন যেমন ভালো লাগে, তেমনি দিনরাত এক করে ছুটে চলার ক্লান্তিটাও চেপে বসে দেহমনে। হাঁপিয়ে ওঠে অপূর্ব। কাজের ক্লান্তিতে নয়, ছুটে চলার ক্লান্তিই সেখানে মূল। হয়তো চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে ১৮ ঘণ্টাই কম্পিউটারের সামনে। যখন কম্পিউটার নেই, তখন আছে স্মার্টফোনে মেইল চেক। এমন জীবনে ভালো লাগার কাজেও স্ট্রেস তো থাকবেই।
এই স্ট্রেসের কারণে অতি অল্প বয়সেও কেউ কেউ হৃদ্রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। কারও কারও স্ট্রোক বা মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হচ্ছে। যাকে সাদা চোখে সবাই নিছক দৈহিক ভারসাম্যহীনতা ভাবছে, সেটাই হয়তো মানসিক অবসাদের মূল কারণ। বিশেষত করপোরেট জীবনের নানামুখী চাপ, কখনো কখনো বহির্মুখী জীবনের অভ্যস্ততাও এই স্ট্রেসের কারণ হয়ে যায়। আবার দীর্ঘদিন প্রাত্যহিক যান্ত্রিকতাজনিত অবসাদে জীবনের ছন্দ হারায় অনেকেই। গণমাধ্যমকর্মী নাসিমা খন্দকার কথায় কথায় বলেন, প্রতিদিন সকালেই অফিসগামী হাজার হাজার তরুণের চোখেমুখে হতাশা জেগে ওঠে। যেন না পারতেই এই যাওয়া।
শহরের কাঠামো বা শহরের ছন্দবিহীন চলাটাও কিন্তু করপোরেটদের জীবনে অবসাদ টেনে আনে। সকালে উঠে অফিসে যাবার তাড়া—রাস্তায় কোথাও আটকে থাকা, রাত হলে ফিরে আসার নিরাপত্তাহীনতার টেনশন—সব মিলিয়ে আসলেই কি ভালো আছে শীতাতপনিয়ন্ত্রিত রুমে কাজ করা মানুষগুলো? এই প্রশ্নের উত্তরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল ইউনিভার্সিটির সাইকিয়াট্রি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সিফাত ই সৈয়দ বলেন, কোনো মানসিক চাপের জীবনই ভালো নয়, সেটা যে কাজেই হোক। এমনকি যে নারী সারা দিন ঘরের কাজ করেন, তিনিও কিন্তু কোনো না কোনোভাবে মানসিক অবসাদে আক্রান্ত। তাই বৈচিত্র্য আনতে হবে। কাজ ছাড়া যেহেতু থাকার সুযোগ নেই আধুনিক জীবনে, শান্তির কাজের মধ্যেই আনন্দের আয়োজন করতে হবে। এবং অবশ্যই আমাদের সবাইকে মানসিক ব্যাপারটা মাথায় রাখতে হবে। হাতে-পায়ে ব্যথা লাগলে যেমন ওষুধের প্রয়োজন, মনের অসুখে অনীহা করা তেমনই বোকামি। এ কারণেই সংগীতশিল্পী আরমিন মুসা নিয়ম করে তার কর্মস্থলে যোগব্যায়ামের আয়োজন করেন। যেখানে তার সহকর্মীসহ বন্ধু, পরিচিতরাও সপ্তাহে এক দিন নিজেদের স্ট্রেস দূর করতে অংশ নেন। ইন্টারন্যাশনাল স্ট্রেস ম্যানেজমেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের মতে, যে কেউ কাজে খুব ভালো দক্ষতা দেখাতে পারেন, যদি কাজের ফাঁকে ফাঁকে ১০-১৫ মিনিটের বিরতি নেওয়ার চর্চাটা সম্ভব হয়।
আর সময় পেলে যোগব্যায়ামের অভ্যাসটা করা যেতেই পারে। কারণ, এর উপকারিতা লিখে শেষ করা যাবে না। যোগব্যায়াম থেকে যে তিনটি শারীরিক উপকারিতা পাওয়া যায় সেগুলো হলো—
 মেরুদন্ডের সুরক্ষা
 ব্যথা উপশম
 হৃদযন্ত্রের সুস্থতা
বেশির ভাগ যোগব্যায়ামেই পশ্চার তথা শারীরিক গঠন ঠিক রাখার অনুশীলন চলে। ফলে মেরুদন্ড থাকে সোজা। ব্যাংকার টুম্পা সানজিদা জানান, আমি চেষ্টা করি সিটে সোজা হয়ে বসার। কিন্তু কেমন করে যে আমিও কুঁজো হয়ে যাই একসময়।
দীর্ঘক্ষণ চেয়ারে বসে থাকার কারণে বেশির ভাগ ডেস্ক জব কর্মীর একটা সময় পরে ব্যাকপেইন হয় বলে জানান ডা. সিফাত।
ঢাকার কিছু জনপ্রিয় ইয়োগা সেন্টার আছে। যেমন ইন্দিরা গান্ধী কালচারাল সেন্টার, ইয়োগানিকা, এভারগ্রিন ইয়োগা ট্রেনিং অ্যান্ড রিসার্চ সেন্টার, জয়সান ইয়োগা অ্যান্ড হেলথ স্কুল, গোল্ডেন লাইফ ইয়োগা সেন্টার ইত্যাদি।
যোগব্যায়ামের কারণে কিছুটা সময় হলেও নিজের ভুবনে ডুবে থাকা যায়। ফলে অনেকের মানসিক চাপটাও কমে যায়। নানা রকমের ভঙ্গি রপ্ত করতে হয়। তাই শরীরে মেদ ঝরে গিয়ে ফিরে আসে ছন্দ। সব মিলিয়ে করপোরেটদের জন্য যোগব্যায়াম হতে পারে দৈহিক ও মানসিক প্রশান্তির কার্যকর উপায়।
তবে শুধু যে এতেই সব সমাধান, তা নয়। পাশাপাশি আহার হতে হবে স্বাস্থ্যকর। ডায়েট অ্যান্ড ফিটনেসের অন্যতম স্বত্বাধিকারী আদিবা ফারজিন জানান, করপোরেটদের একটা বড় অভ্যাস হলো জাঙ্ক ফুডে ক্ষুধা মিটানো। সময়ের অভাবেই হোক বা অন্য যেকোনো কারণে, কর্মজীবীরা পছন্দ করেন বাইরের খাবার খেয়ে ঘরের রান্নার ঝামেলা এড়াতে। কিন্তু এতে করে জাঙ্ক ফুডের প্রতি আসক্তি এবং তা থেকে বাড়তি মেদ শরীরকে ক্রমশ ভারী করে। তাতে হতাশা আরও বেড়ে যায়। যেহেতু এখন ফিট থাকার ট্রেন্ড এবং তা অনুসরণ করা জরুরিও বটে, তাই জাঙ্ক ফুড পরিহার করতে হবে এখনি। স্বাস্থ্যকর খাবার, ফল, ফলের রস, স্যালাড, বাদাম, দুধ, ডিম ডায়েট মেনে খেতে হবে। মনে রাখতে হবে, যার যার ডায়েট তার তার। আরেকজনের জন্য নির্ধারিত ডায়েটে হিতে বিপরীত হতে পারে।
বিজ্ঞাপনী সংস্থার কর্মকর্তা আয়শা আড্ডায় বা অনুষ্ঠানে পেটপূজা করেন বটে, কিন্তু দৈনন্দিন জীবনে তার আহার খুবই সীমিত। সপ্তাহে অন্তত একবার সাঁতার কাটেন। আর অফিসে অনেক সময় থাকতে হয় বলে সঙ্গে এক জোড়া বাড়তি জুতা আর পোশাক নিয়ে চলেন। অন্তত চল্লিশ মিনিট অফিসের চারপাশে দৌড়ে আসেন তিনি একটু বিরতিতেই। চাঙা হয়ে ফের কাজ করা শুরু করেন।
আয়শার মতো অন্য চাকরিজীবীরাও বিশেষ করে যারা করপোরেট, তারা যোগব্যায়াম ও ডায়েটের পাশাপাশি এইভাবে হালকা শরীরচর্চাও করতে পারেন। আরও কিছু সহজ পন্থা আছে, যেমন ডেস্কে পানি না রেখে প্রতিবার পানি পানের জন্য উঠে যাওয়া, ঘাড়ের ও পিঠের ব্যায়ামের জন্য টান টান করে ১০ থেকে ১৫ মিনিট বসে বড় বড় শ্বাস নেওয়া, চা পানের ছোট্ট বিরতিতে হাসিঠাট্টা করে স্ট্রেস দূর করা। এবং অবশ্যই অফিসে কাউকে শত্রু মনে না করা। কর্মস্থলে প্রফেশনালিজমের মাত্রা ঠিক করতে পারলেই নিজেকে আসলে হালকা মনে হবে। আর না হলে তো জিম আছেই। প্রতিটি এলাকাতে যেমন এখন জিম গড়ে উঠছে, তেমনই অনেক করপোরেট অফিসেও আছে নিজস্ব জিম। কাজের শেষে মাত্র তিরিশ মিনিটের একটা ছোট্ট বিরতি আর শরীরচর্চা মনে ও দেহে আনতে পারে নির্ভার ভাব।
আর করপোরেটদের জন্য যা দরকার তা হলো কথা বলা! স্ট্রেস রিলিফের জন্য নানা রকমের বেসরকারি উদ্যোগ আছে। এগুলোর মধ্যে মনের বন্ধু অন্যতম। এ ছাড়া ডিনেট মানসিক চাপ কমানোর কর্মশালার উদ্যোগ নেয় প্রতিষ্ঠানগুলোতে। এ ছাড়া আরও আছে ইয়েশেম ইকবালের উদ্যোগ—কান পেতে রই। যান্ত্রিকতার যুগে শুধু হাসি নয়, দূরে চলে গেছে কথা বলার মানুষটিও। নানা কারণে এখন অনেকেই নিজের মনের কথা বলতে নারাজ অন্যকে। বিশেষ করে করপোরেট দুনিয়ায় তীব্র প্রতিযোগিতা মনের সঙ্গে মনের দূরত্ব বাড়িয়ে দিয়েছে। তাই কথা বলার জন্য সঙ্গে আছে নানা রকমের হেল্পলাইন। কিন্তু এর থেকেও বেশি দরকার বন্ধুর হাতের স্পর্শ। সময় করে না হয় কম্পিউটার গেম না খেলে একটু আড্ডাই দেওয়া যাক। অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ বলেছেন, ‘পৃথিবীর সকল ভালো আইডিয়া শুরু হয় আড্ডা থেকে।’
এমনও তো হতে পারে, কোনো এক আড্ডা সামনে নিয়ে এল নতুন সম্ভাবনার দ্বার, যেখান থেকে শুরু হবে যেকোনো করপোরেটের নতুন যাত্রা। জীবনের কাছে যে ঋণ জমছে, সেটার না হয় শোধ হোক নতুন উদ্যম দিয়ে। আর যেন জমা না হয় অবসাদ আর ক্লান্তি।

ছবি: ইন্টারনেট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top