এডিটরস কলাম I পৃথিবীকে সবুজ করে তুলি
বিশ্ববাসী বিক্ষুব্ধ, কেননা পৃথিবীর প্রয়োজনীয় অক্সিজেনের ২০ শতাংশ আসে এই অরণ্য থেকে। অধিকন্তু জীববৈচিত্র্যের বিশাল এক ভান্ডার এই বনাঞ্চল, ব্রাজিল ছাড়াও এটি বিস্তৃত কলম্বিয়া, ভেনেজুয়েলা ও বলিভিয়ার ভূখন্ডে। শুষ্ক মৌসুমে সেখানে অগ্নিকান্ডের ঘটনা স্বাভাবিক একটা ব্যাপার, কিন্তু এবার যা ঘটেছে, তা মানবসৃষ্ট এবং খুবই উদ্বেগজনক
আমাজন পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে। পৃথিবীর ফুসফুস হিসেবে পরিচিত এই বনাঞ্চলে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত আগুন লেগেছে ৭৫ হাজার বার, ৪ মাস বাকি থাকতেই বিগত বছরগুলোর রেকর্ড পেরিয়েছে। এ নিয়ে বিশ্ববাসী বিক্ষুব্ধ, কেননা পৃথিবীর প্রয়োজনীয় অক্সিজেনের ২০ শতাংশ আসে এই অরণ্য থেকে। অধিকন্তু জীববৈচিত্র্যের বিশাল এক ভান্ডার এই বনাঞ্চল, ব্রাজিল ছাড়াও এটি বিস্তৃত কলম্বিয়া, ভেনেজুয়েলা ও বলিভিয়ার ভূখন্ডে। শুষ্ক মৌসুমে সেখানে অগ্নিকান্ডের ঘটনা স্বাভাবিক একটা ব্যাপার, কিন্তু এবার যা ঘটেছে, তা মানবসৃষ্ট এবং খুবই উদ্বেগজনক। কেননা, এটি এত ভয়াবহ যে ঘটনাস্থল থেকে ৩ হাজার ২০০ কিলোমিটার দূরের রাজ্য সাও পাওলোর আকাশ ধোঁয়ায় কালো হয়ে গেছে। আটলান্টিকের আকাশেও ধোঁয়ার কুন্ডলী দেখা যাচ্ছে। আরও উদ্বেগের বিষয়, আগুন নিভছে না, বরং দগ্ধ হচ্ছে নতুন নতুন এলাকা। বিপন্ন ও ধ্বংস হচ্ছে নানা প্রজাতির প্রাণী-পশুপাখি; ক্ষতিগ্রস্ত ও নিঃস্ব হচ্ছে দগ্ধ লোকালয়ের অধিবাসীরা। উল্লেখ্য, বিশ্বের সবচেয়ে বড় গ্রীষ্মমন্ডলীয় অরণ্য আমাজনে রয়েছে প্রায় ৩০ লাখ স্বতন্ত্র প্রজাতির গাছপালা ও প্রাণী। প্রতিবছরই বিভিন্ন দেশের বনাঞ্চলে দাবানলের খবর আমরা পাই; কিন্তু এটা একটা রেইন ফরেস্ট, যেখানে গাছপালা একবার ধ্বংস হলে নতুন করে আর জন্মায় না।
কিন্তু কেন এই অগ্নিকান্ড? ব্রাজিলে এর কারণ নিয়ে মোটাদাগে দুটি পক্ষ ইতিমধ্যে তৈরি হয়ে গেছে: সরকার ও এনজিও। উভয়েই একে অন্যের ওপর দোষ চাপিয়ে দিচ্ছে। এনজিওগুলো বলছে, ব্রাজিলের সরকার স্থানীয় কৃষক ও কাঠুরেদের উচ্ছেদ করার জন্য সেখানে আগুন লাগিয়েছে, অন্যদিকে সরকার বলছে, এনজিওগুলোতে অর্থ বরাদ্দ কমিয়ে দেওয়ায় তারাই এই কান্ড ঘটিয়েছে। যারাই দায়ী হোক, এই বিপর্যয় এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ আমাদের নেই। কেননা এতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে বিশ্বপ্রকৃতি। কেউ এর থেকে পরিত্রাণ পাবে না।
বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ও বায়ুমন্ডলে কার্বন বেড়ে যাওয়ায় বিশ্ব যখন বিপন্ন, তখন এই অগ্নিকান্ডকে প্রকৃতি ও প্রাণিজগতের জন্য এযাবৎকালের সবচেয়ে বড় হুমকি হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে। যে আমাজন মিলিয়ন মিলিয়ন টন কার্বন ডাই-অক্সাইড শোষণ করে এসেছে এবং অক্সিজেনের বিপুল জোগান দিয়ে বাঁচিয়ে রেখেছে প্রাণিজগৎ, তা যদি বিপন্ন হয়, এর বিপজ্জনক প্রভাব পড়বে সর্বত্রই। এমনিতেই উন্নয়নের নামে, নতুন শিল্পকারখানা আর আবাসনের অজুহাতে দেশে দেশে বন উজাড় হচ্ছে, বৃক্ষ কর্তনের উৎসব চলছে। কিন্তু কোনো নতুন বন সৃষ্টি করা হচ্ছে না, একটা গাছ কেটে যেখানে অন্তত দুটি লাগানো দরকার—কিছুই আমরা করছি না। মাটি ন্যাড়া করে নানা ধরনের প্রাকৃতিক বিপর্যয় ডেকে আনছি। ভূমিক্ষয়, অকালবন্যা, জীববৈচিত্র্য ধ্বংস, কার্বনের আধিক্য, বায়ুদূষণ—এগুলো তো দেখতেই পাচ্ছি। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে, এসব মোকাবিলার জন্য বিপুল অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে। আমাদের আশঙ্কা, আগামী দিনগুলোতে পরিবেশ বিপর্যয়ের ক্ষতি কাটিয়ে উঠতেই বিশ্বজুড়ে এত ব্যয় বাড়বে, যার প্রভাব আন্তর্জাতিকভাবেই সর্বগ্রাসী হয়ে উঠতে পারে।
আমাজন অরণ্যে এই ভয়াবহ অগ্নিকান্ড বিশ্ববাসীর জন্য একটা বিপৎসংকেত বা সতর্কবার্তা। অধিকন্তু, এই শিক্ষা আমাদের নেওয়া জরুরি যে, কোনো অঞ্চলের প্রকৃতি ধ্বংস কেবল সেখানকার বিপর্যয় ডেকে আনে না, তা সন্নিহিত সব এলাকায় বিপদের কারণ হয়ে ওঠে এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মও এর থেকে রেহাই পায় না। কেননা, গোটা পৃথিবীর বায়ুমন্ডল তো একটাই। প্রত্যেকের জীবন দৃশ্যত যত আলাদা হোক না কেন, আমরা একই বিশ্বপ্রকৃতির অংশ। কেবল কৃক্ষ নয়, যে পাখিটি এর ডালে আশ্রয় নেয়, তার সঙ্গেও আমাদের প্রাণের যোগ আছে। সুতরাং আর বৃক্ষনিধন নয়। একটা গাছ কাটার প্রয়োজনও যদি পড়ে, তার বিপরীতে আমরা যেন কমপক্ষে দুটি গাছ লাগাই। আসুন, পৃথিবীকে সবুজ করে তুলি। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে রক্ষা করি।