ফিচার I করপোরেট যখন ইনফরমাল
করপোরেট জগতের কোথাও কোথাও কাজের ধারা প্রচলিত ছকের বাইরে মানে ইনফরমাল। যেমন আইটি ইন্ডাস্ট্রি, বিজ্ঞাপনী সংস্থা, গণমাধ্যম ইত্যাদি
করপোরেট কালচার বলতেই নির্দিষ্ট ছকে বাঁধা নিয়মনিষ্ঠ কর্মজগতের একটা ছবির সঙ্গে আমরা পরিচিত। কিন্তু গ্লোবালাইজেশনের সূত্রে প্রডাক্ট আর সার্ভিস এখন বহুমাত্রিক হয়ে যাওয়ায় কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির দুনিয়াও আগের মতো পরিচিত ছকে বাঁধা নয়। সে কারণে করপোরেটের জগৎ আজ আর সবক্ষেত্রেই শুধুই পূর্বনির্ধারিত ডিসিপ্লিনের ঘেরাটোপে বন্দি নয়, বরং কোনো কোনো সেক্টরে কিছু কিছু দায়িত্বের ক্ষেত্রে কাজের ধরন হয় সেমিফরমাল অথবা ইনফরমাল। তাদের ড্রেস কোড, ওয়ার্ক টাইম, উপস্থিতি, অফিস রিপোর্টিং ইত্যাদি অনেকাংশে করপোরেটের ধ্রুপদি চেহারার বাইরে। বিশেষত কোনো কোনো ইন্ডাস্ট্রির ক্ষেত্রে করপোরেটের ইনফরমাল ফরমালিটি চোখে পড়ে। অবশ্য ইনফরমালিটি আসলেই বাহ্যত। কিন্তু ভেতরে করপোরেট সুশৃঙ্খলা বিদ্যমান।
আমরা যদি আইটি ইন্ডাস্ট্রির দিকে তাকাই, সেখানে আইটি সলিউশন, সফটওয়্যার প্রোগ্রামিং, সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট, ল্যাঙ্গুয়েজ প্রোগ্রামিংয়ের মতো বিষয়গুলোর ব্যাপারে আমরা সবাই অবগত। আবার প্রায় সব বহুজাতিক কোম্পানিই তাদের কাস্টমার সলিউশন ও মার্কেটিংয়ের ক্ষেত্রে বিভিন্ন আইটি ফার্মের সহায়তা নেয়। এসব ক্ষেত্রেই আইটি ইন্ডাস্ট্রি ফরমাল ও ইনফরমাল—এই দুই ওয়ার্ক কালচারের মধ্য দিয়েই তাদের কার্যকলাপ চালিয়ে যায়। যেমন আইটি ইন্ডাস্ট্রির অনেক ক্ষেত্রেই ওয়ার্ক ফ্রম হোমের সুবিধা পায় কর্মচারীরা। সফটওয়ার সলিউশন ও প্রোগ্রামিংয়ে অনেক সময় কর্মচারীদের অফিসের পাশাপাশি নিজের বাড়িও টেম্পরারি ওয়ার্কস্টেশন। কোম্পানির নিজস্ব ওয়েব প্ল্যাটফর্মে লগ ইন হয়ে কাজ শুরু করার চেক ইন যেমন সম্পাদিত হয়, তেমনই কাজ শেষের চেক আউট হয় ওয়েব প্ল্যাটফর্ম থেকে লগ আউটের মাধ্যমে। এ ক্ষেত্রে কী কাজ হচ্ছে, কতটুকু হচ্ছে, তার হিসাব থেকে যায় ওয়েব প্ল্যাটফর্মে কর্মীর এক্সিস্টিং প্রোফাইলের মধ্যে। ওয়ার্ক ফ্রম হোমের ক্ষেত্রে কর্মীর জন্য বরাদ্দ অফিস পরিষেবার কস্ট কার্টেল হয়ে যায়, যেই সুবিধা প্রতিষ্ঠান ভোগ করে। কিন্তু এটা তখনই সম্ভব, যখন অফিসের প্রশাসনিক বিষয়ের সঙ্গে কর্মীর সম্পর্ক থাকে না এবং বাইরে বাইরে থাকা কর্মীদের মধ্যে ওয়েববেসড ইন্টারনাল কানেকশন সচল থাকে।
এমনিতে এখন প্রায় সব করপোরেট সেক্টরে সপ্তাহান্তে অফিসে ক্যাজুয়াল পোশাক পরা ও ক্যাজুয়াল অফিস কালচার চালু হয়েছে। কিন্তু আইটি ইন্ডাস্ট্রির মধ্যে থাকা কল সেন্টারের কর্মীদের ড্রেস কোড থেকে শুরু করে অফিশিয়াল প্র্যাকটিস অনেকটাই আপাতদৃষ্টিতে ইনফরমাল। ভারতের আইটি ইন্ডাস্ট্রি বেশ কয়েক দশক ধরে খুবই কার্যকর অবস্থায় রয়েছে। ইন্ডিয়ান ইকোনমিতেও এই ইন্ডাস্ট্রির একটা ভালো রকম অবদান লক্ষণীয়। কগনিজেন্ট, ইনফোসিস, টাটা, উইপ্রো প্রভৃতি কোম্পানিগুলো ইন্ডিয়ায় চুটিয়ে বাণিজ্য করছে। এসব কোম্পানির কর্মীরা বিশ্বে ছড়িয়ে রয়েছে। আর ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের অফিসগুলোর ক্ষেত্রেও এই ইনফরমাল ফরমালিটিজ চোখে পড়ে এদের করপোরেট কালচারে। এমনকি বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানের অফিসগুলোতে কর্মীদের রীতিমতো অবসরে ঘুমিয়ে বিশ্রাম নেওয়ার ব্যবস্থা যেমন রয়েছে, তেমনই রয়েছে অফিসের মধ্যেই বিনোদনের বন্দোবস্ত। যেমন ইনডোর গেমস, ক্যাফে, অফিস পার্টির রুম, সিনেমা দেখার জন্য প্রজেকশন রুম ইত্যাদি। এসব প্রতিষ্ঠানেও বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে ও সময় বিবেচনায় ওয়ার্ক ফ্রম হোমের মাধ্যমে কাজের সুবিধাও রয়েছে। আর ড্রেস কোডের মতো বিষয়গুলোতে এগুলোর কল সেন্টারের কর্মীরা প্রচলিত করপোরেট আচরণবিধির বাইরে। এমনকি অফিস চত্বরে ধূমপান ও মদ্যপান নিষিদ্ধ ছিল না। কিন্তু মদ্যপানে ছাড় দিয়ে একসময় নানাভাবে বিপাকে পড়তে হয়েছে অফিস কর্তাদের। তাই এই বিষয়ে শিথিলতা তুলে নিতে হয়েছে। তারপরেও কলকাতার সেক্টর ফাইভ ও রাজার হাটের আইটি হাবগুলোতে গেলে দেখা যায়, অফিস বিল্ডিংয়ের নিচেই রাত্রিকালীন গানবাজনার আসর জমিয়েছেন কর্মীরা, সঙ্গে চলছে নেশাযাপন।
এবার আসা যাক বিজ্ঞাপন এজেন্সি প্রসঙ্গে। বিজ্ঞাপন দুনিয়াটি সৃজনশীল দুনিয়া। কপিরাইটার, কপি এডিটর, ভিজ্যুয়ালাইজার, গ্রাফিক ডিজাইনার, ফটোগ্রাফার, ভিডিওগ্রাফার, সিনেমাটোগ্রাফারের মতো সৃজনশীল মানুষজন এই সেক্টরে যুক্ত। ফলত করপোরেটের বাঁধাধরা নিয়ম এখানে অনেক ক্ষেত্রেই বেমানান। বিজ্ঞাপনী সংস্থায় যারা প্রশাসন, হিসাবরক্ষণ ও বিপণন বিভাগে কাজ করেন তাদের ফরমাল হতে হয়। সেখানে ডেটলাইনের শৃঙ্খলাই আসল। বাকি বিষয়গুলো শিথিল। ডেটলাইনের মধ্যে নির্দিষ্ট কাজগুলো নির্দিষ্ট জায়গায় সাবমিট করা এবং কো-অর্ডিনেশনই বিজ্ঞাপনী সংস্থাগুলোর মূল চ্যালেঞ্জ। তাই ড্রেস কোড, অফিশিয়াল ম্যানারস, করপোরেটের চিরায়ত কমার্শিয়াল ট্যাবু মিডিয়া হাউসগুলোর মতোই অ্যাড হাউসগুলোতে খুব একটা কার্যকর নয়। কিন্তু ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টরদের কাছে চ্যালেঞ্জ থাকে বাকি সৃষ্টিশীলদের কাছ থেকে কো-অর্ডিনেশনের মাধ্যমে যথাযথ সময়ে কাজ বের করে আনার।
পাশাপাশি মার্কেটিং টিমের সঙ্গে সমন্বয় বজায় রাখার। এর চেয়েও বড় চ্যালেঞ্জ হলো ক্লায়েন্টের মনের মতো কাজ বের করে আনা ও বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে প্রডাক্টকে সর্বোচ্চ বিক্রয়যোগ্য করে তোলা। মোদ্দাকথা, মার্কেটে ক্লায়েন্টের প্রডাক্টের চাহিদা বাড়ানোই বিজ্ঞাপনী সংস্থার লক্ষ্য। এই লক্ষ্যপূরণের ক্ষেত্রে নিজেদের কর্ম প্রক্রিয়াকে দমবন্ধ করপোরেট অফিস কালচারে বেঁধে না রেখে সব সময়ে খোলামেলা একটা পরিবেশের মধ্য দিয়েই বিজ্ঞাপনী সংস্থাগুলো কাজ করতে চায়। তাই আমরা দেখি, সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটক, থেকে ঋতুপর্ণ ঘোষ কিংবা অমিতাভ রেজা, মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর মতো চিত্রপরিচালকেরা বিজ্ঞাপনী সংস্থাগুলোর হয়ে স্থানীয় বা আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডের জন্য কমার্শিয়াল তৈরি করতে পেরেছেন। ঋতুপর্ণ ঘোষ তো বেশ কিছুদিন ‘অ্যাডভারটাইজমেন্ট কপিরাইটার’ হিসেবে কাজ করেছেন। ওয়ার্ল্ড সিনেমা থেকে শুরু করে বলিউডের বহু বিখ্যাত চলচ্চিত্রকারকেই এভাবে বিজ্ঞাপনী সংস্থার হয়ে কখনো কমার্শিয়াল বানাতে দেখা গেছে, কখনোবা তারা রীতিমতো চাকরি করেছেন বছরের পর বছর। সৃজনশীল মানুষকে স্বাধীন পরিবেশে নিজ দায়িত্ব পালনের অনেকখানি সুযোগ করে দেয় বিজ্ঞাপনী সংস্থাগুলো। কাজের ওপর সারাক্ষণ নজরদারি, বসের ছড়ি ঘোরানো, এইটা এইভাবে করতে হবে বা ওইভাবে করা যাবে না—এ ধরনের আচরণ সাধারণভাবে বিজ্ঞাপনী সংস্থাগুলোতে দেখা যায় না। বাংলাদেশের কিছু বিজ্ঞাপনী সংস্থায় এই উন্মুক্ততা বিদ্যমান।
এদিকে পোস্ট গ্লোবালাইজেশন পর্বে নিউজ মিডিয়াও এ মুহূর্তে তুমুলভাবে করপোরেট। কিন্তু সংবাদ সংস্থা অথবা সংবাদমাধ্যমে রিপোর্টারদের ওপর তাদের কাজের ধরনের জন্যই অনেক সময়ই অফিসের চেক ইন ও চেক আউট টাইম, ড্রেস কোড, উইকলি অফ এসব ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট নিয়ম বর্তায় না। এখানে ডেটলাইন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। প্রিন্ট অথবা অডিও ভিজ্যুয়ালে রিপোর্টারকে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে প্রতিবেদন সাবমিট করতে হয়। তারপর তা সাব-এডিটর মারফত এডিট ও প্রুফরিডিং হয়ে নিউজ এডিটরের কাজে যায় এবং তারপর তা পাবলিশিং বা ব্রডকাস্টিং প্রসেসের মধ্যে ঢুকে পড়ে। আরেকটি বিষয় এ ক্ষেত্রে সংবাদ প্রতিবেদক ও অন্যদের মাথায় রাখতে হয়। সেটি হলো এডিটরিয়াল পলিসি। রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ইত্যাদি বিষয়ে আজকের দুনিয়ার প্রতিটি সংবাদমাধ্যমের সম্পাদকীয় নীতি অথবা হাউস পলিসি নির্দিষ্ট করা থাকে। সেই অনুযায়ীই নিউজ অথবা ফিচার নির্মিত হয়। এই বিষয়গুলো বাদ দিয়ে সংবাদমাধ্যমের রিপোর্টারদের ওপর অন্য কোনো হাউস ডেকোরাম সেভাবে ফলো করতে হয় না বললেই চলে।
আজকের বিনোদন জগতে অডিও ভিজ্যুয়ালের ক্ষেত্রে ওয়েব সিরিজ এখন এই উপমহাদেশেও জনপ্রিয়। এমনকি দুই বাংলাতেও। এই ওয়েব সিরিজকে কেন্দ্র করে অডিও ভিজ্যুয়াল জগতে তৈরি হয়েছে বেশ কিছু করপোরেট সংস্থা। যেগুলোকে একপ্রকার প্রোডাকশন হাউস বলা যেতে পারে। কিন্তু চিরায়ত প্রযোজনা সংস্থার মতো এরা নয়। এদের টেকনিক্যাল ও ক্রিয়েটিভ টিম মোটামুটি নির্দিষ্ট। এ ক্ষেত্রে আইদার ফিন্যান্সিয়াল প্যাকেজ অথবা স্যালারির মাধ্যমেই এই টেকনিক্যাল ও ক্রিয়েটিভ টিমকে এরা নিয়ন্ত্রণ করে; যারা ওয়েব প্ল্যাটফর্মে নিত্যনতুন অডিও ভিজ্যুয়াল ফিকশন তৈরি করে। সিনেমা বা টেলিভিশন জগতের মতোই স্ক্রিপ্ট রাইটিং, লোকেশন রেইকি, অডিশন, শুটিং ও পোস্টপ্রোডাকশনের কাজ হয় এবং তারপর তার ওয়েব প্ল্যাটফর্মিংয়ের জন্য আইটি সলিউশনের বেশ কিছুও কাজ এখানে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে থাকে। কিন্তু এই ফিকশন তৈরিতে পরিচালক, অভিনেতা-অভিনেত্রী ও অন্যান্য কলাকুশলীর ওপর কোনোভাবেই ফরমাল করপোরেট ওয়ার্ক কালচার বর্তায় না। কাজের ডিমান্ড ও তার নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে প্রোডাকশনই এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ।
এতক্ষণ কথা হচ্ছিল এসব করপোরেট সেক্টরে ইনফরমাল করপোরেট ওয়ার্ক কালচার নিয়ে। এর মানে এই নয় যে এই ইনফরমাল স্পেসের কারণে এসব সেক্টরে অ্যাকাউন্টিং, লিগ্যাল, অ্যাডমিনিস্ট্রেশন, পে-পলিসি, এইচআর রুল ইত্যাদি বিষয়ও ইনফরমাল। না, তেমনটা মোটেও না। আর সেটা হলে তো করপোরেট শব্দটিই অর্থহীন হয়ে পড়ে। তাই এসব ক্ষেত্রে প্রবলভাবেই করপোরেট স্ট্রাকচার অনুসরণ করা হয়। কেবল বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে কাজের ধরন ও আঙ্গিকের ওপর নির্ভর করে ওয়ার্ক কালচারে আনা হয় কিছু ইনফরমাল আবহ।
অতনু সিংহ
মডেল: মুন্না ও নাজিয়া
ওয়্যারড্রোব: ক্লাবহাউজ
ছবি: ক্যানভাস ও সংগ্রহ