skip to Main Content

কভারস্টোরি I বিশ্বায়নে কর্মক্ষেত্র

উদার অর্থনীতির সুবাদে করপোরেট দুনিয়া এখন বেশির ভাগই বহুজাতিক। বিশ্বায়িত অর্থনীতিতে এর কর্মকান্ড পরিচালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক লগ্নিপুঁজির মাধ্যমে। বদলে গেছে পুঁজির ধারণা, সমাজ-রাজনীতিতে পড়ছে এর প্রভাব। লিখছেন অতনু সিংহ ও রুম্পা সৈয়দা ফারজানা জামান
বাণিজ্যদুনিয়ায় সাংগঠনিকভাবে সুশৃঙ্খল এবং উৎপাদন ও পরিষেবায় প্রসারমাণ কোনো প্রতিষ্ঠানকে আমরা সাধারণভাবে করপোরেট প্রতিষ্ঠান বলতে পারি। যদিও করপোরেশন শব্দটির মধ্যেই করপোরেটের ধারণা অন্তর্নিহিত, তথাপি করপোরেশন আর করপোরেট অর্থনীতির ফলিত ক্ষেত্রে তা সমার্থক কোনো বিষয় নয়। পুঁজিবাদ ও ব্যক্তি অথবা গোষ্ঠী মালিকানার সঙ্গে করপোরেট ব্যবস্থার ওতপ্রোত সম্পর্ক রয়েছে। তবে পুঁজিবাদী বহির্জগতের সঙ্গে তাল মিলিয়ে যেসব সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র পরিচালিত হয়, সেগুলোর বাজারের নিয়ন্ত্রক ভূমিকায় সোশ্যাল করপোরেট সংস্থাও রয়েছে, যেগুলো কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সরকারনিয়ন্ত্রিত। বেসরকারি পুঁজিপতি গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণও এ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য। পুঁজিবাদী মডেলে সোশ্যালিস্ট এমন করপোরেট ব্যবস্থার সহজ উদাহরণ হিসেবে রাষ্ট্রীয়ভাবে আমরা চীনের কথা বলতেই পারি। আবার সামাজিক উদ্যোগ কিংবা এনজিওর ক্ষেত্রেও করপোরেট স্ট্রাকচার বেশি চোখে পড়ে। কিন্তু এ কথা ঠিক, পুঁজিবাদের বিকাশ ও তার অগ্রযাত্রার মধ্যেই করপোরেট ব্যবস্থার উদ্ভব ও বিকাশ। আর পুঁজিবাদী ব্যবস্থার প্রাকরণিক অভিযোজনের সবচেয়ে ডেভেলপড যে অর্থনৈতিক অবস্থা, তাকে আমরা ভুবনায়ন বা বিশ্বায়ন নামে জানি।
অর্থনীতিবিদ পল সুইজি মান্থলি রিভিউ পত্রিকায় লিখেছিলেন, ‘বিশ্বায়ন কোনো শর্ত নয়, ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য কোনো ঘটনা নয়, এটা হচ্ছে একটি প্রক্রিয়া. এটি চলছে চার শ-পাঁচ শ বছর ধরে। তবে পুঁজিবাদের ভেতরে এমন ব্যবস্থা রয়েছে যে তা সব সময় সম্প্রসারিত হচ্ছে।’ সুইজি বিশ্বায়ন বা ভুবনায়নের ইতিহাসকে চার শ-পাঁচ শ বছরের পুরোনো বললেও উল্লেখিত উদ্ধৃতির শেষাংশে পুঁজিবাদের সম্প্রসারণের একটি আঙ্গিক হিসেবে গ্লোবালাইজেশনের প্রসঙ্গ উত্থাপন করেছেন। অর্থাৎ সহজ ভাষায় বলতে হয়, আমরা যে বিশ্বায়ন বা ভুবনায়নের কথা বলছি, তা হলো পুঁজিবাদী বিশ্বায়ন। অর্থাৎ পুঁজিবাদের নতুন একটি রূপ। জাতীয়তাবাদ ও রাষ্ট্রীয় গন্ডি ছাড়িয়ে এটি আন্তর্জাতিক। শ্রমিকের ক্ষমতায়নের যে মার্ক্সীয় মডেলকে আমরা আন্তর্জাতিকতাবাদ হিসেবে চিহ্নিত করেছি, এখানে সেই টার্মটি করপোরেট পুঁজিবাদের পরিপ্রেক্ষিতে বিবেচ্য। শ্রমিকের ক্ষমতায়ন নয়, বরং পুঁজিপতি বা করপোরেট পুঁজিগোষ্ঠীর মুনাফাকেন্দ্রিক ক্ষমতার ভাগ-বাঁটোয়ারাই হলো আজকের এই অর্থনৈতিক বিশ্বায়ন।
তার মানে করপোরেট পুঁজির আন্তর্জাতিকীকরণ এবং সেই অনুযায়ী বিশ্বায়িত বাজারব্যবস্থাকেই আমরা আজকে ফিন্যান্সিয়াল গ্লোবালাইজেশন বলে চিনি। শুধু তাই নয়, বরং আমাদের প্রতিটি যাপিত মুহূর্ত এই বিশ্বায়িত করপোরেট অর্থনীতির সুতায় বাঁধা। পণ্য, পরিষেবা, বিনোদন, তথ্যজ্ঞাপন ও তথ্য জ্ঞাপিত হওয়ার মধ্যে আমাদের ২৪ঢ৭ রুটিনের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রই বিশ্বায়িত করপোরেট ইকোনমির নিয়ন্ত্রণে। জনকল্যাণমুখী সব রাষ্ট্রের জনক্ষেত্রগুলোও এখন এই গ্লোবাল ইকোনমির সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রয়েছে। এখন এই করপোরেট বিশ্বায়নের অন্দরে আলোকপাত করার আগে এই করপোরেট পুঁজির ধরনের বিষয়টি আমাদের স্মরণ করা দরকার। আমরা জানি, ভুবনায়িত বা বিশ্বায়িত বাজার অর্থনীতি সোভিয়েত ইউনিয়ন তথা বৃহৎ সমাজতান্ত্রিক শিবিরের পতনের পরে ধীরে ধীরে ঝান্ডা তুলে প্রায় প্রতিদ্বন্দ্বীহীন এক ব্যবস্থা হিসেবে উঠে আসে। এবং পুঁজির ধরনেও বিরাট এক পরিবর্তন ঘটে যায় গত শতাব্দীর আশির দশকের মাঝামাঝি সময় থেকেই। যা পূর্ণতা পায় নব্বই দশকের সূচনার কিছু সময় পরেই বিশ্বব্যাপী নিও-লিবারাল অর্থনৈতিক নীতিনির্ধারণের জমানায়। আমরা পুঁজিলগ্নির পূর্ণ প্রকাশ এবং এর আর্থসামাজিক প্রকাশ হিসেবে পুঁজিবাদকে যদি দেখে থাকি, সে ক্ষেত্রে এবার তা এমন এক অর্থনৈতিক শৃঙ্খলায় বিশ্ববাজার ব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করল, যেখানে দৃশ্যমান পুঁজি তার লগ্নিকর্মকে ব্যাপক হারে বৃদ্ধি করে নিজে হয়ে গেল বিমূর্ত ও গায়েবি। শোনা গেল, এই বিশ্বব্যাপ্ত পুঁজির একটি বিশেষ নাম ‘গ্লোবাল ফিন্যান্স ক্যাপিটাল’। করপোরেট এভাবেই জাতীয় গন্ডি ও সাংস্কৃতিক সীমানা অতিক্রম করে নিজেই হয়ে উঠল বহুমাত্রিক। স্থানীয় সংস্কৃতি, ভাষা ও অর্থনীতির বলয় অতিক্রম করে সে যেমন হয়ে উঠল বহুজাতিক, ঠিক তেমনই শেয়ারবাজার এবং ক্রমে আন্তর্জাতিক লেনদেন ও প্লাস্টিক মানির সৌজন্যে পুঁজি হয়ে উঠল গায়েবি বা অদৃশ্য; কিন্তু তার নিয়ন্ত্রণ, শৃঙ্খলা এবং বাজারব্যবস্থা পরিচালনার ক্ষমতা আগের সব রেকর্ড ছাপিয়ে হয়ে উঠল ‘অপ্রতিরোধ্য’।
উদার অর্থনীতিকেন্দ্রিক এই লগ্নিপুঁজির বিশ্বায়নব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ দুটি নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান হচ্ছে বিশ্বব্যাংক এবং আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা ইন্টারন্যাশনাল মনিটারি ফান্ড (আইএমএফ)। দ্বিতীয় প্রতিষ্ঠানটি করপোরেট পুঁজির বিশ্বায়নের চারটি মৌলিক দিক চিহ্নিত করেছে; যথা—বাণিজ্য ও আর্থিক লেনদেন, পুঁজি ও বিনিয়োগ সঞ্চালন, অভিগমন ও জ্ঞান বিতরণ। এ ক্ষেত্রে প্রথম দুটি বিষয়কে কেন্দ্র করে বাকি দুটি পরিচালিত হয়। পুঁজিবাজার যে কর্মসংস্থান ও জীবিকা নির্বাহের ব্যবস্থা করে, তার জন্যই নির্দিষ্ট স্থানিক গন্ডি বা যাপন-সীমানা অতিক্রম করে রাষ্ট্রীয় ও জাতীয় পরিচিতির বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে নিজেকে মেলাতে হয় আজকের ‘সভ্য’ মানুষকে। এবং এই সামগ্রিক কর্মকান্ডকে সফল করে তোলার জন্য জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিচর্চার বিষয়টিও করপোরেট লগ্নিপুঁজির বিশ্বায়নের মৌলিক দিকগুলোর সঙ্গে সম্পৃক্ত। পাশাপাশি অবধারিতভাবেই করপোরেট লগ্নিপুঁজির বিশ্বায়নের আরেকটি কাঠামোগত উপাদান হলো মাসমিডিয়া। এটি সাম্প্রতিক উদার অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ জায়গা, যার ধারক ও বাহক হলো ইনফরমেশন। এটি বাজারব্যবস্থার অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক চালিকাশক্তি। সে কারণেই তথ্য বা ইনফরমেশন সামাজিক ও রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ ফলপ্রসূ করে। তাই বাজারব্যবস্থাকে ধরে রাখতে এবং তাকে চাঙা করতে গণমাধ্যমের ভূমিকা ব্যাপক। ক্ষমতা ও তার প্রকাশকে কেন্দ্র করে ‘সত্য’ উৎপাদিত হয়, এমন ধারণা আমরা দার্শনিক মিশেল ফুকোর চিন্তা থেকে পাই। নব্য উদার অর্থনীতির করপোরেট বিশ্বায়নের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ও বাজারব্যবস্থার স্বার্থে গণমাধ্যম যে একতরফা ঘটনা ও জনমত তৈরি করে, তা মার্কিন সমাজবিজ্ঞানী নোয়াম চমস্কির ম্যানুফ্যাকচারিং কনসেন্ট বইটি পাঠ করলেও আমরা বুঝতে পারি। যেখানে বাজারব্যবস্থার সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে ওঠা করপোরেট গোষ্ঠীর পৃষ্ঠপোষকতায় পরিপূর্ণ রাজনীতি ও নির্বাচনী ব্যবস্থা প্রসঙ্গে চমস্কি বলেছেন, ‘মতামতভিত্তিক ভোট নেওয়া হয় কোনো নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে নয়, করপোরেট প্রচার সংস্থা হিসেবে মিডিয়ার দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে।’ গ্লোবালাইজেশনের বিশ্ববাজার ব্যবস্থাকে ‘পলিটিক্যাল ইকোনমি’ নামেও অভিহিত করা হচ্ছে।
সত্য যে, এই করপোরেট গ্লোবালাইজেশনের বাইপ্রডাক্ট হলো পরিবেশ ও আবহাওয়ার পরিবর্তন। এ নিয়ে প্রথম বিশ্বের পরিবেশকর্মীরা সরব, অনেকেই করপোরেট লগ্নিপুঁজির নব্য উদার অর্থনৈতিক বিশ্বায়নকে বিশ্ব উষ্ণায়নের জন্য দায়ী করেছেন। এ ছাড়া লেফট উইং ফেমিনিস্টরা এই ব্যবস্থার ধারক-বাহক পণ্য-দুনিয়া বা পণ্যায়নকে নারী স্বাধীনতাহরণ ও লৈঙ্গিক বৈষম্যের কারণ হিসেবেও অভিযুক্ত করে থাকেন।
পণ্যায়নের কথা যখন উঠল, তখন বলা দরকার, শুধুই বস্তুর পণ্যায়ন নয়, নিও-লিবারাল ইকোনমি জীবনের মৌলিক পরিষেবা, যথা শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের মতো বিষয়কেও পণ্য হিসেবে তুলে ধরেছে। এমনকি নিরাপত্তা এবং জাতীয় সার্বভৌমত্বও অনেকাংশে বহুজাতিক করপোরেটের পণ্য। যদিও সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন এবং নব্য উদার অর্থনীতির সূচনার ঐতিহাসিক ঘটনাকে আরেক মার্কিন সমাজবিজ্ঞানী ফ্রান্সিস ফুকুয়ামা ‘ইতিহাসের সমাপ্তি’ এবং ‘উদারনৈতিক গণতন্ত্রের বিজয়’ ঘোষণা করেছিলেন। এর কারণ, অর্থনীতির রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ, ভর্তুকি এবং ব্যক্তিস্বাধীনতার ওপর রাষ্ট্রীয় অতিনিয়ন্ত্রণ।

ভর্তুকিমুক্ত অর্থনীতি, পুঁজির গণতান্ত্রিক লগ্নিস্বাধীনতা, ক্রয়-বিক্রয়ের অবাধ সুযোগ এবং রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের বিলগ্নীকরণের কর্মসূচি সামনে রেখেই বহুজাতিক করপোরেটের নব্য উদার বিশ্বায়নের সূচনা। সমাজতান্ত্রিক দুনিয়ায় রাষ্ট্র খোদ নিজেই পুঁজি ও বাজারের পাহারাদার হয়ে উঠে ব্যক্তির ওপর যে ছড়ি ঘুরিয়েছে, তার পরিপ্রেক্ষিতে ফুকুয়ামাদের এই পর্যবেক্ষণ আপাত অর্থে গণতান্ত্রিক বলেও মনে হতে পারে। কিন্তু গণমানুষের বিবেচনায়, সংখ্যাগরিষ্ঠ হ্যাভ-নটদের বিচারে কিছুদিন যেতে না-যেতেই এই নব্য উদার অর্থনীতি সামনে এসেছে নানা প্রতিবাদ প্রতিরোধ। এই অর্থনৈতিক ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রক গোষ্ঠী জি-৮-এর সামিট বসেছিল ২০০১ সালে ইতালিতে। সেখানে প্রতিবাদরত তরুণ কার্লো গিউলানির ওপর গুলি চালায় পুলিশ। বলা হয়, কার্লো বিশ্বায়নবিরোধী লড়াইয়ের প্রথম শহীদ। এরপর অবশ্য এই ব্যবস্থার বিরুদ্ধে নানা বাদ-প্রতিবাদ বিশ্বের মানুষ লক্ষ করেছে। কিন্তু এর বিরুদ্ধে জোরালো কোনো বিকল্প রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ধারা গড়ে ওঠেনি। ভেনেজুয়েলার মতো রাষ্ট্র অবশ্য সমবায় অর্থনীতির মডেল সামনে রেখে বিকল্প সমাজতন্ত্রের সন্ধান দিতে পেরেছিল, কিন্তু তা সার্বিকভাবে বিশ্বায়িত বা আন্তর্জাতিক হয়ে উঠতে পারেনি। এদিকে গ্লোবালাইজেশন ও নিও-লিবারাল ইকোনমিকেও এযাবৎ নানা সংকটের মুখে পড়তে হয়েছে। আন্তর্জাতিক শেয়ারবাজারে বারবার নেমেছে ধস। সৃষ্টি হয়েছে অর্থনৈতিক মন্দা। ফলে কর্মী ছাঁটাই, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি এমনকি যুদ্ধ পরিস্থিতিরও সাক্ষী থেকেছি আমরা। যার মোকাবিলায় অস্ত্র ব্যবসা, অপেক্ষাকৃত কম ক্ষমতাধর রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ক্ষমতাধর রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ, গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের নামে মানবাধিকার লঙ্ঘন ও যুদ্ধাপরাধের ঘটনা ঘটেছে নানা জায়গায়।
এই নব্য উদার অর্থনীতির বহুজাতিক করপোরেটের বিশ্বায়নের ক্ষেত্রে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো বিজ্ঞাপন। আগেই বলা হয়েছে, পণ্যবাদ যেহেতু এই ব্যবস্থার কেন্দ্রক, তাই পণ্যের বিজ্ঞাপন, প্রমোশন, ব্র্যান্ডিং ইত্যাদি গুরুত্ব ব্যাপক। অন্যদিকে এর আরেকটি চালিকাশক্তি হলো অন্তর্জাল বা ইন্টারনেট। মূলত ইন্টারনেট দুনিয়াকে কেন্দ্র করেই টিকে আছে এই ব্যবস্থা। এবং এরই বদৌলতে পুঁজির চরিত্র বিমূর্ত ও গায়েবি।
কেউ কেউ এই বহুজাতিক করপোরেট লগ্নিপুঁজির বিশ্বায়নকে সাম্রাজ্যবাদের একটি বিশেষ আঙ্গিক বলে মনে করেন। লেনিন মনে করতেন, পুঁজির সর্বোচ্চ রূপ হচ্ছে সাম্রাজ্যবাদ। কিন্তু লেনিনীয় যুগ অতিক্রম করে পুঁজির যেমন চরিত্র ও মাত্রা বদল হয়েছে, তেমনই প্রত্যক্ষ সাম্রাজ্যবাদের যুগও পেরিয়ে এসেছি আমরা। এখন ক্ষমতাধর রাষ্ট্র ও করপোরেট গোষ্ঠীগুলো একত্র হয়ে লগ্নিপুঁজির বিশ্বায়ন পরিচালনা করছে। এই পরিস্থিতিতে বিকল্প কী হতে পারে, তা-ও যেমন আলোচনাসাপেক্ষ, ঠিক তেমনই এই করপোরেট বিশ্বায়ন কতটা মানবিক ও জনকল্যাণমুখী হয়ে উঠতে পারে, তা অনুসন্ধানের অবকাশ রয়েছে।
করপোরেট সোশ্যাল রেসপনসিবিলিটি বা সিএসআর একদিকে মুনাফার বাইরে করপোরেটের সামাজিক দায়বদ্ধতার জায়গা, অন্যদিকে করপোরেট স্ট্রাকচারের মধ্যে থেকে সামাজিক উদ্যোগ এবং এর মাধ্যমে নিম্নবিত্তকে বিত্তে উত্তরণের কর্মসূচিও একটা পন্থা। যে কাজ এখন আকছার হচ্ছে। পুঁজি ও অর্থনীতি যেভাবে তার রূপ বদল করে, এই বিশ্বায়নও নিশ্চয়ই সেভাবে আরও মানবিক নানা পথ খুঁজে বের করবে। অন্তত বিশ্ব অর্থনীতি ও পিছিয়ে থাকা দেশগুলোর মানুষ এ আশা নিয়ে জীবনযাপন করে।

প্রচ্ছদব্যক্তিত্ব: ড. রুবানা হক
সভাপতি, বিজিএমইএ ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক, মোহাম্মদী গ্রুপ
মডেল: চাঁদনি, রাব্বি, বর্ণ ও তন্ময়
ওয়্যারড্রোব: আড়ং ও তাগা
মেকওভার: পারসোনা
ছবি: সৈয়দ অয়ন ও সংগ্রহ

নিজের হাতে নিজের লাগাম ধরে রাখতে হবে

-গীতিআরা সাফিয়া চৌধুরী
প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, অ্যাডকম লিমিটেড

অ্যাডকমের বয়সই পঁয়তাল্লিশ। কিন্তু গীতিআরা সাফিয়া চৌধুরী মনেপ্রাণে নবীন হলেও কাজের বয়স পঞ্চাশ ছুঁই-ছুঁই। তার সময়ে কাজ করা, তা-ও আবার বিজ্ঞাপনী সংস্থায়, সে কম যুদ্ধ ছিল না—হেসে জানান তিনি। এরপরে বললেন তাঁর কাজ, পরিবার আর অফিস নিয়ে বড় একটি পরিবারের সাজানো-গোছানোর মূল রহস্য।
গীতিআরা সাফিয়া চৌধুরী বলেন, আমারও একসময় বয়স অল্প ছিল। আর সেই অল্প বয়সেই আমার কাজ করা শুরু। তখন থেকেই আমি ছিলাম নিয়মানুবর্তীর অনুসারী। সঠিক সময়ে সঠিক কাজটি করা আর ডেলিভার করার অভ্যাসের কারণেই হয়তো আজও আমি কাজ করতে পারছি সেই আগের গতিতেই।
আমি বিশ্বাস করি, সমাজ বদলেছে। কিন্তু এখনো অতটা বদলে যায়নি যে নারীদের জন্য সব পথ মসৃণ হয়ে গেছে। বিশেষ করে যারা করপোরেট দুনিয়ায় কাজ করছে। এই দুনিয়া অনেক ঝলমলে, অনেক মোহনীয়। কিন্তু তাতে একেবারে মিশে গেলে চলবে না। সেখান থেকে নিজেকে আলাদা করে উপস্থাপন করার কৌশল যার আছে, তারই ক্যারিশমায় মুগ্ধ হয় সবাই। কারণ, যত যা-ই বলি, দেশ-সমাজ-পরিবার—এসব আমাদেরই অংশ। একে অস্বীকারের উপায় নেই। পাশাপাশি নারী যখন অভিজ্ঞতার পথে হাঁটা শুরু করবে, তখন তাকে পরিবারকেও সমানতালে সামলাতে হবে। এবং অবশ্যই পুরুষকেও সেই দায়িত্ব পালন করতে হবে। কারণ, বাবা-মা উভয়কেই দরকার পরিবারকে সুন্দরভাবে গড়ে তোলার জন্য।
ডি. সুফিয়া আহমেদ আমাকে বলেছিলেন প্রতিদিন অন্তত একটি ঘণ্টা সন্তানদের সঙ্গে কাটাতে। এবং সারা দিনে কী করেছি, বা আমরা কী করছি সেটা নিয়ে আলাপ করতে। আমি কিন্তু আমার সন্তানদের ছোটবেলা থেকেই এই অভ্যাসটা নিজের মধ্যে গড়ে তুলেছি। ফলে ওরাও কিন্তু আমার সঙ্গে সব কথা বলে বা জানায়। তাতে করে, যতই ব্যস্ত হোক, সন্তানের সঙ্গে বাবা-মায়ের দূরত্ব হয় না। আর যেহেতু আমিও সব বলতাম, আমার কাজ নিয়ে—হয়তো সে কারণেই আমার সন্তানেরাও একই ধরনের কাজে আজ যুক্ত হয়েছে এবং আমার মতোই উপভোগ করছে।
আর কাজের কথা বললে একটা কথাই বলব, নারীর কাজ বলে কিছু নেই। এবং এই নেই কথাটা নিজেকে বিশ্বাস করতে হবে। বিজ্ঞাপনী সংস্থায় কাজ করার সময় বলা যাবে না, আমি অমুক ব্র্যান্ডের কাজ করব না বা প্রয়োজনের সময় অফিসে থাকতে পারব না। কাজ কাজই। কাজের সময় যদি একটা পুরুষ বা অন্য কোনো নারী বা ম্যানেজমেন্ট এমন কোনো দুর্বলতা ধরে ফেলতে পারে, তাহলে হয়তো নিজেকে প্রমাণের সুযোগ পরে সে না-ও পেতে পারে। নিজেকে পেছানোর জন্য সুযোগ তৈরি করে দেওয়া একদমই ঠিক নয়। বরং যেকোনো সুযোগ চট করে লুফে নেওয়া দরকার। তাহলে করপোরেট দুনিয়া হোক বা যেকোনো অঙ্গন বা নিজের কোনো উদ্যোগ—কেউ কাউকে দাবিয়ে রাখতে পারবে না। আর ছেলেদের শেখাতে হবে কীভাবে নারীদের সম্মান করতে হয়। যেসব মা তরুণ, তাদের এটা আরও বড় কর্তব্য। কারণ, তারা নিজেরাও এখন কাজ করে। নারীকে সেভাবে সম্মান করার উচিত, যেভাবে তারা মাকে সম্মান করেন, সেভাবে প্রটেক্ট করা উচিত, যেভাবে বোনকে করে, সেভাবে আগলে রাখা উচিত যেভাবে নিজের কন্যাকে করে। যেদিন থেকে নারী-পুরুষ একইভাবে একই ছন্দে আর সুরে নারীর সম্মানের আরাধনা করবে, সেদিন থেকেই কিন্তু নারীর পথচলাটা আরও মসৃণ হয়ে যাবে।

মেয়েদের চিন্তাভাবনায় কাজ করার পাশাপাশি আরও অনেক উইন্ডো খোলা থাকে
-কাশফিয়া ফিরোজ
হেড অব ইনফ্লুয়েন্স, প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল

দীর্ঘদিন ধরে উন্নয়ন কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করে যাচ্ছেন কাশফিয়া ফিরোজ। শুধু ঘরে-বাইরে সমানতালে কাজ করা কাশফিয়া একাধারে টিম লিডার, মা, স্ত্রী, বোন এবং মেয়েও বটে। সব মিলিয়ে তার জীবনযাত্রা একেবারে সময়ক্ষেপণ না করা রেলগাড়ির মতো। কাশফিয়া জানান, একটা মেয়ে যখন কাজ করতে ঘরের বাইরে যান, তখন তার মাথায় এমনিতেই চার-পাঁচটি উইন্ডো খুলে থাকে। আমরা যে রকম ইন্টারনেটে কাজ করার সময় বিভিন্ন উইন্ডো খুলে রাখি ঠিক সে রকম। একেকটা উইন্ডো একেকটা কথা বলে। একটাতে থাকে সঠিক সময়ে অফিসে যাবার চিন্তা, একটাতে ঘরের যত ভাবনা, একটাতে ফিরে আসার পর কী কী করতে হবে সেটা—এ রকম নানাভাবে। এবং এটা কখনোই মনে করা ঠিক নয় যে রান্নাবান্নার ব্যাপারেই মেয়েরা বেশি চিন্তিত থাকে। বিষয়টা শুধু হেঁশেলঘেঁষা নয়, সবকিছু নিয়ে। বাসার নিরাপত্তা থেকে স্বাচ্ছন্দ্য—সবই। এরপর আসে যে সে কী পোশাক পরবে। মেয়েদের নানা রকমের পোশাকও মাথায় রাখতে হয়। ফিল্ডে যাবার সময় এক রকমের পোশাক, পাবলিক ট্রান্সপোর্ট মাথায় রেখে এক রকমের পোশাক, মিটিং, গণফোরামে উপস্থিত থাকার সময়ে আরেক পোশাক। এগুলো নিয়েও কিন্তু নারী কর্মীকে ভাবতে হয়। পুরুষেরা এই ভাবনা থেকে পুরোপুরি মুক্ত বলেই আমার ধারণা।
এরপরেও মেয়েরা যখন বাইরে আসে, তখন কিন্তু তাদের নানা রকমের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়। আমার মতো যারা উন্নয়নধর্মী প্রতিষ্ঠানে আছেন, তাদের জন্য ফিল্ডওয়ার্কে মেয়েদের যাওয়া-আসা বা থাকা নিয়ে এখনো দ্বন্দ্ব কাজ করে। একেবারে রিক্রুটমেন্ট থেকে শুরু করে যত উপরেই ওঠা হোক, নারীর জন্য চ্যালেঞ্জ একটি চলমান প্রক্রিয়া। যেই নারী কর্মকর্তা আসনে বসেন, তাকেও কিন্তু প্রতিনিয়ত নিজেকে প্রমাণের জন্য প্রস্তুত রাখতে হয়। কারণ, তিনিও জানেন তার সম্মানী দিয়ে হয়তো একাধিক কর্মীকে প্রতিষ্ঠানে কাজ করানো সম্ভব। কিন্তু নারীকে তার যোগ্যতা দিয়ে আসন, সম্মান ও সম্মানী ধরে রাখতে হয়।
এত কিছুর পরেও যখন নারী ঘরের বাইরে যায়, আজও কিন্তু তারা সমাজের চোখে একটু হলেও কাঁটা। আর নারীদের বাইরে আসাও যেহেতু আমাদের মতো দেশগুলোতে এখনো অনেকের চোখে ‘অপ্রয়োজনীয়’, তাই নারীরাও নারীর কর্মসাফল্যের নানা রকমের ব্যাখ্যা দিয়ে বসে। আর কোনো কিছু না হলেও ধর্ম বা চরিত্র দিয়ে নারীকে কলুষিত করে ঘরে আটকে রাখার বন্দোবস্ত করে ফেলে। সমাজের এই জায়গাটা এখনো আঁধারে ঢাকা। আমি প্রাণপণে বিশ্বাস করি, যারা কাজ করছে তাদের আলোতেই এই আঁধার কেটে যাবে। তারাই পারবে নারীর পথ সুগম করে অন্য নারীকে এগিয়ে নিতে।

চাকরিটা শুধুই খেয়েপরে বাঁচার জন্য নয়, বা হাতখরচের জন্য নয়
-ফারজানা খান
মহাব্যবস্থাপক, এসএমই ফাউন্ডেশন

করপোরেট হোক বা অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানে হোক, আমরা কিন্তু একটু বয়স এবং সময় পর্যন্ত নারীদের উৎসাহ দিলেও যখন দায়িত্ব নেওয়ার বা প্রতিনিধিত্ব করার সময় আসে, তখন অনেক পুরুষই কিন্তু সেই জায়গাটা ছেড়ে দিতে রাজি হয় না। এভাবেই শুরু করলেন ফারজানা খান।
দীর্ঘদিন ধরে উৎসাহ দিয়ে নারীদের সামনে আনার পাশাপাশি তিনি নিজে কীভাবে নারীর কাজকে মূল্যায়ন করেন, সেটাও জানালেন।
ফারজানা খান বলেন, আমাদের সামাজিক অবস্থা এবং কাঠামো আজও নারীকে পেছনে টেনে ধরে। তা কিন্তু কিছু কিছু ক্ষেত্রে নিজের কারণেই হয়। যেমন স্বামী-স্ত্রী একই অফিসে কাজ করলেও আজও নারীরা মনে করেন, তার একটু আগে বাসায় গিয়ে ঘরের কাজ সামাল দেওয়া প্রয়োজন। অথচ আমরা কিন্তু বলেই আসছি, ঘরের কাজ শুধুই নারীর নয়। ব্যক্তিগত পর্যায়ে আমি নারী-পুরুষ সবাইকেই এই ব্যাপারে কাউন্সেলিং করি। কারণ, এই প্র্যাকটিসটা কিন্তু কর্মজীবনে প্রভাব বিস্তার করে। একজন নারী যদি সব সময় একই তাড়ায় থাকে, তাহলে তা ম্যানেজমেন্টকে যেমন ভাবায়, তেমনই মাথার তাড়া হাতের কাজে বিরূপ প্রভাব ফেলে। নারীদের প্রথমেই একটা বিষয় মাথায় রাখতে হবে, তা হলো চাকরিটা শুধুই খেয়ে-পরে বাঁচার জন্য নয়, বা হাতখরচের জন্য নয়। এমনকি যারা শুধু নিজের খরচের জন্যই কাজ করছেন, তাদেরও এমন ভাবনা থেকে সরে আসতে হবে। কারণ, তা না হলে কিন্তু লিডারশিপে যাবার যে আকাক্সক্ষা, সেটা নষ্ট হয়ে যাবে। আর এমন ভাবনা কিন্তু সেসব নারীর কর্মজীবনেও প্রভাব ফেলে, যারা নেতৃত্বে যেতে চান। কারণ, হাজারটা ভালো কাজের পরেও একটি নেতিবাচক পদক্ষেপই কিন্তু চর্চার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়।
আমাদের সমাজে এখনো নারীর কাজের এবং সাফল্যের পেছনে তার পরিবারের হাত আছে, যেমনটি আছে পুরুষের সাফল্যের পেছনে নিজের পরিবারের। তাই আমি মনে করি, কাজের ক্ষেত্রে, সেটা যে কাজই হোক—নারীকে অনুপ্রেরণা দিতে হবে। নারীকে বোঝাতে হবে, এটা তার মেধার প্রতিফলনের আয়না। আয়নাকে যে রূপ দেখা যাবে, সেটাই কিন্তু মানুষের চোখে সারা জীবন থেকে যাবে।
আর অবশ্যই কাজের জন্য সেক্রিফাইস করতে হবে, নিজের দায়িত্বকে নিজের আপন করে ভাবতে হবে। যেকোনো অফিসে, যেকোনো কর্মক্ষেত্রে সাফল্য পাওয়ার জন্য এর কোনো বিকল্প নেই। আর থেমে গেলে চলবে না। নিজের মেধার পরিচয় দিতে প্রয়োজনে মুখোমুখি মেধার লড়াইতে নামতে হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top