স্মৃতিকথা I দুর্গা অর্চনার স্মৃতি
ষাট ও সত্তরের দশকে আমাদের গ্রামীণ জীবনে কেমন ছিল দুর্গাপূজার রূপ? ধর্মবর্ণনির্বিশেষে সেই উৎসবে সম্প্রীতির সৌন্দর্যই-বা কেমন ছিল? লিখেছেন গোলাম শফিক
মনে তো পড়ে কত কথাই, দুর্গাপূজাকে ঘিরে। জন্মগ্রাম সরিষাপুর আর বারইগ্রামের মাঝখানে আছে এক খাল, সেটি তেজখালীর শাখা। খালটি পেরিয়ে আমাদের কাজের মেয়েদের কলসি কাঁখে যেতে হতো বারইগ্রাম, ছিরিবাড়িতে (হয়তো শুদ্ধ নাম শ্রীবাড়ি), কারণটা ছিল জল আনা। একটামাত্রই কল- আনতে হবে জল। আশপাশের দু-চার গ্রামে আর কোনো চাপকল ছিল না যে বিশুদ্ধ জলপানের সুযোগ পাব। সম্ভবত এই অবস্থা চলমান ছিল স্বাধীনতার পরও দু-এক বছর।
সম্পন্ন জোতদারের ঘরে জন্ম হলেও এ নিয়তি আমাদের মেনে নিতে হয়েছে। একটা টিউবওয়েল বসানোর যে হাঙ্গামা, সেটিই হয়তো নিরুৎসাহিত করেছিল। তবে জানতাম মাস্টারবাড়িতে একটি কল ছিল, কিন্তু আমাদের মেয়েরা একান্ত বাধ্য না হলে ওপথ মাড়াত না। জল আনতে গিয়ে নাকি ওই বাড়ির মেয়েদের ভ্রুকুটি সহ্য করতে হতো। এর চেয়ে খাল পেরোনো ঢের ভালো। তাই মূলত মৌলিক চাহিদা এই জলের সঙ্গেই জড়িয়ে আছে দুর্গা মায়ের স্মৃতি। কারণ, একমাত্র ওখানেই তখন দুর্গাপূজা হতো।
বাজিতপুরের অনিন্দ্যসুন্দর এ বারইগ্রামের ছিরিবাড়ির পাশেই ছিল আমাদের একমাত্র পূজামন্ডপ, এখন আরও প্রতিমা গড়া হয় এ গ্রামে। তা ছাড়া ক্রমে একটি ব্যয়বহুল বাণী অর্চনা মন্দিরই গড়ে উঠেছে এখানে, তবে অন্য পাড়ায়। কিন্তু পূর্বের অনুন্নত পরিবেশে, অপ্রাপ্তির হাহাকারের মধ্যে, মানুষের প্রেম-ভালোবাসা চাষ করা এইটুকু উঠোনে, হিন্দি ছবির গানবিহীন পূজার মন্ডপে, মোবাইলের মুহুর্মুহু রিংটোন ছাড়াই ডাকাডাকির প্রক্রিয়ার মধ্যে দেবীকে যেভাবে পাওয়া যেত, সেটা এখন যায় না। দারিদ্র্যপীড়িত নুয়ে হাঁটা মানুষ দুর্গতিনাশের উদ্দেশ্যে কীভাবে ছুটে যেতেন মায়ের ভোগারতির আসরে, তা স্মৃতিতে জ্বলজ্বল করছে। ক্রমে পূজারির অনেক দুর্গতিই হয়তো নাশ হয়েছে, একটু সোজা হয়ে দাঁড়িয়েছে বাংলার মানুষ, কিন্তু সবকিছুই কেমন মেকি হয়ে গেছে।
কী জন্য বলা হতো ‘ছিরিবাড়ি’ জানি না, তবে এটি একটি জেলেপাড়া, যাদের অনেকের সঙ্গেই ছিল আমাদের গভীর বন্ধুত্ব। কী করে ভুলি নামগুলোÑ রাজমোহন, মনোমোহন, ধীরেন্দ্র, নরেশদা! বছরব্যাপী চ্যাপা শুঁটকি এবং শীতকালে কাইকা, চাপিলা, ট্যাংরা শুঁটকির ব্যবসাই এদের প্রধান জীবিকা। কিন্তু এ অন্তজজনেরাই ছিল দুর্গা মায়ের প্রত্যক্ষ পূজারি।
জেলেপাড়ায় আসত সাহাপাড়ার মানুষেরাও, এখন যদিও বাণী অর্চনা মন্দিরটি গজিয়ে উঠেছে সাহাপাড়াতেই। আমরা বলতাম জালুহাটি, সালুহাটি। একদল বর্মণ, অন্যদল সাহা। সাহাদের মূল জীবিকা লুঙ্গি, গামছা, শাড়িকাপড়ের ব্যবসা। কিন্তু চুটিয়ে দুর্গাপূজা করত উভয় দলই। ঢাকে বাড়ি পড়লেই আমরা ছুটে যেতাম পূজার মন্ডপে। ঢাকের বাদ্য চলত সারা রাত। হ্যাজাক বাতির আলোয় দেখতাম দেবীর মুখ। দেখতাম কোনো একটি বাতির আলো কমে গেলে কীভাবে নরেশদা বা মনোমোহন বর্মণ আঙুল বা হাতের তালুতে টিপে টিপে সেটিতে বাতাস ভরে আলোটা উজ্জ্বল করত। সে উদ্ভাসিত আলোয় দেখতাম দশভুজা দেবী ও তাঁর সন্তানদের মুখ। বন্ধু চন্দন-নিরঞ্জন-নিহার রঞ্জনেরা বুঝিয়ে দিত কোনজন কোন দেবী-দেব।
ওরা কেউ দুর্গাপূজার বৃত্তান্ত সেভাবে বর্ণনা করতে পারত না। তবে দিতে পারত ভালো আরতি নৃত্য- কোমর দুলিয়ে, হাতে ধূপ-ধুনা নিয়ে, নানান অঙ্গভঙ্গি করে। দেব-দেবী পাঁচজন, আর ছিল মহিষাসুর (অপশক্তি)। সর্বমধ্যে দশভুজা দুর্গা অসুরের বুকে পা রেখে একটি অস্ত্র তার বুকে ঠেকিয়ে মাথা উচিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন, তাঁর বাহন সিংহ। উভয় পাশেই আছে তাঁর পুত্র-কন্যাদের প্রতিমা। বাঁয়ে দেবী লক্ষ্মী ও কার্তিক, যাঁদের বাহন যথাক্রমে প্যাঁচা ও ময়ূর; ডানে দেবী সরস্বতী ও গণেশ, যাঁদের বাহন হংস ও ইঁদুর। কার্তিকের চুলের ঢেউ আমাদের মোহিত করত। আবার গণেশের গজানন দেখে প্রথম দিনেই বিস্মিত হয়েছি। তখনই বন্ধুরা বর্ণনা করেছে কেন তিনি হাতিমুখো। তবে এখন আর আদ্যোপান্ত মনে নেই। পরে ঘাঁটাঘাঁটি করে জেনেছি, বারান্তরে বলা যাবে এসব।
তবে কীভাবে হিন্দু সংস্কৃতিতে অনুপ্রবেশ ঘটে আমাদের, সেটি বর্ণনার প্রয়োজনীয়তা এখন অনুভব করছি। তাতে স্বাধীনতা-পূর্ববর্তী একটি সমাজচিত্রও পাওয়া যেতে পারে। পিতার অবসরসূত্রে ১৯৬৭ সালে রাজধানী ঢাকা থেকে চলে আসি অজপাড়াগাঁয়। তখন পর্যন্ত ঢাকায় কোনো হিন্দু পরিবারের সঙ্গে আমাদের সখ্য হয়নি। চারপাশে সবই ছিল অবাঙালি উর্দু ভাষাভাষী মানুষ। হয়তো হিন্দু শব্দটি শুনেছি, কিন্তু এরা ছিল আমাদের স্পর্শের বাইরে। গ্রামে এসেই এদের সঙ্গে গড়ে ওঠে চরম সখ্য। কালক্রমে বুঝি বাঙালি সংস্কৃতির এপিঠ আর ওপিঠ হচ্ছে হিন্দু-মুসলমান। গ্রামে নতুন ঘরদোর বানানোর জন্য যে বাড়িটি কেনা হয়েছিল, সেটিও ছিল হিন্দুবাড়ি।
তামা-কাঁসার থালায় নাড়ু-পিঠা-খই-মুড়ি খাওয়ায় অভ্যস্ত হতে থাকি। ক্রমেই ঢোল-করতাল-মন্দিরার শব্দে তন্ময়তা সৃষ্টি হয়। তখন রাজনৈতিক বাস্তবতা ছিল ভিন্ন রকম। বড় কিছু ঘটবার আশঙ্কায় কোনো কোনো হিন্দু দেশ ত্যাগ করে ভারতে চলে যেতে থাকে। তবে পাকিস্তানিরা বিস্মিত হয়েছিল, বাংলা ভাগ হলেও এতটা সাংস্কৃতিক সম্প্রীতি কী করে বজায় আছে! তাই বাঙালি সংস্কৃতিকে এরা হিন্দু সংস্কৃতিই বোঝাত, হিন্দু সংস্কৃতি বলে প্রচারও করত। ওই দিকে আমরা বুঝেছি, জীবনাচারের প্রতিটি ক্ষেত্রেই যাদের নান্দনিকতার প্রকাশ (কপালে সিঁদুর দেওয়া থেকে শুরু করে বিশেষ উপচারসহযোগে পূজা অর্চনা করা) সেই হিন্দু সংস্কৃতি ত্যাগ করা অনুচিত। সেই ধারণাকে এখনো কামড়ে ধরে আছি। তবে সাম্প্রদায়িক পাকিস্তানিদের ধারণা ছিল সম্পূর্ণই ভ্রান্ত। আমরা বন্ধুদের আমন্ত্রণে পূজামন্ডপে গেলেও কোনো দিন কোনো মুসলিমকে কোনো দেবদেবীর সামনে মাথা নত করতে দেখিনি। কাশি দূর করার জন্য তুলসী পাতা আনলেও সেখানে গড় হয়ে প্রণাম করতে দেখিনি, দেখিনি কোনো তন্ত্রমন্ত্র জপতেও। তা হলে কী করে বাঙালি মুসলমানরা হিন্দু হয়ে গেল? ওই দিকে কারও কানে আজানের শব্দ এলে ঢাকঢোল বাদনে বিরতি এসে যায়। শঙ্খধ্বনি কখনো মাগরিবের নামাজে বিঘœ ঘটিয়েছে শুনিনি। হিন্দুরাও কি ভেবেছে কখনো মুসলমানরা তাদের বিরক্তির কারণ? একদা আত্মীয় সাইদুর রহমান মুন্সিকে সঙ্গ দিতে গিয়ে সরারচরের এক হিন্দু বাড়ির বারান্দায় নামাজ পড়তে হয়েছিল। কারণ, বাড়ির এক তরুণ তাদের বারান্দায় পাটি বিছিয়ে দিয়ে আমাদের ওখানেই নামাজ পড়ার অনুরোধ জানায়। সালাম ফিরিয়েই দেখতে পাই সিদ্ধিদাতা গণেশের ছবি। ধর্মভীরু সাইদুর রহমান আজ প্রয়াত, কিন্তু তার মহানুভবতা হৃদয়ে এখনো অক্ষয়। মাথা মোটা পাকিস্তানিরা এ সম্প্রীতি অনুধাবনে গভীরে প্রবেশ করতে ব্যর্থ হয়েছিল।
স্বগ্রাম সরিষাপুরে হিন্দুঘর হাতে গোনা হলেও পাশের বারইগ্রামে এরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল। ওই গ্রামে পান বিক্রি করতেন মনাদাস, লালদাস ও একজন বোবা বিক্রেতা। পিতা-মাতার অতিরিক্ত তাম্বুল অনুরাগের কারণে প্রায়ই দেখতে হতো তাদের মুখ। লালদাস বেঁটেখাটো, কমলার মতো গায়ের রঙ, কোনো দিন ঊর্ধ্ববস্ত্র পরতে দেখিনি। কেবল ধুতি পরে এখানে-সেখানে পান বিক্রি করার জন্য ছুটে বেড়াতেন। দেখে মনে হতো পৌরাণিক যুগেরই কোনো এক চরিত্র। এই রকম বিভিন্ন পেশার আরও অনেক হিন্দু চরিত্র ছিল, যারা আমাদের নানাভাবে জীবনধারণে সহায়তা করতেন। তাদের স্মৃতি আমাদের মধুর উত্তরাধিকার।
খুব কাছে বলে খাল পেরিয়ে চলে আসত খোল-করতাল ও কীর্তনের শব্দ। কোনো কোনো সময় সারা রাতেই চলত। ঘুমের ঘোরেও করোটিতে এই শব্দ আলোড়ন তুলত। প্রায় প্রতিদিনই জেলেপাড়ার শুঁটকির গন্ধ পেরিয়ে যেতাম সাহাপাড়ায় যেখানকার ঘরদোরগুলো অনেক পরিপাটি দেখতাম। গোবর দিয়ে লেপা হয়েছে বারান্দা, প্রতিটি বাড়ির আঙিনায় ফুটে আছে বাহারি ফুল। বউঝিয়েরা সকালেই স্নান সেরে ফিরছে ঘরে। ভেজা বস্ত্রে জবুথবু শরীর, ওইখান থেকে ছড়াচ্ছে পবিত্রতার সৌরভ।
জেলেপাড়ায় শীতলা দেবীর একটি মন্ডপও ছিল। বসন্তকালে তার পূজা হতো। এ পূজা অনুষ্ঠিত হতো চৈত্রের শুক্লপক্ষে (মতান্তরে মাঘ মাসে)। বসে যেত একটি মেলাও, আয়োজিত হতো ঘুড়ি কাটাকাটি। তবে তখন কলেরা-বসন্তের প্রকোপ ছিল বলে এ দেবীকে ওলা ওঠা, বসন্তের নিবারণকারী হিসেবে জ্ঞান করা হতো। আর এখানে দলে দলে ছুটে আসত নিঃসন্তান নারীরা। পরে বুঝেছি, যে হিন্দু মহিলা এ মন্ডপের সেবাইত, তিনি হয়তো কোনো ভেষজ ওষুধপথ্য দিতেন, তাতেই কাজ হতো। তবে এ পাড়ার জেলেরা দেবীদের বরপ্রাপ্তই ছিল। কেননা ছোট্ট একটি খালের ওপর ভর করে এদের জীবিকায় স্বাচ্ছন্দ্য এসেছিল। পুরো পাড়ায় ভাত-কাপড়ের কোনো কষ্ট ছিল না তেমন। তবে ভেবে বিস্মিত হই, তখন কত মিঠাপানির প্রাকৃতিক মৎস্যসম্পদের অধিকারী ছিলাম আমরা। চাষের কোনো কারবারই ছিল না।
দেখতাম, নবান্নের সময় বারইগ্রামের মেয়েরা মাগনে আসত আমাদের গ্রামে। তাদেরকে ধান-চাল দিয়ে বিদায় করতেন মা। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায়কারী জননী আমার, যিনি প্রতিটি বাক্য শুরু করতেন ‘আল্লাহর রহমত’ শব্দদ্বয় উচ্চারণ করে, তিনিও হিন্দু বালিকাদের ঝাঁপিতে ধান তুলে দিতেন সের কে সের। তাতে কি তাঁর ধর্ম বিনষ্ট হতো?
গর্ভধারিণী জননী থেকে এবার ফিরে আসি দুর্গা জননীর কাছে। দুর্গা একটি প্রতীকী নাম, যিনি শক্তির প্রতীক। এ দেবী মিশে আছেন মাতা বসুন্ধরার বিস্তীর্ণ ইমেজের সঙ্গে। দেবীদের কাছে আমরা ঋণী তাদের একাধিক শ্রুতিমনোহর নামের জন্য। তেমনি দেবী দুর্গাও। পৌরাণিক এ দেবী বাংলা ছাড়াও পূজিত হন নেপাল ও ভারতের অসমে। তিনি কাশ্মীর ও দাক্ষিণাত্যে অম্বা-অম্বিকা, গুজরাটে হিংগুলা ও রুদ্রাণী, কান্যকুঞ্জে কল্যাণী, মিথিলায় উমা এবং কুমারিকা প্রদেশে কন্যাকুমারী। তিনি আদ্যশক্তি, মহামায়া, শিবানী, ভবানী, দশভুজা ও সিংহবাহনা। দুর্গা বা দুর্গম নামক দৈত্যকে বধ করেন বলে এই নাম। আর জীবের দুর্গতি নাশ করেন, তাই দুর্গতিনাশিনী। ব্রহ্মার বরে পুরুষে অবাধ্য মহিষাসুর নামের এক দানব স্বর্গরাজ্য দখল করলে রাজ্যহারা দেবতারা বিষ্ণুর শরণাপন্ন হন। বিষ্ণুর নির্দেশে সকল দেবতার তেজঃপুঞ্জ থেকে যে দেবীর জন্ম হয় তিনিই দুর্গা। দেবতাদের শক্তিতে শক্তিময়ী এবং দশটি অস্ত্রে সজ্জিতা হয়ে এ দেবী যুদ্ধে মহিষাসুরকে বধ করেন। সে কারণেই তিনি মহিষমর্দিনী।
পূজা বিষয়ে জানা যায়, পুরাকালে রাজ্যহারা সুরথ এবং স্বজন প্রতারিত সমাধি বৈশ্য একদিন মেধস মুনির আশ্রমে গমন করেন। আর মুনির পরামর্শেই তাঁরা দেবী দুর্গার পূজা করেন। দেবীর বরে তাদের মনস্কামনাও পূর্ণ হয়েছিল। সূচনায় পূজাটি বসন্তকালে হতো বিধায় এটি ছিল বাসন্তীপূজা। এখন যে শারদীয়া এবং সর্বজনীন পূজা উৎসব সেটিরও কারণ আছে। কৃত্তিবাসী রামায়ণে উল্লেখিত, রামচন্দ্র রাবণ বধের জন্য অকালে শরৎকালে পূজা দিয়েছিলেন। তাই এটিকে বলা হয় অকালবোধন বা শারদীয় দুর্গাপূজা। আমরা জানি, এ সময় শুক্লা ষষ্ঠীতিথিতে দেবীর বোধন হয় এবং সপ্তমী, অষ্টমী ও মহানবমীর দিনে পূজা দিয়ে দশমীর সন্ধ্যায় বিসর্জিত হন দেবী। পূজায় নানা স্থানে বসে দশোহরার মেলা। একদা নৌকাবাইচও হতো। আমাদের ঈদের মতোই পূজারিরা নতুন পোশাক পরেন- কোলাকুলি, প্রণাম, আশীর্বাদ ও শুভেচ্ছা বিনিময়ও হয় তখন।
দুর্গাপূজার তিনটি প্রকাশ: সাত্ত্বিক, তামসিক, রাজসিক। অতীতে পূজায় পশু বলি হতো। তার রং অতসীপুষ্প বর্ণ বা তপ্ত কাঞ্চন বর্ণ, কখনো রক্তবর্ণ। তিনি ত্রিনয়না। তবে কিনা পূজা হতে পারে অন্যত্রও- দর্পণে, অনাবৃত ভূমিতে, পুস্তকে, চিত্রে, ত্রিশূলে, শরে, খড়গে বা জলে। অনেকের মতে রাজশাহীর তাহিরপুরের রাজা কংস নারায়ণ, মতান্তরে নদীয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় (১৭১০-১৭৮৩) বঙ্গদেশে দুর্গাপূজার এটি প্রচলন করেন। ব্রিটিশরাও এতে যোগ দেয়। তখন ধনীদের নাচঘরগুলো নর্তকী, বাইজি ও গায়িকাদের কলহাস্যে মুখরিত ছিল। তবে এসব নৃত্যগীতের পাশাপাশি চলত যাত্রা-পাঁচালি-কবিগানও।
নিজ গ্রামের পাশে যে সাহাপাড়ার কথা উল্লেখ করা হয়েছে, যাদের একসময় তেমন কোনো সঙ্গতিই ছিল না, শুনলাম তারা এখন দেবী দুর্গাকে গয়নাগাটিও পরায়। এমন হয়তো বাংলাদেশের অন্যান্য বারোয়ারি পূজামন্ডপেও দেখা যাবে। কারণ, সার্বিকভাবে এ ভূখন্ডের মানুষের অবস্থার উন্নয়ন ঘটেছে।
একমাত্র আমাদের গ্রামেই একটি ব্রাহ্মণ পরিবার ছিল। শৈলেশদা (আমার গৃহশিক্ষক, এখন পশ্চিমবঙ্গের রানাঘাটবাসী), দেবেশদা, দুলাল গাঙ্গুলী, হরিঠাকুর, পরেশ ঠাকুর- এরা ছিলেন আমাদের পরিচিত নাম। আর ছিল বন্ধু বাচ্চু গাঙ্গুলী। পরিবারটি এখনো আছে, তবে বয়োজ্যেষ্ঠদের কেউ আর বেঁচে নেই। সকালে পরেশ ঠাকুরকে দেখতাম পুকুরে নেমে সূর্যের দিকে তাকিয়ে পৈতা ঘষে ঘষে কী সব মন্ত্র জপছেন। আমাদের কেউ একজন অনুকরণ করে অথবা বানিয়ে ফেলে সেই সব মন্ত্র:
গঙ্গা মা ভগবতী
হাঁটু পানিত মাথা যাতি
যদি পাপ কইরে থাকি
পাপ নাই একরতি।
হিন্দু বন্ধুদের এই সব বললে তারা হাসত। তবে বরাবরই পূজার প্রসাদ গ্রহণের জন্য নিমন্ত্রণ জানাত। কখনো খাওয়া হতো খিচুড়ি। আর পূজার আসরে গিয়ে দেখতাম আমাদের গ্রামেরই কোনো না কোনো পুরোহিত বসে মন্ত্র জপছেন। আশ্বিন এক অদ্ভুত মাস। কারণ, কখনো আমাদের যেতে হতো শিশির মাড়িয়ে, শিউলিগুলো তখন ফুটতে শুরু করেছে। আবার বৃষ্টি হয়ে ভেসেও যেত। পূজার সময় নাকি দুর্গা মায়ের বরে বৃষ্টি হতেই হবে।
বলছিলাম যে, পূজার আসরে গণেশের অদ্ভুত মূর্তি দেখে আমরা বিস্মিত হতাম। তার কারণটি হিন্দু বন্ধুরা যেমন ব্যাখ্যা করত, পরে তা আরও জেনেছি নানাভাবে। তবে ২০০২ সালে মহারাষ্ট্রের পুনায় গিয়ে যেভাবে গণেশ ভক্তি লক্ষ করেছি, তা বিস্মিত হওয়ার মতো। গণেশ শিব ও পার্বতীর পুত্র, সিদ্ধিদাতা। তিনি খর্বাকৃতি, ত্রিনয়ন, চতুর্ভুজ, হস্তীমস্তক। তাঁর উদরের ভাঁজ আমরা ছুঁয়ে দেখাতাম। লক্ষ করতাম শঙ্খ-চক্র-পদ্মধারী গণেশের বাহন ইঁদুর। তিনি মঙ্গল ও সিদ্ধির জনক এবং সর্বাগ্রে পূজিত হন। গণেশ গজানন ও একদন্ত। বিষ্ণুর বরে পার্বতী পুত্রসন্তান লাভ করলে সদ্যোজাত শিশুকে দেখার জন্য দেবতারা উপস্থিত হন। এ সময় শনি দেবের দৃষ্টিপাতে তাঁর মস্তক বিচ্ছিন্ন হয়। তবে বিষ্ণুর কৃপায় হস্তীমুন্ড পেয়ে তিনি বেঁচে ওঠেন। তাই যাতে অবহেলিত না হন, দেবতারা তাকে সর্বাগ্রে পূজা দেওয়ার নিয়ম করেন।
ব্রহ্মকৈবর্ত পুরাণে পাওয়া যায়, তিনি ছিলেন শিব-পার্বতীর দ্বাররক্ষক। সেখানে পরশুরামের সঙ্গে গণেশের তুমুল যুদ্ধ হয়। তাতে কুঠারাঘাতে একটি দাঁত সমূলে উৎপাটিত হয়। তাই তিনি একদন্ত। তিনি বেদের লিপিকার। অপর নাম গজানন, লম্বোদর, বিনায়ক, সিদ্ধিদাতা। গণেশ দুর্গাপূজার সময় অন্যান্য দেবতার সঙ্গেই পূজিত হন। তাঁর ছবি বা মূর্তি থাকে সর্বত্রই, বসতঘর ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে। ব্যবসায় সফলতা কামনায় তাঁরই শরণ নিতে হয়, কখনো লোকসান হলে রচিত হয় বাগ্ধারা ‘গণেশ ওল্টানো’।
দুর্গাপূজার পরের পূর্ণিমায় বসে কোজাগরি লক্ষ্মীপূজার আসর। ঐশ^র্যের দেবী লক্ষ্মী। এটিকে বলা হয় কোজাগরি রাত। কী বিশ্বাসে জানি না, মানুষের গাছের ফলফলারি অনেক বিনষ্ট করা হতো, চুরি করে খাওয়া হতো দেদার। অন্ধ এক বিশ্বাস ছিল যে, এ রাতের চুরিতে পাপ তো হয়ই না, উল্টো কিছু পুণ্য অর্জিত হয়। এমনকি হাঁস-মুরগিও জোগাড় করা হতো অন্যের খোঁয়াড় থেকে। এমনই ছিল আমাদের শৈশব-কৈশোরের কান্ডকারখানা। তবে হিন্দু বন্ধুদের বাড়িতে পূজার প্রসাদ খেতেও যেতাম। সে রাতে আকাশ থাকত মেঘমুক্ত জ্যোৎস্নায় উজ্জ্বল। আসর বসে যেত ঘরের উঠোনে খড়-পাটশোলা বিছিয়ে, আড্ডা চলত গভীর রাত অবধি। সময়টা কাটত চালভাজা, শিমের বিচি, কাঁঠালের বিচি ও তাল-নারকেল খেয়ে।
জমাপুরের বন্ধু নয়ন-নারায়ণদের ঘরে প্রথম দেখেছিলাম লেখা আছে একটি ক্যালেন্ডারের ওপর, বীণারঞ্জিত পুস্তক হস্তে ভগবতী-ভারতী দেবী নমস্তুতে! সকালে দেখে বিকেলেই সেটি নির্ভুল উচ্চারণ করতে পারায় নয়ন সরকার বিস্ময় প্রকাশ করেছিল।
দেখলাম যে, আমাদের সাহাপাড়ার সামর্থ্য আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। এলাকায় প্রথম জাঁকজমকের সঙ্গে পালিত হচ্ছে সরস্বতীপূজা, শ্রী পঞ্চমীতে। ওখানে গিয়ে উপস্থিত হয়ে সন্তোষদার (দ্বিতীয় গৃহশিক্ষক, এঁদের হাতেই মানুষ) মুখে প্রথম শুনলাম এ দেবীর রং হচ্ছে সাদা, সাদা পবিত্রতার প্রতীক, আরও কত কথা…। এ দেবীর বাহন হংস দুধ পান করলে জল আলাদা হয়ে পড়ে থাকে তলানিতে, এর চেয়ে বিস্ময় পৃথিবীতে আর কিছু আছে? তখন আমরা হয়তো কলেজ ত্যাগ ও বিশ^বিদ্যালয়ে প্রবেশের সন্ধিক্ষণে, তা-ও প্রায় চার দশক আগের কথা। তখনো চন্দনদের বাড়ির বাঁশঝাড়ের নিচের সরু পথটি ছিল যেখানে জন্মাত অগণন বিদ্যাপাতার গাছ। হিন্দু বন্ধুদের অনুকরণে আমরাও বিদ্যাপাতা ছিঁড়ে বইয়ের ভেতর রেখে দিতাম। কারণ, তাতে বিদ্যা বৃদ্ধি পায়। বিদ্যা বৃদ্ধির জন্য বন্ধুদের সে কী প্রাণান্তকর চেষ্টা। তাই দুর্গাপূজার মন্ডপে অত অত দেবদেবী থাকতে ওদেরকে দেখতাম কেবল মা বীণাপাণির পায়ে বইখাতা ছোঁয়াত। কানাইদার মতো ভালো ছাত্রকেও দেখেছি, তার বিদ্যাবুদ্ধি আরও বৃদ্ধি পাওয়ার মানসে দেবী সরস্বতীর শরণ নিতেন।
এসবই এখন স্মৃতির আকরে বন্দি। করপোরেট পুঁজির দাপটে দুর্গাপূজা ও অন্যান্য অনুষ্ঠানের আদল পাল্টে গেছে। সব ক্ষেত্রেই এখন বাহুল্য প্রদর্শনের প্রতিযোগিতা লক্ষ করি। যেভাবে উচ্চ স্বরে গান বাজানো হয়, তার কাছে আমাদের চিরায়ত ঢাকের শব্দ ম্লান হয়ে যায়। শব্দতরঙ্গের এত পুরু পর্দা ভেদ করে প্রায়ই আসতে পারে না মন্দিরার মিহি তাল। বাঙালি মানসে কি এখন দুর্গতি ভর করেছে? সে দুর্গতি নাশ করবে কে? কে বধিবে মনের রাবণ? আবার কি দেবী দুর্গা আসবেন ভক্তদের প্রবোধ দিতে, দিতে কোনো অনুশাসন? রামচন্দ্র তো নই, যে অন্য কোনো অকালে ঘটাবে দেবীর বোধন।
ছবি: ইন্টারনেট