ফিচার I দশমহাবিদ্যা
যে দশটি রূপে শিবকে দর্শন দিয়েছিলেন দেবী। এর রয়েছে পারমার্থিক ও ইহজাগতিক নানা অর্থ
দেবীর দশটি রূপের প্রকাশ দশমহাবিদ্যা। পুরাণ মতে, সতী তাঁর স্বামী শিবকে নিজের এই দশটি রূপের দর্শন করিয়েছিলেন। কিন্তু রূপের সঙ্গে ‘মহাবিদ্যা’র কী সম্পর্ক? বিদ্যা শব্দটির অর্থ নানাবিধ, যেমন- প্রকাশ, রূপ, জ্ঞান ইত্যাদি। দশ রকমের জ্ঞান বা গুণের একেকটি প্রকাশই একত্রে ‘দশমহাবিদ্যা’। ‘বৃহদ্ধর্ম পুরাণ’ অনুযায়ী গিরিরাজ কন্যা পার্বতী পূর্বজন্মে ছিলেন প্রজাপতি দক্ষরাজকন্যা সতী। দক্ষরাজের গৃহে যজ্ঞের সময় সতী স্বামীগৃহ থেকে পিত্রালয়ে যেতে চাইলে মহাদেব শিব জানতেন, পিতৃগৃহে স্বামীর ব্যাপারে গঞ্জনা শুনতে হবে সতীকে।
শিব ত্রিকালজ্ঞ। তিনি জানতেন, স্বামীনিন্দা সহ্য করতে না পেরে সতী দেহত্যাগ করবেন। তাই পিত্রালয়ে যেতে বাধা দিয়েছিলেন স্ত্রীকে। কিন্তু স্বামী শিবের বাধা মেনে নেননি সতী। এর ফলে তাঁদের সংসারে তৈরি হয় কলহ। একপর্যায়ে সতী তাঁর নিজের দশটি রূপের দর্শন করান স্বামী শিবকে। দেখে শিব পালানোর চেষ্টা করেন। এই অবস্থায় তাঁকে নিজের দশটি রূপ দিয়ে ঘিরে ফেলেন সতী। শেষে শিব তাঁকে পিত্রালয়ে যাওয়ার অনুমতি দেন।
সতীর এই দশটি রূপের প্রকাশে হাজির হলেন কালী, তারা, ষোড়শী, ভৈরবী, ভুবনেশ্বরী, ছিন্নমস্তা, ধূমাবতী, বগলা, মাতঙ্গী ও কমলাকামিনীর মতো দেবীরা। বৃহদ্ধর্ম পুরাণে মহাবিদ্যাকে সংখ্যায় ‘দশ’ বলা হলেও এ নিয়ে মতপার্থক্য রয়েছে। অনেক পৌরাণিক বয়ানে মহাবিদ্যার সংখ্যাকে সাতাশ বলা হয়েছে। যদিও তা অনেক পরের ঘটনা। এই সাতাশ মহাবিদ্যায় দুর্গা, কামাখ্যা ও অন্নপূর্ণাকেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়। আবার মালিনী বিজয় গ্রন্থের মতে, মহাবিদ্যা হলেন কালী, নীলা, মহাদুর্গা, ত্বরিতা, ছিন্নমস্তিকা, বাগ্বাদিনী, অন্নপূর্ণা, প্রত্যঙ্গিরা, কামাখ্যাবাসিনী, বালা, মাতঙ্গী ও শৈলবাসিনী। সে যা-ই হোক, বিষয়টি অখন্ড বঙ্গের সাংস্কৃতিক ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড় নিয়ে আসে। শাক্তধর্মে ভক্তিবাদের সূচনা করেছিল এই মহাবিদ্যার ধারণা।
মূলত এটি রয়েছে তন্ত্রশাস্ত্রের কেন্দ্রে। এই দশটি রূপ হলো দশ প্রকারের তন্ত্রবিদ্যা। যা জগৎ, প্রকৃতি ও মানুষের মধ্যে আন্তসম্পর্কে আবর্তিত। আমরা এই দশমহাবিদ্যার প্রতিটি বিদ্যা বা রূপকে সংক্ষেপে ব্যাখ্যা করতে পারি।
কালী: সর্বসংহারকারিণী, কাল ও মৃত্যুর দেবী। আবার হরিবংশ গ্রন্থে কালীকে দানবী বলা হয়েছে। মূর্তির পৌরাণিক চিহ্নের পাঠোদ্ধার থেকে অনেকের কাছে স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে ভারতবর্ষের পূর্বাঞ্চলের জল-জমি-জঙ্গলে পরিপূর্ণ এলাকায় (বঙ্গদেশ এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ) আর্য অনুপ্রবেশকে প্রতিরোধ করার জন্য কোনো এক শক্তিসম্পন্ন অনার্য নারী লড়াইয়ে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। যিনি ঘোর কৃষ্ণবর্ণা। তাঁর প্রতিরোধে ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছিল আর্যরা। অনার্যদেরই রাক্ষস, রাক্ষসী, দানব-দানবী হিসেবে দেখানো হয়েছে বিভিন্ন আর্যীয় পৌরাণিক গ্রন্থে। বৈদিক সমাজও পরে কালীকে গ্রহণ করে অনুকূল রূপান্তরের মধ্য দিয়ে। তন্ত্রে কালী সময়ের আদি ও মৃত্যুর অন্ধকার রূপে চর্চিত। এ ছাড়া তিনিই মহাপ্রকৃতি।
তারা: পথপ্রদর্শক ও রক্ষাকারিণী (তারিণী) দেবী। বিশ্বের উৎস হিরণ্যগর্ভের শক্তি এবং মহাশূন্যের প্রতীক। মহাজগতের প্রতি মানুষের বন্দনার কালপর্ব দেবী তারার ধারণার মধ্যে হাজির। তারার একটি অর্থাৎ নক্ষত্র; যিনি অন্ধকারে দিকনির্ণয়ে সহায়তা করেন। আবার নক্ষত্র থেকেই জগতের সৃষ্টি। তাই তারাকেই মনে করা হয় পৃথিবীর উৎস। আর মহাশূন্যে তিনি ব্যাপ্ত। তিনি তাই মহাশূন্যের প্রতীক। তারা মূলত বৌদ্ধ দেবী। সেখান থেকেই তাঁর ধারণাকে তন্ত্রবিদ্যায় নিয়ে আসা হয়।
ষোড়শী: অন্য নাম ত্রিপুরসুন্দরী বা ললিতা-ত্রিপুরসুন্দরী। পূর্ণতা ও পূর্ণাঙ্গতার স্বরূপ। শ্রীকুল সম্প্রদায়ের সর্বোচ্চ দেবী। তান্ত্রিক পার্বতী নামে পরিচিত। দেবী পার্বতী প্রকৃতির মহাবিদ্যা ধারণ করেই তন্ত্রে ষোড়শী।
ভুবনেশ্বরী: ভুবনের ঈশ্বরী বা বিশ্বজননীই হলেন ভুবনেশ্বরী। জগতের বিদ্যমান শক্তিসমূহের প্রতীক তিনি।
ভৈরবী: ভয়ংকরী দেবী। সেই কামনা ও প্রলোভনের স্বরূপ, যা মৃত্যুর দিকে টেনে নিয়ে যায়। কামনা ও প্রলোভনের মধ্যে ফেলে যেমন তিনি জীবন নাশ করতে পারেন, তেমনি তিনি রিপু নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে এমন প্রবৃত্তি থেকে মানুষকে নিবৃত্ত করতে পারেন। বিষয়টি তন্ত্রেও গুরুত্বপূর্ণ। কাম দিয়েই কামনা উত্তরণের দেহবিদ্যার ধারণা তন্ত্রে প্রাচীন। তবে এ ব্যাপারে শ্রীচৈতন্য তন্ত্রের সমালোচনা করেছেন। কাম দিয়ে কামনা জয় করার মধ্যে দেহকে উপায় করে তোলার বিষয়টিতে শেষমেশ উত্তরণের বদলে কামের চক্রেই আটকে যাওয়ার ঘটনা ঘটতে পারে।
ছিন্নমস্তা: উলঙ্গিনী দেবীমূর্তি। তিনি স্বহস্তে নিজ মস্তক ছিন্ন করে নিজের রক্ত পান করেন। চক্রপথে আত্মধ্বংস ও পুনরুজ্জীবনের মাধ্যমে সৃষ্ট জগতের অবিরাম বিদ্যমানতার শক্তির প্রতীক এই ছিন্নমস্তা দেবী। অহম ও আমিত্ব ধ্বংসের মধ্যে নির্বাণপ্রাপ্তির সাধনতত্ত্বের বিদ্যাও রয়েছে এই মূর্তির মর্মে।
ধূমাবতী: বিধবা দেবীমূর্তি। অগ্নির দ্বারা জগৎ ধ্বংসের পর ভস্মরাশির মধ্য থেকে যে ধূম নির্গত হয়, তার স্বরূপ। তিনি কখনো কখনো অলক্ষ্মী বা জ্যেষ্ঠাদেবী নামেও অভিহিত হন।
বগলা: শত্রু নিষ্ক্রিয়কারিণী দেবী। ঈর্ষা, ঘৃণা ও নিষ্ঠুরতার মতো মানবচরিত্রের অন্ধকার দিক নিয়ন্ত্রণ করেন। যে বিদ্যায় মনোজগতে ক্রূরতাকে নিয়ন্ত্রণ করা যায়, সেই বিদ্যার প্রকাশ বগলা বা বগলামুখী।
মাতঙ্গী: কর্তৃত্বশক্তির প্রতীক। কালীকুল সম্প্রদায়ে জাতপাত ও বর্ণবিভাজনবিরোধী দেবী। ইনি তান্ত্রিক সরস্বতী হিসেবেও পরিচিত।
কমলাবাসিনী: শুদ্ধ চৈতন্যের দেবী কমলা। ইনি বরাভয় প্রদায়িনী। ভাগ্যদেবী লক্ষ্মীর অন্য রূপ। তান্ত্রিক লক্ষ্মী নামেও পরিচিত। রিপু-নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে চৈতন্য শুদ্ধ করলেই প্রাকৃতিক শক্তিসমূহের সঙ্গে আত্মসংযোগ সম্ভব। তন্ত্রবিদ্যায় এটাই জীবের পরম সাফল্য।
পৌরাণিক আখ্যান ও তার ভিত্তিতে তৈরি হওয়া এই দশটি রূপকল্পের আড়ালে যে অর্থ লুকিয়ে রয়েছে, তা কেবল অধিবিদ্যক ধারণা নয়, ইহলৌকিক জীবনচর্যার দার্শনিক প্রতীকও বটে। এসব পৌরাণিক রূপকল্পের ক্রিয়াপদভিত্তিক আর্থসামাজিক বয়ান আরও ব্যাপক। তা নিয়ে অবশ্য ভিন্ন পরিসরে আলোচনা হতে পারে।
অতনু সিংহ
ছবি: সংগ্রহ