skip to Main Content

ফিচার I পঞ্চমানবী

বাংলা চলচ্চিত্রে চরিত্র সৃজনের দিক থেকে নারীর গুরুত্ব অপরিসীম। মমতায়, দায়িত্বশীলতায়, সৌন্দর্যে, দৃঢ়তায়, তার ব্যক্তিত্ব নানারূপে প্রকাশিত। এই আয়োজনে বেছে নেওয়া হলো তেমন পাঁচজন নারীকে। লিখেছেন অতনু সিংহ

সামগ্রিকভাবে বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে বহু নারী চরিত্র বরাবরই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। শুধু প্রেমের আখ্যানে এই গুরুত্ব তৈরি হয়নি, বরং সামাজিক তাৎপর্য তৈরি হয়েছে নানাভাবে। তাই এই উৎসবের আবহে সত্যজিতের তিনটি ছবি এবং ঋত্বিকের দুটি ছবির মানবী চরিত্র আমরা তুলে ধরছি। পাশাপাশি পোশাক ও সাজসজ্জার অনুসরণে এসব চরিত্রের ইমেজকে আজকের মডেলদের মাধ্যমে পুনর্নির্মাণের প্রচেষ্টা থাকল ক্যানভাসের শারদসংখ্যায়।

দয়াময়ী

১৯৬০ সালে সত্যজিৎ রায়ের পরিচালনায় তৈরি হয় ‘দেবী’ ছবিটি। মুখ্য চরিত্র দয়াময়ী। এই চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন শর্মিলা ঠাকুর। বাংলার শাক্ত ঐতিহ্যে নারীই শক্তি ও প্রকৃতিস্বরূপা। কিন্তু কোনো মানুষকে যদি মানবসত্তা থেকে বিযুক্ত করে তার ওপর দৈবসত্তা আরোপ করা হয়, তখন সে বিচ্ছিন্ন সত্তার কারাগারে বন্দি হয়ে পড়ে। দয়াময়ী চরিত্রটিও এমন এক দৈবসত্তায় বন্দি। শেষমেশ এই দৈবশৃঙ্খলা তথা পিতৃতান্ত্রিক শেকল থেকে নিজেকে মুক্ত করে।
মডেল: রুবি হোসেন

আরতি

১৯৬৩ সালে মুক্তি পায় সত্যজিৎ রায় পরিচালিত ছবি ‘মহানগর’। এর কেন্দ্রীয় চরিত্র আরতি মজুমদার। অভিনয় করেছিলেন মাধবী মুখোপাধ্যায়। নারীর অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা, আত্মসম্মান ও সামাজিক ন্যায়বিচারের ব্যাপারে তার সচেতনতা ও দৃঢ় অবস্থানের দিকগুলো ফুটে উঠেছিল এই চরিত্রে। স্বামীর অর্থনৈতিক অবস্থার কথা মাথায় রেখে সংসারের ব্যাপারে নিজের আর্থিক অবদান রাখতে একটি চাকরিতে যোগ দেয় আরতি। ছবির প্রেক্ষাপট ১৯৫০-এর কলকাতা। সেই সময়ে কলকাতার মধ্যবিত্ত বাঙালি সমাজে গৃহবধূর চাকরিতে যোগ দেওয়ার মতো ঘটনা খুবই বিরল। পরিবারকে অর্থনৈতিকভাবে সে সচ্ছল করে তোলে। ক্রমে স্বামী চাকরি হারালে সে হয়ে ওঠে সংসারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। চাকরিক্ষেত্রে তার বন্ধুত্ব হয় এডিথ নামে এক অ্যাংলো মহিলার সঙ্গে। একদিন ওই মহিলাকে মিথ্যা সন্দেহের বশে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়। বিষয়টা মেনে নিতে পারেনি আরতি। প্রতিবাদস্বরূপ চাকরি থেকে সে ইস্তফা দেয়।
মডেল: তৃণ

বিমলা

রবীন্দ্রনাথ ‘ঘরে বাইরে’উপন্যাসটি লিখেছিলেন ১৯০৫ সাল-পরবর্তী স্বদেশি আন্দোলনের পটভূমিতে। এটি ১৯৮৫ সালে সত্যজিৎ রায়ের হাতে চলচ্চিত্রায়িত হয়। তথাকথিত বিপ্লবী, সামন্ততান্ত্রিক পরিবার, বাল্যবিবাহ এবং ত্রিকোণ প্রেম ইত্যাদি অনুষঙ্গ গল্পে রয়েছে। ছবিটির গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র বিমলা। যে নিখিলেশের স্ত্রী। স্বামীর বিপ্লবী বন্ধু সন্দ্বীপের সঙ্গে প্রণয়ের সম্পর্ক তৈরি হয় বিমলার। বিত্তবান বাড়ির গৃহবধূর নিজেকে এবং বহির্জগৎকে জানতে চাওয়ার আকাঙ্ক্ষার বিষয়টিও এখানে গুরুত্বপূর্ণ। বিমলার চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন স্বাতীলেখা সেনগুপ্ত।
মডেল: লাকি

অনসূয়া

ঋত্বিক কুমার ঘটক তাঁর ছবিতে নারীকে গ্রেট মাদার আর্কিটাইপে রূপ দিতেন মিথের সমাজ-রাজনৈতিক বিনির্মাণের মধ্য দিয়ে। ১৯৬১ সালে ‘কোমলগান্ধার’ ছবিটি নির্মাণ করেন ঋত্বিক। এই ছবির প্রধান নারী চরিত্র অনসূয়া। অভিনয় করেন সুপ্রিয়া দেবী। প্রেক্ষাপট বাংলা ভাগ। চরিত্রটি সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ। ক্ষুধা-দারিদ্র্যের তৎকালীন পশ্চিমবঙ্গে অনসূয়ার মধ্যে শস্যপ্রতিমার ইমেজ তুলে ধরে কৃষিবিপ্লবের প্রস্তাব সূক্ষ্মভাবে রয়ে গেছে এই ছবিতে।
কোমলগান্ধারে অভিজ্ঞানম শকুন্তলমের মঞ্চায়নের দৃশ্য ছাড়াও অন্য বেশ কিছু নাট্য প্রযোজনার দৃশ্য রয়েছে। তেমনই একটি নাটকে পূর্ব বাংলার কৃষক বধূর চরিত্র দেখা যায় অনসূয়াকে। গোটা ছবিতে অনসূয়া আধুনিকা। কিন্তু আমরা এখানে যে কোমলগান্ধার ছবির নাট্যদৃশ্যের অনসূয়াকে চিত্রায়িত করেছি।
মডেল: বর্ণ

রাজার ঝি

নদীমাতৃক বাংলায় মালোদের জীবনসংগ্রামের প্রেক্ষাপটে রচিত অদ্বৈত মল্লবর্মণের উপন্যাস ‘তিতাস একটি নদীর নাম’। এটি চলচ্চিত্রায়িত হয় ১৯৭৩ সালে, ঋত্বিক কুমার ঘটকের পরিচালনায়। এই ছবির প্রধান দুটি নারী চরিত্র রাজার ঝি (অনন্তর মা) ও বাসন্তী। দুটি চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন যথাক্রমে কবরী সারোয়ার ও রোজী সামাদ।
ছবিতে নারী কখনো পুরুষতন্ত্রের শিকার আবার কখনো প্রতিরোধের মুখ। নদীমাতৃকার মতোই রাজার ঝি এতে চিরায়ত বাঙালি জননীর প্রতীক। যদিও সে পুরুষের লালসা, সমাজ-রাজনৈতিক প্রতিহিংসায় বিপন্ন। লেঠেলদের হাতে খুন হওয়া স্বামীর শোকে মৃত্যু হয় তারও। অনন্তর মা কোমল স্বভাবের, অন্যদিকে এর বিপরীত বাসন্তী। সে যেমন সন্তান ও তার মাকে আশ্রয় দিতে পারে, তেমনি হয়ে ওঠে ব্রাহ্মণ-কায়স্থদের শোষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ-প্রতিরোধের রূপকও। এই দুটি চরিত্র নারীর দুই রকম অবস্থার নির্দেশক। অনন্তর মা যেন একই সঙ্গে রাজার ঝি ও বাসন্তী।
মডেল: এমা

স্টাইলিং ও কনসেপ্ট: নুজহাত খান
মেকওভার: পারসোনা
ছবি: সৈয়দ অয়ন ও ইন্টারনেট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top