ছুটিরঘণ্টা I মনোরম অক্ষয়ধাম
দিল্লির অক্ষয়ধাম। সেখানকার স্থাপত্য আর সুবিন্যস্ত পৌরাণিক উপাদান খুব দৃষ্টিনন্দন। রয়েছে নৈসর্গিক বিনোদনের ব্যবস্থাও। জানাচ্ছেন দিদারুল দিপু
হাজারো ব্যস্ততা গুটিয়ে ঈদের ছুটির এক দিন আগেই ছুটে চলা দিল্লির পথে। কথায় বলে, ‘দিল্লিকা লাড্ডু খেলেও পস্তায়, আবার না খেলেও পস্তায়।’ তাই সেই লাড্ডুর আশায়। ৮ আগস্ট সকালেই দিল্লির সূর্য স্বাগত জানাল আমাদের- হুম্, এটি ছিল গ্রুপ ট্যুর। যদিও সেদিনই দিল্লিকে চেনা হয়নি পুরোপুরি। কারণ, তাকে সময় দেওয়ার ব্যাপারটা ছিল পুরো ট্যুরের প্রায় মাঝামাঝি। ১৫ আগস্ট ভারতের স্বাধীনতা দিবস। প্রায় সব দর্শনীয় স্থান এদিন বন্ধ থাকে। তাই ১৪ আগস্ট দিল্লি পরিভ্রমণে বেরোলাম আমরা। দেখার মধ্যে অনেক কিছুই ছিল। কিন্তু পুরোপুরি হিন্দু ট্র্যাডিশন এবং ভারতীয় সংস্কৃতিসংবলিত যে স্থাপত্যটি আমাকে বিস্মিত করে, তা হলো ‘অক্ষয়ধাম মন্দির’। যেটা মূলত একটি কমপ্লেক্স।
দিল্লিতে ট্রাফিক জ্যাম ঢাকার চেয়ে বেশিই। তাই সকালে ঝটপট খেয়ে-দেয়ে রওনা দিলাম। কমপ্লেক্সের কাছাকাছি আসতেই মাইকে জানানো হচ্ছে, আপনার ব্যাগ, মোবাইল ফোন যথাস্থানে জমা দিন। তার মানে, আপনি ছাড়া সেখানে আর কিছু প্রবেশযোগ্য নয়। মন খারাপ হলো কিছুটা, ট্যুরে এলাম অথচ ছবি তুলতে পারব না। কিন্তু কী আর করা, দেখতে তো হবেই। চেকিং শেষ করে কমপ্লেক্সে ঢুকতেই নির্বাক হয়ে গেলাম এর গাম্ভীর্য দেখে। তাড়াহুড়ো ভুলে গেলাম, ছবির কথাও। শুধু দেখতে লাগলাম এর গায়ে খচিত কারুকার্যময় অলংকরণ।
এই অক্ষয়ধাম কমপ্লেক্স স্বামী নারায়ণ অকশার ধাম নামেও পরিচিত। যুগ যুগ ধরে বহমান হিন্দু রীতি-নীতি আর ঐতিহ্যের ধারক। প্রায় ১০০ একর জমির উপর নির্মিত এই কমপ্লেক্সের নির্মাতা প্রমুখ স্বামী মহারাজ। এর অনুপ্রেরণায় ছিলেন যোগিজী মহারাজ।
কমপ্লেক্সের মাঝখানে অবস্থিত মন্দিরটি মূলত বাস্তুশাস্ত্র ও পঞ্চরত্নে নির্মিত। সিমেট্রিক্যাল কম্পোজিশনে তৈরি এই ভবনে রয়েছে কিছু এক্সিবিশন হল, যা স্বামী নারায়ণের জীবন ও কাজ সম্পর্কিত। ১৪১ ফুট উঁচু ও ৩১৬ ফুট চওড়া এই মন্দির উন্মোচিত হয় ২০০৫ সালের ৬ নভেম্বর। আধুনিক সংস্করণের সঙ্গে স্থপতি যুক্ত করেছেন মহারীতি বাস্তুস্থাপনাশৈলী।
রাজস্থানি পিংক স্যান্ডস্টোন এবং ইতালিয়ান কারারা মারবেলের মাধ্যমে রচিত হয়েছে ‘শিল্পশাস্ত্র’। কোনো মেটাল ব্যবহার করা হয়নি একে কাঠামো দেওয়ার জন্য, এমনকি দেওয়া হয়নি কোনো কংক্রিট। ২২৩টি আলংকারিক পিলার, ৯টি ডোম এবং ২০ হাজার মূর্তিসমৃদ্ধ এই মন্দিরের ব্যাখ্যায় গজেন্দ্র পীঠ, যা হাতির উদ্দেশে নিবেদিত। উল্লেখ্য, হাতি ভারতীয় পুরাণ এবং সংস্কৃতির প্রধান একটি চরিত্র বা উপাদান। ১৪৮টি পূর্ণ বয়স্ক হাতি স্থাপিত হয়, যার ওজন প্রায় তিন হাজার টন।
টেম্পলের নিচের অংশে হাই রিলিফে বর্ণনা করা হয়েছে লক্ষ্মীপতি নারায়ণের ধ্যানমগ্ন আসন, তাকে ঘিরে অন্য সব পৌরাণিক বিষয়বস্তু। সব মূর্তিই পঞ্চধাতুতে তৈরি। টেম্পলের মধ্যে আলাদা করে স্থাপন করা হয়েছে গান্ধারা ও মথুরা স্টাইলে নির্মিত রাম-সীতা, রাধা-কৃষ্ণ, শিব-পার্বতী এবং লক্ষ্মী-নারায়ণের মূর্তি। মন্দির পুরোপুরি আবৃত নানা মুভমেন্ট ও অঙ্গভঙ্গির ভাস্কর্য আর রিলিফ ওয়ার্কে। একটু আধুনিকায়ন, তাই হয়তো একে পুরোপুরি হাইলাইটের জন্য কিছু ডি-ফোকাস স্পট লাইট ব্যবহার করা হয়েছে। এই প্রযুক্তির বদৌলতে পুরো মন্দির রাতে তার গড়নশৈলীতে আরেক রূপ ধারণ করে।
মন্দিরের এক পাশে রয়েছে মিউজিক্যাল ফাউনটেইন। অনবদ্য ক্রিয়েশন। আটটি ফুটন্ত পদ্মের মাঝে পানির মাধ্যমে কালার লেজার ডিসপ্লে আর কিছু পারফর্মিংয়ের মাধ্যমে বর্ণনা করা হয় ফুলের কাহিনি। বসার জন্য স্টেপ ওয়াল আছে, যা ভারতবর্ষের সম্ভবত সবচেয়ে বড় বসার স্থান। এম্ফিথিয়েটার বললেও ভুল হবে না। এ ছাড়া রয়েছে মন্দিরের ভেতর ১০/১২ মিনিটের নৌকাভ্রমণের ব্যবস্থা। ভ্রমণ করতে করতে খুঁজে পাবেন সেই সব ঐতিহাসিক চরিত্র, যা হিন্দু ঐতিহ্যের ধারক।
মন্দিরের অপর পাশে রয়েছে গার্ডেন অব ইন্ডিয়া। পদ্ম ফুলের আদলে নির্মিত এই বাগান ভারত উপবন বলেও পরিচিত। গাছ-লতা-গুল্ম ইত্যাদি ঘেরা এই বাগানে রয়েছে ব্রোঞ্জনির্মিত অনেক ভাস্কর্য, দেখা মিলল মহাত্মা গান্ধীর ভাস্কর্যও।
দশটি প্রধান প্রবেশদ্বারবেষ্টিত এই মন্দিরকে ঘিরে রেখেছে নারায়ণ সরোবর, যা ১৫১টি নদীর পবিত্র পানি ধারণ করে আছে। গোমুখ থেকে অনবরত পানির ধারা এই সরোবরে পড়ছে, যা কল্পলোকেই অনুভব করা যায়।
শহরের প্রাণকেন্দ্রে স্থাপিত হওয়ায় তেমন একটা বেগ পেতে হয়নি পৌঁছাতে। কিন্তু অনেক গরম ছিল সেই সময়টায়। আমার ভ্রমণপ্রিয় বন্ধুদের বলে দিই, অনেক সময় নিয়ে অক্ষয়ধাম যাওয়া উচিত এবং পারলে একটু শীতে পরিকল্পনা করা উচিত। পরিপূর্ণ আনন্দ নিয়ে আপনার সময় কেটে যাবে অনায়াসে।
ছবি: লেখক ও সংগ্রহ