আলাপন I পুরস্কারের চেয়ে মানুষের ভালোবাসা মূল্যবান- হৈমন্তী শুক্লা
হৈমন্তী শুক্লা। উপমহাদেশের প্রখ্যাত সংগীতশিল্পী। ধ্রুপদি সংগীত ও ভারতীয় সমকালীন বাংলা গানে তাঁর কৃতিত্ব প্রশ্নাতীত। কলকাতার অজস্র বাংলা সিনেমার পাশাপাশি বলিউডি অনেক চলচ্চিত্রে তিনি প্লেব্যাক করেছেন। জন্ম ১৯৪৯ সালের ২ ফেব্রুয়ারি, কলকাতায়। রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্যে এম এ। রবিশঙ্কর, আলী আকবর খাঁ, আল্লারাখা, নওশাদ, সলিল চৌধুরী, মান্না দে, হেমন্ত মুখোপাধ্যায় প্রমুখ সংগীতব্যক্তিত্বের সঙ্গে তিনি কাজ করেছেন। কলকাতায় তাঁরই মুখোমুখি অতনু সিংহ
ক্যানভাস: আমরা জানি, শৈশব থেকে আপনার বেড়ে ওঠা সাংগীতিক আবহের মধ্যে। কারণ, আপনার বাবা পন্ডিত হরিহর শুক্লা হিন্দুস্তানি ক্লাসিক্যাল মিউজিকের একজন দিকপাল ছিলেন। সংগীতের প্রথম তালিম কি তাঁর কাছ থেকেই পেয়েছেন?
হৈমন্তী শুক্লা: হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছেন। আমার সংগীতচর্চার শুরুটা বাবার কাছ থেকেই। তিনি ধ্রুপদি সংগীতের শিল্পী ছিলেন বলে এমনটা নয় যে তাঁর মধ্যে সংগীতের অন্যান্য জায়গার প্রতি কোনো ছুঁতমার্গ ছিল। ক্ল্যাসিক্যাল মিউজিকের নানা ঘরানার পাশাপাশি লঘু শাস্ত্রীয় সংগীত থেকে শুরু করে রবীন্দ্রসংগীত, নজরুলসংগীত কিংবা অতুলপ্রসাদ ও রজনীকান্তের গান, কীর্তন, বাউল এবং সিনেমা ও আধুনিক বাংলা গান- এসবের কৈশোরকাল থেকেই আমার আগ্রহ ছিল; এ ক্ষেত্রে বাবা প্রেরণাও দিয়েছেন। আমাকে শুধু ধ্রুপদি সংগীতের মধ্যে বেঁধে ফেলতে চাননি। আমি তো হিন্দি সিনেমাতেও গান গেয়েছি। বাবা বলতেন, সব রকমের গান গাওয়ার অভ্যাস থাকতে হবে। তার এই কথাকে শিরোধার্য করেই আমার সংগীতজীবন এগিয়েছে।
ক্যানভাস: শুরুটা তো ক্ল্যাসিক্যাল মিউজিক দিয়েই?
হৈমন্তী: হ্যাঁ, সেটা তো বললামই। ক্ল্যাসিক্যাল মিউজিক দিয়ে শুরু করলেও সব ধরনের গান গেয়েছি। তার মানে এই নয় যে ক্ল্যাসিক্যাল মিউজিকের সঙ্গে আমার কোনো রকম দূরত্ব তৈরি হয়েছে। সমানতালে আমি ধ্রুপদি হিন্দুস্তানি সংগীতচর্চাও চালিয়ে গেছি। আজও তা অব্যাহত।
ক্যানভাস: বাবা ছাড়া আর কাকে কাকে সংগীতশিক্ষক হিসেবে পেয়েছেন?
হৈমন্তী: অনেককে। যেমন চিন্ময় লাহিড়ী, ডি এল রানা, পন্ডিত রবিশঙ্কর, ওস্তাদ আলী আকবর খাঁ। আর যাঁদের কম্পোজিশনে, সুরে গান গেয়েছি, তাঁরাও আমার শিক্ষক। অনেকের থেকেই শিখেছি, আজও শিখছি। শেখা থেমে থাকে না।
ক্যানভাস: সংগীতের নানা ধারায় সমানভাবে আপনার বিচরণ। কোনটিকে আপনি আপনার সত্তার সবচেয়ে কাছের বলে মনে করেন?
হৈমন্তী: উচ্চাঙ্গসংগীতের মধ্য দিয়েই আমার সংগীতজীবন শুরু। এর সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে আমার পরিবার। সেই দিক থেকে হয়তো উচ্চাঙ্গসংগীত আমার সত্তার অনেক কাছে। কিন্তু তার মানে এই নয় যে অন্যান্য যেসব গান আমি গেয়ে থাকি, সেগুলোর প্রতি আমার ভালোবাসা কম! যেকোনো ধরনের সংগীতই আমার প্রিয়। সব ধরনের গান গাইতেই আমি স্বচ্ছন্দ। সবই আমি শিখে গাওয়ার চেষ্টা করি।
ক্যানভাস: কলকাতার বাংলা ছবির পাশাপাশি বলিউডের অজস্র ছবিতেও আপনি প্লে-ব্যাক করেছেন। বলিউডে কাজের অভিজ্ঞতা কেমন ছিল? শুরুর দিনগুলো মনে পড়ে?
হৈমন্তী: প্রথম যখন বলিউডে কাজ শুরু করি, ভয় লাগত কিছুটা। নতুন পরিবেশ, নতুন নতুন মানুষ…যদিও বাংলার অনেক শিল্পী ও সুরকার তখন দাপটের সঙ্গে সেখানে কাজ করতেন, তাঁদের সাহচর্যে এসে আস্তে আস্তে বলিউডের মতো করে নিজেকে তৈরি করতে পেরেছি। অনেক সম্মানও পেয়েছি। ভালোবাসা পেয়েছি। সব মিলিয়ে অভিজ্ঞতা খুবই ভালো।
ক্যানভাস: সুরকার হিসেবে কাদের সঙ্গে কাজ করতে সবচেয়ে ভালো লেগেছে?
হৈমন্তী: আমি এত গুণীজনের সান্নিধ্য পেয়েছি যে সবচেয়ে কাদের ভালো লেগেছে, সেটা আলাদা করে বলা সম্ভব নয়। তাঁদের প্রত্যেকেই নিজ নিজ ক্ষেত্রে বটবৃক্ষ। আমি তাঁদের ছায়া পেয়েছি। প্রত্যেকের কাছ থেকেই শিখেছি।
ক্যানভাস: আগে গান রেকর্ডিংয়ের সময় স্টুডিওতে সংগীতশিল্পীর সঙ্গে সঙ্গতে যন্ত্রসংগীতশিল্পীরাও উপস্থিত হতেন। সবার উপস্থিতি ও পারফরম্যান্সের মধ্য দিয়ে গান রেকর্ড হতো। এখন অনেক সময়েই মিউজিক তৈরি হয়ে যাচ্ছে সফটওয়্যার প্রোগ্রামিংয়ের মাধ্যমে। ব্যাপারটা কীভাবে দেখছেন?
হৈমন্তী: সব ক্ষেত্রে এমনটাই হচ্ছে, বলা যাবে না। তবে এইটা একটা কমন বিষয় এখন। এ ব্যাপারে বলব যে প্রযুক্তির সাফল্যের বিষয়টা মেনে নিয়েই আমাদের কাজ করে যেতে হবে। দিন বদলাচ্ছে। এই বাস্তবতাটা তো মেনে নিতেই হবে। তবে আমি আজকের সিস্টেমের সঙ্গে কোনো রকম ডিসকমফোর্ট ফিল করি না। এখন যে রেকর্ডিং করতে যাই, যেভাবে গাই তা নিয়ে আমার কোনো খেদ নেই। আমি অমনভাবে ভাবি না যে আমাদের সময়ে যা ছিল সব ভালো ছিল, এখন সব খারাপ হয়েছে…আমি এই সময়ের পরিবর্তনটাকে স্বাভাবিকভাবে নিই, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নতির দিকটাকেও স্বাভাবিকভাবে দেখি। তবে এটা ঠিক, এখন গান বা গায়কির মান অনেক নেমে গেছে। যেভাবে গাওয়া হয়, তা কখনো ভালো লাগে, কখনো লাগে না…কিন্তু এটা তো সব সময় শেয়ার করা যায় না। অনেক সময়েই এই বিষয়ে কিছু বলার থাকে না।
ক্যানভাস: আচ্ছা, গানকে কেন্দ্র করে প্রতিযোগিতামূলক টেলিভিশন শো হচ্ছে, যেমন ‘সারেগামাপা’। আপনাকেও বিচারক হিসেবে দেখা গেছে…এই ধরনের শো সম্পর্কে আপনার কী বক্তব্য?
হৈমন্তী: এ ধরনের প্রোগ্রামগুলোর ফলে নতুন প্রতিভারা অল্প দিনেই পরিচিতি পেয়ে যায়। সবাই তাদেরকে গান গাওয়ার জন্য ডাকে। এটা ভালো। কিন্তু এসব নতুন প্রতিভার প্রতি আমার একটাই উপদেশ, তারা যেন ¯্রােতে গা ভাসিয়ে না দেয়, গানের প্রতি কমিটেড থাকে। তারা যাতে অনেক দিন ধরে গাইতে পারে, সে জন্য সাধনা চালিয়ে যেতে হবে।
ক্যানভাস: আপনি ভারতের রাষ্ট্রপতির হাত থেকে সম্মান গ্রহণ করেছেন, পুরস্কার পেয়েছেন, সংগীতে অবদানের জন্য পশ্চিমবঙ্গ সরকার তাদের সর্বোচ্চ পুরস্কার আপনাকে দিয়েছে। এ ছাড়া দেশ-বিদেশ থেকে নানা সময় সম্মানিত হয়েছেন। অসংখ্য পুরস্কার অর্জন করেছেন। আপনার এই সংগীতজীবনে সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি কী? এ ক্ষেত্রে কি কোনো নির্দিষ্ট পুরস্কারের কথা বলবেন? নাকি পুরস্কারের বাইরে অন্য কিছু?
হৈমন্তী: আমি রাষ্ট্রপতির হাত থেকে পুরস্কারই পাই বা অন্য কোনো পুরস্কার; এসবের থেকে আমার কাছে অনেক বেশি মূল্যবান সাধারণ মানুষের ভালোবাসা। তারা আমার গান এত দিন ধরে শুনছেন, আমায় মনে রেখেছেন, আমার বিষয়ে চর্চা করছেন- এগুলোর মূল্য পুরস্কারের চেয়ে অনেক বেশি। শুধু আমার কাছেই নয়। যেকোনো শিল্পীর কাছে সাধারণ মানুষের ভালোবাসাই সবচেয়ে বড় পাওয়া বলে আমি মনে করি।
ক্যানভাস: বাংলাদেশের সংগীতজগৎ সম্পর্কে কিছু কি বলবেন?
হৈমন্তী: বাংলাদেশের মানুষের সঙ্গে আমার অনেক দিনের যোগাযোগ। পশ্চিমবঙ্গ বা ভারতের মানুষের মতোই বাংলাদেশের মানুষ আমায় ভালোবাসেন। আমায় তাঁরা খুবই পছন্দ করেন। বাংলাদেশের সংগীতশিল্পীদের সঙ্গেও আমার দারুণ সখ্য। আমি যখনই ঢাকায় বা বাংলাদেশের অন্য কোনো জেলায় অনুষ্ঠানের জন্য যাই, তাঁরা ছুটে আসেন। আমার সঙ্গে সময় কাটান। সম্প্রতি সুবীর নন্দী মারা গেলেন। ওঁর সঙ্গে আমার খুবই সুন্দর সম্পর্ক ছিল। বাংলাদেশের পুরোনো ও নতুন, এমন অনেক শিল্পীর সঙ্গেই আমার দারুণ সম্পর্ক। আর ওখানকার সাধারণ মানুষের ভালোবাসায় আমি বরাবরই আপ্লুত।
ক্যানভাস: একসময়ের সাড়া জাগানো ব্যান্ড কালচার এখন অনেকটাই স্তিমিত। আপনি কী বলেন?
হৈমন্তী: শুরুতে ভালোই লাগত। ব্যান্ড কালচারের ব্যাপারে আমার ছুঁতমার্গ নেই। কিন্তু পরে দুই বাংলাতেই ব্যান্ডের মান অনেক কমে যায়! একটা কথা মনে রাখতে হবে, যেকোনো নতুন কিছু মানুষের সামনে হাজির হলে তা নিয়ে কিছুদিন হইচই হয়। কিন্তু তার মধ্যে পোটেনশিয়ালিটি না থাকলে কত দিন আর এটা কন্টিনিউ হবে? নতুন নতুন এক্সপেরিমেন্ট, লিরিকের বৈচিত্র্য ও রক, মেটাল, ব্লুজ- এসবকে নতুনভাবে বাংলা গানে হাজির করার ক্ষেত্রে ব্যান্ডের অবদান ছিল। কিন্তু একসময় দেখা গেল, যে কেউ চাইলে একটা ব্যান্ড তৈরি করতে পারেন। এত সহজ হয়ে যাওয়ার কারণে ব্যান্ড কালচার এখানে দীর্ঘস্থায়ী হতে পারেনি বলে আমার মনে হয়। যদিও আমি এই ঘরানার কেউ নই। তাই এই নিয়ে বেশি কিছু বলতে চাই না।
ক্যানভাস: কলকাতায় দুর্গাপূজার আগে, গানের রেকর্ড আর ক্যাসেট বের হতো। কিন্তু এটা এখন আর নেই। যদিও বাংলাদেশে ঈদুল ফিতরের আগে ইউটিউবে নতুন শিল্পীরা কিছু গান রিলিজ করছেন। সিডি বের হচ্ছে। তবে আগের মতো তা নিয়ে উন্মাদনা নেই। কলকাতায় পূজার আগে ওই যে গান বের হতো, এখন আর হয় না, কীভাবে দেখেন এই পরিবর্তনটা? মিস করেন আগের ওই ট্রেন্ডকে?
হৈমন্তী: পূজার গান নিয়ে আগে কলকাতাসহ গোটা পশ্চিমবঙ্গে ব্যাপক একটা উন্মাদনা ছিল। সেসব গান পৌঁছে যেত আসাম, ত্রিপুরা ও বাংলাদেশে। আজ আর তা নেই। এখন কলকাতায় পূজা উপলক্ষে কোনো সিডিও বেরোয় না। কেউ কেউ গান গেয়ে ইউটিউবে দেন। আমার আবার ওসব ভালো লাগে না। এই ব্যাপারে আমি আমাদের সময়টা সত্যিই মিস করি। কিন্তু কী আর করার, আজকের সময়টাকেও তো মেনে নিতে হবে।
ক্যানভাস: আপনার গাওয়া প্রিয় গান কোনটা?
হৈমন্তী: এই প্রশ্নের উত্তর আমি কীভাবে দিই? বরং আমি এই প্রশ্নটা আপনাকে করতে পারি।
ক্যানভাস: ‘এমন স্বপ্ন কখনো দেখিনি আমি’, আর ‘আমার বলার কিছু ছিল না’।
হৈমন্তী: ধন্যবাদ। এই দুটো গান খুবই জনপ্রিয়। বিশেষত, ‘আমার বলার কিছু ছিল না’।
ক্যানভাস: ‘এমন স্বপ্ন কখনো দেখিনি আমি’ গানটা হলো ‘আমি সেই ও সখা’ নামের একটি সিনেমার। গানটি রচনা করেছিলেন গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার আর সুর দিয়েছিলেন শ্যামল মিত্র। অন্যদিকে ‘আমার বলার কিছু ছিল না’ গানটার সুর মান্না দে আর কথা পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের। তাই তো?
হৈমন্তী: একেবারেই তাই। আপনারা আমায় মনে রেখেছেন। এইটা আমার পরম প্রাপ্তি।
ক্যানভাস: আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। আপনার দীর্ঘ ও সুস্থ জীবন কামনা করি। আপনার থেকে বাংলা সংগীতজগৎ আরও অনেক কিছু পাবে, এই প্রত্যাশা রাখি। আপনাকে অনেক শুভেচ্ছা।
হৈমন্তী: ধন্যবাদ। আমার ভালোবাসা নেবেন। বাংলাদেশের মানুষকে এবং ওখানকার শিল্পীদের আমার ভালোবাসা ও শুভেচ্ছা জানাবেন।
ক্যানভাস: নিশ্চয়ই।
ছবি: মাসুদুর রহিম রুবাই