এডিটরস কলাম I এক হয়ে যাই মাতৃসাধনায়
সনাতন ধর্মাবলম্বীরা মনে করেন, মানুষের ভেতরে লুকিয়ে রয়েছে পাশব শক্তির প্রতীক অসুর, সত্য-সুন্দরের প্রতীক শিব। অশুভ বা মন্দের বিনাশ ঘটিয়ে শুভ কিংবা ভালো তথা কল্যাণ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে শান্তিপূর্ণ ও আনন্দময় জগৎ সৃষ্টি করা- এই প্রতিজ্ঞার জয়গান রচিত হয় শারদীয় দুর্গোৎসবে
ইতিহাস, সাহিত্য ও লোকস্মৃতির দিকে তাকালে এটা মানতেই হয়, বাঙালি সবচেয়ে বেশি ভালোবেসেছে নিজের দেশকে। এই জাতি তার জন্মভূখন্ডের জন্য প্রাণও উৎসর্গ করেছে। কারণ, বাংলাদেশ তার কাছে জননীতুল্য। আমাদের জাতীয় সঙ্গীতে ‘মা’শব্দটি বারবার ধ্বনিত হয়েছে। তাতে বোঝা যায়, নিজের দেশ আর মায়ের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। পেশাগত কাজে আমি যখন দেশের বাইরে যাই, এক অনিবার্য আবেগে মনটা হু-হু করে ওঠে, অনুভব করি- মায়ের আঁচল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছি যেন! এ-ও ভাবি, আমার মনের মধ্যে যেমন মা আছেন, তেমনি চিরস্থায়ী হয়ে রয়েছে মাতৃরূপিণী বাংলাদেশ। তার আনন্দ আমার চিত্তে দোলা দেয়, আর তার ‘বদনখানি মলিন হলে’ চোখ ভিজে আসে।
এই মাতৃ-আরাধনার মধ্যেই বাঙালির আত্মনিবেদনের বিচিত্র বীজ রোপিত হয়; তাতে বঙ্গজননীর বুক ফুলে-ফলে পল্লবিত হয়ে ওঠে। প্রকৃতিতে সঞ্চারিত হয় পবিত্ররূপ নীল-শুভ্রের মায়া, তাতে ভর দিয়ে আসেন হিন্দু সম্প্রদায়ের দেবী দুর্গা। দুষ্টের দমন আর শিষ্টের পালন যার ব্রত। তার আনুষ্ঠানিক আরাধনা চলে পাঁচ দিন, কিন্তু পুরাণ আর লোকজ আবেগ থেকে সৃষ্ট এই প্রতিমার মর্ম বাঙালি হিন্দুরা জীবনভর বয়ে চলেন। দেবীর দশটি হাত একটি কল্পজগৎ তৈরি করে। সেখানে তিনি সর্বকর্মা। কেননা, হাতের সঙ্গে তো কাজ কিংবা শ্রমের সম্পর্ক নিবিড়। অন্যদিকে, এটা নিশ্চিত- দুষ্টের দমন আর শিষ্টের পালন সম্ভব হলেই তো ভালো থাকবে সংসার, শান্তি বিরাজ করবে সমাজে আর উদ্বেগহীন এবং সুন্দর হয়ে উঠবে দেশ!
সনাতন ধর্মাবলম্বীরা মনে করেন, মানুষের ভেতরে লুকিয়ে রয়েছে পাশব শক্তির প্রতীক অসুর, সত্য-সুন্দরের প্রতীক শিব। অশুভ বা মন্দের বিনাশ ঘটিয়ে শুভ কিংবা ভালো তথা কল্যাণ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে শান্তিপূর্ণ ও আনন্দময় জগত সৃষ্টি করা- এই প্রতিজ্ঞার জয়গান রচিত হয় শারদীয় দুর্গোৎসবে। পাঁচ দিন ধরে সকাল থেকে রাত অব্দি তাই চলে ঢোল-করতালের বাজনা আকাশে-বাতাসে তরঙ্গ তুলে। পাড়ায়-পাড়ায় মন্ডপে-মন্ডপে আনন্দের ঢেউ বয়ে যায়। শিশু থেকে বুড়ো, সব সম্প্রদায় আর শ্রেণি-পেশার মানুষ নিজেদের ভেদাভেদ থেরক মুক্তি পেয়ে শামিল হয় মহামিলনের সুখকর শামিয়ানায়। সনাতন ধর্মে দেবী অনাদি-অনন্ত, কিন্তু তাকে নিয়ে যে উদযাপন, তার শুরু যেমন আছে, তেমনি সমাপ্তিও আছে। একটা গানের মতোই, যার সুর ষষ্ঠী থেকে চূড়ায় উঠতে থাকে, দশমীর সন্ধ্যায় বিসর্জনের পর হিন্দু সম্প্রদায়ের জীবন নিজস্ব প্রাত্যহিকতার শব্দ আর নীরবতায় ফিরে আসে।
সবাই বলে ‘বিসর্জন’; আমি বলি ‘বিদায়’। কিন্তু তিনি কি প্রস্থান করেন বাঙালি হিন্দুর হৃদয় থেকে? উত্তর : না। তাছাড়া, প্রতিবছরই শরতের মায়াময় নিসর্গের পটে প্রতিমারূপে প্রকাশ ঘটে তার, দশমীর সন্ধ্যায় চলে যান দৃশ্যের আড়ালে। দেখা-অদেখার খেলা তো পৃথিবীতে নিত্য, এ দুয়ের মধ্যেই মানুষের গমন ও প্রস্থান। ফিজিক্স আর মেটাফিজিক্সের এই জ্ঞান ও শিক্ষা তো প্রাচ্যেরই দান। যা হোক, ‘বিসর্জন’ কিংবা ‘বিদায়’যা-ই বলি না কেন, কল্যাণের অধিষ্ঠাত্রী রয়ে যান হিন্দু সম্প্রদায়ের চিত্তে, কেননা, এটাই তাদের কম্য।
মতৃভূমির প্রতি ভালোবাসার প্রসঙ্গ দিয়ে কলামটি শুরু হয়েছিল। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের দুর্গারূপ মাতৃভক্তি মনে করিয়ে দেয়- মাকে ভালোবাসার মধ্যে গভীর এক প্রশান্তি ও আনন্দ রয়েছে। জীবন শুরু হয় মায়ের কোলে, তখন সেটাই দেশ, প্রসারিত অর্থে পৃথিবী। বড় হয়েও সেই মাকে ছেড়ে থাকতে পারি না আমরা। কেননা তার দান অকৃপণ। মাতৃসাধনার নিমিত্তে বাঙালি হিন্দুদের এই যে উৎসব, তার তুলনা কোথায় মিলবে? বৃহৎ অর্থে এটা তো মানুষের মহৎ ও মানবিক আবেগের রূপক। কিন্তু এর সীমায় তা আটকে থাকতে পারে না। পারেনি। তাই মায়ের আঁচল হয়ে যায় বাংলাদেশের সবুজ প্রান্তর, তার হাসি মধুর হয়ে ওঠে অঘ্রাণের ভরা ক্ষেতের রূপ নিয়ে। এই অনুভবে ধর্ম-শ্রেণি-পেশার গন্ডি পেরিয়ে আমরা পারস্পরিক হয়ে যাই। এক হয়ে যাই।
মডেল: নীল
ওয়্যারড্রোব: বিশ্বরঙ
মেকওভার: পারসোনা
ছবি: সৈয়দ অয়ন