রসনাবিলাস I বৈঠকি ভোজ
বিদেশি কুজিনের ভিড়ে দেশীয় খাবারের ঠিকানা। সঙ্গে আড্ডার ব্যবস্থাও। স্বাদে যেমন, সজ্জায়ও বাঙালিয়ানার স্ফুরণ। লিখেছেন সামীউর রহমান
বন্ধু, আড্ডা, গান। চায়ের কাপে ঝড়। চটপটির ঝালে চোখে জল, ফুচকায় কুড়মুড়ে প্রেম। নিঃসঙ্গ দুপুর, মুখরিত বিকেল কিংবা রোম্যান্টিক সন্ধ্যা। সব নিয়েই বৈঠক।
… এক কাপ ধূমায়িত চা হাতে আপনি একবার আমাদের বারান্দায় আসতে পারেন। রেলিংয়ে দেখা পেতে পারেন শালিক, নইলে কোনো সানশেডে আশ্রয় নেওয়া কাকভেজা শঙ্খচিলের। … সবাইকেই নিমন্ত্রণ আমাদের এই “বৈঠক” খানায়। দেখা হচ্ছে বাঙালি ভোজের টেবিলে।’ রেস্তোরাঁর ফেসবুক পাতার পরিচিতি অংশে লেখা আছে কথাগুলো। বনানীর ১১ নম্বর সড়কজুড়ে যখন শুধুই ভিনদেশি রসনার হাতছানি, বৈঠকে তখন আটপৌরে আড্ডার আমন্ত্রণ।
মাথার ওপর ঢালাই করা ছাদের বদলে চৌচালার আবহ, বাইরে ঝুলছে লন্ঠন। ঝাড়বাতির মেকি আলোয় উত্তরাধুনিক সাজতে থাকার যে আপ্রাণ চেষ্টা, বৈঠক যেন সেই ইঁদুরদৌড় থেকে মুক্ত।
অন্দরসজ্জায় বাঙালিয়ানা ধরে রাখার একান্ত চেষ্টা প্রতিফলিত হেঁশেলেও। বলা চলে, বিশুদ্ধ বাংলা খাবার পরিবেশিত হয় বৈঠকে। যদিও পরিবেশনায় আছে খানিকটা ভিন্নতা। দুপুর ও রাতের খাবারের জন্য কয়েকটি সেট মেনু তৈরি করে রেখেছে বৈঠক কর্তৃপক্ষ। কাটারিভোগ চালের এক থালা সাদা ভাতের সঙ্গে নানান রকম ভাজি, ভর্তা, শাক আর একটি মাছ বা মাংসের পদ। সেট মেনু ১-এর আয়োজনে আছে ভাত, আলু, মুরগির ঝোল, আলু ভর্তা, শুঁটকি ভর্তা, পটোল অথবা বরবটি ভর্তা, আচার, সবজি, টমেটোর স্যালাড, ডিম ভাজা, বেগুন ভাজা ও ডাল।
ভর্তা ও শাকের পদগুলো সাধারণত একই থাকে, তবে মৌসুম অনুযায়ী শাকসবজির তালিকায় আসে বদল। ঘরোয়া স্বাদে রান্না করা মুরগির আলু ঝোল, গরুর মাংসের কালা ভুনা, রুপচাঁদা মাছের ভাজা, শর্ষে ইলিশ এসব পাওয়া যায় দুপুরে ও রাতে।
দুপুরের আয়োজন দুপুর ১২টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত, রাতের খাবার পাওয়া যাবে রাত ৮টা থেকে ১২টা পর্যন্ত। এ ছাড়া আছে গরুর মাংসের তেহারি, চিকেন ভুনা, আলুর দম, স্যালাড ও বোরহানির আরও একটি সেট মেনু। সব কটি সেট মেনুর দামই ৫৫০ টাকা, কর আলাদা।
বিকেলের বৈঠকের চেহারা আবার অন্য রকম। আড্ডার প্রধান অনুষঙ্গ চা আর প্রেমের অবিচ্ছেদ্য উপাদান ফুচকা- দুটোই বৈঠকখানার সাঁঝবাতির রূপকথা। ফার্নে ছাওয়া দেয়ালঘেরা বারান্দায় বসে চায়ের কাপে ঝড় তুলতে, কিংবা কোণে রেখে দেওয়া ক্যারম বোর্ডে বন্ধুকে চ্যালেঞ্জ জানানোর ফাঁকে চেখে দেখা যাবে চটপটি, ফুচকা আর লুচি-আলুর দম। সন্ধ্যার আয়োজন চলে রাত আটটা পর্যন্ত, এরপর রাতের খাবারের আয়োজন। মাসালা চা আর নানান রকম মৌসুমি ফলের রস পাওয়া যাবে সব সময়ই।
বৈঠকের স্বত্বাধিকারীদের একজন আদনান আল রাজীব। বিজ্ঞাপন আর নাটক নির্মাতা হিসেবে তার পরিচিতির গন্ডি দেশের সীমানাও ছাড়িয়েছে। কাজের ফাঁকে পেট ভরাতে ফাস্ট ফুডই ভরসা, তাই অবসরে নিজেরা বন্ধুবান্ধব নিয়ে খানিকটা আড্ডা আর পেটপূজার জন্যই সাজিয়েছেন বৈঠক। রুপালি জগতের তারাদের অনেককেই তাই দেখা যায় এ রেস্তোরাঁয় আসতে। এখানেই হয়তো আড্ডা থেকে তৈরি হয় নাটকের গল্প, বিজ্ঞাপনের থিম কিংবা সিনেমার চিত্রনাট্য!
এই ফুড ভেন্যুতে মানুষের পদচারণই প্রমাণ করে, যতই বিদেশি খাবারের প্রলোভন পথে পথে ছড়ানো থাকুক না কেন, শর্ষে ইলিশ আর চটপটি-ফুচকার কাছে পিৎজা-পাস্তা নস্যি! শুধু একটা ব্যাপারই চোখ টাটাল। যে রেস্তোরাঁর খাদ্যতালিকা, অন্দরসজ্জাজুড়ে বাঙালিয়ানা, সেখানে বইয়ের তাকজুড়ে শুধুই ইংরেজি বই আর পুরোনো সাময়িকী কেন!
লেখক: কালের কণ্ঠের সিনিয়র স্পোর্টস রিপোর্টার ও রসনালিখিয়ে
ছবি: আশরাফুল ইসলাম নিলয়