ফিচার I প্লাস্টিকের পুনর্ব্যবহার
লড়াইটা নীরব ঘাতক প্লাস্টিকের বিরুদ্ধে। তাতে শামিল হয়েছেন বাংলাদেশের কয়েকজন ব্যক্তি, কাজ করছে কিছু প্রতিষ্ঠান। এই কর্মযজ্ঞের অংশীদার তিনটি সংস্থা নিয়ে এই ফিচার
পাঁচ শ বছরে পচে না প্লাস্টিক। পুড়িয়েও রেহাই নেই। তাতে বিষাক্ত গ্যাস ‘ডাইঅক্সিনক্স’ তৈরি হয়, যা ক্যানসারের কারণ। আরও তৈরি হয় কার্বন মনোক্সাইড ও কার্বন ডাই-অক্সাইড। উভয়টিই পরিবেশ ও প্রাণিকুলের জন্য ক্ষতিকর। বায়ুমন্ডলে এসব গ্যাস বাড়লে পৃথিবী উষ্ণ হয়। ফলে মেরু অঞ্চলের বরফ গলে সাগরের পানির উচ্চতা বাড়ে। এতে উপকূলীয় অঞ্চল প্লাবিত হয়। এমনকি দেশ বিলীন হয়ে যেতে পারে সমুদ্রগর্ভে। এক কেজি প্লাস্টিক উৎপন্ন করলে বায়ুমন্ডলে দুই থেকে তিন কেজি কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্যাস নির্গত হয়। এ থেকেই দূষণের ভয়াবহতা আঁচ করা যায়।
প্লাস্টিক পণ্য যত্রতত্র ফেললে মাটি দূষিত হয়। উর্বরতা শক্তি কমে যায়। ফসল ফলনে ব্যাঘাত ঘটে। নদীতে ফেলা প্লাস্টিক সমুদ্রে পতিত হয়। জলাশয়ে ফেললে তা পরিবেশের জন্য আরও ক্ষতি করে। পরিত্যক্ত প্লাস্টিক জীববৈচিত্র্যের জন্য হুমকি। সাগরে মহাসাগরে প্রতিবছর ৮০ লাখ টন এমন বর্জ্য জমছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে, ২০৫০ সাল নাগাদ সাগরে মাছের তুলনায় প্লাস্টিকের পরিমাণ হবে বেশি।
প্লাস্টিক দূষণে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় মানুষ। এ বর্জ্যরে ক্ষুদ্রতম ভগ্নাংশকে মাইক্রোপ্লাস্টিক বলে। তা বায়ুবাহিত হয়ে শরীরে ঢুকে রোগ সৃষ্টি করে। এই ক্ষুদ্রাংশ পৌঁছে গেছে পর্বতচূড়ায়। এমনকি প্রশান্ত মহাসাগরের গভীরতম অঞ্চল মারিয়ানা ট্রেঞ্চেও! কিছুই রক্ষা পাচ্ছে না এই দূষণ থেকে। কিন্তু প্লাস্টিকের উৎপাদন ও ব্যবহার কমছে না। সহজলভ্য ও বহনযোগ্য হওয়ায় এতে তৈরি পণ্য দৈনন্দিন গৃহস্থালি ও খেলনা তৈরিতে বিশ্বব্যাপী এর চাহিদা তুঙ্গে। শুধু বাংলাদেশেই প্লাস্টিক উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান আছে প্রায় চার হাজার। সমীক্ষা বলছে, বাংলাদেশে গড়ে প্রতিবছর মাথাপিছু ৩.৫ কিলোগ্রাম প্লাস্টিক ব্যবহৃত হচ্ছে। সমস্যা হলো, ব্যবহারের পর প্লাস্টিক পণ্য যেখানে-সেখানে ফেলা হয়। ঢাকায় প্রতিদিন ১ কোটি ৪০ লাখ পলিমার ব্যাগ পরিত্যক্ত হচ্ছে। এ শহরে দৈনিক উৎপাদিত ৩ হাজার ৫০০ টন আবর্জনার ৩০ শতাংশই প্লাস্টিক। বিশ্বের অন্যান্য বড় শহরও এমন দূষণে আক্রান্ত। এই পরিস্থিতিতে পরিত্যক্ত প্লাস্টিক পুনর্ব্যবহারের দিকে ঝুঁকছে বিশ্ব। বাংলাদেশেও সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে কাজ চলছে। ব্যক্তিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক- উভয় ক্ষেত্র থেকেই মানুষকে সচেতন করা হচ্ছে। কোনো কোনো ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান আবার বাসাবাড়ি, রেস্তোরাঁ কিংবা রাস্তার পাশের চায়ের দোকান থেকে বর্জ্য প্লাস্টিক সংগ্রহ করে পুনর্ব্যবহারে নিয়োজিত।
গার্বেজ ম্যান
প্রতিষ্ঠাতা ফাহিম উদ্দিন শুভ। গার্বেজ ম্যান প্রজেক্টের মাধ্যমে প্লাস্টিক দূষণের বিরুদ্ধে কাজ করে যাচ্ছেন। প্লাস্টিক ও অন্যান্য বর্জ্য সংগ্রহ করে লাইফস্টাইল পণ্য ও জৈব সার তৈরি করেন। কার্যক্রমের শুরু নিজের বাসা থেকেই। বছরখানেক আগে। বর্জ্য সংগ্রহের জন্য ১২টি পরিবারে দুটি করে বালতি দেন। সংগৃহীত আবর্জনা রিসাইকেল করতে শুরু করেন। কিছুদিন পর ঘরের বর্জ্য সংগ্রহ বন্ধ করে বাণিজ্যিক স্থানের দিকে নজর দেন। বালতি বসান উত্তরা ৪ ও ৬ নম্বর সেক্টরের ৩০টি চায়ের দোকানের সামনে। দুটি রেস্তোরাঁতেও। আপাতত এসব জায়গা থেকেই আবর্জনা সংগ্রহ করছেন। ঘরবাড়ির বর্জ্য সংগ্রহের জন্য প্রযুক্তির আশ্রয় নিয়েছেন। তৈরি হচ্ছে বিশেষ একটি অ্যাপ। যেটির মাধ্যমে বাসিন্দারা তাদের পরিত্যক্ত প্লাস্টিক সামগ্রী বিক্রি করতে পারবেন।
এসব আবর্জনা সংগ্রহ করে অন্য কোনো ভূমিতে ফেলে আসার উদ্দেশ্য নেই গার্বেজ ম্যানের। ফাহিম উদ্দিন বলেন, ‘আমি পরিবেশকে প্লাস্টিক দূষণমুক্ত করতে চাই, কিন্তু একটি টেকসই পদ্ধতিতে। এক জায়গার বর্জ্য আরেক জায়গায় ফেলে নয়। প্লাস্টিকের অনেকগুলো ক্যাটাগরি আছে। প্রায় ১১ প্রকার। যারা রিসাইকেল করে, প্লাস্টিকের বোতল তাদের কাছে বিক্রি করে দিচ্ছি। চিপস ও বিস্কুটের র্যাপার জাতীয় প্লাস্টিক দিয়ে কিছু লাইফস্টাইল প্রডাক্ট, যেমন ব্যাগ ও মানিব্যাগ বানানোর চেষ্টা করছি। একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছোট একটি মেশিন ডোনেশন পেয়েছি। সেটি দিয়ে টপ বানানোর চেষ্টা করছি। সেই টপে আমাদের তৈরি সার পুরে প্যাকেজ আকারে বিক্রি করতে চাই। এভাবেই আমরা মানুষের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করছি। কেউ বর্জ্য দিয়ে সহায়তা করতে না পারলেও যেন পণ্য কিনে সহায়তা করতে পারেন, সে ব্যবস্থা করছি। বর্জ্য পরিষ্কার করা জরুরি। তা রিসাইকেল করে উৎপাদিত পণ্যের বাজার তৈরিও গুরুত্বপূর্ণ।’
আবর্জনা রিসাইকেল করার শুরুটা খুব সহজ ছিল না ফাহিমের। ধীরে ধীরে সব গুছিয়ে এনেছেন। তিনি কাজ করতে চান পরিবেশসচেতন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে। সচেতনতা বৃদ্ধিতে কাজ করছেন ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে। স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্যাম্পেইন করারও পরিকল্পনা আছে। উত্তরার আজমপুরে তার অফিস।
প্লাস্টিক ইনিশিয়েটিভ নেটওয়ার্ক
সুমন চৌধুরীর উদ্যোগে নাটোর থেকে শুরু হয় প্লাস্টিক ইনেশিয়েটিভ নেটওয়ার্কের কার্যক্রম। সঙ্গী হন দেশের ১১টি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আসা ১৯ জন তরুণ-তরুণী। বিভিন্ন জেলা থেকে একযোগে কাজ করছেন তারা। প্লাস্টিক দূষণের হাত থেকে পরিবেশকে বাঁচানো এবং প্লাস্টিক রিসাইকেল করে পুনরায় ব্যবহার নিশ্চিত করাই তাদের উদ্দেশ্য। কাজের শুরু ২০১৮ সালের ১ ডিসেম্বর। শহরের বিভিন্ন স্থানে সচেতনতামূলক স্টিকার লাগানো, হিউম্যান চেইন র্যালি, ইকো ট্যুরিজম ক্যাম্পেইন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সচেতনতা গড়ে তোলার জন্য ক্যাম্পাস সেশন, স্বাক্ষর সংগ্রহ প্রচারাভিযান করে যাচ্ছে সংস্থাটি। প্লাস্টিক দূষণের বর্তমান অবস্থা তুলে ধরতে গবেষণা হচ্ছে এ প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে। তুলনামূলকভাবে নতুন এ সংগঠন ঢাকা, নাটোর, রাজশাহী, রংপুর, খুলনা, চট্টগ্রাম ও সাতক্ষীরায় কার্যক্রম চালাচ্ছে। তাদের সক্রিয় স্বেচ্ছাসেবীর সংখ্যা সাড়ে তিন শর বেশি।
প্লাস্টিকের রিসাইকেলিং ভিত্তিক কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে শতভাগ পুনর্ব্যবহার নিশ্চিত করতে চায় সংগঠনটি। পুরো দেশকে দূষণমুক্ত করার স্বপ্ন দেখে। বর্তমানে কী কাজ করছে, তা জানিয়েছেন সংগঠনের ভাইস প্রেসিডেন্ট রিয়াজ গৌরি এবং এইচআর ডিরেক্টর নাজনীন সুরাইয়া। খুব শিগগির বাংলাদেশ প্লাস্টিক অ্যাসোসিয়েশনের সঙ্গে যুক্ত হতে যাচ্ছে প্লাস্টিক ইনেশিয়েটিভ নেটওয়ার্ক। কিছুদিনের মধ্যেই বিভিন্ন স্কুলে ক্যাম্পেইন শুরু করবে। প্লাস্টিক যেন যেখানে-সেখানে না ফেলা হয়, প্রাথমিক পর্যায় থেকেই সেই সচেতনতা বৃদ্ধি করতে চায়। স্টিকার ক্যাম্পেইনের জন্য বেছে নেওয়া হয়েছে গণপরিবহন। রিয়াজ গৌরি মনে করেন, এ পদ্ধতিতে জনসাধারণের মধ্যে দূষণের ক্ষতিবিষয়ক বার্তা সহজে পৌঁছে দেওয়া যাবে। তিনি বলেন, ‘প্লাস্টিক ব্যবহারের বিরুদ্ধে নয়, বরং প্লাস্টিক দূষণের বিরুদ্ধে কাজ করে যাচ্ছে প্লাস্টিক ইনেশিয়েটিভ নেটওয়ার্ক। সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে গণপরিবহনের পাশাপাশি করপোরেট অফিসেও স্টিকার ক্যাম্পেইন করব।’
মুমানু পলিয়েস্টার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড
পরিত্যক্ত প্লাস্টিকের পানির বোতল দিয়ে তৈরি হচ্ছে ফাইবার। তা দিয়ে সুতা, তারপর রঙবেরঙের পলিয়েস্টার কাপড়। উৎপন্ন হয় তুলাও। সেগুলো রপ্তানি করে বছরে ২০০ কোটি টাকা আয় হচ্ছে। মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইরের পানিয়াশাইলে চীনা প্রযুক্তিতে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে মুমানু পলিয়েস্টার ইন্ডাস্ট্রিজ। সেখানে প্লাস্টিক দিয়ে প্রতিদিন প্রায় ৪০ টন তুলা উৎপাদিত হচ্ছে। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কাছ থেকে সংগ্রহ করা হচ্ছে প্লাস্টিকের পরিত্যক্ত বোতল। তা কেটে ছোট ছোট ফ্লেক্স তৈরি করা হয়। সেগুলো গরম পানিতে ধোয়ার পর উচ্চ চাপ ও তাপে বায়ুনিরোধক ড্রামে রাখা হয় আধঘণ্টা। তাপ দেওয়ার পর তৈরি হয় পেস্ট। তা দিয়ে বিশেষ প্রক্রিয়ায় সূক্ষ্ম সুতা হয়। এগুলো বিভিন্ন আকারে কেটে মেশিনে দেওয়ার পর পলিয়েস্টার স্ট্যাপল ফাইবার হিসেবে সাদা তুলা বেরিয়ে আসে, যা কার্পাসের মতোই মোলায়েম ও মসৃণ। এরপর প্যাকেজিং হয়। পুরো প্রক্রিয়ায় যে বর্জ্য উৎপন্ন হয়, তা-ও রিসাইকেল করে তুলা তৈরি হয়।
পরিত্যক্ত প্লাস্টিক রিসাইকেলের মাধ্যমে তুলা তৈরি করে পরিবেশকে প্লাস্টিক দূষণের হাত থেকে রক্ষা করছে প্রতিষ্ঠানটি। বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের পাশাপাশি কর্মসংস্থানের পরিসর গড়ে তুলছে। ৪৫০ জন কর্মী কাজ করছেন সেখানে।
এসব ছাড়াও দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ব্যক্তিপর্যায়ে মেধা খাটিয়ে পরিত্যক্ত প্লাস্টিক থেকে তৈরি করা হচ্ছে পেট্রল, ডিজেল, গ্যাস, ছাপাখানা ও ফটোকপি মেশিনের কালি। নওগাঁর মান্দা উপজেলার বাসিন্দা ইদ্রিস আলী পলিথিন থেকে তৈরি করেছেন যৌগগুলো। একই কাজ করেছেন জামালপুরের তৌহিদুল। ১০০ কেজি পলিথিন থেকে ১০ লিটার মিথেন গ্যাস, ৭০ লিটার জ্বালানি তেল ও ২০ লিটার ছাপার কালি উৎপন্ন করা সম্ভব বলে মন্তব্য করেন তিনি।
শিবলী আহমেদ