আলাপন I ‘মিঠু যে নেই, মেলাতে পারি না’
চিত্রকর কনকচাঁপা চাকমা স্মৃতিচারণা করেছেন চিত্রকর ও চলচ্চিত্রকার খালিদ মাহমুদের সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্ব, প্রেম, বিয়ে ও সুখকর দাম্পত্য নিয়ে। তাতে যৌথ শিল্পচর্চার সঙ্গে সংসারজীবনের একাকার হওয়ার গল্পও প্রাসঙ্গিক হয়েছে। আবেগঘন এই আলাপে ছিলেন চিত্রকর ফারেহা জেবা এবং ক্যানভাসের পক্ষ থেকে কবি ও কথাসাহিত্যিক চঞ্চল আশরাফ
ধানমন্ডির সেই ফ্ল্যাটের ড্রয়িংরুমে চায়ে চুমুক দিতে দিতে কথাক্রমে খালিদ মাহমুদ মিঠুর প্রসঙ্গ এলো। কনকচাঁপা চাকমা বললেন, ‘আমার ক্লাসমেট ছিল মিঠু, পরে বন্ধুত্ব হলো। সে ছিল অন্য সহপাঠীদের চেয়ে আলাদা, ভদ্র, ভালো ফ্যামিলির ছেলে। তার মধ্যে কোনো কুটিলতা ছিল না। একটা ভালো বলয়ের ভেতর সে বড় হয়েছে। চলচ্চিত্রকার আলমগীর কবির তার মামা, বেগম মমতাজ হোসেন তার মা, একটা শিক্ষিত পরিবারে সে বড় হয়েছে। শিক্ষার আলো তো তার ওপর পড়বেই। এসব মিলিয়ে সে আমাকে আকর্ষণ করতো। ওর সঙ্গে আমার সম্পর্ক হয় অনার্স ফার্স্ট ইয়ারে, যখন আমরা ড্রয়িং অ্যান্ড পেইন্টিং বিষয়টি নিয়েছিলাম। ওই বিভাগে আমরা গিয়েছিলাম, তখন থেকে ওর প্রতি আমার ভালো লাগাটা শুরু হয়। আস্তে আস্তে বন্ধুত্ব হলো, এরপর প্রেম হলো। অনেক পরেই, দু’বছর বাদে আমরা তা প্রকাশ করেছিলাম। তবে অনেকেই বুঝতে পেরেছিল, কারণ মিঠুর প্রতি আমার বিশেষ মনোযোগ তাদের দৃষ্টি এড়ায়নি।
‘ক্যাম্পাসের বাইরে কোথায় প্রথম ঘুরতে গিয়েছিলেন?’ প্রশ্নটি শুনে সলজ্জ হাসলেন কনকচাঁপা। বললেন, ‘এটা বেশ ইন্টারেস্টিং। প্রথম আমরা গিয়েছিলাম শাহবাগে, মৌলি নামের একটা রেস্টুরেন্টে। ওখানেই আমাদের প্রথম।’…ফারেহা জেবা হেসে বললেন, ‘ডেট’। কনকও বললেন, ‘ওটা আমাদের প্রথম ডেট। কিন্তু ওখানে কোনো রুম তো ছিল না, খাওয়াদাওয়ারই জায়গা ওটা। ওখানে বসেই প্রথম আমরা দুজনে খেয়েছিলাম। এটা ১৯৮১ সালের কথা।’
‘প্রথম রোম্যান্টিক দিন?’ শুনে বেশ ভাবনায় পড়ে গেলেন কনকচাঁপা, বললেন- ‘রোম্যান্টিক দিন প্রথম কোনটি বলতে পারবো না। চারুকলায় একসঙ্গে বসে বাদাম খেতে খেতে গল্প করা, বৃষ্টিতে ভেজা, সবাই চলে গেলে ডিপার্টমেন্টের ছাদে আমরা দু’জন … এসব তো ছিলই। তখন কিন্তু এমন কোনো জায়গা ছিল না যে বন্ধুর বাড়িতে দুজনে সময় কাটাবো বা কোনো রেস্টুরেন্টে আলাদা হয়ে গল্প করবো।’
‘ভালোবাসার প্রস্তাবটা আপনাদের মধ্যে কে প্রথম দিয়েছিলেন?’ চটজলদি জবাব তাঁর, ‘ওটা কারও দিক থেকে ঘটেনি, এমনি-এমনি দু’জনের অজান্তেই ঘটে গেছে। প্রেম আমাদের কাছে ছিল একসঙ্গে কাজ করা। আমরা আউটডোরে গেছি, রমনা পার্কে গেছি কাজ করতেই। হাত ধরে বসে থাকারও সময়-সুযোগ ছিল না। ছবি আঁকতাম, তারপর বেঞ্চিতে বসে একটা কিছু খেয়ে নিতাম। এরই ফাঁকে হয়তো ব্যক্তিগত কথাবার্তা হতো। এটাই ছিল আমাদের তখনকার প্রেম।’
‘আশির দশকে আপনারা বিয়ে করেছেন। তখন এরশাদবিরোধী আন্দোলন চলছে। এটা কি আপনাদের প্রেমে অন্যতর কোনো অনুভূতি সৃষ্টি করেছিল? প্রশ্নটা এজন্যই যে, আপনাদের প্রেম একধরনের বিদ্রোহ, কেননা এর মধ্য দিয়ে প্রচলিত সমাজকাঠামো ভেঙে আপনারা পরস্পর একটা স্থায়ী সম্পর্কে জড়িয়েছেন।’ -এই জিজ্ঞাসায় জেবারও সায় পাওয়া গেল। তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ, এই প্রেম বৈপ্লবিক।’ আর কনকচাঁপা বললেন, “তখনকার দিনে রাজনীতি ছাত্রজীবনে এত সরাসরি ছিল না। মিঠু চারুকলার ভিপি ছিল একসময়, অনেক অ্যাকটিভিটিজে সে থাকতো, কিন্তু সরাসরি রাজনীতির মধ্যে ছিল না। তবে এরশাদবিরোধী আন্দোলনে তার অংশগ্রহণ ছিল। অনেকবার পুলিশের তাড়াও খেয়েছে। কিন্তু ওগুলো প্রেমে বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। বরং সবচেয়ে বড় বাধাটি ছিল পাহাড়ি-বাঙালির বিরোধ। আমার বন্ধুবান্ধব সরে গেল, যখন জানতে পারলো মিঠুর সঙ্গে আমার প্রেম, তারা আমাকে বয়কট করলো। ইউনিভার্সিটিতে আদিবাসী ছাত্রছাত্রীদের অনেক অনুষ্ঠান হয়, সেগুলোয় আমার যাওয়া বন্ধ হয়ে গেল। কারণ ওরা জানতো যে কনক ডিটারমাইন্ড, মিঠুকেই সে বিয়ে করবে। মানে, আমাকে আর ফেরানো যাবে না। তবে আমাকে বোঝানোর চেষ্টা হয়েছিল। এই বলে, ‘তুমি অনেক দিন পর চারুকলায় পড়ছো, তুমি আমাদের সম্পদ হয়ে থাকবে যদি তাকে বিয়ে না করো।’ বাবা-মাকেও সমাজ থেকে বলা হলো, ‘তোমাদের মেয়েকে ফেরাও। বাঙালির সঙ্গে আমাদের বৈবাহিক সম্পর্ক নিষিদ্ধ। অন্য মেয়ে হলে বলতাম না। যেহেতু সে একটা সাবজেক্টে পড়ছে, তাকে নিয়ে আমরা আশাবাদী।’ বাবা তাদের কথায় সেভাবে সাড়া না দিলেও মা খুব বকেছেন আমাকে, কান্নাকাটিও করেছেন। প্রতিজ্ঞা করিয়েছেন। তাকে আমি বলেছি, মিঠু আমাকে গভীরভাবে ভালোবাসে। ওর জন্য আমার খুব কষ্ট হয়, ছোটবেলায় বাবাকে হারিয়েছে, মা থেকেও নেই। তবু আমি দেখি ফিরে আসতে পারি কি না।”
‘তারপর?’ কনকচাঁপা বললেন, “মিঠুকে আমি এসব বলেছিলাম। সে বলেছিল, আমি তোমাকে জোর করবো না যদি তুমি চলে যেতে চাও। কিন্তু তোমাকে আমি আশ্রয় ভেবেছি, আমার তো তেমন কেউ নেই, এর-ওর বাড়িতে বড় হয়েছি। তুমি চলে গেলে আমার জীবনটা শেষ হয়ে যাবে। … আমার দুই বান্ধবী ওকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বললো, ‘তুমি অনেক ভালো ছেলে, আমরা সবাই তোমাকে খুব ভালোবাসি, তুমি ওকে যেতে দাও।’ … অনেক ঝড় বয়ে গেছে আমাদের ওপর দিয়ে, কিন্তু আমরা কেউ কাউকে ছাড়িনি। কারো কথাই শেষ পর্যন্ত শুনিনি। বিয়ে করলাম। এটা ১৯৮৬ সালের কথা। এ ঘটনায় আমাদের সমাজের লোকজন আমার বাবা-মাকে যথেচ্ছ অপমান করলো, একঘরে করবে বলে হুমকি দিয়ে গেল। বাবা বললেন, আপনারা যদি চান, আমি ওকে বাড়িতে আসতে দেবো না। কিন্তু সে অ্যাডাল্ট। নিজের দায়িত্বেই সে বিয়ে করেছে। জোর করে চাকমা ছেলের সঙ্গে বিয়ে দিলে ওর জীবন নষ্ট হবে। এক বছর আমি বাড়িতে যাইনি। কোনো যোগাযোগ ছিল না পরিবারের সঙ্গে। কিন্তু একজন ভান্তে ছিলেন আমাদের, যিনি মাকে বুঝিয়ে আমাদের ডেকে পাঠালেন। আমরা তাঁর কাছে গেলাম। তিনি মিঠুকে বললেন, ‘কনক ছবি আঁকতে পারবে তো?’ ভান্তেকে সে বললো, ‘আমরা একসঙ্গে ছবি আঁকবো বলেই বিয়ে করেছি। তার মতো করে সে নিজের ধর্মকর্ম করতে পারবে, সব করতে পারবে। ওকে শুধু সংসার আর সন্তান পাওয়ার জন্য বিয়ে করিনি। আমি চাই ওর শিল্পী হওয়ার স্বপ্ন পূরণ হোক। আমরা একসঙ্গে ছবি আঁকবো, কাজ করবো। ওকে রান্না করতে হবে না, এটা ওর কাজ নয়, ওর কাজ ছবি আঁকা। প্রয়োজনে আমরা শিঙাড়া খেয়ে থাকবো।”
আবেগাপ্লুত হয়ে পড়লেন কনকচাঁপা। কথা তাঁর থামতে চায় না। বলতে লাগলেন, “সত্যি মিঠু তা-ই করেছিল আমার জন্য। আমাকে রান্নাঘরে দেখলে রাগ করতো। বলতো, ‘রান্নাঘরে তুমি যাবে না, তোমার সময় নষ্ট হবে।’ ২৯ বছর সংসার করেছি, খাবার নিয়ে কোনো দিন তার কোনো অভিযোগ ছিল না। অথচ কখনো কখনো মাত্র একটা তরকারি দিয়ে খেয়েছি। … মাঝখানে কনফেকশনারি শিখেছিলাম। বিস্কুট বানানো, কেক তৈরি এত ভালো লাগতো, সারা দিন এই নিয়ে ব্যস্ত থাকতাম। সে খুব রেগে গেল। বললো, ‘সব আমি ফেলে দেবো। তোমার অনেক সময় চলে যাচ্ছে। এসব কাজ তোমার না।”
‘আপনার শিল্পীসত্তাকে তিনি বেশি ভালোবাসতেন।’ শুনে কনকচাঁপার স্বর আরও সংবেদনশীল হয়ে ওঠে- বলেন, “যখন আমাদের একটা সুযোগ আসতো, মিঠু আমার জন্য সেটা রেখে দিত। বলতো, ‘আমি পরে যাবো, এবার তুমি যাও।’ কিন্তু প্রতিবারই সে এমন করতো আমার জন্য। কতো ডিপ্রাইভড হয়েছে সে! শ্রীলঙ্কা, আমেরিকা, ইউরোপে আমন্ত্রণ এলে মিঠু একবারও নিজের কথা বলতো না। বলতো, ‘যেহেতু আমাদের দুজনের মধ্যে একজনকে ওরা চাইছে, তুমি যাও।’ আমাদের সংসার তখন বড় হয়েছে, সন্তান আছে; কিন্তু সে বলতো, ‘বাসা আমিই সামলাবো, তোমার যাওয়া উচিত, নইলে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তোমার কাজ আর সংস্কৃতিকে তুলে ধরবে কে!’ আমি বলতাম, আমার ভালো লাগছে না, দুজন একসঙ্গে যেতে পারি না কেন! সে বলতো ‘ওরা তো আমাদের একজনকেই সিলেক্ট করেছে, সেখানে তোমার যাওয়াটাই বেশি ভালো হবে।”
ফারেহা জেবা বললেন, ‘নিজেকে বঞ্চিত করে তোমাকে সে সমৃদ্ধ করেছে।’ কনকচাঁপার কন্ঠস্বরে বয়ানের ব্যাকুলতা, “পুরুষ বা স্বামীমাত্রই ভাবে, নারী বা স্ত্রী কেন তার চেয়ে শ্রেষ্ঠ হবে! কিন্তু মিঠু অন্য রকম, এই ভাবনার ধারেকাছেই সে ছিল না। সে বরং আমাকে নিয়ে গর্ব করেছে, স্বপ্ন দেখেছে। প্রায়ই বলতো, ‘কনক এত বড় শিল্পী হবে, যে আদিবাসী সমাজ ওকে ত্যাগ করেছে, তারাই ওকে নতুন করে সম্মান দিয়ে গ্রহণ করবে।’ তা-ই হয়েছে। মিঠু আমাকে পাহাড়ে ও সমতলে দু’জায়গাতেই প্রতিষ্ঠিত করে গেছে। পাহাড়ি সংস্কৃতি নিয়ে সে অনেক কাজ করেছে। মিউজিক ভিডিও, ডকুমেন্টারি বানিয়েছে। নিজের কাজ আর গুণ দিয়ে সে পাহাড়িদের মন জয় করেছে। পাহাড়ি-বাঙালিদের পারস্পরিক ঘৃণার যে সংস্কৃতি, তার অবসানে মিঠু লড়াই করে গেছে। সমতল-অসমতলের মধ্যে সুসম্পর্কের একটা ব্রিজ ছিল সে।”
খালিদ মাহমুদ মিঠু সম্পর্কে কনকচাঁপা চাকমার আলাপ যেন থামতে নেই- “একদিন খেতে খেতে সে আমাকে বললো, ‘এবারের ছুটিতে পাহাড়ে যাবো আমরা।’ আমি বললাম, ‘ইন্ডিয়া যেতে পারি, অন্য কোনো দেশে বেড়াতে পারি ছুটি কাটানোর জন্য।’ সে বললো, ‘এবার তোমাকে যেতেই হবে।’ আমি ঠাট্টা করে বললাম, ‘ওটা তো আমারই জায়গা, নতুন করে আমাকে চেনাতে হবে কেন!’ সে বললো, ‘সিরিয়াসলি বলছি, তোমাকে নিয়ে রাঙামাটিতেই যাবো। ওখানে আমরা অনেক ভিতরে ঘুরবো। থাকবো কয়েক দিন।’ একটা প্ল্যান হলো এক সপ্তাহ বা দশ দিনের জন্য। কিন্তু আমি কোনো গুরুত্বই দিইনি। দেখা গেল, আমরা বরকল, মারিশ্যা, বাঘাইছড়ির এমন সব জায়গায় গেলাম- আগে কখনো এগুলোয় যাওয়া হয়নি। আমাকে সে বললো, ‘তোমাকে নিয়ে আসার কারণ তোমার ছবির মধ্যে একটা অভাব আছে, এসব জায়গায় ঘুরে বেড়ালে সেই ঘাটতি তুমি মেটাতে পারবে। এখানে তুমি বেড়ে উঠেছ ঠিকই, কিন্তু এর ভেতরের জীবনধারা তুমি সত্যিকার অর্থে দেখোনি।’ তো ওই সব জায়গায় গিয়ে সে আমাকে দিয়ে কিছু স্কেচ করিয়েছিল, এ নিয়ে একটা ডকুমেন্টারিও করেছিল। বলেছিল, ‘তোমার ছবিতে আদিবাসীদের জীবনের রিয়্যাল ইমেজটা আসে না। ওরা তো প্রিন্টেড জামাও পরে, ওদের ক্যাজুয়াল পোশাক অত পরিপাটি নয়, পিনন পরার ঘরোয়া একটা ধরনও তাদের আছে। ওরা অনেক গয়না পরে। তুমি কেবল একরঙা আর পরিপাটি জামাতেই আদিবাসীদের দেখাও। কারণ, তুমি তোমার জীবন দেখোনি।” বলতে বলতে কনকচাঁপার স্বর কান্নায় জড়িয়ে আসে- ‘আমার মনে হয়েছে, কী বিশাল এক মানুষকে আমি পেয়েছি।’
ফারেহা জেবাও আবেগাপ্লুত তখন। বললেন, ‘তোমার স্বামীকে তো আমরা জানলাম। এখন বলো, বাবা মিঠু কেমন মানুষ ছিল?’
কনকচাঁপা কাঁদছিলেন। প্রশ্নটি শুনে উপরের দিকে মুখ তুলে কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। অশ্রু মুছে বললেন, ‘প্রথমে আমি ওকে বন্ধু হিসেবে পেয়েছি। অসাধারণ। প্রেমিক হিসেবেও অসাধারণ। স্বামী হিসেবেও তাই। আর বাবা হিসেবে ওর কোনো তুলনা হয় না। মিঠু চলে যাওয়ার পর জীবনের সবখানে কী যে শূন্যতা, কী যে হারিয়েছি- মেলাতে পারি না। সকালে, গানেই সে ঘুম ভাঙাতো। রবীন্দ্রসংগীতে আমরা জেগে উঠতাম প্রতিদিন।’ আবার কাঁদলেন তিনি। কান্নায় কথা হারিয়ে যাচ্ছিল। কিছুক্ষণ শান্ত থাকার পর বলতে লাগলেন, ‘আমার যখন প্রথম সন্তান হয়, মিঠু খুশি হয়েছিল। কনসিভ করার পর থেকেই সে আমার যত্ন নিতে শুরু করেছিল। সিজার হয়েছিল আমার, বাচ্চার ন্যাপি-কাঁথা বদলানো থেকে ব্রেস্ট ফিডিংয়ের জন্য আমার কাছে নিয়ে আসা- কোন কাজটি সে করেনি? শুকিয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছিল ওর শরীর। বাচ্চাদের সে সময় দিত। দেখা গেল, বাচ্চারা ওর দিকেই ঝুঁকে পড়েছে। আসলে আমি, আমাদের সন্তান সবাই ওর ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিলাম। বাচ্চারা তো বাবা বলতেই অজ্ঞান ছিল। স্কুলে গিয়ে বাচ্চাদের জন্য শিক্ষকদের সঙ্গে সে কত ঝগড়া করেছে, হিসাব করে বলার নয়। আমি বিদেশে গেলে সেই সন্তানদের টেককেয়ার করতো।’
‘হানিমুনে গিয়েছিলেন?’
শুনে ফারেহা জেবা হাসলেন। কনকচাঁপা বললেন, ‘হানিমুন বলতে যা বোঝায়, তা হয়নি কখনো। তবে বিয়ের বহুদিন পর আলাদাভাবে একটা চমৎকার সময় আমরা কাটিয়েছি, মনে হয়েছিল ওটাই আমাদের হানিমুন। মিঠু চলে যাবে বলেই এমনটা হয়েছিল, আজ মনে হয়। ওকে যখন বিয়ে করি, তখন ওর কিছু নেই, গাছের নিচে থাকার মতো আমাদের অবস্থা। জেনেশুনেই আমি আগুনে ঝাঁপ দিয়েছিলাম। বিয়ের পর আমরা একটা ফ্ল্যাটে অন্য একটি পরিবারের সঙ্গে সাবলেটের মতো থাকতে শুরু করেছিলাম। বছরখানেকের মধ্যে মিঠুর চাকরি হয়ে গেল, আমরা আলাদা বাসায় উঠলাম। ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদের সন্তানকে আমরা ছবি আঁকা শেখাতাম, তিনিই আমাদের জন্য একটা সরকারি ফ্ল্যাটের ব্যবস্থা করেন। ১৯৮৭ সালে ভুটানে সোলো এক্সিবিশন হয়েছিল আমার, সেখানে আমরা গিয়েছিলাম। সেখানে হানিমুন হতে পারতো। কিন্তু এত ব্যস্ততা, হয়ে ওঠেনি। বেশ কয়েকবার আমরা একসঙ্গে বিদেশে গেছি, কিন্তু যেটা বললেন, হয়ে ওঠেনি। কিন্তু কখন হয়েছিল, বলি?’ কনকচাঁপার মুখ উজ্জ্বল, বললেন- “মৃত্যুর কিছুদিন আগে, ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে সে দিল্লির ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে গিয়েছিল, ফরেন সেকশনে ‘জোনাকির আলো’ ছবিটির জন্য শ্রেষ্ঠ পরিচালক হিসেবে মিঠু সেখানে পুরস্কৃত হয়েছিল। আমি বললাম, ‘তুমি দিল্লি থেকে কলকাতায় চলে আসো, ওখানে আমরা দু’তিন দিন থাকবো, ঘুরবো। রেস্টুরেন্টে, রাস্তার দোকানে খাবো। এটাই হবে আমাদের হানিমুন।’ মজা করেই বলেছিলাম। সে রাজি হয়ে গেল। আমি কলকাতা এয়ারপোর্টে নামলাম। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো। ওখানকার কোনো সিম নেই, যোগাযোগও করতে পারছি না। খুব টেনশন হচ্ছিল। হঠাৎ দেখি লম্বা একটা মানুষ হাত নেড়ে নেড়ে আমার দিকে আসছে। দেখি, মিঠু। দৌড়ে গিয়ে আমি ওকে জড়িয়ে ধরলাম। এমনটা বাইরে আমি কখনো ওর সঙ্গে করিনি। হয়তো ওকে হারিয়ে ফেলবো বলে। হয়তো আমার নজর লেগেছিল, কারণ এত সুন্দর লাগছিল ওকে- একটা অ্যাশ কালারের শার্ট পরেছিল, মনে পড়ে।
ছবি: সৈয়দ অয়ন