সেলুলয়েড I প্রজাপতি বিস্কুট (২০১৭)
পরিবারের তত্ত্বাবধানে দুজন অপরিচিত তরুণ-তরুণীর বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হওয়া এবং একে অন্যকে জানার মতো সহজ-সরল বিষয়কে কেন্দ্র করে এই চলচ্চিত্রের আখ্যান। কিন্তু এই অতিসাধারণ ভাবনা থেকেই বহুদিন পর কলকাতার কোনো ছবিতে গভীর এক মানবিক আবেদন দর্শকের মধ্যে সঞ্চারিত হয়েছে। সেটা হলো, পারিবারিক আবহ ও তার অনুশাসন এবং শ্রেণি অবস্থানের বিষয়গুলো গৌণ হয়ে ওঠে, যদি দুজন মানুষ একে অন্যকে মায়ায় বেঁধে ফেলে।
আখ্যান সাদামাটা, কিন্তু শাওনের চরিত্রে ঈশিতা সাহা আর অন্তরের চরিত্রে আদিত্য সেনগুপ্তর মিনিম্যালিস্ট অভিনয় দারুণ। বাকি সবকটি চরিত্রের অভিনেতাও সফল। কিন্তু মুখ্য চরিত্রদ্বয় সফলভাবে চিত্রায়িত হয়েছে অভিনয়ের কারণে।
ছবিটিতে মুখ্য দুই চরিত্র অন্তর সেন ও শ্রাবণী ওরফে শাওন। অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ সূত্রে ঘর বাঁধে তারা। উচ্চমধ্যবিত্ত, রাবীন্দ্রিক, ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত কলকাতার বাবু-বাঙালি হিন্দু পরিবারের সন্তান অন্তর সেনের বিয়ে হয় হাওড়ার ছাপোষা মধ্যবিত্ত মফস্বলী পরিবারের মেয়ে শ্রাবণীর (শাওন) সঙ্গে। পাত্রীর বাড়ির সাংস্কৃতিক রুচির দিকটি অন্তরের অভিজাত মা খুব একটা পছন্দ করেনি। কিন্তু পাত্রীর ছবি দেখে তার পুত্র স্থির করে, একেই বিয়ে করবে। ছবি শুরু হচ্ছে কলকাতার একান্নবর্তী এই পরিবারের একটি সকালে। যখন বাড়ির সদর দরজা খুলে অন্তরের বাবা দেখে, কারা যেন কার্তিক ঠাকুর ফেলে রেখে গেছে। উল্লেখ্য, পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি হিন্দুদের কার্তিকপূজার ব্যাপারটি বেশ অদ্ভুত। প্রচলিত সংস্কার, যে নবদম্পতির বাড়িতে কার্তিকপ্রতিমা ফেলা হলে তাদের সন্তান জন্ম নেবে খুব শিগগির। এটি মাথায় রেখে লোকের বাড়ির দরজায় কার্তিক ফেলে রাখার রেওয়াজ রয়েছে। তো রাবীন্দ্রিক সংস্কৃতির মানুষ শাওনের শাশুড়ি বাড়ির সামনে মূর্তিটি দেখে বিরক্ত হন, কিন্তু স্ত্রীর ইচ্ছায় সেটি ঘরে তুলে এনে পূজার অনুরোধ করে পুত্র অন্তর। শাওনের শাশুড়ির সায় না থাকলেও পূজা হয়। এই পূজা করতে চাওয়া আসলে শাওনের সন্তান কামনা। তারপরও এই দম্পতি নিঃসন্তান থাকে। চিকিৎসাসহ কোনো কিছুতেই লাভ হয় না। বলে রাখা ভালো, শাওন লুকিয়ে লুকিয়ে মেগা সিরিয়ালের স্ক্রিপ্ট লেখে। কারণ, তার শাশুড়ি এসব সিরিয়াল-টিরিয়াল একেবারেই পছন্দ করে না। তো এই মেগা সিরিয়ালের একজন সহপরিচালক শাওনের বান্ধবী। সেই মেয়েটি হঠাৎ অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়ে, কিন্তু বয়ফ্রেন্ড তখন লাপাত্তা। গর্ভপাত করাতে যাবে- এই সময় শাওন বলে, তার দরকার নেই। ওই সন্তানকে সে আর তার স্বামী দত্তক নিতে চায়। কিন্তু শেষমেশ শাওনের বান্ধবীর বয়ফ্রেন্ড ফিরে আসে এবং বিয়ের সিদ্ধান্ত নেয়। তাই দত্তক নেওয়া আর হয় না শাওনের। শ্বশুরবাড়ির গঞ্জনা, নানা রকম চাপ ইত্যাদি কারণে সে তার বাপের বাড়ি ফিরে যায়। কিন্তু অন্তর তাকে ভুলতে পারে না। শাওন তার ছাপোষা গৃহবধূ সত্তা থেকে বেরিয়ে নতুনভাবে জীবনকে একা উপভোগ করতে চায়। কিন্তু অন্তরকেও সে ভালোবাসে। স্বামীও তার স্ত্রীকে প্রেমের মানুষ হিসেবে পেতে চায়। তাই সংসারের বাইরে নতুন করে শুরু হয় তাদের প্রেম। কিন্তু অন্তরকে তার চাকরির কারণে কলকাতার বাইরে চলে যেতে হবে। যাওয়ার আগে তার স্ত্রী বলে যে, সে একটা জিনিস চায়। অন্তর ভাবে, সন্তানের কথা বলা হচ্ছে। শাওন বলে, ভালোবাসারও তো একটা শরীর আছে, হাত-পা আছে। স্বামী-স্ত্রীর ভৌগোলিক দূরত্ব সৃষ্টির আগে তাদের মধ্যে প্রেম নতুন মাত্রা পায়। এর মাঝখানে অবশ্য গল্পের নানা রকম উত্থান-পতন ঘটে।
‘প্রজাপতি বিস্কুট’-এর গানগুলো ছবিটিকে পূর্ণতা দিয়েছে। সুপ্রিয় দত্তর ক্যামেরা আর অর্ঘ্যকমল মিত্রের এডিটিং জুটিতে বলিষ্ঠ হয়েছে চলচ্চিত্রভাষা। কলকাতার বাবুয়ানি আর হাওড়ার ছাপোষা মধ্যবিত্তপনা, সাংসারিক ঘেরাটোপ আর তার বাইরে আজকের প্রজন্মের স্বনির্ভর যাপনভাবনা ছবিতে দারুণভাবে উঠে এসেছে।
অতনু সিংহ
কুইজ
১। কোন পূজার দৃশ্য রয়েছে ছবিতে?
ক। দুর্গা
খ। সরস্বতী
গ। কার্তিক
২। শাওনের পেশা কী?
ক। গল্পকার
খ। ওয়েব ডিজাইনার
গ। স্ক্রিপ্ট রাইটার
৩। কে গর্ভপাত করানোর কথা ভাবে?
ক। শাওন
খ। শাওনের বোন
গ। শাওনের বান্ধবী
গত সংখ্যার বিজয়ী
১. শিপন মাহমুদ, আকুরটাকুর পাড়া, টাঙ্গাইল।
২. কামরুল হাসান কামাল, যাত্রাবাড়ী, ঢাকা।
৩. শাহানাজ আক্তার, কলাবাগান, ঢাকা।