ছুটিরঘণ্টা I প্রাচ্যের ঐশ্বর্য পেট্রা
নাবাতিয়ান রাজারা ছিলেন শৌর্যবীর্যে শ্রেষ্ঠ সে সময়ে। সময়টা খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দী। তাদের নগরের নাম ছিল পেট্রা। স্থানীয় কিংবা আরবি ভাষায় যাকে বলা হতো ‘বেত্রা’। তখন নগরটিকে বলা হতো প্রাচ্যের মক্কা। পেট্রা ঘুরে লিখেছেন ফাতিমা জাহান
পেট্রা নগরীর ইতিহাস খুঁজলে পাওয়া যায় আরও গভীর তথ্য। এ নগরীর অস্তিত্ব ছিল খ্রিস্টপূর্ব ৯০০০ সালেই।
আরব দেশসমূহের উত্তর-পশ্চিম স্থান থেকে নাবাতিয়ান যাযাবর গোষ্ঠী নিজেদের সুবিধার্থে, জর্ডানের মরুভূমিতে এসে বসবাস শুরু করে। পেট্রার বিশাল গিরিখাত ছিল জন-বসবাসের উপযোগী। নাবাতিয়ান জনগোষ্ঠী দক্ষ ছিল শিল্পকলা ও ব্যবসা-বাণিজ্যে। এমনকি শত্রুর আক্রমণ প্রতিহত করার নিত্যনতুন কৌশলও রপ্ত ছিল তাদের। ব্যবসা-বাণিজ্যে সমৃদ্ধিশালী এ জাতির উদয়নের সময় ছিল খ্রিস্টাব্দ পয়লা শতাব্দী। নাবাতিয়ান জাতির বৈশিষ্ট্য ছিল চাষাবাদে বৃষ্টির পানির উত্তম ব্যবহার, পশুপালন আর পাথরে খোদাই শিল্প।সে সময় জনসংখ্যা ছিল প্রায় কুড়ি হাজার।
সূচনাকালে পেট্রা ছিল রোমান সংস্কৃতির ধারক ও বাহক। খ্রিস্টধর্মের প্রচার ও প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে সেখানে খ্রিস্টধর্মাবলম্বীর সংখ্যা বাড়তে থাকে শুরুতেই। এ সময় বেশ কিছু গির্জা নির্মিত হয়। জলপথ আবিষ্কারের পর স্থলপথে ব্যবসা-বাণিজ্যে ভাটা পড়ে। এবং চতুর্থ শতাব্দী থেকে ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হতে থাকে পেট্রা। ধারণা করা হয়, ষষ্ঠ শতাব্দীতে নগরটি ইতিহাস থেকে হারিয়ে যায়। ১৮১২ সালে জোহান লুডউইং বার্কহার্ড নামের একজন সুইস ভ্রমণার্থী পেট্রার খোঁজ পান। এরপর প্রত্নতত্ত্ববিদেরা কাজে লেগে যান।
পুনরায় খুঁজে পাবার পর বিভিন্ন নামকরণ হয়েছে শহরটির। যেমন ‘রক সিটি’, ‘দ্য লস্ট সিটি’ ইত্যাদি। আমার কাছে সবচেয়ে ভালো লেগেছে ‘দ্য লস্ট সিটি’ নামটি। হারিয়ে যাওয়া একটি সমৃদ্ধিশালী নগর আর তার মুছে যাওয়া জীবনযাত্রাকে আবার উজ্জীবিত করে স্মরণ করার দিন এলো তাই।
জর্ডানের রাজধানী আম্মান থেকে পেট্রার দূরত্ব প্রায় ১৫০ কিলোমিটার। জর্ডানে প্রায় প্রতিটি পরিবারের নিজস্ব গাড়ি আছে। এ দেশে সবচেয়ে বেশি অসুবিধার সম্মুখীন হয়েছি গণপরিবহনের স্বল্পতার কারণে। মাঝে মাঝে দূরপাল্লার যাত্রায়ও ট্যাক্সিতে চড়তে হয়েছে। তবে এযাত্রায় বাসের ব্যবস্থা থাকার কারণে আম্মান থেকে পৌঁছাতে সময় লাগল তিন ঘণ্টা। মরুভূমির দেশ, প্রচন্ড রোদ আর গরমে ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। যে হোটেলটি বুক করেছিলাম, সেটি বাসস্ট্যান্ডের খুব কাছেই। আর শহরটি এতই ছোট যে হেঁটেই পুরো শহরে চক্কর মারা যায়। আশপাশে লাল পাথুরে পাহাড়। তাই চলার পথ কখনো ওপরে ওঠার তো কখনো নিচে নামার খেলায় মত্ত। হোটেলে হেঁটে যেতে সময় লাগল বড়জোর পাঁচ মিনিট। তখন সবে মাগরিবের ওয়াক্ত। আকাশের গোলাপি রঙের সঙ্গে সঙ্গে পাহাড় আর বাড়িঘরও এক অদ্ভুত গোলাপি আবরণে আচ্ছন্ন হয়ে ডাক দিতে লাগল কোনো এক সুদূরের প্রার্থনার, কারও মন জয় করার।
হোটেলটা ফোর স্টার, ছাদে বসার ব্যবস্থা আছে। ছাদে চলে গেলাম মরুভূমির পাহাড়ের রূপ দেখার জন্য, সঙ্গে ছিল পূর্ণিমা, আমার বাড়তি পাওনা। ছাদে খোলা আকাশের নিচে বসার জন্য বিশালাকার সোফা রাখা। পাহাড়ের নিচে পেট্রা শহরের টিমটিম করে জ্বলে ওঠা সারিবদ্ধ ঘরবাড়ির বাতি, মাথার ওপরে পূর্ণ তিথি সঙ্গে আরব কফি আর ততোধিক মধুর আরবি সংগীত। এক মোহময় পরিবেশ।
আমি ছাড়া হোটেলে কোনো অতিথি দেখলাম না।
রাতের খাবারের ব্যবস্থাও ছাদে। খাবার খেতে খেতে পরিচয় হলো হোটেলমালিকের সঙ্গে। বয়সে আমার চেয়ে কয়েক বছরের ছোট, নাম আলী। বাবার করে দেওয়া হোটেল এখন নিজে চালাচ্ছে। তাদের কয়েক ভাইকে বাবা কয়েকটি ব্যবসা ধরিয়ে দিয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের পথে পা বাড়ানো হয়নি, সে কারণে আক্ষেপ খুব। আরব দেশগুলোতে অবশ্য এটা নতুন কিছু নয়, বেশির ভাগ ছেলেমেয়েই বিশ্ববিদ্যালয়ের মুখ দর্শন করে না। ছেলেরা পারিবারিক ব্যবসায় নামে আর মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়। এর ব্যতিক্রমও আছে।
আলীর কাছ থেকে পেট্রা হেরিটেজ সাইটের খুঁটিনাটি জেনে নিয়ে নিজের রুমে চলে গেলাম।
পরদিন সকালে খুব দ্রুত নাশতার পর্ব সেরে চললাম বহু প্রতীক্ষিত পেট্রা হেরিটেজ সাইটে। হোটেল থেকে হেঁটেই যাওয়া যায়, তবে হোটেল থেকে গাড়ির ব্যবস্থা করা আছে প্রত্যেক অতিথির জন্য। গাড়ি আমাকে হেরিটেজ সাইটের গেটে নামিয়ে দিল।
টিকিট কেটে ঢুকে পড়লাম আমার কল্পনার স্বপ্নপুরীতে। চারদিকে শুধু সোনালি মরুভূমির সোনালি রঙের পাথর আর পথের নিশানা। আমাকে মূল আকর্ষণীয় স্থানে যেতে হলে পাড়ি দিতে হবে দেড় কিলোমিটারের বেশি পথ। আর পুরো হেরিটেজ সাইটের শেষ অবধি দেখতে হলে পার হতে হবে পাঁচ কিলোমিটার পথ। সাধারণত এ পথ আমার জন্য তেমন কোনো দূরত্বই নয়, তবে প্রখর রোদে মরুভূমিতে হেঁটে বেড়ানো খুব একটা সুখদায়ক নয়। এখন সকাল মোটে আটটা কিন্তু সূয্যিমামাকে দেখে মনে হচ্ছে, আমাদের দেশের গ্রীষ্মকালের বেলা একটা।
বিশাল এক খোলা সোনালি চত্বর পার হতে সময় লাগল পনেরো মিনিট। এরপর শুরু প্রাচীন স্থাপনা আর সোনালি, কমলা, লালের মিশ্রণে অনিন্দ্যসুন্দর পাথুরে পাহাড়ের কারুকাজ। পথের ডানে-বাঁয়ে আদিম কালের বাড়িঘর পাহাড় খোদাই করে তৈরি করা হয়েছে। এর মধ্যে কয়েকটা নাকি জিনের বাড়ি। বলা হয়ে থাকে, এখানে জিনদের বসবাস ছিল একসময়। পেট্রায় এ রকম পঁচিশটি জিনের বাড়ি আছে।
অনুচ্চ পর্বত খোদাই করে নির্মিত বাড়িগুলো কোনোটা একতলা, কোনোটা আবার দোতলা ভবন। খানিক হাঁটলেই শুরু হবে পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে সরু পথ, যাকে আরবিতে বলা হয় ‘সিক’। আসলে ভূমিকম্পে পাহাড়ের মাঝখানে ফাটল ধরে সরু পথের সৃষ্টি হয়েছে। এতক্ষণ কড়া রোদে পুড়ে ফ্রাই হয়ে যাচ্ছিলাম। সিক-এর ভেতরে ঢুকে স্বস্তি মিলল। সিক দেখতে অত্যন্ত মনোরম। সরু পথের দুপাশে পাহাড় ঢেকে ছায়া দিয়েছে পথকে, বাইরের তাপ স্পর্শ করছে না। এর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অন্য যেকোনো মরুভূমির পাহাড়কে হার মানায়। সোনালি পর্বতের গায়ে রেখা টেনে টেনে আঁকা আছে যেন কমলা, হলুদ, লাল খনিজের রূপকথা। এখানে পর্বতের দেহ খোদাই করে দাঁড়িয়ে রয়েছে খ্রিস্ট জন্মের পূর্বের কয়েকটি রোমান টেম্পল। যেখানে দেবদেবীর মূর্তির খানিকটা অবশিষ্টাংশ ক্ষয়িষ্ণু অবস্থায় জানান দিচ্ছে। সিক ধরে হাঁটতে হাঁটতে মাথার ওপর মিলবে প্রগাঢ় নীল আকাশ। আমাদের দেশের শরতের আকাশের মতো ঝকঝকে আর নীল, এক ফোঁটা মেঘ নেই। এ দেশে বৃষ্টি হলে উৎসবের ঢল নামে পথে পথে। আর বৃষ্টির দর্শন পাওয়া যায় কয়েক বছরে একবার।
পথ পেরিয়ে পৌঁছলাম পেট্রার মূল আকর্ষণ ‘আল খাজনেহ’ সামনে। ধারণা করা হয়, রোমান ক্ল্যাসিক্যাল স্থাপত্যকলায় নির্মিত এ ভবন নাবাতিয়ান রাজা এরেটাস (৪)-এর সমাধিসৌধ। মতান্তরে ভবনটি মিসরের কোনো এক ফেরাউন রাজার ফেলে যাওয়া অর্থভান্ডার। মতান্তর যতই থাকুক না কেন, ভবনটির স্থাপত্যকলা তাক লাগিয়ে দেওয়ার মতো। কোরিন্থিয়ান আর গ্রিক স্থাপত্যকলার এক অনন্য মেলবন্ধন।
খাজনেহ-এর সামনে সারিবদ্ধভাবে নাবাতিয়ান সৈন্যদের পোশাকে দাঁড়িয়ে আছে একদল অভিনয়শিল্পী। তাঁরা কিছুক্ষণ পরপর বাদ্যযন্ত্রের সঙ্গে সঙ্গে লাইন ধরে পুরো চত্বর প্রদক্ষিণ করে ভ্রমণার্থীদের মনোরঞ্জনে ব্যস্ত।
যারা এতখানি পথ হাঁটতে চান না, তাদের জন্য আছে উটের পিঠে বা ঘোড়ার গাড়িতে ভ্রমণের ব্যবস্থা। উট বা ঘোড়া- কোনোটাই আমার মনঃপূত হলো না। হেঁটে ঢের ভালো ঘুরে বেড়ানো যায়।
খাজনেহ ভবনটিও পাহাড় খোদাই করে তৈরি করা হয়েছে। ছয়টি স্তম্ভের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা স্থাপনাকে যেকোনো রাজপ্রাসাদ বললেও অত্যুক্তি হবে না।
খাজনেহ দেখার আরেকটি উত্তম পদ্ধতি হলো উল্টো দিকের পাহাড়ে চড়ে একদম সামনাসামনি দেখা। আমি চললাম পাহাড়ে চড়তে। পাথরের খাড়া পাহাড়, পা ফসকালে সমাধি হবে এই মরুভূমিতে। পথে একজন চায়নিজ ভ্রমণার্থীর সঙ্গে দেখা। তিনি নামতে নামতে বলছিলেন, ‘রিস্কি, ভেরি রিস্কি’। আমি আকাশ কাঁপিয়ে হা হা করে হেসে উঠলাম। এসব ছোটখাটো পাহাড় আমি অনায়াসে বেয়ে উঠতে পারি। মুখোমুখি খাজনেহ দেখতে অবিকল কোনো পুরোনো বইয়ের ছবির মতো এর ভেতর ঢুকে গেলেই আমি হয়ে যাব আরব্য রজনীর কোনো দারুণ একটা চরিত্র।
খাজনেহ প্রাঙ্গণ থেকে বের হয়ে খানিক এগোলেই মিলবে আসল নগরের দেখা। মাঝখানে চওড়া পথ আর দুপাশে পাথুরে রঙিন পাহাড় কেটে কেটে গুহার মতো করে ঘরবাড়ি নির্মাণ করা হয়েছে। দেখতে সুদৃশ্য দোতলা, তিনতলা ভবনের আকারের। রঙের অসাধারণ কারুকাজ একেকটা পাহাড়কে আরও শৈল্পিক করে তুলেছে। হালকা লাল আর গোলাপি রঙের মিশেল স্যান্ডস্টোন পর্বতমালাকে রূপকথায় পরিণত হয়েছে। এর মধ্যে উটের অবাধ বিচরণ বাস্তব থেকে কল্পনার জগতে নিয়ে যায়। রঙের অনন্য সাধারণ প্রাকৃতিক চিত্রকলার জন্য পেট্রাকে বলা হয় ‘রেড রোজ সিটি’।
আরও খানিক দূরে চোখে পড়ল রোমান এম্ফিথিয়েটার। প্রায় সাত হাজার দর্শক ধারণক্ষম এই এম্ফিথিয়েটার অন্যান্য রোমান থিয়েটারের স্থাপত্যকলা অনুসরণে নির্মিত হয়েছে। অর্ধচন্দ্রাকৃতির রোমান থিয়েটারের বৈশিষ্ট্য হলো এর যেকোনো সিঁড়িতে বসে অভিনেতা বা শিল্পীর গলার আওয়াজ শুনতে পাওয়া যেত।
এম্ফিথিয়েটারের উল্টো পাশ ধরে বেশ বড় একটা এলাকাজুড়ে রয়েছে রাজকীয় সমাধি, সেও পাহাড়ের খাঁজ কেটে গুহার মতো করে তৈরি। সমাধি ভবনের ওপরে পাহাড় বেয়ে উঠে আশপাশের দৃশ্য দেখা যায় আরও ভালোভাবে। ভবনগুলো একটির সঙ্গে আরেকটি লাগোয়া।
আরও খানিক হেঁটে চললাম রাজপ্রাসাদের দিকে। অন্যান্য স্থাপনার মতো এটিও পাহাড়ের শরীর খোদাই করে কারুকার্যে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে শিল্প। অন্যান্য সাধারণ ভবনের চেয়ে শিল্পে আরেকটু বেশি জৌলুশময়, আরও মোহময়। প্রাসাদের ভেতরে চার দেয়াল ছাড়া আর কিছুই নেই। এরপর চললাম পেট্রা নগরীর সর্বশেষ আকর্ষণ ‘মনাস্টেরি’ বা আরবিতে ‘আল-দিইর’ দেখতে। সে পথ মরুভূমির সে পথে যেতে হলে আরেকটু ধুলোর পথ পাড়ি দিতে হয় মাথার ওপর প্রখর তাপ আর অটুট মনোবল আরেকটি পাহাড় বেয়ে ওপরে ওঠার- তবেই বিরল সুন্দরের দেখা মিলবে।
পথে পড়ল অপূর্ব টেম্পল ‘কাসর-আল-বিনত’-এর।
বহু চড়াই-উতরাই পার হয়ে প্রায় এক ঘণ্টা পাহাড় বেয়ে ওঠার পর দেখা মিলল ‘আল দিইর’। আকারে আল খাজনেহ-এর চেয়ে তিন গুণ বড় আদলে আল খাজনেহরই প্রতিরূপ। খ্রিস্টপূর্ব ৮৬ সালে বাইজেনটাইন শাসনামলে নির্মিত এই স্থাপনা মূলত উপাসনালয় হিসেবে ব্যবহার করা হতো।
আল দিইর থেকে আশপাশের উপত্যকার দৃশ্য অপূর্ব।
আল দিইর থেকে ফেরার পথ একটাই- যে পথ ধরে আমি হারিয়ে গিয়েছিলাম আড়াই হাজার বছরের পুরোনো বাস্তবিক কল্পলোকে।
শিল্প, প্রকৌশলবিদ্যার আবাসভূমি, ব্যবসা-বাণিজ্যে সমৃদ্ধিশালী নগর ছিল এটি। পেট্রাকে পৃথিবী মনে রাখে তার অবদানের জন্য, তার ঐশ্বর্যময় ইতিহাসের জন্য। পেট্রা তাই মোহিত করে যেকোনো ভ্রমণার্থীকে।
ছবি: লেখক