ফিচার I বিচিত্র বিবাহ
প্রাণপ্রবাহ টিকিয়ে রাখার জন্য মানুষের মধ্যে রয়েছে বিয়ে নামক একটি প্রথা। তেমনি তার সমাজেও রয়েছে জড় ও জীবজগতের মধ্যে প্রাণসঞ্চারের জন্য প্রতীকী বিয়ের আয়োজন। সবই মূলত আত্মরূপ দর্শনের প্রয়াস। লিখছেন অতনু সিংহ
জন্মে জীবনের সূচনা, বিবাহে পূর্ণ। তা জৈবিক ও সামাজিক। মানবসমাজে প্রচলিত বিয়ের বাইরেও এ ধরনের কিছু আনুষ্ঠানিক রীতি রয়েছে, যেগুলো অদ্ভুত বটে। জীব ও প্রকৃতিজগতে নিজের সৃজন, রুচি ও জীবনবোধের বিস্তার ঘটাতেই হয়তো দুটি মানুষের বিয়ের পাশাপাশি এসব বিয়ের রীতি; যা কখনো খেলার ছলে, কখনোবা লোকসংস্কৃতির অংশ হিসেবে অনুষ্ঠিত হয়।
পুতুলের বিয়ে
খেলার উপকরণ হিসেবে শিশু-কিশোরদের হাতে ইলেকট্রনিক ডিভাইসের উপস্থিতি ঘটার আগেও পুতুলের বিয়ে বিয়ে খেলা মধ্যবিত্ত, উচ্চমধ্যবিত্ত বাঙালি বাড়িতে আকছার দেখা যেত। এমনকি এই খেলা ঘিরে সত্যিকারের বিয়ের মতোই আয়োজন করা হতো ভোজের। যার পুতুল মেয়ে, তার বাড়িতে আসত পাত্রপুতুলের বাড়ি থেকে বরযাত্রী। আবার কনেপুতুলের বাড়ি থেকে কনেযাত্রীও যেত বরপুতুলের বাড়ি। আমন্ত্রিত-নিমন্ত্রিত অতিথিদের জন্য রান্না হতো পঞ্চব্যঞ্জন। অবশ্য অতিথিরা সবাই কিশোর-কিশোরী। পুতুলের বিয়ে উপলক্ষে রেকর্ড প্লেয়ারে বেজে উঠত সানাই। এমনও দেখা গেছে, এই বিয়েতে কারও কারও বাড়িঘর ঝলমলে হয়ে উঠেছে টুনিবাতির আলোকসজ্জায়।
পুতুলের মধ্যে প্রাণপ্রতিষ্ঠার চেষ্টা মানুষের আদি প্রবৃত্তির একটি। গোষ্ঠীবদ্ধ সমাজ তৈরি হওয়ার পর কোনো জীব, উদ্ভিদ অথবা বস্তুকে যখন কোনো একটি গোত্রের (পরিবারপরম্পরা) উৎস মনে করা শুরু হলো (ফ্রয়েড যাকে বলছেন টোটেম), সেই ভাবনার ভেতর থেকেই পুতুল কনসেপ্টের সূচনা। পুতুল কখনো খেলার অথবা মনোরঞ্জনের বস্তু বা উপায়, কখনোবা পৌরাণিক গাথা ও অধিবিদ্যক কল্পনা একত্র হয়ে দেবদেবীর প্রকাশ। তবে যেটা বোঝা সবচেয়ে জরুরি, তা হলো, মানুষ তার রূপকে বস্তুর মধ্যে প্রতিভাত করতে গিয়ে পুতুলের জন্ম দিয়েছে। একইভাবে নিজের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ প্রাণোচ্ছল পর্বগুলোকে ওই জড়পুতুলের মধ্যে সঞ্চার করতে চেয়েছে। পুতুলের বিয়ের ধারণাটি এসেছে এসব প্রণোদনা থেকেই। শিশু-কিশোরেরা এই খেলার আয়োজক হলেও বড়দের অংশগ্রহণ যে থাকত না, তা নয়।
অদ্ভুত এই ক্রীড়ারীতির প্রসঙ্গ বাংলা সাহিত্য, সংগীত, নাটক, সিনেমাসহ বিভিন্ন শিল্পমাধ্যমে বারবার উঠে এসেছে। কাজী নজরুল ইসলামের একটি বিখ্যাত নাটক ‘পুতুলের বিয়ে’। নজরুলের শিশুতোষ রচনাবলির মধ্যে এটি উল্লেখযোগ্য। এর আখ্যান বিস্তার ঘটেছে পুতুলের বিয়ে দেওয়ার খেলা নিয়ে। কমলি, টুলি, পঞ্চি, গেদি, বেগম, ঠাকুর মা, কমলির দাদামণি ও পুরুত ঠাকুর- এই কয়েকটি চরিত্রের মধ্য দিয়ে গড়ে উঠেছে নাটকের কাহিনি। কমলির চীনা চেহারার ছেলে পুতুল ফুচুংয়ের বিয়ে দেওয়া নিয়ে ভারি বিড়ম্বনা। চীনা চেহারার পুতুল পাত্রর বিয়ের জন্য বাঙালি কন্যাপুতুল কেউই হাতছাড়া করতে চাইছে না। অবশেষে বেগমের জাপানি চেহারার মেয়ে পুতুল গেইসার সঙ্গে ফুচুংয়ের বিয়ে ঠিক করা হয়। আর কমলির আরেকটি সুন্দর চেহারার ছেলে পুতুল ডালিম কুমারের সঙ্গে শেষে টুলির মেয়ে পুতুল পুটুর বিয়ে ঠিক হয়। এই নাটকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হলো সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি। ব্রিটিশ সা¤্রাজ্যবাদ বাঙালি হিন্দু ও বাঙালি মুসলিম সমাজের ঐক্যের মধ্যে যে বিভেদ তৈরি করেছিল, নজরুল সেই বিভেদ দূর করতে শিশুসাহিত্যকেও ব্যবহার করেছেন। পুতুলের বিয়ে নাটকে তাই হিন্দু পুতুল ও মুসলিম পুতুলের বিয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে উঠেছে। কমলির ছেলে পুতুল ফুচুংয়ের সঙ্গে বিয়ে হচ্ছে বেগমের মেয়ে পুতুল গেইসার। এই বিয়েকে কেন্দ্র করে গেদি ও কমলির কথাবার্তার মধ্যে ফুটে উঠেছে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি। কেমন সেটা?
‘গেদি: আচ্ছা ভাই, মুসলমানের পুতুলের সাথে তোর পুতুলের বিয়ে হবেক কী করেক।
‘কমলি: না ভাই, ও কথা বলিসনে। বাবা বলেছেন, হিন্দু-মুসলমান সব সমান। অন্য ধর্মের কাউকে ঘৃণা করলে ভগবান অসন্তুষ্ট হন। ওদের আল্লাহও যা, আমাদের ভগবানও তা।’
এই নাটকের জন্যই নজরুল লিখেছিলেন সেই গান, ‘মোরা একই বৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু-মুসলমান’
সুতরাং বোঝা যাচ্ছে, মধ্যবিত্ত বাঙালি সংস্কৃতির অন্দরে পুতুলের বিয়ে নানা দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
ব্যাঙের বিয়ে
বিভিন্ন সমাজ ও সংস্কৃতিতে বিচিত্র লোকবিশ্বাস প্রচলিত। বাংলাসহ গোটা উপমহাদেশের বিভিন্ন জায়গায় এমন একটি লোকবিশ্বাস, বর্ষা ঋতু চলে আসার পরে বৃষ্টি না হলে ব্যাঙের বিয়ে দিতে হয়। তাতে নাকি ওপরওয়ালার করুণাধারা বর্ষিত হয় পৃথিবীতে। মনে রাখা দরকার, ব্যাঙ পরিবেশ, প্রাকৃতিক ভারসাম্য ও বাস্তুতন্ত্রের জন্য গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রাণী। বর্ষা প্রাণীটির প্রজনন ঋতু। মানবসমাজে বিয়ের সঙ্গে রয়েছে প্রজননের সম্পর্ক। এই বোধ থেকেই তারা ব্যাঙের বিয়ের আয়োজন করে। প্রাণীটির বংশবিস্তারের জন্য। যার মধ্য দিয়ে বৃষ্টির প্রার্থনার কাজটি সম্পন্ন হয়।
ব্যাঙের বিবাহ অতিপ্রাচীন এক লৌকিক ক্রিয়া হলেও এখনকার ডিজিটাল যুগেও এমন লোকাচার পরম উৎসাহে পালিত হয় গ্রামাঞ্চলে। প্রতিবছরই এই খবর পাওয়া যায়। অদ্ভুত এই লোকাচার ঘিরে নানা লৌকিক ছড়া ও লোকগান রয়েছে। ব্যাঙের বিয়ের সময় এসব গান ও ছড়া শোনা যায়। মূলত আদিবাসী ও নিম্নবর্ণের হিন্দুদের মধ্যেই এটি দেখতে পাওয়া যায়। মুসলমানরাও এতে শামিল হন। হিন্দু-মুসলমানের অংশগ্রহণে ব্যাঙের বিয়েকে কেন্দ্র করে গ্রামাঞ্চলের অনেক জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে উৎসবের আমেজ। চাঁদা তুলে আয়োজন করা হয় ভোজের। লাল কাপড়ে মুড়ে সাজানো হয় স্ত্রী ব্যাঙকে। তৈরি করা হয় ব্যাঙের বিশেষ ছাতা। ছাতার তলায় বসিয়ে বিয়ে দেওয়া হয় ব্যাঙযুগলকে। আর বৃষ্টির ঝরে পড়ার আশা ছড়িয়ে পড়ে গ্রামীণ সমাজে।
বৃক্ষবিবাহ
বিশ্ব উষ্ণায়ন ও যথেচ্ছ নগরায়ণের যুগে বৃক্ষরোপণ বা বন সৃজন বিশ্বায়িত সংস্কৃতির অন্দরে নতুন করে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। এই অবস্থায় বৃক্ষবিবাহ বা গাছের বিয়ের মতো লোকাচার পরিবেশবাদীদের কাছে নতুনভাবে সমাজ-রাজনৈতিক একটি উৎসব হিসেবে তাৎপর্যপূর্ণ। গাছের বিয়ের এই লোকাচার এমনিতে সুপ্রাচীন। একসময় গাছের ফল-পাতা খেয়ে মানুষ জীবনযাপন করত, তারপর ক্রমে পশুশিকার, পশুপালন কৃষি যুগে প্রবেশ করে। মানুষ যখন গোষ্ঠীবদ্ধ হয়েছে, কৃষিকার্য শিখেছে, তখন থেকেই মানুষের একেকটি পরিবারের উৎসমুখ বা টোটেম হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে একেকটি গাছকে।
গাছ ও মানুষের এই সম্পর্কের ভিত্তিতেই বৃক্ষবন্দনা থেকে শুরু করে বৃক্ষবিবাহের মতো গুরুত্বপূর্ণ লোকাচার তৈরি হয়েছে বহু বহু আদি জনগোষ্ঠীর মধ্যে। যান্ত্রিক জীবনে প্রবেশের পর মানুষ প্রকৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন হতে শুরু করে। আজ দূষণ, উষ্ণায়ন ও জলসংকটে মানুষের অস্তিত্ব যখন বিপন্ন, তখন শোনা যাচ্ছে সেই কাব্যোক্তি, ‘আমি ছেড়েই দিতে রাজি আছি সুসভ্যতার আলোক/ আমি চাই না হতে নববঙ্গে নবযুগের চালক…’। অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদ থেকে বন সৃজনকে সামাজিক উৎসব হিসেবে তুলে আনার প্রয়াস লক্ষণীয়। ফলে বৃক্ষবিবাহের মতো প্রাচীন লোকাচার শহুরে পরিসরেও জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন কল্যাণমূলক সংগঠন ও পরিবেশবাদী সমাজকর্মীদের উদ্যোগে নানা জায়গায় অনুষ্ঠিত হচ্ছে বৃক্ষবিবাহ। দুটি উদ্ভিদের বিয়ে দিয়ে বৃক্ষের রক্ষণাবেক্ষণ এবং ফল ও বীজের বিস্তারে যাতে সবুজায়নে সম্ভাবনা দৃঢ় হয়, সেদিকে লক্ষ রাখা হচ্ছে। একই সঙ্গে এ উপলক্ষে বন সৃজন করা হচ্ছে ব্যাপকভাবে। নিয়ম করে গাছ কেনা, রোপণ ও রক্ষণাবেক্ষণে উৎসাহিত করা হচ্ছে শহুরে মানুষকে। বৃক্ষবিবাহ রীতি পালনের মাধ্যমে প্রাণপ্রবাহের প্রকৃতিবাদী দর্শন ব্যাপ্ত হচ্ছে মানবসমাজে।
ছবি: ইন্টারনেট