ফিচার I বেঁধেছে এমন ঘর
যৌথ যাপনের অঙ্গীকার সূত্রেই ঘরবাঁধা শব্দবন্ধটির ব্যবহার। এর মূলে আছে প্রেম। তা যখন সংসার ধর্মে প্রবেশ করে তখন ঘর, ঘরবাঁধা, ঘরনি পরস্পর সম্পর্কিত হয়ে ওঠে। লিখছেন অতনু সিংহ
বাংলায় ‘ঘরবাঁধা’ শব্দবন্ধটির তাৎপর্য ব্যাপক। যাপিত জীবনে এর অর্থ বহুমাত্রিক। প্রণয়সূত্রে ঘরবাঁধার প্রচলিত অর্থ দুই নরনারীর যৌথ যাপনে অঙ্গীকারবদ্ধ হওয়া। এর সামাজিক রূপ হলো বিয়ে। ঘরবাঁধার প্রসঙ্গের শুরু এখান থেকেই। বাংলা কাব্যে ও সংগীতে বিষয়টি বারবার উঠে এসেছে। শাক্ত পদাবলী, বৈষ্ণব পদাবলী, ফকিরি তত্ত্ব থেকে শুরু করে বাংলা কবিতায়, চলচ্চিত্রে, সাহিত্যে ‘ঘর’, ‘ঘরবাঁধা’ ও ‘ঘরনি’ প্রসঙ্গটি নানা মাত্রায় প্রকাশিত। ঘরের মাহাত্ম্য আর ঘরনির উপর গৃহের নির্ভরতার ভাবনা ছিল বঙ্গের যাপনদর্শনে গুরুত্বপূর্ণ। ঘরবাঁধা হয় যেমন যৌথ যাপনের শর্তে, তেমনই ঘরের ধারণা ঘরনিকে কেন্দ্র করেই পূর্ণতা পায়। রামপ্রসাদ সেন বলছেন, ‘আমি যন্ত্র, তুমি যন্ত্রী/ আমি ঘর, তুমি ঘরণী/ আমি রথ, তুমি রথি/ যেমন চালাও তেমনি চলি…/’। আরাধ্য ঈশ্বরীর প্রতি তিনি এই গান নিবেদন করলেও, এর দার্শনিক জায়গাটা ইহলৌকিক। ঘরবাঁধার পর গৃহের দায়িত্ব গৃহিণীর ওপরই বর্তায়। তিনিই চালান ঘরসংসার।
কেবল গৃহকেন্দ্রিকতা নয়, ঘরের ধারণা দেহের রূপেও নানাভাবে পল্লবিত। আপন সত্তাকে বোঝার জন্যেও এই শব্দটির ব্যবহার রয়েছে। তন্ত্রের দেহতত্ত্ব কিংবা চৈতন্যের দ্বৈতাদ্বৈত দর্শনে ঘুরেফিরে ঘর আসলে দেহমন্দির। এখানে ঘরবাঁধার অর্থ যুগলে পুরুষ ও প্রকৃতির একাত্ম হয়ে যাওয়ার মাধ্যমে ঘর বা দেহ বা অস্তিত্বের পূর্ণ বিকাশ। এই উপলব্ধি থেকে লালন সাঁই গানে গানে বলেন, ‘বেঁধেছে এমন ঘর/ শূন্যের উপর পোস্তা ক’রে/ ধন্য ধন্য বলি তারে’! আর রবীন্দ্রনাথ লেখেন, ‘আমার এ ঘর বহু যতন করে ধুতে হবে মুছতে হবে মোরে/ আমারে যে জাগতে হবে কে জানি সে আসবে কবে/’। লালন বলছেন, শূন্যের ওপর পোস্তা করে ঘরবাঁধার কথা। তাতে দেহের নয় কুঠুরি, আটদরজা ইত্যাদি প্রসঙ্গ এসেছে। রবীন্দ্রনাথের গানে ঘর ধুয়েমুছে সাফ করে রাখার রূপকে আত্মশুদ্ধির কথা বলা হয়েছে। যার উৎস ও আকাঙ্ক্ষা প্রেম। প্রেমের কাছে নিজেকে সমর্পণ। সেই প্রেমের মানুষই লালনের মনের মানুষ। তাকে পাওয়াই পরমকে পাওয়া। রবীন্দ্রনাথ অপেক্ষা করছেন তাঁর আগমনের। তাই নিজের ঘরকে, নিজের মনকে শুদ্ধ করার কথা বলছেন তিনি। কেননা, এই ঘরে সেই মনের মানুষের আগমন ঘটলে তবেই গৃহ পরিপূর্ণ হয়ে উঠবে।
সত্যজিতের অপুর ট্রিলজিতে স্ত্রী অপর্ণার মৃত্যুর পর ভেঙে গিয়েছিল অপুর সংসার। ফলে অপুর জীবনে নেমে আসে বিপর্যয়। চরম দিশেহারা অবস্থায় পৌঁছায় অপু। আসলে মনের মানুষ থেকে বিচ্ছিন্ন হলে ঘরের অস্তিত্ব বিপন্ন হয়। এই সত্য বৈষ্ণব পদাবলীতে প্রকাশিত। জ্ঞানদাস লিখছেন, ‘সুখের লাগিয়া এ ঘর বাঁধিনু/ অনলে পুড়িয়া গেল/ অমিয়া-সাগরে সিনান করিতে/ সকলি গরল ভেল’! ঘর ভেঙে যাওয়া বা পুড়ে যাওয়ার মধ্য দিয়ে আসলে রাধিকার বিরহযাতনার কথা বলছেন এই কবি। সেখানে শ্রীরাধিকার বিলাপ, ‘নগর বসালাম সায়র বাঁধিলাম/ মাণিক পাবার আশে।/ সাগর শুকাল মাণিক লুকাল/ অভাগার করম-দোষে।।/’ মনের মানুষের সঙ্গে ঘরবাঁধার বাসনা বাংলা কাব্যে আজও বহমান। সত্তর দশকের কবি মৃদুল দাশগুপ্ত বিবাহ প্রস্তাব কবিতায় লিখছেন, ‘বাড়িটি থাকবে নদীর কিনারে, চৌকো,/ থাকবে শ্যাওলা রাঙানো একটি নৌকো,/ ফিরে এসে খুব আলতো ডাকবো, বউ কই…/ রাজি?’ কবিতাটি শেষ হচ্ছে যে বাক্যে, সেটি হলো ‘তোলো মুখ, এসো ধরো হাত, চলো সঙ্গে’। একটি বাড়ির কল্পনাকে সামনে রেখে মনের মানুষকে বিবাহ প্রস্তাব দিচ্ছেন কবি।
অর্থাৎ বঙ্গসংস্কৃতিতে ‘ঘরবাঁধা’ শব্দটি প্রেমের পূর্ণতা ও আকাঙ্ক্ষা নানাভাবে প্রকাশ করে এসেছে। ঘর ভেঙে যাওয়া আসলে চূড়ান্ত বিচ্ছেদের মেটাফর। এখানে ঘরের সঙ্গে সম্পর্কিত ‘গৃহলক্ষ্মী’র ধারণাও। তিনি গৃহকর্ত্রী। ঘরনি। ঘরকে পূর্ণতা দেন। ঘরসংসার চালানোর প্রতিটি বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেন। এই ঘরনিই আসলে প্রকৃতিস্বরূপা। এখানে ঘরবাঁধার অর্থ দুটি মানুষের এক হয়ে যাওয়া, যা আসলে পুরুষ ও প্রকৃতির একত্বে ‘অর্ধনারীশ্বর’-এর আদি বঙ্গীয় দর্শনের প্রবহমানতা।
ছবি: ‘অপুর সংসার’-এর দৃশ্য