এডিটরস কলাম I সেই গ্রাম দেখতে চাই
আজকাল গ্রামগুলো হয়ে উঠেছে একেকটি সেমি টাউন। শহুরেদের মতোই সেখানকার জীবনধারা। লক্ষ করেছি, শীতে অনেক পরিবারে পিঠা খাওয়া হয় কাছের কোনো বাজার থেকে কিনে এনে। দালানকোঠায় ভরে গেছে গ্রাম। অনেক পুকুরই উধাও হয়ে গেছে। ঝোপঝাড়, ফসলের মাঠ, জলাশয়, গাছপালার গাঢ়তা—কিছুই আর আগের মতো নেই
বাংলাদেশে শীতকালটা বেশ ছোট। আগে এমন ছিল না। বিশেষত গ্রামাঞ্চলে। অক্টোবর এলেই কাঁথা জড়াতে হতো গায়ে। নভেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে লেপ-কম্বল বের করে রোদে মেলে দেওয়া হতো। তখন থেকেই উত্তরের কনকনে হাওয়ায় এক অনির্ণেয় শিহরণে কেঁপে উঠত শরীর আর মন। অধিবাসীদের বেশির ভাগই, বিশেষত সচ্ছল পরিবারগুলো মৌসুমটা বেশ উপভোগ করত। নতুন আর তাজা সবজিতে, বেড়ানোয়, খোশগল্পে, পিঠাপুলিতে, আত্মীয় সমাগমে।
আজকাল গ্রামগুলো হয়ে উঠেছে একেকটি সেমি টাউন। শহুরেদের মতোই সেখানকার জীবনধারা। লক্ষ করেছি, শীতে অনেক পরিবারে পিঠা খাওয়া হয় কাছের কোনো বাজার থেকে কিনে এনে। দালানকোঠায় ভরে গেছে গ্রাম। অনেক পুকুরই উধাও হয়ে গেছে। ঝোপঝাড়, ফসলের মাঠ, জলাশয়, গাছপালার গাঢ়তা—কিছুই আর আগের মতো নেই। হুমায়ুন আজাদ একটা কবিতায় লিখেছিলেন, ‘আমাকে ভালোবাসার পর কিছুই আর আগের মতো থাকবে না তোমার।’ শহুরে জীবনধারার প্রেমে পড়ে গ্রামবাসীর আর কিছুই আগের মতো নেই!
ফলে, মানুষের স্বাভাবিক খাদ্যশৃঙ্খলও বদলে গেছে বিপজ্জনকভাবে। হাইব্রিড কিংবা জিএম (জেনেটিক্যালি মোডিফায়েড) ফুড, রাসায়নিক সার ও কীটনাশক, ফরমালিন ইত্যাদির কবলে পড়ছি আমরা। চাষ করা মাছ, অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া মুরগির মাংস ও ডিম, ইনজেকশনে ফাঁপিয়ে তোলা গরুর মাংস, উচ্চফলনশীল শস্য গ্রহণ করে বেড়ে উঠছে আমাদের সন্তানেরা। সবই কৃত্রিম ও চাপিয়ে দেওয়া—যা মানুষের সুস্থ ও স্বাভাবিক বিকাশের অনুকূল নয়। কেন এমন হলো? কারণ মূলত একটাই—গ্রামকে নিজের মতো থাকতে দিচ্ছি না আমরা। ক্ষণিকের সুবিধার জন্য ধ্বংস করছি প্রকৃতি। কে আমাদের বোঝাবে যে, কৃত্রিম সবকিছুর সৃষ্টি কিংবা উৎপাদন মানুষের পক্ষে সম্ভব, কিন্তু প্রকৃতির মৌলিকতা নয়। উভয়ের মধ্যে পার্থক্য মেরুদূর। তা প্রাণবৈচিত্র্যের ওপর প্রভাবের দিক থেকেই। গ্রাম তথা প্রকৃতির শূন্যতা প্লাস্টিকের বাগান দিয়ে মেটানো যায় না। খেজুরগাছ ধ্বংস করে আপনি কি খেজুরের রস আশা করতে পারেন? সুইমিংপুলে পুকুরের চাহিদা কি মেটে?
বলছি না যে, উন্নত জীবনযাপনের সুযোগ গ্রামে থাকতে নেই। বরং বলি, সেখানেই তা থাকা বেশি জরুরি। আমাদের কৃষকেরা সারা বছর পরিশ্রম করেন। খাদ্যের জোগান দিয়ে দেশের মানুষকে বাঁচিয়ে রাখতে এর বিকল্প আর কিছুতে নেই। উন্নত জীবন তাদের বেশি প্রাপ্য। কিন্তু প্রযুক্তির নির্বিচার ব্যবহার, দ্রুত ও বেশি ফলনের নিশ্চয়তা, প্রকৃতি ধ্বংস করে আবাসন ও অন্যান্য স্থাপনা—এগুলোই কি সেই জীবনের চাবিকাঠি? উন্নতির ধারণা কি এটাই? মোটেই নয়। পৃথিবীজুড়ে এখন টেকসই উন্নয়নের কথা বলা হচ্ছে। তা এই—সব ধরনের অগ্রগতির সঙ্গে প্রকৃতির সুরক্ষাও নিশ্চিত করা। অর্থাৎ তা যেমন আছে, তেমন থাকতে দিয়ে, জীবনব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটানো।
ছোটবেলায় আমরা গ্রামবাংলার বর্ণনায় ‘পুকুরভরা মাছ আর গোয়ালভরা গরু’র কথা পড়েছি ও শুনেছি। খানিকটা দেখেছিও। আজকের প্রজন্মের কাছে এটা কল্পনামাত্র। ‘গ্রাম’ শব্দটি উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে যে ছবি জেগে ওঠে আমাদের মনে, তা আজ প্রায় মুছে যেতে বসেছে। ‘ছায়া সুনিবিড় শান্তির নীড় ছোট ছোট গ্রামগুলি’ আর নেই। কারণ, গ্রাম থেকে প্রকৃতি উচ্ছেদ হয়ে যাচ্ছে। ফলে, ঘাসের ডগায় কিংবা পত্রপল্লবে হেমন্তের সেই শিশির, বিন্নি চালের সুগন্ধি ভাত, শরীরে শিহরণ জাগানো মৃদু ঠান্ডা হাওয়া, শুকিয়ে আসা জলাশয়-পুকুর থেকে মাছ ধরা—সব বিলীন হয়ে যাচ্ছে প্রযুক্তির ওপর অন্ধ-নির্ভরতার দাপটে।
শীতে বেড়ানোর জন্য সবাই যায় দেশ-বিদেশের সমুদ্রসৈকতে, পাহাড়ে, নয়তো শহরের কাছাকাছি কোনো রিসোর্টে। আমি এসবের কোথাও যেতে চাই না। চাই গ্রামে যেতে, ভোরের কুয়াশার ভেতর কোনো জলাশয়ের ধারে কিংবা একগুচ্ছ গাছের মাঝখান দিয়ে হেঁটে যেতে। সূর্য উঠলে দেখতে চাই শিশিরে ভর করেছে রঙিন আলো। যখনই অবসর আসে, তখনই আমি কল্পনায় এই সৌন্দর্যে ডুবে যেতে থাকি। চলে যাই সেই উঠোনের নরম রোদে, যেখানে মাদুর পেতে বসে আছেন আমার পূর্বপ্রজন্মের মানুষেরা, তাদের কাছ থেকে প্রকৃতির পাঠশালায় পাওয়া গল্প শুনতে থাকি!