ফিচার I বিশ্বরঙের সিকি শতাব্দী
২৫ বছরে আজকে যে ‘বিশ্বরঙ’, তার শুরুটা বলতে গেলে মর্মে রঙ লাগানোর মতোই। কালক্রমে সেই রঙ ছড়িয়েছে কর্মে। একদিন শখের বশেই রঙ লাগানোর যে খেলা শুরু করেছিলাম, তা সময়ের ধারা বেয়ে কেমন করে যেন দেখতে দেখতেই পেরিয়ে এল দুই যুগের বেশি সময়। দেশীয় আত্মপরিচয়ের মূল্যবোধ থেকে অনেক স্বপ্ন নিয়ে শুরু হয় চতুষ্টয়ের স্বপ্নযাত্রা ১৯৯৪ সালে ১০০ স্কয়ার ফুটের একটা দোকান নিয়ে। নারায়ণগঞ্জে শিল্পীদের একটি সংগঠন ছিল চারু রঙ নামে।
সান্তনা মার্কেটে দোকান নেওয়ার পর ওই চারু রঙ-এর চারু বাদ দিয়ে ‘রঙ’ শব্দটিই চয়ন করি। দোকানের নাম হয় ‘রঙ’। রাতারাতি সাফল্য যে আসে, তা নয়। কিন্তু ক্রমেই নামটা ছড়িয়ে যায় মানুষের মুখে মুখে। ওই সময়ের চারুকলার শিক্ষক মরণ চাঁদ পালের কাছ থেকে তাঁর তৈরি সিরামিকসের সামগ্রী নিয়ে এসে বিক্রি হলে দাম দিয়ে আবার নতুন সামগ্রী কিনে আনা হতো। এভাবেই চলতে থাকে এই সিরামিকসের আর্ট পিসগুলো, সঙ্গে বিয়েবাড়ির স্টেজ ও আলপনার কাজ। ক্রমেই বাড়ে এর চাহিদা। তখনো দোকানে কাপড়ের প্রবেশ ঘটেনি। সেটা আসতে সময় নেয় আরও কিছুদিন। ১৯৯৫ সালে শাড়ি স্থান পায় সিরামিকসের আর্ট পিসগুলোর পাশাপাশি।
ঈদের সময় অত কাপড় কেনা, তাতে কাজ করার মতো প্রয়োজনীয় পুঁজি থাকত না। তখন পরিচিতজনেরাই দিতেন টাকা। তা দিয়ে ঈদের সময় কাপড় তোলা হতো ‘রঙ’-এ। মজার ব্যাপার হলো, ক্রমে কাপড়ে ঝুঁকে যাওয়া রঙ-এর প্রাথমিক সাফল্য পাঞ্জাবিতে। এত দিন যেটা ছিল আবেগ, শখ; সেটাই নতুন এক বোধের তৈরি করে। তা থেকেই জন্ম নেয় দায়িত্বশীলতা। কারণ, তত দিনে সরাসরি শত শত মানুষ জড়িয়ে গেছে রঙ-এর কর্মকা-ের সঙ্গে। জড়িত হয়েছে শত শত তাঁতি পরিবার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে। রঙের শিল্পবোধ আর রুচির বাস্তবায়নের প্রধান কারিগর এরাই।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ থেকে প্রথম বিভাগে এম এফ এ সম্পন্ন করে শিল্পসত্তাকে দেশ ও জাতির কল্যাণে ব্যবহারের প্রচেষ্টায় আত্মমগ্ন হই। মুক্তবাজার অর্থনীতির এই অস্থির সময়েও নিজস্ব শিকড়ের সন্ধান করতে গিয়েই ফ্যাশন ডিজাইনার হিসেবে দেশীয় তাঁতকে প্রাধান্য দিয়েছি সব সময়। এ দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্যের বিশ্বব্যাপী মূল্যায়নে ‘বিশ্বরঙ’ এর পথচলা সুদীর্ঘ ২৫ বছরের। সকল সীমাবদ্ধতা উপেক্ষা করে সৃষ্টির ব্যাকুলতায় ১৯৯৪ সালের ২০ ডিসেম্বর সময় রাঙানোর ব্রত নিয়ে নারায়ণগঞ্জে ফ্যাশন হাউস রঙ-এর সূচনা। সঙ্গে ছিল মানুষের অকৃত্রিম ভালোবাসা। ‘রঙ যেন মোর মর্মে লাগে’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই অনুভবকে বিশ্বময় ছড়াতেই ২০১৫ সালে পথচলা শুরু করে বিশ্বরঙ।
১৯৯৪ সালে প্রতিষ্ঠার কিছুকালের মধ্যেই বিশ্বরঙ ফ্যাশন-সচেতনদের অকৃত্রিম ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে ওঠে। নিরীক্ষামূলক কাজের মধ্য দিয়ে পরিণত হয় দেশের সেরা একটি ফ্যাশন ব্র্যান্ডে। এ দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্যের বিভিন্ন মোটিফ যেমন—শখের হাঁড়ি, মুখোশ, নকশি পাখা, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বাংলার পটচিত্র, বাংলা পঞ্জিকা, ঐতিহ্যে বাংলা সিনেমা, পানাম নগর, কান্তজিউ মন্দিরের টেরাকোটা, রিকশা পেইন্টিং ইত্যাদি পোশাকের অলংকরণ হিসেবে ব্যবহার করে দেশীয় ফ্যাশনকে শিকড়মুখী করতে চেয়েছি।
আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও তা পৌঁছে দিয়েছি সফলতার সঙ্গে। প্রদর্শন করেছি আমেরিকা, ভারত, মালয়েশিয়া, কানাডার মতো ফ্যাশন-সচেতনদের দেশে। উপহার দিয়েছি পোশাকে অতি উজ্জ্বল রঙের অনুভবকে, যা বাংলাদেশের ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রিকে আরও রাঙিয়েছে অনুকরণীয়ভাবে। টাঙ্গাইলের মলিন তাঁতের শাড়িকে আধুনিক ফ্যাশনের অনুষঙ্গ করতে নিরলস কাজ করেছে বিশ্বরঙ। যার প্রচেষ্টার সুফল দেশীয় ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রিতে বিদ্যমান। বিভিন্ন দিবসে পোশাকের বর্ণিলতা এ হাউসের মাধ্যমেই শুরু হয়, যার প্রচলন আজ দৃশ্যমান।
২০১০ সালে জাতীয় জাদুঘরে প্রথমবারের মতো ‘আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে রঙের উপস্থিতি’ শীর্ষক এক যুগান্তকারী প্রদর্শনীর আয়োজন করি, যা সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে বোদ্ধা মহলেও ব্যাপক প্রশংসা অর্জন করে। সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকেও সরে আসিনি কখনো, দেশীয় বুটিক শিল্পকে রক্ষায় রাজপথেও ছিলাম সরব।
শিশুদের মেধাবিকাশের লক্ষ্যে আয়োজন করি ‘মা’ দিবসে ‘আমার রঙে আমার মা’ শীর্ষক এক ব্যতিক্রমী প্রতিযোগিতা ও প্রদর্শনীর। শিশুদের আঁকা প্রাণবন্ত চিত্রকলাকে ফ্যাশনের উপাত্ত হিসেবে ব্যবহার করে দিয়েছি ভিন্নমাত্রা। ২০ বছর পূর্তিতে আর টিভির সঙ্গে যৌথ আয়োজনে করি ২০২০ কালার্স। সারা দেশের টিনএজদের মধ্য থেকে প্রতিভাবানদের বাছাই করে উন্নত প্রশিক্ষণের মধ্য দিয়ে এ দেশের মিডিয়াকে উপহার দিই একঝাঁক নতুন মুখ। যাদের মধ্য থেকে আন্তর্জাতিক পর্যায়েও কাজ করছে অনেকে।
বিশ্বরঙ-এর সৃষ্টিশীলতা সব সময়ই সুস্পষ্ট এবং স্বতন্ত্র। স্থানীয় কারিগর, তাঁতি, সূচিশিল্পী, কারুশিল্পীদের সঙ্গে কাজ করি। বিশ্বরঙের প্রতিটি নকশা বাংলাদেশের লোকসংস্কৃতির উপাদানে অনুপ্রাণিত। ফলে ফ্যাশনপ্রেমীদের কাছে একটি সর্বজনীন দায়বদ্ধতা নিয়েও প্রতিষ্ঠানটি হাজির হতে পেরেছে।
বিপ্লব সাহা
কর্ণধার, বিশ্বরঙ
ছবি: বিশ্বরঙ