এডিটরস কলাম I সুন্দরের পক্ষে
কিংবদন্তি রুশ কথাসাহিত্যিক লেভ তলস্তয় সুন্দরের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে এ মতেরই প্রতিষ্ঠা করেন। তবে কল্যাণের বিষয়টি তিনি দেখেছেন নৈতিক দিক থেকে। সুন্দর সম্পর্কে তলস্তয়ের দেওয়া সংজ্ঞার কিছুকাল পরে এর সঙ্গে জড়িয়ে যায় আনন্দ ও সুখ শব্দটি। তাহলে শেষ পর্যন্ত আমরা বুঝলাম— যা ভালো, কল্যাণকর ও আনন্দদায়ক, তা-ই সুন্দর। আমরা যখন বলি মানুষটি সুন্দর, তখন তা মূলত ওই ব্যক্তি সম্পর্কে এই তিনটি ধারণা ও অনুভূতির মিলিত প্রকাশ
এক.
পারিবারিক, সামাজিক ও পেশাগত পরিমন্ডলে আমরা শুভেচ্ছা বিনিময় করি, বিদায় সম্ভাষণও। বলি— ভালো থেকো, সুন্দর থেকো। এই দুটি থাকা যে আলাদা কিছু নয়, তা সবারই জানা। রুশ সমাজে তো আঠারো শতকেও সুন্দর ও ভালোর অর্থ ছিল একই। অর্থাৎ ‘লোকটি সুন্দর’ বললেই সবাই বুঝে নিত— সে ভালো। উনিশ শতকের শেষ দিকে সেখানে সুন্দরের সঙ্গে নতুন একটি অর্থ যুক্ত হয়। তা হলো, শুভ বা কল্যাণ। মানে, যা মঙ্গলময় ও কল্যাণকর, তা-ই সুন্দর। কিংবদন্তি রুশ কথাসাহিত্যিক লেভ তলস্তয় সুন্দরের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে এ মতেরই প্রতিষ্ঠা করেন। তবে কল্যাণের বিষয়টি তিনি দেখেছেন নৈতিক দিক থেকে। সুন্দর সম্পর্কে তলস্তয়ের দেওয়া সংজ্ঞার কিছুকাল পরে এর সঙ্গে জড়িয়ে যায় আনন্দ ও সুখ শব্দটি। তাহলে শেষ পর্যন্ত আমরা বুঝলাম— যা ভালো, কল্যাণকর ও আনন্দদায়ক, তা-ই সুন্দর। আমরা যখন বলি মানুষটি সুন্দর, তখন তা মূলত ওই ব্যক্তি সম্পর্কে এই তিনটি ধারণা ও অনুভূতির মিলিত প্রকাশ।
‘ভালো থেকো, সুন্দর থেকো’— বিদায়ের আগে এই উক্তি যার উদ্দেশে আমরা করি, আমাদের একটা প্রত্যাশার কথাই প্রকারান্তরে তাতে ব্যক্ত হয়ে যায়। নৈতিকভাবে ভালো থাকার আশাটিও এতে লুকিয়ে থাকে, যদিও আমরা তা টের পাই না। কবি জন কিটসের ‘ট্রুথ ইজ বিউটি, বিউটি ইজ ট্রুথ’ কথাটি এ প্রসঙ্গে মনে পড়ছে। সত্য সব সময়ই নৈতিক। এর সৌন্দর্য অনস্বীকার্য।
দুই.
সৌন্দর্য খন্ডিত কোনো ধারণা নয়, বরং সামগ্রিক একটি ব্যাপার, যদিও বিভিন্ন জায়গায় এর বিচিত্র অবস্থান, গ্রহণযোগ্যতা ও আবেদন। এমনকি ব্যক্তিভেদে এর ভিন্নতা অবধারিত। প্রশ্ন হচ্ছে, এর সমগ্রতা নিয়ে আমরা যত কথা ভাবি ও বলি— এর যথাযথ উপস্থাপনের ক্ষেত্রে আমরা কি ততটা মনোযোগী? যেমন ধরুন, কোনো দিবসে বা সামাজিক অনুষ্ঠানে কিংবা কর্মস্থলে আমরা উপযোগমাফিক সাজপোশাকে হাজির হই। কিন্তু আমাদের আচরণেও যে সুন্দর হওয়া দরকার এবং ব্যক্তি, সময় ও স্থানভেদে তা ভিন্ন হবে— সেই চর্চাও তো জরুরি। আচরণ বুঝিয়ে দেয়, মানুষ হিসেবে আপনি কেমন আর কোন পরিবেশে বিকশিত হয়েছেন এবং অবস্থান করছেন। বলতে চাইছি, যত সাজগোজ করি না কেন, আমাদের আচরণও হতে হবে সুন্দর। এটি পরিবারে, সমাজে, কর্মক্ষেত্রে আপনার গ্রহণযোগ্যতা ও গুরুত্ব বাড়িয়ে দেবে। মনে রাখবেন, অন্যদের কাছে সুন্দর হলেই আপনি সুন্দর।
কেমন করে অন্যদের কাছে সুন্দর হবেন? চিত্তের সৌন্দর্যই রূপে ধরা দেয় বা প্রকাশিত হয়ে থাকে, এটা আমিও বলি এবং বিশ্বাস করি। কিন্তু চিত্ত ও রূপ— দুটি পৃথক ধারণা। প্রথমটি বিমূর্ত, দ্বিতীয়টি মূর্ত। আমরা যখন কোনো ব্যক্তির মুখোমুখি হই; তার চেহারা, আচরণ, রুচি, মূল্যবোধ, জ্ঞান, অবস্থান ইত্যাদি সম্পর্কে ধারণা একসঙ্গে তাৎক্ষণিকভাবে পেয়ে যাই। ভালো লাগলে বলি, লোকটি সুন্দর বা তার মন ভালো। খারাপ লাগলে এর উল্টোটি বলি কিংবা এ সম্পর্কে নীরব থাকি। এ সত্য চিরন্তন যে, মানুষ কখনোই তার আসল রূপটি লুকিয়ে রাখতে পারে না। আড়াল করতে না-পারা সেই চেহারাটি মূলত তার চিত্ত। পরিবেশভেদে এটি নানাভাবে বিকশিত হয়— তা মেনে নেওয়ার পরও এ ব্যাপারে আমি একটা কথা যোগ করতে চাই। তা হলো, সবকিছু ছাপিয়ে যে ব্যক্তি নিজেকে পরিশুদ্ধ রাখতে পারে, সে-ই সত্যিকারের সুন্দর। কোনো কলুষতা, ক্ষুদ্রতা, জটিলতা তাকে স্পর্শ করে না। জীবন ও জগৎ সম্পর্কে তার দৃষ্টিভঙ্গি স্বচ্ছ, মহৎ, কল্যাণকর। সহজতার দীপ্তি নিয়েই তার বিচরণ।
তাহলে আসুন, আমরা তেমনই হই। বছরটা সেভাবেই শুরু হোক।