ফুড ট্রাভেল I পাঁচ শহরের পঞ্চব্যঞ্জন
পাঁচটা ভিন্ন শহরে পাঁচটা ম্যাচ, পাঁচ রকম খাবার। ভারতীয় রসনার বৈচিত্র্য উপভোগের অভিজ্ঞতা বয়ান করেছেন সামীউর রহমান
করিম, ইকবাল, বাবু, নাফিস, সিরাজ— কাকে ছেড়ে কার কথা বলি! নাহ্, এরা কেউ ক্রিকেটার নন, তবে নিজেদের খেলার পাকা খেলোয়াড়। কারও হাতযশ কাবাবে, কেউবা বিরিয়ানির বাজিকর। মাঠের খেলায় একেক শহরে দেখেছি মুশফিকুর রহিম, রোহিত শর্মা, মায়াঙ্ক আগারওয়াল কিংবা বিরাট কোহলির কবজির বাহাদুরি। তাদের চাইতে কম মুগ্ধ করেনি করিম’স-এর বাটার চিকেন, ইকবাল-এর মাসালা চিকেন, বাবু কাবাবের চিকেন আফগানি, নাফিসের তাংরি কাবাব আর সিরাজের মাটন বিরিয়ানি। শুধু পার্থক্য হচ্ছে, ক্রিকেট সিরিজ সূচিতে দুটো টেস্টের আগে তিনটা টি-টোয়েন্টি ম্যাচও ছিল, আমার তো সবই TASTE ম্যাচ!
মোগলদের দিল্লি, পান্ডবদের হস্তিনাপুর। রাজধানী দেখা না হলে নাকি দেশটাই অদেখা থেকে যায়। ভারতের মাটিতে এর আগে পা পড়েছে একাধিকবার। কলকাতার গন্ডি ছাড়িয়ে মাসখানেকের জন্য থাকা হয়েছিল বেঙ্গালুরুতেও। সেসবই স্রেফ ঘুরতে অথবা পারিবারিক প্রয়োজনে। এবারে একেবারেই অন্য উদ্দেশ্য। স্পোর্টস রিপোর্টার হিসেবে বাংলাদেশ-ভারত ক্রিকেট সিরিজ দেখার জন্য। ঢাকা থেকে প্রথম গন্তব্য দিল্লি। বিমানের ফ্লাইট সন্ধেবেলায় দিল্লির ইন্দিরা গান্ধী হাওয়াই আড্ডায় (হিন্দিতে বিমানবন্দরকে তাই বলে!) নামিয়ে দেওয়ার দিনটায় দিল্লির বাতাসে দূষণের মাত্রা বিপজ্জনকের সীমাও ছাড়িয়েছে। প্রথম গন্তব্য পাহাড়গঞ্জ, ওখানেই হোটেল ঠিক করা। নানান কাজে বাংলাদেশের অনেকেই হিল্লি-দিল্লি করছেন, তাই এখানকার বর্ণনায় শব্দখরচ কম করাই ভালো। প্রথম রাতটা দিল্লিতে পিটিআইতে কর্মরত এক সাংবাদিক বন্ধুর বাসায় পরোটা, আলুর দম, মাটন কষা আর ভরপুর আড্ডায় কাটিয়ে দেওয়ার পরের দিনের সকালটা কেটে গেল মোবাইলের সিম কার্ড আর রাজকোট যাবার বন্দোবস্ত করতেই। তারই এক ফাঁকে পাহাড়গঞ্জের এক পাঞ্জাবি ধাবায় তাওয়া রুটি আর বাটার চিকেনের ত্বরিত মধ্যাহ্নভোজ শেষে গন্তব্য ফিরোজ শাহ কোটলা স্টেডিয়াম। সেখানেই তো সিরিজের প্রথম টি-টোয়েন্টি!
ম্যাচের আগে উড়ো হুমকি ছিল বলেই হয়তো খাকি আর জলপাই উর্দির কড়া পাহারা স্টেডিয়ামে। যা হয়, বেশ খানিকটা ভুল-বোঝাবুঝি এবং সঠিক গেট খুঁজে না পাওয়ার বিড়ম্বনার পর প্রেসবক্সে গিয়ে ল্যাপটপ খানা মেলে বসতে না-বসতেই দেখি সামনের সারিতে এক সহকর্মী বড়সড় এক শিঙাড়ায় কামড় বসাচ্ছেন! জানলাম, আপ্যায়নের কমতি রাখেনি ডিডিসিএ (দিল্লি অ্যান্ড ডিস্ট্রিক্ট ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন)। বিকেলের নাশতায় চা-কফির সঙ্গে শিঙাড়া (হিন্দিভাষীদের কাছে যেটা সামোসা), সবজি দিয়ে ‘হারা-ভরা কাবাব’ আর নন-ভেজ ফিশ ফিঙ্গার। টি-টোয়েন্টি ম্যাচে নৈশভোজের জন্য বিরতি মাত্র ১০ মিনিট, ওদিকে পত্রিকার ডেডলাইনের তাড়া থাকায় লেখা ফেলে খেতে যাবার উপায় নেই! তাই প্রথম ইনিংসেই যা রান করার করে ফেলার মতো একগাদা স্ন্যাকস খেয়েই পেটটা ভরিয়ে নিলাম। পরে বুঝেছি, টস জিতে ব্যাটিংয়ের মতোই ঠিক ছিল সিদ্ধান্তটা। মুশফিকের হাফ সেঞ্চুরি আর মাহমুদউল্লাহর ছক্কায় সিরিজের প্রথম ম্যাচেই স্বাগতিকদের হারিয়ে দেওয়া গল্প আর পেছনের গল্প লেখার চাপে যে চটজলদিই সারতে হয়েছিল রাতের খাবারটা। চানা মাসালা, পনির মাসালা, নান, জিরা পোলাও আর বাটার চিকেন— এই ছিল আয়োজন। সঙ্গে গুলাবজামুন। খাবারটা মজাদার হলেও চেখে দেখার সময়টাই যে ছিল কম!
লেখা শেষ করে রাতে হোটেলে ফিরতে ফিরতে ক্যালেন্ডারে তারিখ পাল্টে গেছে। রাজকোট যাবার জন্য আহমেদাবাদের বিমান ধরতে হলো সেদিনই রাত আটটায়। দিল্লিতে এসেও কি তাহলে করিম’স-এর খানাতল্লাশি চালানো হবে না? সাহস পেলাম সতীর্থদের কাছ থেকে; কারণ, তাদের পেটেও যে দানাপানি পড়েনি রাতে! অতএব ল্যাপটপ হোটেলে রেখেই করিম’স-এর উদ্দেশে উবার ডাকা! জামে মসজিদের কাছে করিম’স তখন ঝাঁপ ফেলার অপেক্ষায়, এমন সময় হাজির আমরা চার বান্দা। কাবাবের চুলার কয়লাগুলো নিভে গেছে অনেক আগেই। তাই বাটার চিকেন, ডাল মাখানি আর তাওয়া রুটিতেই সেরে নিলাম দিল্লির এই খাদ্যতীর্থদর্শন।
ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানবে। তেমনি সাংবাদিক কোথাও গেলে প্রেসক্লাবে যাবে না, এটা হতেই পারে না। প্রেসক্লাব অব ইন্ডিয়ার সাবেক সভাপতি গৌতম লাহিড়ীর আমন্ত্রণে মধ্যাহ্নভোজনে হাজির হলাম ১ নম্বর রাইসিনা হিলের বাড়িটায়। পাশেই রাষ্ট্রপতি ভবনসহ ভারত সরকারের কেন্দ্রীয় অনেক কার্যালয়। প্রেসক্লাবের মেনুতে বাঙালি খাবার মাছ-ভাত চালু করার কৃতিত্ব নেওয়া গৌতমদাই বললেন, ‘তোমরা ঢাকা থেকে এসেছ, এখানে বাঙালি খাবার কেন খাবে? চায়নিজটা ভালো করে এখানকার বাবুর্চিরা, ওটাই খাও।’ দরাজ হাতে অর্ডার দিলেন চিকেন স্যুপ, এগ ফ্রায়েড রাইস, চিকেন মাঞ্চুরিয়ান, সুইট অ্যান্ড সাওয়ার প্রন আর আইসক্রিম। আমরাও খেলাম একদম পেট ভর্তি করে! কারণ, রাতের বেলায় ফ্লাইট আর বিমানবন্দরের ঝক্কি-ঝামেলায় রাতের খাবারের সময় বের করাটা হবে কঠিন। সেটা করাটা যে কী ভালো হয়েছিল, তার প্রমাণ পেয়েছি পরের ১৮টা ঘণ্টায়!
ইন্ডিয়া গেট, হুমায়ুন টম্ব ঘুরে প্রেসক্লাবে ফিরে কফি খেয়ে আর ব্যাগ-বোঁচকা নিয়ে বিমানবন্দরের পথে। ট্যাক্সি-সংক্রান্ত খানিকটা জটিলতা, অভ্যন্তরীণ ফ্লাইটে চেক-ইন লাগেজের কম ওজনসীমা-সংক্রান্ত ঝামেলা এবং প্রায় হয়রানিমূলক নিরাপত্তা তল্লাশির পর যখন ফ্লাইটের জন্য অপেক্ষমাণ যাত্রীদের জায়গায় পৌঁছলাম, ততক্ষণে ফ্লাইটের আর অল্প সময় বাকি। বাজেট এয়ারলাইন, তাই খাবার খেতে হবে কিনে। ভেজ স্যান্ডউইচ কেনার আগ্রহ জš§াল না। আহমেদাবাদ নেমে বিমানবন্দরের দোকান থেকে চিপস, বিস্কুট আর পানি দিয়েই রাতের খাবার চালিয়ে রাত ১২টায় চড়ে বসলাম রাজকোটের বাসে। ভোর সাড়ে পাঁচটায় হোটেলে ঢুকে সটান বিছানায়। ঘুম ভাঙল ক্ষুধার জ্বালায়, ১০টার দিকে। হোটেলের রিসেপশনে কড়া ভাষায় নোটিশ টাঙানো, ‘আমিষ খাবার হোটেলে নিয়ে আসা সম্পূর্ণ নিষেধ’। মেনুকার্ডেও তাই ব্রেড-অমলেট-বাটারের মতো চিরায়ত প্রাতরাশও অনুপস্থিত। বরং ঢোকলা, ফাফড়াসহ বিদঘুটে সব নাম। বিকল্পের সন্ধানে বাইরে গিয়ে একটা ছোট্ট দোকানে খাবারের ছবি দেখে মনে হলো লুচি ও ছোলার ডালজাতীয় কিছু একটা। জিজ্ঞেস করতেই নাম জানা গেল ‘ডাল-পাকোয়ান’। কিন্তু একি! পরিবেশন করা খাবার আর ছবির ভেতর যে আকাশ-পাতাল তফাত। এক বাটি মিষ্টি ডালের ভেতর চানাচুর, বাদাম, শুকনা ভাজা সেমাই বা শন পাপড়ির সঙ্গে খাস্তা ভাজা নিমকি ভেঙে গুঁড়িয়ে ছড়িয়ে দিলে যা হয়, এ তো তাই! অগত্যা পাশের বেকারি থেকে দুটো বানরুটি (সেটাও এগলেস, প্রচন্ড খড়খড়ে) কিনে চায়ের দোকানে গিয়ে এক গেলাস চায়ে ডুবিয়ে খেয়ে উপবাস ভঙ্গ করা। নিরামিষভোজীদের এলাকার চায়ের স্বাদটা হয় দারুণ, এই ব্যাপারটা পরে মধ্যপ্রদেশের ইন্দোরেও খেয়াল করেছি। খাঁটি দুধে ফোটানো হয় চা-পাতা, তাতে মেশে এলাচি, দারুচিনিসহ নানান মসলা আর আদার রস। মোটা কাপড়ে ছেঁকে পরিবেশন করা হয় সেই চা। অদ্ভুত স্বাদের মিষ্টি, গরম, ঘন সেই চায়ে ডুবিয়ে খড়খড়ে বানরুটিটাও খেতে মন্দ লাগছিল না।
ভারতের অধিকাংশ প্রদেশে অ্যালকোহল বিক্রি নিষিদ্ধ না হলেও গুজরাট এ বিষয়ে অনেক বেশি রক্ষণশীল। গুজরাটের বেশির ভাগ বাসিন্দাই নিরামিষভোজী। সকালের অভিজ্ঞতায় স্থানীয় খাবার চেখে দেখার উৎসাহও মিইয়ে গেছে। ভরসা তাই মুসলিম রেস্তোরাঁ। ‘সর্বজ্ঞানী’ গুগলের শরণাপন্ন হবার পর জানা গেল, হোটেল থেকে মাত্র দুই কিলোমিটার দূরে ইকবাল নামের একটি মুসলিম রেস্তোরাঁ, যেখানে ‘নন-ভেজ’ পাওয়া যায়। রাতের খাবারে গন্তব্য তাই ‘ইকবাল’। অটোচালক একবাক্যে চিনে নামিয়ে দিল মিনিট চারেকেই। চেয়ারে বসতেই অ্যালুমিনিয়ামের ছোট গ্লাসে ঠান্ডা পানি আর মেনু ধরিয়ে দিয়ে গেল ওয়েটার। চিকেন মাসালা, মাটন বিরিয়ানি, মাটন ভুনা, তন্দুরি চিকেন…সবই মজুত। সঙ্গে রুটি, পরোটা, ভাত। লম্বা সময় পর চেনা খাবারে উদরপূর্তির পর সামনেই আইসক্রিমের দোকানে রোজ মালাই আর পেস্তা কুলফির স্বাদ নেওয়ার পর মনে হলো জীবনটা আসলেই সুন্দর!
রাজকোট থেকে পরের গন্তব্য নাগপুর। আগের অভিজ্ঞতায় এবারে হোটেল ঠিক করা হলো মুসলিম রেস্টুরেন্টের পাশেই! সকালে ‘কমপ্লিমেন্টারি ব্রেকফাস্ট’ খেতে গিয়ে অভূতপূর্ব এক অভিজ্ঞতা। ট্রের ঢাকনা তুলে ঝাল চিড়েভাজা জাতীয় ‘পোহে’, আর ‘ইডলি সাম্বার’-এর মতো অচেনা খাবারকে সকালবেলাই দেহঘড়ির সঙ্গে পরিচিত করে তোলার বদলে হাত বাড়ালাম স্যান্ডউইচের দিকে। প্রথম কামড়েই হতভম্ব! ভেতরে স্রেফ শসা আর টমেটো! এ রকমটা যে স্যান্ডউইচ হতে পারে, সেই ধারণা আগে ছিল না। ওয়েটারকে জিজ্ঞাসা করতেই জানাল, এটা নাকি জৈন স্যান্ডউইচ। মহারাষ্ট্র প্রদেশে ভারতীয় জৈন ধর্মাবলম্বীদের একটা বড় অংশ বাস করে। অহিংসায় বিশ্বাসী জৈনরা মাছ, মাংস, ডিম কিছুই খায় না; এমনকি মাটির নিচে জম্মানো আলু, গাজরও না। সন্ধ্যায় বাংলাদেশ দলের ভারতীয় ভিডিও অ্যানালিস্ট শ্রীনিবাসনের কাছ থেকে হদিস পাওয়া ‘বাবু’ কাবাবের ঠিকানায় পৌঁছানো গেল নানান ঘটনার পর। ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.)-এর রাতে, মাথায় টুপি পরা এক অটোচালকের সৌজন্যে পৌঁছে যাই মোমিনপুরা এলাকায়। ঠিক যেন এসে পড়লাম পুরান ঢাকার হোসেনি দালানে! মাইকে বয়ান হচ্ছে, রাস্তায় চেয়ার টেবিল পেতে শিরনি খাওয়ানো হচ্ছে, সরু রাস্তায় যে যেভাবে পারে ধাক্কা দিয়ে চলছে আর এর ভেতরেই প্রচন্ড আওয়াজে হর্ন বাজিয়ে ছুটছে বাইক কিংবা অটো। কে জানত, এই গোলকধাঁধাতেই লুকিয়ে আছে স্বর্গের স্বাদ!
আফগানি, রেশমি, মালাই আর হারিয়ালি; শুধু কাবাবই খেয়েছি সেই রাত্তিরে। কোনো রুটি পরোটার সংগত নয়, ভাত বা বিরিয়ানির ভারিক্কিও নয়। স্রেফ কাবাব, জ্বলন্ত তন্দুর থেকে সিজলিং প্লেটে চেপে টেবিলে আসার পর কাবাবগুলোর দিকে তাকিয়ে ছিলাম বিস্ময়ে! মাংসখন্ডগুলোর অমন মসৃণ, তুলতুলে গা কী করে হয় জ্বলন্ত কয়লার আঁচে সেঁকা হওয়ার পরও। কী তার স্বাদের খোলতাই, রূপের রোশনাই। সাদা টক দইয়ের প্রলেপ মাখা মালাই কাবাব, ধনেপাতা-পুদিনাপাতা-কাঁচা মরিচ বাটার ম্যারিনেশনে ডুব সাঁতার কাটার পর তন্দুরের ধোঁয়াটে গন্ধ মেখে ঝলসে যাওয়া হারিয়ালি নাকি অনাবিষ্কৃত স্বাদের আফগানি; একেক রকমের স¦াদ ছড়িয়ে পড়ছে মুখের ভেতর। সঙ্গে পেঁয়াজকুচি, বাঁধাকপি আর কাশ্মীরি মরিচের স্যালাড আর সবুজ চাটনি।
সফরের প্রথম অংশটা ছিল টি-টোয়েন্টি, খেলার মতো ভ্রমণও। ম্যাচের পরদিনই দৌড়াও অন্য শহরে, থিতু হওয়ার সময় নেই। পরের অংশ টেস্ট ম্যাচ, তাই হাত-পা খেলিয়ে বেশ কয়েকটা দিন থেকে চেখে নেওয়ার সুযোগ মিলল ইন্দোরে। মধ্যপ্রদেশের সবচেয়ে বড় শহরে সব মিলিয়ে থাকা হয়েছে দিন আটেক। চেখে দেখা হয়েছে নাফিস রেস্তোরাঁর কাবাব ও বিরিয়ানি, যেটা নাকি সালমান খানের পছন্দ। সিরামিকের মটকায় পরিবেশন করা মাটন বিরিয়ানিতে বাসমতী চাল আর নরম মাংসের কেরামতি। তাংরি কাবাব আর হারিয়ালি কাবাবে ম্যারিনেশনে দই, সরষেবাটা আর পুদিনা-ধনেপাতার সুস্পষ্ট স্বাদ। মাংসে পোড়াভাব থাকলেও পুড়ে তিতকুটে হয়ে যায়নি, ভেতরটা নরম, রসালো আর মখমলের মতোই মসৃণ। চিকেন আঙগারায় ঝালটা কড়া, মাটন রোগানজোশটাই বরং রুমালি রুটির সঙ্গে সহনীয়।
আচার আর স্যালাডের যুগলবন্দিতে স্বাদ পেখম মেলে। ছাপান্ন দুকান আসলে একটা রাস্তার দুই ধারে রাতের বেলা পথখাবারের জমজমাট বাজার। পনির টিক্কা, ভেজিটেবল চিজ মোমো আর চাউমিনে উদরপূর্তির ফাঁকে ফাঁকে গলা ভেজানো হয় টাটকা আনারের শরবতে। একটা দোকানে শুধুই ডিমের পদ! আন্ডা ঘোটালা, আন্ডাপাও, আন্ডা পরাঠা…কত কী! সেদ্ধ ডিম গোটা চারেক ছিলে মাঝবরাবর কেটে ফুলের মতো ছড়িয়ে উপরে বিটনুন, ভাজা মসলার মিশ্রণ ছিটিয়েও খাচ্ছে অনেকে। ঝুরিভাজা, যা স্থানীয়ভাবে পরিচিত বিকানির নামে, বিক্রি হচ্ছে দেদার। আছে শাহি শিকাঞ্জি, যা আদতে ঘন লাচ্ছির মতো একধরনের পানীয়, আছে শাহি ফালুদাসহ কত কী! একাধিকবারই যাওয়া হয়েছে রাতের এই আয়োজনে। যেখানে পরিবার-পরিজন, বন্ধুবান্ধব নিয়ে নির্বিঘেœ চলছে খাওয়াদাওয়া। যাওয়া-আসার সুবিধার জন্য রাস্তার একটা মাথায় অটোরিকশাস্ট্যান্ড, সেখানেই পুলিশিচৌকি। তাই নিরাপত্তা নিয়ে নেই দুর্ভাবনা।
সবশেষ গন্তব্য কলকাতা। গোলাপি বলের টেস্ট নিয়ে মাতোয়ারা ইডেনে গোপালদার ক্যানটিনের ফিশ ফ্রাই আর স্যান্ডউইচ দিয়ে ‘লেট ব্রেকফাস্ট’ সেরে ঢুকে যাই শতাব্দীপ্রাচীন এই স্থাপনার অন্দরমহলের গোলকধাঁধায়। দুপুরে ইডেনের উল্টো দিকেই মোহনবাগান ক্লাবের ক্যানটিনে চিকেন স্টু, ডিমের হাফফ্রাইয়ের সঙ্গে সেঁকা পাউরুটি। রাত্তিরের ডিনারে তাই বিরিয়ানি, সিরাজ গোল্ডেন রেস্তোরাঁয়। কলকাত্তাইয়া ঘরানার বিরিয়ানি, যাতে আলু আর ডিমসেদ্ধও থাকে মাটনের দুটো টুকরোর সঙ্গে। জাফরান মাখা হলুদ বাসমতী লুকোচুরি খেলে সফেদ দানার সঙ্গে। চেখে দেখা হয়েছে আমিনিয়ার রেজালা ও চাপ, আফরিনের বিরিয়ানি। সকালের নাশতায় কস্তুরীর লুচি, ছোলার ডাল ক্ল্যাসিক। কলকাতায় বেড়াতে গিয়েছেন আর কস্তুরীতে খাননি, এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া কঠিন। তবে ভোজ কোম্পানির সকালের নাশতাটাও কম সুস্বাদু নয়। সকালবেলায় রবীন্দ্রসংগীত শুনতে শুনতে ফুলকো লুচি তিন আঙুলে ছিঁড়ে পাঁচফোড়ন দেওয়া সবজি দিয়ে খেতে খেতে শুরু করতে পারেন দিনটা। নিউমার্কেট-সংলগ্ন মারকুইস স্ট্রিট, রফি আহমেদ কিদওয়াই স্ট্রিট আর সদর স্ট্রিট— এই রাস্তায় যত না স্থানীয়দের দেখা পাওয়া যাবে, তার চেয়ে বেশি দেখা যাবে বাংলাদেশ থেকে যাওয়া পর্যটকদের। তাই তো এদিককার হোটেল রেস্তোরাঁগুলোতে বাঙাল ভাষা দিব্যি চালিয়ে দেওয়া যাবে, ‘ঘটি’ভাষা বলতেই হবে না! খাবারদাবার তো সব বাংলাদেশের মতোই। সর্ষে ইলিশ, বোয়ালের টমেটো আর শিম দিয়ে ঝোল, আলু দিয়ে কাতলা, মুড়োঘন্ট— সবই তো আছে কস্তুরী, ভোজ কোম্পানি আর রাঁধুনির মেনুকার্ডে। স্বাদবদলের জন্য ভোজ কোম্পানির চায়নিজ মেনুটাও চেখে দেখতে পারেন, স্বাদে বেশ। তবে মোটেও হাতছাড়া (বলা উচিত জিভছাড়া!) করা ঠিক হবে না এখানকার ভেটকি পাতুড়ি আর কচুপাতা দিয়ে চিংড়ি। কলাপাতায় মোড়া ভাপানো ভেটকি আর সর্ষেবাটা, কচুপাতা আর কুচো চিংড়ির পদটা নিলে নির্ঘাত এক বাটি ভাত বাড়তি লাগবে!
পাঁচটা প্রদেশ, পাঁচ রকম স্বাদ। দিল্লি রাজধানীর মতোই, বেছে নেওয়ার আছে অনেক কিছু। রাজকোট অনেকটাই রক্ষণশীল, খাবারেও বৈচিত্র্য কম। নাগপুরের থাকা হয়েছে খুবই কম সময়, মাত্র তিনটে দিন। তবু বাবু কাবাব আর মমিনপুরার নাম না জানা মিষ্টির দোকান স্মৃতিতে থাকবে আজীবন। ইন্দোরে নিরামিষ, আমিষ— সবই সুস্বাদু। কলকাতায় চেনা খাবারই পাবেন একটু অন্য রকম স্বাদে। হাতের পাঁচটা আঙুল যেমন সমান নয়, তেমনি সফরের পাঁচটা শহরও হয়তো একটা অন্যটার মতো নয়। তবে সব কটি মিলিয়ে দারুণ এক রসনাযাত্রার অভিজ্ঞতাই হলো। সেই সঙ্গে সাক্ষী হয়ে থাকা গেল ইতিহাসেরও।
লেখক: কালের কণ্ঠের সিনিয়র স্পোর্টস রিপোর্টার ও রসনালিখিয়ে