রসনাবিলাস I মিষ্টি সুখের উল্লাসে
বার্গার আর ওয়াফেলস দিয়ে লালমাটিয়ায় ছোট্ট করে শুরু হয়েছিল যাত্রা। এখন ধানমন্ডির শংকর আর গুলশান অ্যাভিনিউয়ে বড় দুটো হ্যাংআউট রেস্টুরেন্টে পরিণত হয়েছে। সুইটসিনের আদ্যোপান্ত জানিয়েছেন আল মারুফ রাসেল
মিষ্টি খেলে কী হয়? শরীরে থাকা ডোপামিন হয় বাঁধনহারা, যা আমাদের নিউরনে খুশির বার্তা পৌঁছায়, আনন্দ ছড়ায়। আমাদের শহুরে যান্ত্রিক জীবনে, যেখানে স্বাস্থ্যসচেতন হয়ে চলতে হয় প্রতিটি মুহূর্ত, সেখানে এই মিষ্টি খাওয়ার ব্যাপারটা রীতিমতো ছোটখাটো অপরাধের পর্যায়েই পড়ে যায়। তবে ব্যস্ত এই শহরে এটুকু সুখও যদি না থাকে, তাহলে আর রইল কী! সে কারণেই হাজির সুইটসিন কফিস। পরিবেশ, খাবার— সব মিলিয়ে কোয়ালিটি সময় কাটানোর মোক্ষম জায়গা।
গুলশান অ্যাভিনিউর ব্যস্ততা ছেড়ে একটু ১১৩ নম্বর রোডের ওয়াই এন সেন্টারে ঢুঁ মারলেই দ্য সুইটসিন কফিস। বাইরে থেকে দেখে বোঝার উপায় নেই, ভেতরে ১৫০০ স্কয়ার ফুট জায়গা নিয়ে বসে আছে এই ব্রেকফাস্ট অ্যান্ড ব্রাঞ্চ রেস্টুরেন্ট। গত বছরের আগস্ট মাসের থেকে এই বনেদিপাড়ায় তাদের আগমন।
দরজা দিয়ে ঢুকতেই সরু প্যাসেজ, দেয়ালে শেলফে রাখা বই। খানিকটা আঁকাআঁকি। সামনে চোখ মেলতেই বসার জায়গা, ছোট্ট একটা স্মোকিং জোন চোখে পড়ে। হাতের ডানে কফি আর বেকারি কাউন্টার। আর একদম বামে আরাম করে বসার জন্য সোফা। মাঝে বেশ কিছু কাঠের টেবিল-চেয়ার। রেস্টুরেন্ট জুড়ে প্রাকৃতিক আলোর রোশনাই। ইন্টেরিয়রে কোজিনেসের ছাপ, রঙের ব্যবহারে মুনশিয়ানা। মূলত হলুদ, ক্রিম আর মেহগনি, তিনটে রং দিয়ে ইন্টেরিয়রের কাজ সারা হয়েছে। কেবল একটি দেয়ালে সাদা আর আকাশি রঙের আভা। শেলফে কৃত্রিম সবুজের ছোঁয়া। এই বৈপরীত্যটাও বেশ। কালো ফলস সিলিং থেকে ছোট ছোট স্পট লাইট। শেলফে উনো কার্ড, মনোপলির বাক্স, দাবা বোর্ড চোখে পড়ল।
কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে রেস্টুরেন্টের তরুণ কর্ণধার কাজী রাফসান শান্তর সঙ্গে কথা হলো। দেয়ালে থাকা একটি পেইন্টিংয়ের দিকে ইঙ্গিত করে জানালেন, লালমাটিয়ার সেই ছোট্ট ওয়াফেল আর বার্গারের দোকানটি যে একদিন এত বড় হবে ভাবেননি এভাবে— ‘ছোট পরিসরে হলেও মুখে মুখে সুইটসিনের নাম ছড়িয়ে পড়ায় ঢাকার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে খেতে আসত সবাই। তাই স্থান পরিবর্তন করতে হলো, মেনুকার্ডে যোগ করতে হলো নতুন নতুন সব খাবার। সেটা ২০১৬ সালে। এখন এই আগস্ট থেকে ধানমন্ডির পাশাপাশি এখানেও।’
কথা বলতে বলতেই এলো ব্রাঞ্চ। প্যানকেক সারপ্রাইজ। ছোট একটি বাটিতে নাটেলা দিয়ে তৈরি করা সসের সঙ্গে দুটো বড় চিতই পিঠা আকৃতির প্যানকেক। দুটি নয় কেবল— প্লেটে তাদের সঙ্গ দিতে রয়েছে একখানা চিজ ওমলেট, দু টুকরো চিকেন সসেজ আর খানিক গার্লিক মাশরুম। কাঁটাচামচ দিয়ে একটু কেটে, ওমলেট মুখে পুরতেই চিজি ফ্লেভার পাওয়া গেল। আমাদের স্বাদেন্দ্রিয়ের জন্য খানিকটা ম্যাড়ম্যাড়ে লাগতে পারে অনেকের! তবে বিশ্বাস করুন, তাবৎ দুনিয়ায় চিজ ওমলেট একটু ‘ব্লান্ট’ই হয়ে থাকে। লবণ আর গুঁড়া গোলমরিচের অপশন তো থাকেই টেবিলে। সসেজ চলনসই, যেমন হয়ে থাকে। এটায় আসলে শেফের কিছু করার সুযোগ নেই। কারণ, এ দেশে হাতে বানানো সসেজের চল নেই, প্যাকেটই ভরসা। এখানে প্যানকেক আর তাকে সঙ্গ দেওয়া নাটেলা সসেরই যত কৃতিত্ব— এই মিলটাকে জাতে তোলার। অসাধারণ স্বাদ পাওয়া গেল ছোট টুকরো করে কাঁটাচামচে গেঁথে, নাটি-চকলেটি সসে ডুবিয়ে তারিয়ে তারিয়ে খেতে। ভালো প্যানকেক খেলেই কেবল বোঝা সম্ভব কেন খ্রিস্টের জন্মের ৫০০ বছর আগে কবি ক্রাটিনাস আর ম্যাগনেস এই প্যানকেকের বন্দনা করে গেছেন।
এরপরই চেখে দেখার জন্য এল গ্রিলড চিকেন উইথ টেরিয়াকি সস। মেক্সিকান রাইস আর গ্রিলড ভেজিটেবলের সঙ্গে। চামচে করে খানিকটা টেরিয়াকি সস মুখে নিতেই এক অদ্ভুত স্বাদ। স্বাদ ও ঘ্রাণ— উভয় ইন্দ্রিয়কেই আচ্ছন্ন করে রাখল। খানিকটা আদা-রসুনের ঝাঁজ, সয়া সসের নোনতা স্বাদ আর চিনি-মধুর মিষ্টি মিলে অসাধারণ এই সস তৈরি করে। মেক্সিকান রাইসটাও বেশ ঝরঝরে। গ্রিল করা মুরগি আর সবজিগুলোও বেশ ভালোমতো রান্না হওয়া।
এরপর চেখে দেখার পালা সুইটসিনের সিগনেচার— রেড ভেলভেট ওয়াফেল। এখানকার মেনুতে এটাকে বেস্ট সেলার হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। ওয়াফেলে ক্রিম চিজ তো রয়েছেই, ওপরেও ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে ক্রিম চিজ সস। ডেন্স আর হেভি এই ওয়াফেল সিম্পল ভ্যানিলা আইসক্রিমের সঙ্গেই খেতে দারুণ লাগে। এটি পারফেক্ট এন্ডিং হতে পারে, মানে মধুরেণ সমাপয়েৎ! আবার এর রিচনেসের জন্য এটা নিজেই একটা ডিশ হয়ে যেতে পারে।
এখানে রয়েছে ৯ পদের মেইন মিল। এগুলোর ভেতরে বেস্ট সেলার আর শেফ’স রেকমেন্ড হলো চিকেন আলা ক্রিম প্ল্যাটার, গ্রিলড চিকেন উইথ টেরিয়াকি সস আর সারলোয়িন স্টেক। অবশ্য মাংসে অরুচি থাকলে লেমন বাটার ফিশ বা ফিশ অ্যান্ড চিপসও রয়েছে মেনুতে। স্যালাড বোল রয়েছে চার পদের। র্যাপস রয়েছে পঞ্চপদের। এগুলোর ভেতরে বেস্ট সেলার টেরিয়াকি চিকেন আর শেফের সাজেশন রয়েছে চিকেন আলফ্রেডো র্যাপে। স্যান্ডউইচ রয়েছে পাঁচ পদের— বেস্ট সেলার পিৎজা স্যান্ডউইচ আর শেফের মতে স্মোক চিকেনে। পাস্তায় বেস্ট সেলার ফেটুচিনি আলফ্রেডো। ব্রাঞ্চ মেনুতে প্যানকেক সারপ্রাইজ কেসেডিয়া মিক্স প্ল্যাটার শেফের পছন্দ, আর বেস্ট সেলার প্যানকেক সারপ্রাইজ। তবে বেস্ট সেলার আর শেফের পছন্দ— দুটোই মিলেছে ওয়াফেলড আপ ব্রেকফাস্টে।
ওয়াফেলে ভোজনরসিকদের মাঝে সেরা কুকি অ্যান্ড ক্রিম আর রেড ভেলভেট। শেফরা কেন জানি বরাবরই জনপ্রিয় ঘরানার বাইরে যেতেই পছন্দ করেন— আর দিন শেষে সেটা খাওয়ার পর মনে হয়, শেফই বোধ হয় স্বাদেন্দ্রিয় সম্পর্কে অন্যদের চেয়ে ভালো বোঝেন। সে হিসেবে তার সাজেশন নাটি ওয়াফেল! প্যানকেক ঘরানায় শেফ ও ভোজনরসিকেরা একমত হয়েছেন চকোচিপ প্যানকেক উইথ নাটেলা সসে। শেফের অবশ্য আরেকটি পছন্দ— পিনাট বাটার অ্যান্ড ম্যাপল সিরাপ প্যানকেক। ভোজনরসিকেরাও তাই আরেকটি পছন্দ করে নিয়েছেন— ব্লু বেরি প্যানকেক।
এত এত খাবারের মাঝে বার্গার ব্রাত্য হলে কি আর হয়! নাগা বার্গার আর চিকেন অ্যান্ড বেকন বার্গার ভোজনরসিকদের আনন্দ দিয়েছে সুইটসিন— জন্মলগ্ন থেকেই। শেফের যত জারিজুরি মেইনস্ট্রিম ডিলাইট আর কিংকং বার্গারে।
খাবারের সঙ্গই বলি আর কেবল পানীয়ই বলি, সুইটসিনের চিলার্সের তালিকাও বিশাল। আইস ব্লেন্ডেড ক্রিমে হ্যাজেল নাট, টফি নাট, ব্লুবেরি, বাটার স্কচ, আইরিশ ক্রিম, চকলেট, স্ট্রবেরি, কুকিজ, ক্যারামেল ক্রিম রয়েছে। কফি ব্যাপারটা ভালোমতো ঢুকেছে লালমাটিয়া ছাড়ার পরেই। ধানমন্ডি আর গুলশানের বড় পরিসরে ভালো কফির ব্যাপারটা ছাড়া ঠিক জমে না। তাই কফির আগমন, সুইটসিনে। ঠান্ডা-গরম মিলে প্রায় ২৫ পদের কফি!
আরও একটা কথা বললেন শান্ত যে এই রেস্টুরেন্টের কনসেপ্টই হলো ভোজনরসিকেরা যেন ভালো খাবারের সঙ্গে কোয়ালিটি সময়ও এখানে কাটাতে পারেন, সেটা নিশ্চিত করা। তাই এখানে বিভিন্ন ধরনের বোর্ড গেম, বই রাখা হয়েছে। খাবার নিয়ে যতক্ষণ ইচ্ছে বসে থাকুক, আড্ডা-গল্পে মেতে উঠুক— এই হলো সুইটসিনের মন্ত্র। তাই মাঝেমধ্যে কালচারাল ইভেন্টের ভেন্যুও হয়ে যায় এই রেস্টুরেন্ট।
ঠিকানা: ওয়াই এন সেন্টার, লেভেল-৫, ৬/এ, রোড ১১৩, গুলশান অ্যাভিনিউ, ঢাকা। ফোন: ০১৮৪৪৫০৯৯৬৮
ছবি: লেখক