স্বাদশেকড় I পাওভাজি
মুম্বাইয়ের প্রসিদ্ধ খাবার। সস্তা ও সুস্বাদু। কিন্তু খাদ্যগুণে পরিপূর্ণ। এর উদ্ভাবন ঔপনিবেশিক কালে। আদতে এর ইতিহাসই-বা কী?
‘আখতারীর গজল, শশীবাবুর সিং আর আফ্রিকার রাজা’, জয় বাবা ফেলুনাথ ছবিতে গোয়েন্দা প্রদোষ চন্দ্র মিত্র ওরফে ফেলুদার জবানিতে চুরি যাওয়া গণেশমূর্তি উদ্ধারের গোলকধাঁধাটা এভাবেই বলিয়েছিলেন সত্যজিৎ রায়। শুনে হতভম্ব হয়ে যাওয়া লালমোহন গাঙ্গুলী ওরফে জটায়ুর উত্তর ছিল ‘চন্দ্রবিন্দুর চ, বেড়ালের তালব্য শ আর বেড়ালের মা, এটা বললেও সহজ হত’। কে জানত, গণেশপূজা ভারতের যে শহরে সবচেয়ে জমজমাট, সেই মুম্বাই শহরের বিখ্যাত খাবার ‘পাওভাজি’র উৎস খুঁজতে গিয়ে ফেলুদার মতো একই রকম ধাঁধায় পড়তে হবে! পর্তুগালের রাজকন্যার সঙ্গে ব্রিটিশ রাজপুত্রের বিয়ে, আমেরিকার গৃহযুদ্ধ, গুজরাটি ব্যবসাদারদের উদ্যোগ— সব মিলিয়ে পাওভাজি!
এই খাবারের পেছনে আছে ইতিহাস, ভূগোল, অর্থনীতি— সবকিছুই। ভারতবর্ষে ইংরেজরা সবচেয়ে বেশি দিন রাজত্ব করলেও পর্তুগিজ প্রভাবও কম নেই। আলু, টমেটো, কাঁচা মরিচ, আনারসসহ অনেক রকম সবজিই ভারতবর্ষে এসেছে পর্তুগিজদের সঙ্গে। তারা আবার সেসব এনেছে মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকা থেকে। সে এক ভিন্ন গল্প। ফিরে আসা যাক পাওভাজির কথায়। মুম্বাই বা বোম্বে— যে নামেই আরব সাগর তীরের রুপালি নগরটিকে ডাকা হোক না কেন; শাহরুখ, অমিতাভদের বিলাসবহুল বাংলোগুলো এখানে গড়ে ওঠার অনেক অনেক আগে যখন এটা ছিল মৎস্যজীবীদের আস্তানা, তখন সাতটি দ্বীপ নিয়ে গড়ে ওঠা মুম্বাই ছিল পর্তুগিজদের দখলে। সেটা পনেরো শতকের গোড়ার দিকেই, ফুরিয়ে আসা মোগল সাম্রাজ্যও তখন পর্তুগিজদের ঘাঁটাচ্ছে না। ১৬৬১ সালে ইংল্যান্ডের রাজা দ্বিতীয় চার্লস বিয়ে করলেন পর্তুগালের রাজকন্যা ক্যাথরিন ব্রাগাঞ্জাকে। বিয়েতে উপঢৌকন হিসেবে চার্লস পেলেন আরব সাগর তীরের এই সাতটি দ্বীপ। সাত বছর পর এই দ্বীপগুলো ব্রিটিশরাজ বছরে মাত্র ১০ পাউন্ডের বিনিময়ে লিজ দিল ইস্ট ইন্ডিয়া কো¤পানির কাছে। এভাবেই মুম্বাইয়ের পরতে পরতে লাগল ইউরোপের দুই ঔপনিবেশিক পরাশক্তির প্রভাব, খাদ্যাভ্যাসও যার বাইরে নয়।
পাওভাজির উৎস খুঁজতে অবশ্য সময়ের স্রোতে আরেকটু এগিয়ে আসতে হবে। সময়টা ১৮৬১। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চলছে গৃহযুদ্ধ। দক্ষিণপন্থী রাজ্যগুলো কনফেডারেট আর উত্তরপন্থী ইউনিয়ন; দুইয়ের ভেতর ৪ বছরের রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধের সময়টায় মুম্বাইয়ের গুজরাটি তুলা ব্যবসায়ীরা কী করে রাতারাতি (আক্ষরিক অর্থেই!) ধনী হয়ে গেলেন, তার পেছনে বড় অবদান এই পাওভাজির। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণভাগের নিও অরলিন্স, মিসিসিপি অববাহিকা হচ্ছে তুলা উৎপাদনের সবচেয়ে বড় ক্ষেত্র। এই খামারগুলোতেই ক্রীতদাসদের দিয়ে করানো হতো সব কাজ। মার্কিন গৃহযুদ্ধের প্রধান একটি কারণ ছিল এই দাসপ্রথা। গৃহযুদ্ধের কারণে তুলার উৎপাদন ও সরবরাহ বন্ধ। কারণ, জর্জ ওয়াশিংটন তার ইউনিয়ন নৌবাহিনী দিয়ে পাহারা বসিয়েছেন মিসিসিপির অববাহিকায়।
ম্যানচেস্টারের কাপড় কলগুলোর তাঁত তাই বন্ধ হয়ে পড়ে আছে। বেনিয়া ব্রিটিশদের চতুর বুদ্ধির তো আর অভাব নেই, তারা তুলা আমদানি করতে লাগল উপনিবেশ ভারতবর্ষ থেকে। গুজরাটি ব্যবসায়ীদের বলা যায় পৃথিবীর প্রথম নাইট শিফট কলসেন্টার ম্যানেজার। কারণ, ইউরোপের সঙ্গে ভারতবর্ষের সময়ের পার্থক্যের কারণে তারাই রাতের বেলায় টেলিগ্রামে ইংল্যান্ড থেকে ক্রয়াদেশ, দরপত্র— এসব পেতেন বা পাঠাতেন! প্রচন্ড চাহিদার জন্য কারখানাগুলোতে কাজও হতো দীর্ঘ সময় ধরে। প্রায়ই শ্রমিকেরা বাড়ি ফিরত রাতে। কাজের মাঝে খাবারের জন্য সময়ও মিলত কম। তাদের খাওয়ানোর জন্যই পাওভাজির উদ্ভাবন।
পাওভাজির পাও মানে হচ্ছে পাউরুটি আর ভাজি হচ্ছে সবজি। আলু, টমেটো ও মটরশুঁটি সেদ্ধ করে, নানান মসলায় মাখিয়ে তাওয়াতে নাড়তে নাড়তে প্রায় ঘন থকথকে একটা ঝোলের পর্যায়ে নিয়ে এলে যেটা হয়, সেটাই হচ্ছে পাওভাজির ভাজি। পাও শব্দটা এসেছে ‘পোয়া’ থেকে, যার অর্থ চার ভাগের এক ভাগ। কোয়ার্টার পাউন্ড ব্রেডের পথচলতি নাম। রাতের বেলা শ্রমিকদের খাবারের জন্য সারা দিনের বিক্রির পর অবশিষ্ট সবজিই তাওয়ায় গরম করতে করতে গলে গিয়ে থকথকে ঝোলে পরিণত হতো। সেই তাওয়ার কোনাতেই সেঁকে নেওয়া হতো কোয়ার্টার পাউন্ড ব্রেড, মাঝখানটা কেটে ছড়িয়ে দিয়ে। বাটিতে সেই ঘন থকথকে ঝোলের ওপর ছড়ানো পেঁয়াজকুচি, লেবুর রস আর মাখন; সঙ্গে সদ্য সেঁকা পাউরুটি। এই হলো পাওভাজি। ভারতে নানান জায়গার মানুষের খাদ্যাভ্যাস নানান রকম হলেও মুম্বাইয়ের পাওভাজি মুখে তুলল সবাই। নিরামিষ, মজাদার ও মসলাদার, অল্প টাকায় পেটভর্তি। আর কী চাই!
মুম্বাইয়ের সেই একচেটিয়া তুলার বাজার এখন আর নেই। সুতার সব কলও পরিত্যক্ত। নগরটি এখন স্বপ্ন বিক্রির সবচেয়ে বড় বাজার। ভারতবর্ষের নানান জায়গা থেকে তো বটেই, এখন ভারতের বাইরে থেকেও তারকা হবার স্বপ্নচোখে মুম্বাই আসছেন তরুণ-তরুণীরা। তারকা হয়ে ওঠার আগে, কষ্টের সময়গুলোতে তাদের অনেকেরই দিন কেটেছে পাওভাজি দিয়ে উদর পূর্তি করে।
সামীউর রহমান
লেখক: কালের কণ্ঠের সিনিয়র স্পোর্টস রিপোর্টার ও রসনালিখিয়ে