বিশেষ ফিচার I মানব বিবর্তনে রান্নার অবদান
আদিম অবস্থা থেকে সভ্যতায় উত্তরণের পথটি মানুষ অর্জন করেছে খাদ্যের বিশেষত্ব থেকে। নইলে সে রয়ে যেত স¦গোত্রীয় বন্য প্রাণীর মতোই। কেমন করে মানুষ নিজের খাবারটি পৃথকভাবে তৈরি করতে শিখল? লিখেছেন শিবলী আহমেদ
ষাট লাখ বছর আগের কথা। একটি নরবানরের দুটি কন্যাসন্তান হয়েছিল। সেই দুই বোনের একজন হচ্ছে বর্তমান হোমো সেপিয়েন্স তথা মানুষের আদি মাতা। অপরজন শিম্পাঞ্জিদের। এদেরই আত্মীয় গরিলা ও ওরাং-ওটাং। অর্থাৎ মানুষ, শিম্পাঞ্জি, গরিলা, ওরাং-ওটাং একে অপরের কাছাকাছি। কিন্তু হোমো সেপিয়েন্স ছাড়া সবাই-ই রয়ে গেছে বন্য। ওদের নগর, পোশাক, প্রযুক্তি, মহাকাব্য কিংবা যানবাহন নেই। এত ফারাকের উৎপত্তি কোথায়? কী ছিল মানুষের উন্নতির চাবিকাঠি? কোন কৌশল রপ্ত করে হোমো সেপিয়েন্সরা অন্যান্য প্রাণীর ওপর ছড়ি ঘোরাচ্ছে? উত্তর খুঁজতে ‘ইতিহাস’ সৃষ্টিরও আগের অধ্যায়ে যেতে হবে। যখন মানুষ কোনো ইতিহাসের জনগোষ্ঠী নয়, বরং জীববিজ্ঞানের একটি অংশ ছিল মাত্র।
বনবাসী আদিম মানুষের বুদ্ধির বিকাশ ঘটতে শুরু করে ২৫ লাখ বছর আগে। তাদের আদি বাসস্থান ছিল আফ্রিকায়। ২০ লাখ বছর আগে মানুষ সেই অঞ্চল ছেড়ে মধ্যপ্রাচ্য ও এশিয়ার বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে। খাবারের অপ্রতুলতা কিংবা বৈরী জলবায়ু আফ্রিকা ছেড়ে অন্যত্র যেতে বাধ্য করেছিল। নতুন জায়গায় মানেই অচেনা পরিবেশ এবং ভিন্ন আবহাওয়া। টিকে থাকতে প্রয়োজন যথাযথ বিবর্তনের। সেটাই হলো। আবহাওয়া, পরিবেশ ও খাদ্যাভ্যাসের প্রভাবে বিভিন্ন অঞ্চলের বাসিন্দাদের আকার-আকৃতিতে পার্থক্য দেখা দিতে শুরু করল। ফলে বর্তমানে বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন এলাকায় বসবাসকারী আদিম মানুষদের ভিন্ন ভিন্ন নামে চিহ্নিত করেছেন। যেমন আদিমকালে পশ্চিম ইউরেশিয়ার নিয়ান্ডারথাল উপত্যকার মানুষদের নাম দিয়েছেন ‘হোমো নিয়ান্ডারথালেনসিস’। ইন্দোনেশিয়ার জাভা উপদ্বীপে বাস করা আদি মানবদের ‘হোমো সলোয়েনসিস’। ফ্লোরেস দ্বীপের মানুষদের ‘হোমো ফ্লোরেসিয়েনসিস’। সাইবেরিয়ার ডেনিসোভায় ‘হোমো ডেনিসোভা’ এবং পূর্ব আফ্রিকায় থেকে যাওয়া মানুষদের ডাকা হচ্ছে ‘হোমো ইরগেস্টার’। এদিকে এশিয়ার একেবারে পূর্বাংশে বিকশিত হয়েছিল ‘হোমো ইরেক্টাস’। বর্তমান সভ্যতায় পৌঁছানোর প্রথম সোপান তৈরি করে দিয়েছিল এ জাতির মানুষেরাই। তারাই রান্নার উদ্ভাবক। এরই বদৌলতে ইরেক্টাসরা মানুষের অন্যান্য প্রজাতির থেকে বেশি সময় ধরে পৃথিবীতে টিকে ছিল। প্রায় ২০ লাখ বছর। শুরুতে হোমো ইরেক্টাসদের মগজের আকার তাদের নিকটাত্মীয় শিম্পাঞ্জি ও গরিলার সমানই ছিল। কিন্তু হুট করেই এই মানুষেরা বুদ্ধি ও কৌশলগত দিক থেকে এগিয়ে যায়। যার বদৌলতে পরবর্তী ছয় লাখ বছরে তাদের মস্তিষ্কের আয়তন বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু কী এমন ঘটেছিল তাদের যাপনে? বিবর্তনের একই ধাপে থাকা শিম্পাঞ্জি কিংবা গরিলার মগজ বৃদ্ধি না পেয়ে কেন হোমো ইরেক্টাসদেরই বেড়েছিল! এই উত্তরণের পেছনে ছিল রান্না করা খাদ্যের অবদান।
মগজের আকৃতি বৃদ্ধি রান্না করে খাওয়ার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত। কাঁচা খাবার নরম করার ঝক্কি অনেক। রাঁধতে না জানা গরিলা প্রতিদিন ১০ ঘণ্টা করে খাবার চিবোয় শুধু নরম করার জন্য। শিম্পাঞ্জির লাগে পাঁচ ঘণ্টা। কাঁচা খাবার হজম করতে এই দুই প্রাণীকেই প্রচুর ক্যালরি খরচ করতে হয়। ফলে তারা সারা দিন যে পরিমাণ খায়, তা থেকে প্রাপ্ত শক্তির বেশির ভাগই চলে যায় হজমে। এ কারণে মগজ বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় ক্যালরি পায় না শিম্পাঞ্জি কিংবা গরিলা। অন্যদিকে, হোমো ইরেক্টাসরা রান্না করে খেতে শুরু করে। আগুনের আঁচে খাবার এমনিতেই নরম হয়ে যায়। তা বেশিক্ষণ চিবানোর প্রয়োজন হয় না। ফলে খাবার হজম করতে শরীর থেকে অতিরিক্ত ক্যালরি ব্যয় হতো না ইরেক্টাসদের। উদ্বৃত্ত ক্যালরি কাজে লাগত তাদের মগজের বিকাশে। আঁশজাতীয় খাবারও হজম করা সহজ হয়ে গিয়েছিল তাদের কাছে। রান্না করা খাদ্যের শতভাগই হজম সম্ভব। কিন্তু কাঁচা খেলে মাত্র ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ। রেঁধে খাওয়ার কারণে হোমো ইরেক্টাসদের মগজ বিকশিত হতে লাগল। বুদ্ধিমান হতে থাকল। বিপরীত দিকে কাঁচাহারী শিম্পাঞ্জি, গরিলা ও ওরাং-ওটাং যা ছিল তা-ই রয়ে গেল।
রান্না আবিষ্কারের ফলে মানুষের খাদ্যভান্ডারে নতুন খাবার যুক্ত হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হলো। প্রকৃতিতে এমন অনেক শস্য ছিল, যা কাঁচা খেয়ে হজম করা সম্ভব ছিল না। যেমন গম। অথচ আদিমকালে এখানে-সেখানে ফলে থাকত শস্যটি। রেঁধে খাওয়ার ফলে খাদ্যের ক্ষতিকর জীবাণু ও পরজীবীও মারা যায়। বিশেষ করে মাংসের। ফলে স্বাস্থ্যঝুঁকি থেকে রেহাই পেয়েছিল হোমো ইরেক্টাস। কমেছিল মৃত্যুহার। ছোট দাঁত, কম শক্তিশালী চোয়াল ও তুলনামূলকভাবে সরু খাদ্যনালি থাকা সত্ত্বেও অন্যান্য প্রাণীর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তারা টিকেছিল কেবল রান্নার কৌশল রপ্ত করে। কেননা, আগে যেখানে সারা দিন খাবার চিবোতে চিবোতেই সময় চলে যেত, রান্না রপ্ত হওয়ার পর খাওয়ার পেছনে মাত্র এক ঘণ্টা সময় দিলেই চলত। বাকি সময় ইরেক্টাসরা কাজে লাগাত বুদ্ধির বিকাশে।
এখানে বলে রাখা ভালো, রাঁধতে যে আগুন প্রয়োজন, আট লাখ বছর আগেই তা সংগ্রহ করতে শিখেছিল মানুষ। কিন্তু রান্নার জন্য ইরেক্টাসরা তা নিয়মিত ব্যবহার করতে শুরু করে তিন লাখ বছর আগে। এর মানে এই নয় যে তিন লাখ বছর আগেই আগুনে ঝলসে খাওয়ার চল হয়েছিল। তা উদ্ভাবিত হয়েছে ২০ লাখ বছর আগে। হোমো ইরেক্টাসরাও টিকে ছিল ২০ লাখ বছর। সুতরাং, রান্না করে খাওয়া ঠিক কবে শুরু হয়েছিল, তা সঠিকভাবে বলা না গেলেও ইরেক্টাসদের সময়েই যে তা উদ্ভাবিত হয়েছে, সেটা ধারণা করা যেতে পারে। প্রশ্ন হচ্ছে, আদিম শিকারি-সংগ্রাহক মানুষের মাথায় রান্নার আইডিয়া এসেছিল কীভাবে। সম্ভাব্য উত্তর হচ্ছে, দাবানলের আগুনে পুড়ে মারা যাওয়া প্রাণীর মাংসে নতুন স্বাদ পেয়েছিল মানুষ। তা বেশিক্ষণ চিবানো লাগত না বলে কাঁচার বদলে পোড়ানো বা ঝলসানো মাংসই ছিল তাদের পছন্দের খাবার। সেই ভোজনবিলাসই তাদের ধাবিত করেছিল রেঁধে খাওয়ার দিকে। কিন্তু প্রয়োজন ছিল আগুনের। দাবানলে পুড়তে থাকা গাছের ডাল নিজেদের ডেরায় সংরক্ষণ করত তারা। নিভে যাওয়ার আগে শুকনা জ্বালানি দিয়ে উসকে রাখত। তা দিয়েই মাংস ঝলসে নিত। কিন্তু প্রাকৃতিক আগুন সব সময় সহজলভ্য ছিল না। সমস্যার সমাধান হয়েছিল পাথর ঠুকে অস্ত্র তৈরির সময়। সেখানেই আগুনের ফুলকির হদিস পেয়েছিল মানুষ। প্যালিওলিথিক যুগে পাথরের তৈরি চুলার সন্ধান পেয়েছেন বর্তমান বিজ্ঞানীরা। কিছু পাথর গোল করে সাজিয়ে উনুন তৈরি করত তখনকার মানুষ।
রান্না আবিষ্কারের ফলে শিকার, সংগ্রহ ও খাওয়া ছাড়াও অন্যান্য কাজে মনোযোগী হওয়ার সুযোগ পেয়েছিল মানুষ। এতে সংস্কৃতি ও প্রযুক্তিতে এগিয়ে যাওয়ার পথ প্রশস্ত হয়েছিল। সেই সুবাদেই হালের হোমো সেপিয়েন্সরা চাঁদের বুকে হেঁটেছে, পরমাণুকে দ্বিখন্ডিত করেছে, হয়েছে ডিএনএ উন্মোচন; যা শিম্পাঞ্জি, গরিলা কিংবা ওরাং-ওটাংরা পারেনি। তাই হোমো সেপিয়েন্সদের উন্নতির সব কৃতিত্ব দেওয়া যেতে পারে হোমো ইরেক্টাসদের। তাদের আবিষ্কৃত রান্নাকে বলা যেতে পারে মুক্তির দুয়ার, যা আমাদেরকে বন থেকে সভ্যতার পথে হাতে ধরে টেনে এনেছে।
তথ্যসূত্র: ইউভাল নোয়া হারারির লেখা বই ‘সেপিয়েন্স’, রিচার্ড র্যাংহামের লেখা বই ‘ক্যাচিং ফায়ার’ এবং ইন্টারনেট।
ছবি: ইন্টারনেট