আলাপন I ভাষা শিক্ষার মাধ্যম নয়, ভাষাই শিক্ষা-সলিমুল্লাহ খান
বাংলাদেশের শীর্ষ চিন্তাবিদদের একজন তিনি। ভাবেন রাষ্ট্র, রাজনীতি, ইতিহাস, সংস্কৃতি, ভাষা, দর্শন ও সাহিত্যের নানা বিষয় নিয়ে। লেখেনও। তার সঙ্গে আলাপচারিতায় অংশ নিয়েছেন চঞ্চল আশরাফ ও শিবলী আহমেদ
ক্যানভাস: এক বক্তৃতায় আপনি বলছেন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভাষাশিক্ষাকেই প্রাধান্য দেওয়ার দরকার বেশি। এটা কোন ভাষা?
সলিমুল্লাহ খান: বার্ট্রান্ড রাসেলের মতে, বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা আসলে কী শেখাই? দুটি জিনিস শিখি- একটা হচ্ছে ভাষা, আরেকটা হলো গণিত। বিজ্ঞান পড়তে গণিতকে একটা আলাদা ভাষা হিসেবে ধরতে হয়। তাই উনি বলেছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে শেষ বিচারে আমরা ভাষাই শিখি। তার এ কথা আমার মনে ধরেছে বলে আমি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভাষাশিক্ষাকেই প্রাধান্য দেওয়ার কথা বলেছি। আমার বক্তব্য হচ্ছে, বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি ভাষা ছাড়া আর কিছুই শিখিনি। ভাষা হচ্ছে চাবির মতো। তা দিয়ে একটা ঘরের মধ্যে আপনি প্রবেশ করতে পারেন। দেখতে পারেন সেখানে কী অমূল্য ধন আছে। ভাষা শিক্ষার মাধ্যম নয়, ভাষাই শিক্ষা। তা শিখলে আপনি বিদ্যা অর্জনের যেকোনো জায়গায় যেতে পারেন।
ক্যানভাস: মান ভাষা নিয়ে সাম্প্রতিক কালে অনেক বিতর্ক শুরু হয়েছে। বলা হচ্ছে যে মান ভাষা একটি অথরিটি। ইতোমধ্যে আমাদের সংস্কৃতিতে উপভাষার এককগুলো ব্যবহার করে একটা ভাষা তৈরি হয়েছে। অনেকে বলছেন যে এটিই হতে পারে কেন্দ্রীয় বা মান ভাষা। এ বিষয়ে আপনার অবস্থান কী?
সলিমুল্লাহ খান: এর জবাব শুধু যুক্তির মধ্যে পাওয়া যাবে না। বাংলাদেশে অনেকেই ভুল করে বলে, ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ থেকেই একটা মান ভাষা তৈরি হয়েছে। কথাটি পুরোপুরি সঠিক নয়। এর আরও ৫০০ বছর আগেও বাংলা ভাষায় বইপত্র লেখা হতো। কবীন্দ্র পরমেশ্বরের মহাভারতের অনুবাদ, এটা পূর্ব বাংলায় হয়েছে। শাহ মুহম্মদ সগীর, আবদুল হাকিম, আলাওল- তাদের কথা আমরা জানি। তারা যে বাংলায় লিখেছেন, সেটিও মান বাংলার মধ্যে দেখা যায়। পদ্যে লিখেছেন, কিন্তু সেটাকে গদ্যে রূপান্তর করলে তা কী হতো? তো, ফোর্ট উইলিয়ামের কলেজের সময় যে তর্কটা হয়েছে, সেটা হলো ফোর্ট উইলিয়ামের পণ্ডিতেরা তাদের রাজনীতির সঙ্গে মিলিয়ে একটা কথা চালু করেছিলেন যে বাংলা ভাষা আদিতে সংস্কৃত থেকে এসেছিল। এটা তত্ত্ব হিসেবে সঠিক নয়, কিন্তু তার মধ্যে কিছুটা বৈধতা আছে। বাংলার সঙ্গে সংস্কৃতের আত্মীয়তা আছে। কিন্তু মাঝখানে ৪০০ বছর সুলতানি শাসন, মোগল শাসন, যেটাকে তারা এক শব্দে বলার জন্য মুসলিম শাসন বলে, সেই সময় বাংলার মধ্যে অনেক ফার্সি শব্দ প্রবেশ করেছে। রাজনৈতিক কারণে কিছুটা, কিছুটা প্রায়োগিক কারণেও। এগুলোকে তাড়িয়ে সংস্কৃত শব্দ পুনঃপ্রতিস্থাপন করার একটা ঐতিহাসিক উদ্যোগ ইংরেজরা নিয়েছিল। ১৮১৮ সন থেকে যখন সংবাদপত্র ছাপানো শুরু হলো, সংবাদপত্রে তো ইংরেজির মতো বাংলা লেখা যাবে না। পত্রিকায় বাংলা আর কতক্ষণ সংস্কৃত লেখা যায়! আস্তে আস্তে এটা লোক ভাষার মতো হতে শুরু করল। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের প-িতদের অস্বীকার করা তখনই শুরু হয়েছে। এর পরিণতিতে আমরা দেখেছি ‘আলালের ঘরের দুলাল’ এবং ‘হুতুম পেঁচার নকশা’। তারপর বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। বিদ্যাসাগর তো আছেই। ভারতচন্দ্রের বাংলা আর মধুসূদনের বাংলা পড়লে দেখা যায়, মাঝখানে একটা ইন্টারাপশন হয়েছে। একটি ডিপ্রেশন গেছে। বাংলা আবার তার আগের খাতে ফিরে এসেছে। মধুসূদন তার নাটকগুলো যশোরের আঞ্চলিক ভাষায় লিখেছেন। ‘একেই কি বলে সভ্যতা?’, ‘বুড় সালিকের ঘাড়ে রোঁ’, এগুলো ঢাকার টিভি নাটকের চেয়ে অনেক ভালো। মধুসূদনের কবিতায় সাংঘাতিক সংস্কৃতমূলক শব্দ। এ জন্যই আমি বলব, দীনবন্ধু, বঙ্কিম, যাদের নাম এখন আমরা কম নিই, তাদের ভাষার ব্যাপ্তি যদি দেখা হয়, তাহলে মান ভাষা কীভাবে তৈরি হচ্ছে বোঝা যায়। রবীন্দ্রনাথ যখন বাংলা ভাষা তত্ত্ব বইটি প্রকাশ করেন ১৯০৯ সনে, তার আগে তিনি দেখিয়েছিলেন যে কলকাতায় যে একটি ভাষা তৈরি হয়ে যাচ্ছে, এটা ঠিক নদীয়ার ভাষাও না। উনি বলেছেন, বাংলা ভাষায় একটা মান ভাষা হবে, যেটা রাজধানীতে হয়। এ কথায় ঐতিহাসিক যুক্তি আছে। কিন্তু বাংলার রাজধানী কলকাতা থেকে চলে গেল ১৯১১ সনে। মানে ভারতের রাজধানী চলে গেল দিল্লিতে। কলকাতা একটি প্রাদেশিক রাজধানীতে পরিণত হলো। তারপরও বাংলাদেশের কেন্দ্রই রইল। বঙ্গ বিভাগের পর একটা ধাক্কা লাগল। কলকাতার লোকেরা আন্দোলন করে সাত বছরের মধ্যে কলকাতাকে বাংলার রাজধানী রাখল কিন্তু ভারতের রাজধানী আর থাকল না। এরপর ১৯৭১ সনের পর ঢাকা যখন একটি স্বাধীন দেশের রাজধানীর মর্যাদা পেল, সেই সময় মান ভাষার প্রশ্নে অনেকে দ্বিধায় পড়েছেন। কোনটা মান ভাষা হবে- কলকাতারটা, নাকি ঢাকারটা? অনেকেই বলছেন যে আমরা আঞ্চলিক ভাষাগুলোও বজায় রাখব। ঢাকার আঞ্চলিক ভাষা পছন্দ না করলে সিলেটেরটা করতে হবে, সিলেটেরটা পছন্দ না হলে ময়মনসিংহেরটা করতে হবে। একটি দেশকে পাঠ্যবই ছাপাতে হয়। কিন্তু পাঁচ জেলার জন্য তো পাঁচ ভাষায় ছাপাবে না। সেখানে কাউকে কাউকে ছাড় দিতে হবে। একটা মান ভাষা এভাবেই তৈরি হয়েছে। ইতিহাসে আমরা দেখেছি। কিন্তু দ্বিভাষিক, ত্রিভাষিক দেশও আছে। সেটা ভিন্ন সমস্যা। বাংলাদেশ ঐতিহাসিকভাবে একটি ভাষাভাষীর গোষ্ঠী হয়েছে, এটি বাংলাদেশের মহা সুবিধা। আঞ্চলিক ভাষা আছে। এখন মান ভাষা করার জন্য প-িতদের ঘুমিয়ে না থেকে তর্ক করা উচিত। তর্কই আমাদের নিয়ে যাবে মান ভাষা কোনটা হবে, সেদিকে। আঞ্চলিক ভাষা ও মান ভাষার মধ্যে একটা দ্বন্দ্ব সব সময় থাকে।
ক্যানভাস: কেন্দ্রীয় ভাষাক্ষমতার দাপটে অন্যান্য ভাষা বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে, এটা নিয়ে আপনার ভাবনা কী?
সলিমুল্লাহ খান: সারা পৃথিবীতেই আঞ্চলিক ভাষাগুলো এখন বিপদাপন্ন। বিলুপ্তপ্রায় ভাষা। পৃথিবীতে কত রকমের ভাষা আছে, তার পুরোপুরি সার্ভে নেই। কিছুদিন আগেও আমি পড়েছি ৭ হাজার ভাষা, এখন বলছে ৫ হাজার ভাষা। এটা কিছুটা গণনার ফল হতে পারে। বাংলাদেশের কয়টিকে আপনি ভাষা হিসেবে গ্রহণ করবেন? যেমন, বাংলা একটি ভাষা। কিন্তু বাংলাদেশের বিভিন্ন উপভাষাকে যদি আলাদা ভাষা হিসেবে গণ্য করা শুরু করেন, তাহলে ভাষার সংখ্যা বেড়ে যাবে। আজ থেকে দেড় শ বছর আগেও অহমিয়া এবং উড়িয়া বাংলা ভাষা বলেই গৃহীত হতো। অনেক আন্দোলন করে ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরুতে অহমিয়া আলাদা হয়ে যায়। আলাদা হয়ে যায় মনে মনে। কিন্তু আইনগতভাবে ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষে। ১৮৭৫ সালের পর অহমিয়ারা বলে, আমরা বাংলাভাষী নই। আমরা অহমিয়া ভাষী। তাদের পাঠ্যবই আলাদা করতে হবে, পত্রিকার ভাষা আলাদা করতে হবে। অথচ দেখুন, অহমিয়া ভাষা আপনি বুঝতে পারবেন অনেকটাই। চাটগাইয়া ভাষা আর অহমিয়া ভাষা বাংলা থেকে বেশি দূরে নয়। কিন্তু চাটগাইয়া এখন বাংলার অংশ। অহমিয়া নয়। এটা রাজনৈতিক কারণে। উড়িয়া ভাষা তার কিছু আগে আলাদা হয়েছে বাংলা থেকে। সরকারি হিসাবে বাংলাদেশে এখন ৪৫টি জাতি আছে, যারা বাঙালি নয়। তাদের প্রত্যেকের নিজস্ব ভাষা আছে। বাংলার ভেতরে আঞ্চলিক ভাষা আছে। অহমিয়া কিংবা উড়িয়ার মতো চাকমা ভাষাকেও একসময় বাংলা বলে গ্রহণ করা যেত। এখন রাজনৈতিক কারণে উড়িয়ারা যেমন আলাদা হয়েছে ভারতে। এখন অহমিয়াকে আর বাঙালি বলতে পারবেন না। উড়িয়াকেও না। চাকমাকেও আর পারবেন না। এটা মেনে নিতে হবে। বাংলাদেশে এখন প-িতদের মধ্যে যে তর্ক হচ্ছে, যে হুমায়ূন আহমেদ তার নাটকে আঞ্চলিক ভাষা লিখেছেন, চাকরের মুখে আঞ্চলিক ভাষা দিয়েছেন, ভদ্রলোকের ভাষা দেননি ইত্যাদি। এসব তর্কে থাকবে। তবে রাষ্ট্রীয় কার্যকলাপ চালাবার জন্যে, লেখাপড়ার একটি মান ভাষা তৈরির জন্যে, সংবাদপত্রের জন্যে, বয়ানের ভাষার জন্যে যে ভাষা, সেটিকেই মান বাংলা মনে করি আমি।
ক্যানভাস: একটি শ্রেণি বাংলা ভাষার সঙ্গে একধরনের বিশ্বাসঘাতকতা করে চলেছে। তারা শব্দ বিকৃত করছে। এটিকে আপনি কীভাবে দেখেন? একে কি স্বাধীনভাবে ছেড়ে দেওয়া উচিত, নাকি দমন করা উচিত?
সলিমুল্লাহ খান: দমন করবে কে? সরিষার মধ্যে যদি ভূত থাকে! দমন করার শক্তিকে আমরা নাম দিয়েছি রাষ্ট্র। রাষ্ট্র আইন করতে পারে। কিন্তু রাষ্ট্রের আইন দিয়ে সব চলে না। এই বিকৃতিকে দুভাবে দেখতে হবে। একটা হচ্ছে দীর্ঘমেয়াদি ইতিহাসের অংশ হিসেবে। ভাষা সব সময় বদলায়। বাংলা ভাষায় এত ফার্সি শব্দ মিশল কখন? সুলতানি আমলের ৪০০ বছরে। ইংরেজি মিশল ইংরেজ আমলের ২০০ বছরে। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, ইংরেজ চলে যাওয়ার পর ৭০ বছর পার হলো- ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশে; এখন ইংরেজি ভাষার চল আরও বাড়ছে আগের থেকে। এর একটি কারণ হচ্ছে, দুনিয়া ছোট হয়ে আসছে। ইংরেজদের জায়গাটা গোপনে দখল করেছে আমেরিকা। এটা একটা কারণ। আমাদের পাশের দেশ ভারত আরেকটি কারণ। সারা ভারতে তো কোনো নিখিল ভাষা ছিল না। একসময় বলতাম সংস্কৃত ছিল, ফার্সি ছিল, এগুলো অধিকাংশ কল্পনামাত্র। আঞ্চলিক মানুষ আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলত। শ্রীকৃষ্ণের যুগ থেকে বাংলা ভাষা গড়ে উঠছে। আমরা বাংলা পুঁথির জগৎ দেখেছি। শাহ মুহম্মদ সগীর থেকে ভারতচন্দ্র পর্যন্ত। এটা একটা যুগ। সেই যুগে বাংলা গড়ে উঠেছে। ইংরেজ আমলে বাংলা ভাষা একটা ছাপাখানার রূপ পেয়েছে। এ জন্য এটা দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে। বিশেষ করে সংবাদপত্র, পাঠ্যপুস্তক। এখন রেডিও ও টেলিভিশন। এটা বিংশ শতাব্দীর দান। ফলে ভাষা ক্রমশ কাছে আসছে। রেডিও, টেলিভিশন- শব্দগুলো আমাদের ভাষায় ছিল না। এখন আমরা এটাকে ভালোবেসে বেতার বলি, টেলিভিশনকে দূরদর্শন বলে। কিন্তু সাধারণ মানুষের কাছে বেতারের চেয়ে টেলিভিশন জনপ্রিয়। রেডিও শব্দটা বেশি জনপ্রিয়। কিন্তু এগুলো মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। তারা তাদের মিডিয়ার নাম দিচ্ছে ইংরেজি শব্দে। তাতে বোঝা যায়, এই রেডিও টেলিভিশনগুলোর চিন্তা, নকশা প্রকল্প যাদের, তারা হচ্ছে এ দেশে ইংরেজদের তৈরি করা সহযোগী শ্রেণি, পুরোনো বাংলায় যাদের ‘মুৎসুদ্দি’ বলে, এরা হচ্ছে তাদেরই সন্তান। কিন্তু তারা এটি জানেন না। যারা শিল্পায়ন না করে পয়সাওয়ালা হয়েছে, তারাই কথার মধ্যে ইংরেজি শব্দ বেশি ব্যবহার করে। এটা হচ্ছে একটা শ্রেণির ব্যাধি। ব্যাংকের চেকে কি বাংলা লেখা যায় না? দেশের প্রধান হাসপাতালগুলোর ডাক্তারদের প্রেসক্রিপশন ইংরেজিতে। এ বিষয়ে রাষ্ট্রকে নেতৃত্ব নিতে হবে।
ক্যানভাস: পৃথিবীর সব ভাষার সাহিত্য একটা পরাগায়নের মধ্য দিয়ে বিকশিত হয়। যেমন ফরাসি সাহিত্যের পরাগায়নে ইংরেজি সাহিত্য বিকশিত হয়েছে। আমাদের এখানেও কিন্তু একধরনের পরাগায়ন ঘটেছে। মাইকেল মধুসূদন দত্ত ১৮৬১ সালে মেঘনাদবধ কাব্য লিখলেন। এর মধ্য দিয়ে বাংলা কবিতার আগের রূপটি রইল না। যদিও মহাকাব্যের যুগ ততক্ষণে শেষ হয়ে গেছে। এর মধ্যে ফরাসি সাহিত্যে একধরনের বিপ্লব ঘটে গেছে উনিশ শতকে। সেটা হচ্ছে সিম্বলিস্ট মুভমেন্ট। আমার প্রশ্ন হচ্ছে, এখানে ফরাসি কলোনি ছিল, ফরাসি ভাষা জানতেন না এমন লোক যে ছিলেন না তা-ও নয়। ফরাসি ভাষা কলকাতায় নানাভাবে চর্চিত হয়েছে। স্যার আর্থার সায়মন্স ‘দ্য সিম্বলিস্ট মুভমেন্ট ইন লিটারেচার’ নামের একটি বই লিখেছিলেন। বলা হয়ে থাকে, যেটা না লেখা হলে সাহিত্যের ইতিহাস অন্য রকম হতো। আমরা সেখান থেকে নিতে পারলাম না কেন?
সলিমুল্লাহ খান: প্রথমেই বলে রাখি, এটার উত্তর দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আমি উত্তর দিতে চেষ্টা করতে পারি মাত্র। প্রথম কারণ হচ্ছে, ভারতবর্ষে অষ্টাদশ শতাব্দীতে অনেকগুলো শক্তি প্রতিযোগিতা করছিল ক্ষমতা দখলের জন্য। ষোড়শ শতাব্দীতে এখানে ১০০ বছরের মতো রাজত্ব করেছে পর্তুগিজরা। অনেক পর্তুগিজ ভাষা বাংলায় ঢুকেছে। এরপর এলো ওলন্দাজরা। এরপর এখানে রাশিয়ান, আর্মেনিয়ান- অনেকেই ছিল। শেষে প্রতিযোগিতা হলো দুটি শক্তির মধ্যে। ফরাসি ও ইংরেজ। ফরাসিরা পরাজিত হলো। বাংলাদেশে ইংরেজদের প্রভাব বেড়ে গেল, ফরাসিদের প্রভাব কমে গেল। অষ্টাদশ শতাব্দী নাগাদ ইউরোপীয় সাহিত্যে ইংরেজ ও ফরাসিরা পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠল। ইংরেজি সাহিত্য বিকাশের সবচেয়ে বড় নাম হচ্ছে শেক্্সপিয়ার। শেক্্সপিয়ারের পরেও ফরাসিদের মধ্যে বড় বড় নাট্যকার বেরিয়েছে। রাসিন, কর্নেই। পরবর্তী শতাব্দীতে মলিয়ের। এরাও ভালো নাট্যকার। তো ফরাসি ও ইংরেজরা কে কার কাছে ঋণী, সেই তর্কে হয়তো আপনার কথাই সঠিক। ফরাসিদের কাছে ইংরেজরাই বেশি ঋণী। কিন্তু এখন ইংরেজদের কাছ থেকে সবাই ঋণী হচ্ছে। ফরাসি ও ইংরেজি সাহিত্যের মধ্যে বন্ধুত্ব, প্রতিযোগিতা- সবই ছিল। আমাদের এখানে আগে ফার্সি ভাষার চল ছিল। দিল্লিতে ও বাংলাতে। বর্তমানে ইংরেজি ভাষার যুগে আমরা ইংরেজিও পেয়েছি, সেই সূত্রে আধুনিকতা পেয়েছি। ফরাসি আমাদের মধ্যে এসেছে ইংরেজির পথ বেয়ে।
ক্যানভাস: ২০০৫ সাল থেকে আপনি সাধু ভাষায় লিখতে শুরু করেছেন। এর প্রেক্ষাপট কী?
সলিমুল্লাহ খান: ছোটবেলায় আমাদের বাংলা পাঠ্যবইয়ে দুটি অংশ ছিল। গদ্যাংশ ও পদ্যাংশ। বাংলা ভাষা গদ্যে লেখা হয় নাকি পদ্যে লেখা হয়? কেউ কেউ বলবে, যখন গদ্য তৈরি হয়নি লোকে পদ্য লিখত, এখন আমরা গদ্য আবিষ্কার করেছি। কিন্তু পদ্য কি আমরা বাদ দিয়েছি? একসময় আমরা পদ্য কবিতা লিখতাম। কিন্তু এখন গদ্য কবিতা লিখি। পদ্য লিখতে পারার পরও গদ্য লেখা বাদ দেননি কবিরা। লোকে কবিকে জিজ্ঞাসাও করে না- কেন আপনি দুটিই লিখেন? গদ্য লেখক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত কেউ পদ্য লিখলে লোকে তাকে তিরস্কার করতে আসে না। আমরা সবাই এখন চলিত ভাষায় অভ্যস্ত। বাংলাদেশের মানুষ সাধু ভাষায় কথা বলে না। আমার বক্তব্য হলো, আমরা সবাই এখন চলিত ভাষায় লিখি। কিন্তু তার মানে কি এই যে আমরা সাধু ভাষা একেবারেই হত্যা করব? গদ্য রচনা পদ্যের পরে এসেছে- এটা মেনে নিচ্ছি আমি। কিন্তু তার মানে এই নয় যে গদ্য লেখার পর মানুষ পদ্য বাদ দিয়ে দিয়েছে। আমি ভাবলাম, চলিত ভাষায় আমি ২০-২৫ বছর লিখেছি। দেখলাম যে আমাদের লেখা পোকায় কাটে। বাজারে বিক্রি হয় না। তখন আমি ভাবলাম, চলিত লিখলে যেহেতু বিক্রি হয় না, বই যখন চলে না, তো সাধু ভাষায় লিখে দেখি চলে কি না। দেখি যে তা-ও চলে না। সাধু আর চলিতে আমি কোনো ভেদ করতে পারি না। বিক্রয়ের দিক থেকে আমার চলিতও চলে না, সাধুও চলে না। এ দোষ হচ্ছে আমার। আমার লেখা কেউ কেনে না। সুতরাং, সাধুতে লিখলেই কী আর চলিততে লিখলেই কী! এই মনে করেই আমি ২০০৫ সনে একটা ছোট বই বের করেছিলাম। ফ্রয়েড পড়ার ভূমিকা। আমার ভূমিকাটি আমি সাধু ভাষায় লিখলাম। একটু রসিকতা করে। আমি তিন প্রকাশকের কাছে গিয়েছিলাম। সবাই বলল, আপনার লেখা চলে না। আমরা ছাপব না। তখন নিজের পকেটের টাকা খরচ করে বের করি। ৫০০ কপি ছাপাই। সেই বই এক বছরের মধ্যে বিক্রি হয়ে গেল। দেখলাম যে সাধু ভাষা কোনো বাধা হয়নি। একটা এক্সপেরিমেন্ট করেছিলাম আরকি। যা হোক, আমি সাধুতে লিখি এ কারণে যে লিখতে মজা পাই। কিন্তু চলিততে যে লিখি না, তা নয়। আমি মনে করি সাধু এবং চলিত- দুটিকেই আমাদের বাংলা ভাষার মধ্যে স্থান দেওয়া উচিত।
ক্যানভাস: সৃষ্টিশীলতা ও চিন্তাশীলতার জায়গায় এখন আপনি কোন কাজের মধ্যে আছেন?
সলিমুল্লাহ খান: এখন আমি মূলত প্রবন্ধই লিখি। আমার অধিকাংশ কাজই এখন অনুবাদের সঙ্গে যুক্ত। মন্তব্য লিখি এবং অনুবাদ করি। আহমদ ছফার অনেক লেখা অগ্রন্থিত রয়েছে। সেগুলো এখন সম্পাদনা করছি। এটাকে সৃষ্টিশীল কাজ মনে করবেন কি না জানি না। আহমদ ছফার আত্মজৈবনিক কিছু লেখা আছে। আমি তাঁর ২০-৩০টি লেখা পেয়েছি, যেখানে তিনি কী করে লেখক হলেন ইত্যাদি বিষয়ে লিখেছেন। সেটা সংকলন করছি। আমার নিজের কাজ হচ্ছে, আহমদ ছফা সম্পর্কে যে প্রবন্ধগুলো লিখেছি, সেগুলোর একটা সংকলন করব।
ছবি: সৈয়দ অয়ন
স্যারের, কথা শুনতে অনেক ভালো লাগে। এমন সুবক্তা শিক্ষক প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকুক একজন করে।
ক্যানভাসে এমন আধেয়ও (কন্টেন্ট) পাওয়া যায়, তা ভাবিনি। ধন্যবাদ!