ইন্টারন্যাশনাল ফ্যাশন I মেনজ ২০২০
ফ্যাশন ক্যাপিটালগুলোয় হয়ে যাওয়া মেনজ ফ্যাশন উইক থেকে এবার আলো পড়ল রিসাইক্লিং, আপসাইক্লিং এবং স্ট্রিট স্টাইলে। সামনের বেশ কিছুদিন এ তিনটিই পুরুষের গায়ে থাকবে প্রধান পোশাক হয়ে
বড়দিন আর নিউইয়ারের ছুটি শেষ না হতেই নামজাদা ফ্যাশন ডিজাইনার এবং মডেলরা তল্পিতল্পা নিয়ে ছুটে বেড়াচ্ছেন লন্ডন থেকে মিলান, মিলান থেকে প্যারিস। আর তাদের সঙ্গে ঘুরছেন ফ্যাশন-সংশ্লিষ্টরা। বছরের প্রথম সপ্তাহে শুরু হয়েছে ফ্যাশন উইক মেনজ অটাম/উইন্টার-২০২০। প্রথম ইভেন্টটি লন্ডনে। তীব্র ঠান্ডা আর বৃষ্টির অস্বস্তিও ফ্যাশনপ্রেমীদের আটকাতে পারেনি এই ইভেন্ট থেকে। ফটোসাংবাদিক আর ফ্যাশন পুলিশদের চোখ যেমন ছিল রানওয়েতে, তেমনি ছিল অনুষ্ঠানের বাইরের রাস্তাগুলোতেও। কারণ, কখনো কখনো রাস্তার ফ্যাশন থেকেই সৃষ্টি হতে পারে নতুন কোনো ট্রেন্ড।
টেইলারিং, লেদার, চেক, ইউটিলিটি ভেস্ট—এসবই এবারের লন্ডন ফ্যাশন উইক মেনজের কি-ওয়ার্ড। তবে সবদিকে ছিল সাসটেইনেবল ফ্যাশনের জয়জয়কার।
স্ট্রিট স্টাইল
অনেক ফ্যাশন-অনুরাগী নতুন কালেকশন দেখতে ফ্যাশন উইকে এসে থাকেন। তাদের ফ্যাশন থেকেই স্ট্রিট স্টাইল কনসেপ্টটি এসেছে। সাধারণত অনুষ্ঠানস্থলের বাইরের রাস্তায় ঘোরাঘুরির সময় এ সম্পর্কে জেনে নেন সাংবাদিকেরা। বরাবরের মতো অত্যন্ত ইউনিক সব স্টেটমেন্ট স্টাইল দেখা গেছে এবারের লন্ডন ফ্যাশন উইক মেনজের অনুষ্ঠানস্থলের রাস্তায়। বোল্ড কালার আর আউটওয়্যারের দখলে ছিল এবারের ইভেন্ট। এগিয়ে ছিল গাঢ় কমলা রঙ। এ রঙই যেন নতুন কালো। জানুয়ারি মাসের ঠান্ডা থেকে বাঁচতে বেশির ভাগ ফ্যাশন-অনুরাগী বেছে নিয়েছেন বারবেরি, প্রাডা আর জুনিয়া ওয়াতানাবের ওভারসাইজ টেইলারিং আউটওয়্যার। এ ছাড়া ছিল পাফার জ্যাকেট, হুডি। পায়ের উষ্ণতার জন্য সবার প্রথম পছন্দ ছিল প্ল্যাটফর্ম স্নিকার। টোক বা বিনি টুপিকে ছাড়িয়ে এগিয়ে ছিল বাকেট হ্যাট। আর ক্রসবডি স্টাইলে ফ্যানি প্যাকের ব্যবহার ছিল চোখে পড়ার মতো।
আপসাইক্লিং ওভারলোডেড
পশ্চিমা ছোট-বড় বিভিন্ন ব্র্যান্ড সাসটেইনেবল ফ্যাশন চর্চা বিষয়টিকে খুব গুরুত্বের সঙ্গেই নিয়েছে। এবারের লন্ডন ফ্যাশন উইকের কালেকশনগুলোতে দেখা গেছে আপসাইক্লিং পোশাকের উপস্থিতি। অনেকে রিসাইক্লিংকে এর সঙ্গে গুলিয়ে ফেলেন। আপসাইক্লিং হচ্ছে একটি জিনিসকে নতুন করে ব্যবহার উপযোগী করে তৈরি করা। এই ফ্যাশন উইকে পাঁচটি ব্র্যান্ডের এ ধরনের ড্রেস সবার নজর কেড়েছে।
ইটজ ব্র্যান্ড মাত্র ২৬টি হাইক্লাস ক্যাজুয়াল আপসাইকেলড পোশাক নিয়ে হাজির হয়েছে এই ফ্যাশন উইকে। এগুলোর মধ্যে ছিল ডেনিম জ্যাকেট, প্যান্ট, হেরিংবোন প্যাটার্ন লং স্যুট, মেনজ ট্রাউজার। এসবের বেশির ভাগই রিফু, তালি দেওয়া। এমনভাবে বানানো, যাতে অনেক দিন ধরে ব্যবহার করা যায়। অন্যদিকে ভিন্টি এন্ড্রুজ খুব নিপুণতার সঙ্গেই ভিন্টেজ স্পোর্টসওয়্যার আর আউটওয়্যারকে পুনর্ব্যবহারের বদৌলতে করে সম্পূর্ণ নতুন কালেকশন দেখিয়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে। এর মধ্যে একটিমাত্র নিওন হলুদ রঙের প্যাডেড জ্যাকেট ছিল মেট পুলিশের কোট থেকে বানানো। রঙে আরও প্রাধান্য পেয়েছে নিওন কমলা, নিউট্রাল আর নেভি ব্লু।
বেথানি উইলিয়ামের কালেকশনের কালারফুল ইউনিসেক্স পোশাকগুলো ছিল শতভাগ টেকসই। গেল বছর এই মেধাবী ডিজাইনার ফ্যাশনে সাসটেইনেবিলিটি চর্চার জন্য মর্যাদাপূর্ণ কুইন এলিজাবেথ সেকেন্ড অ্যাওয়ার্ড ফর ব্রিটিশ ডিজাইনে ভূষিত হয়েছেন। পোশাকের জন্য তিনি একদম নবায়নযোগ্য, জীবাণুবিয়োজ্য উল সংগ্রহ করেছেন ‘উল অ্যান্ড দ্য গ্যাং’ নামের কোম্পানি থেকে। সম্পূর্ণ রিসাইকেল ডেনিমগুলো এসেছে ক্রিস কার্নে কালেকশন থেকে। তা ছাড়া এ বছর বেথানি তার শোতে ব্যবহার করেছেন ক্ল্যাসিক অ্যাডিডাস সুপারস্টার ট্রেইনার।
স্টুডিও এএলসিএইচের স্বত্বাধিকারী অস্ট্রেলিয়ান ডিজাইনার আলেক্সান্ড্রা হাকেট রিসাইকেল ম্যাটেরিয়াল আর আপসাইকেল স্পোর্টসওয়্যার থেকে তৈরি করেছেন ট্র্যাক প্যান্ট, স্ট্রেইট লেগ প্যান্ট, ভেস্ট টপ, বয়লার স্যুটস এবং মেসেঞ্জার ব্যাগ। তরুণ ব্রিটিশ ডিজাইনার প্যাট্রিক ম্যাকডয়েল তার কালেকশনের জন্য লন্ডন ফায়ার ব্রিগেডের ভিন্টেজ ইউনিফর্ম, বেল্ট এমনকি পানি সরবরাহের হস ব্যবহার করেছেন।
ট্রেন্ড টু ফলো
নতুন সিজনে কী কী ট্রেন্ড আসছে, তার খুব ভালো একটি আভাস বা গাইডলাইন পাওয়া যায় ফ্যাশন উইকের রানওয়ে থেকে। এর মধ্য থেকে পছন্দের ট্রেন্ডটি বেছে নেয় ফ্যাশনপ্রেমীরা।
আপসাইক্লিং তো থাকছেই। এ ছাড়া আরও কিছু ট্রেন্ড এসেছে এই ফ্যাশন উইকের রানওয়ে থেকে। যেমন ডেনিমের বহুমাত্রিক ব্যবহার দেখা গেছে বিভিন্ন ডিজাইনারের কালেকশনে। এগুলোর মধ্যে ছিল ডেনিম স্যুট, ট্রেঞ্চ কোট, ওভারঅল, ওয়াইড লেগ প্যান্ট। হ্যান্ডপেইন্ট এবং লেজার পেইন্ট ডেনিমের ব্যবহার ছিল চোখে পড়ার মতো।
টেইলারিং পোশাকে শোভা পেয়েছে হারনেস, বেল্ট এবং স্ট্র্যাপ। ক্ল্যাসিক স্যুট জ্যাকেট থেকে টেইলরড ওভারকোট—সবখানেই ছিল এদের উপস্থিতি। ব্ল্যাক লেদারের ট্রেঞ্চ কোট, ওয়াইড লেগ প্যান্ট, স্লিম কাট প্যান্ট আর টগেল্ড ব্লেজার বেশি দেখা গেছে। অ্যানিমেল প্রিন্টকে হটিয়ে এই ফ্যাশন উইকের রানওয়ে থেকে ট্রেন্ডে আসছে ফেস প্রিন্ট। ক্ল্যাসিক চেক প্যাটার্নের পোশাক আসছে আরও রাজকীয়ভাবে। এ ছাড়া ট্রেন্ডে আরও থাকবে ইউটিলিটি ভেস্ট, মেশ জাম্পার, লং ওভারকোট, হাই ফ্যাশন গ্লাভস, নাইস স্মার্ট শু।
মিলান ফ্যাশন উইক মেনজ ২০২০
জানুয়ারির ১০ থেকে ১৪ তারিখ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হলো মিলান ফ্যাশন উইক মেনজ ২০২০। বিশ্বের বিখ্যাত সব ফ্যাশন ব্র্যান্ডের জন্ম ও আবাসভূমি মিলান এই ফ্যাশন সপ্তাহ উপলক্ষে সেজেছিল উৎসবের রঙে। ইউনিক সব সেটে চমকে দেওয়ার মতো কালেকশন নিয়ে হাজির হয়েছে গুচি, প্রাডা, জিমি চু, আলেক্সান্ডার ম্যাককুইন, ফেন্দি, ডলশে অ্যান্ড গ্যাবানার মতো নামকরা ব্র্যান্ডগুলো। ফ্যাশন-সংশ্লিষ্টদের চোখ কেবল রানওয়েতে নয়, আয়োজনস্থলের আশপাশের রাস্তায় অতিথিদের সাজপোশাকেও ছিল। এই ইভেন্ট থেকে পাওয়া রেট্রো, রিসাইকেল, রিলাক্স, ওভারসাইজ, ক্যাজুয়াল-ফরমাল ড্রেসের ট্রেন্ড আগামী শরৎ ও শীতে বেশি চলবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
পথ থেকে
মিলান ফ্যাশন উইকের স্ট্রিট স্টাইলে সবচেয়ে বেশি দেখা গেছে ক্যাজুয়াল টেইলারিং পোশাক। এর ভেতর ছিল শার্প ওভারকোট, রিলাক্স ব্লেজার, রিফাইন ট্রেঞ্চ কোট। ডেনিম প্যান্টের সঙ্গে ছিল লেদার আর টেইলারিং ট্রাউজার। চেক, হাফ মুন প্যাটার্ন, লেপার্ড প্রিন্ট, মিলিটারি প্রিন্টের পোশাক বেশ দেখা গেছে। ক্রস বডি ব্যাগ যে ট্রেন্ডে খুব চলছে, তা ফ্যাশন উইকের রাস্তায় তাকালেই বোঝা যায়। চামড়ার জুতার স্বর্গরাজ্য ইতালিতে প্ল্যাটফর্ম স্নিকার খুব একটা সুবিধা করতে পারেনি। তাই তো মিলান ফ্যাশন উইকের রাস্তায় লেদার ও মেটালিক লোফার, বুট, ডেলিকেট এমব্রয়ডারি স্লিপারের সরব উপস্থিতি।
রানওয়ে
এবারের ফ্যাশন উইকের সবচেয়ে তাক লাগানো শো ছিল সম্ভবত গুচির। এর রানওয়ের মাঝখানে ছিল বিশাল একটি পেন্ডুলাম। সময়ের পেছনে গিয়ে ছোটবেলার পোশাকে অনুপ্রাণিত হয়ে নিজের কালেকশনগুলো তৈরি করেছেন গুচির ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টর আলেসান্দ্রো মিশেল। এ ছাড়া তার কালেকশনে প্রকাশ পেয়েছে জেন্ডার ফ্লুইডিটি এবং প্রথাছুট ম্যাসকুলিনিটি। বোল্ড স্লোগান সংবলিত টি-শার্ট ও ব্যাগ আর ছেলেদের পরিহিত মেয়েদের ড্রেস ছাড়াও ছিল নব্বইয়ের ডেনিম, ওভারসাইজ কোট, ডেভিন বাওয়ি স্টাইলড মেটালিক প্যান্ট, কিউট পিটার প্যান কলারড ড্রেস। যা সত্যিই গুচির শোকে এক অন্য মাত্রায় নিয়ে গেছে।
ক্ল্যাসিক আউটফিটে মডার্ন টুইস্ট ছিল ফেন্দির কালেকশনে। শেপ শিফটিং অ্যাটায়ার, ফার, ফ্লানেল ও লেদারের কোট ও জ্যাকেট ছাড়াও নজর কেড়েছে হাইব্রিড প্যান্ট, যার সামনের অংশ প্যান্ট আর পেছনের অংশ স্কার্টের মতো। চোখধাঁধানো ডিজাইনের নানা সাইজের হলুদ ও কালো রঙের ব্যাগ নিয়ে রানওয়ে মাতিয়েছে মডেলরা।
মারসেলো বারলন কাউন্টি অব মিলানের কালেকশনে ছিল সম্পূর্ণ নতুন প্যাটার্নের ক্যাজুয়াল আউটফিট। নতুন প্যাটার্নটিকে বলা যায় ইম্প্রোভাইস হাউন্ডসটুথ ও ডিজিটাল সাইকেডিলিক ডিজাইনের মিশ্রণ। এই প্যাটার্নের ক্যাজুয়াল টেইলর স্যুট, শর্টস, হুডি, জ্যাকেট, কার্ডিগান—সবকিছুই ছিল বারলনের কালেকশনে।
শাইনি রোজ গোল্ড, রাস্টি, পাউডার ব্লু, লাইট পার্পল আর চিরাচরিত সাদা আর কালো রঙের স্মার্ট ক্যাজুয়াল আউটফিটের দৃষ্টিনন্দন কালেকশন নিয়ে হাজির হয়েছেন টম ফর্ড। তিনি এবারের কালেকশনের জন্য ব্যবহার করেছেন তার পছন্দের জেন্টল ওয়াশ ডেনিম আর প্রিন্স অব ওয়েলস উল। শুধু পোশাক নয়, তার কালেকশনে আরও ছিল লেদার ব্যাকপ্যাক, ট্রাভেল ব্যাগ, লেদার শু, স্নিকার। তবে সবার বেশি পছন্দ হয়েছে গলায় ঝোলানো লেদারের ছোট্ট আইফোন ও এয়ারপড কেস।
এবারের ফ্যাশন উইকে বিখ্যাত আমেরিকান ফ্যাশন ডিজাইনার রালফ লরেনের মেনজ ওয়্যার লাইন পার্পল লেবেল প্রতিষ্ঠার ২৫ বছর উদ্যাপন করল। সিলভার জুবিলি উপলক্ষে অন্য সব ব্র্যান্ডের থেকে ইউনিক কিন্তু ক্ল্যাসিক সব টেইলারিং স্যুট নিয়ে এসেছে এই লেবেল। কালেকশনগুলোর জন্য ব্যবহার করা হয়েছে লাক্সারি ইতালিয়ান আর ইংলিশ ফ্যাব্রিক। নিখুঁত টেইলারিংয়ের এই পোশাকগুলোর মাধ্যমে রালফ লরেন সম্মান জানাতে চেয়েছেন ক্ল্যাসিক স্যুটের কারিগরদের। এগুলো হাই সোসাইটি ফরমাল ইভেন্টে পরার উপযুক্ত। চাইলে গ্রুমসওয়্যার হিসেবেও ব্যবহার করা যাবে।
ফাহমিদা শিকদার
ছবি: ইন্টারনেট