রসনাবিলাস I প্যারাডিসো ডেল চিবো ইতালিয়ানো
একে শিশুবান্ধব রেস্তোরাঁ বলা চলে। কেননা, এখানে রয়েছে ওদের খেলা আর ছোটাছুটির বড় পরিসর ও ব্যাপক আয়োজন। ইতালিয়ান কুজিনই এর স্টেটমেন্ট। তবে অন্য খাবারও মেলে
রেস্টুরেন্টের নাম ও’প্লে। কড়া তল্লাশির পর প্রবেশ করতেই চোখে পড়ে দোতলার বারান্দায় বাচ্চাদের খেলার জায়গা। বিভিন্ন ধরনের খেলনা দিয়ে সাজানো। সেখান থেকে একটুখানি চোখ সরালে হাতের ডানে বিশাল লন। সেখানে বসার ব্যবস্থার পাশাপাশি রয়েছে বাচ্চাদের খেলার সরঞ্জাম। রেস্টুরেন্টে প্রবেশের জন্য পেরোতে হয় কৃত্রিম সবুজে সাজানো একটা জানালা।
বাড়িটা পাঁচ যুগের পুরোনো। সাজানো দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই হালকা মেজাজের মিউজিক আর কফির গন্ধ স্বাগত জানায়। অন্দরসজ্জায় বাহুল্য নেই। বাঁ পাশে স্টেট অব আর্ট কফি কাউন্টার, আর বাকিটা জুড়ে ছোট-বড় চেয়ার টেবিলের ব্যবস্থা। একটু আলাদা হয়ে গ্রুপ করে আড্ডা দিতে চাইলে রয়েছে আলাদা একটা ঘর। দেয়ালে নিয়ন সাইন আর আয়না। আলো-আঁধারির জন্য ব্যতিক্রমী স্পটলাইটের ব্যবহার মনোমুগ্ধকর। আয়েশ করে কফি খাওয়ার জন্য আদর্শ পরিবেশ। আর দোতলায় রয়েছে বাচ্চাদের খেলার জায়গা। আর্কেড গেমস, শুয়ে-বসে পড়ার জায়গা, বিভিন্ন রাইড—সব মিলিয়ে বাচ্চাদের জন্য আনন্দদায়ক এই ও’প্লে।
আমেরিকানোর কাপে চুমুক দিতে দিতে এসব ঘুরে তো দেখা হলোই, জানা গেল দোতলায় মায়েদের জন্য রয়েছে আলাদা ব্রেস্টফিডিং রুমও। আর এই খেলাধুলার পর বাচ্চাদের ও তাদের বাবা-মায়েদের ক্ষুধানিবৃত্তির জন্য নিচতলায় খাবারের আয়োজন। মেনুতে রয়েছে ইতালির সব খাবার। তবে কেবল পিৎজা বা পাস্তায় আবদ্ধ নয়। রয়েছে সে দেশের আঞ্চলিক খাবারও। কফির ব্যাপারেও ছাড় নেই, ফ্রেশলি ব্রিউড কফি সার্ভ করা হয় এখানে। চাইলে সিফন কফি মেকারে করেও কফি বানিয়ে খাওয়া যায়। এমনটি ঢাকা শহরে আর কোথাও নেই।
কফির কাপে চুমুক দিতে দিতেই হাজির হলো সি ফুড পিৎজা। ইতালিয়ান রেস্টুরেন্টে বসে পিৎজা না খেলে কি আর হয়! তাই এখানকার সেরাটাই অর্ডার করা হয়েছিল শেফের সুপারিশে। কিছুক্ষণের ভেতরেই হাজির ফ্রুটি ডি মারে। নাম শুনে ভিরমি খেলেও এতে ফ্রুটের মানে ফলের কোনো কারবার নেই। ইতালিয়ান ভাষায় এর অর্থ সমুদ্রের ফল, সোজাসাপ্টা ইংরেজিতে সিফুড! ক্লামস, স্কুইড আর সি প্রনে ভরপুর থিন ক্রাস্ট পিৎজায় বেজ হিসেবে শেফের স্পেশাল রগু মানে সস আর মোজারেলা চিজ দিয়ে তৈরি এই পিৎজা। সি ফুডে যাদের আপত্তি নেই তাদের জন্য অবশ্যই চেখে দেখবার মতো পিৎজা এটা। ফ্রেশ হার্বসের ব্যবহারে এর স্বাদ খোলতাই হয়েছিল পুরোপুরি। জানা গেল পিৎজার হোম ডেলিভারির জন্য নিজস্ব ব্যবস্থা তো আছেই, রাত দুটো অব্দি অর্ডারও নেন তারা গুলশান-বনানী এলাকার জন্য।
এরপর পালা গামবেরেত্তি আলা গ্রিয়ার। গামবেরেত্তি মানে প্রন আর গ্রিয়া অর্থ গ্রিল। পাতে এল গ্রিল করা পাঁচটি চিংড়ি, সঙ্গে বিশাল আকৃতির এক গ্রিলড পোর্তো বেলো মাশরুম। গ্রিল করা চিংড়ি বালসামিক ভিনেগার সসে খেতে মন্দ নয়।
এরপরে এল ওসোবাকো। সমুদ্রপারের ইতালি থেকে এবারে উত্তুরে কেতার খাবার। যারা মনে করেন ইতালিয়ান খাবার মানেই পিৎজা-পাস্তা-অলিভ অয়েল আর হার্বসের কারিগরি; তাদের জন্য একটা ধাক্কাই বটে। অটোমান সাম্রাজ্যের ছোঁয়া লাগা ইউরোপীয় কুজিনের প্রভাব লোম্বার্ডি খাবারে পুরোপুরি বিদ্যমান। তাই এখানে অলিভ অয়েলের বদলে আসে বাটার, মাছের বদলে মাংস। টমেটো এখানে ব্রাত্য। ওসোবাকোর অর্থ হলো বোন উইথ হোল। খাঁটি বাংলায় বলা যেতে পারে নলি-পায়ের গোড়ালি থেকে হাঁটুর মাংসের ক্রস কাট। বেশ ঝোল ঝোল হাঙ্গেরিয়ান গুলাশের মতন। টেবিলে এল স্প্যাগেটির সঙ্গে। তবে খানিকটা হতাশ হলাম উপরে লেমন জেস্ট, গার্লিক আর পার্সলে কুচি না পেয়ে! তবে সে দুঃখ বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি। কারণ, ততক্ষণে অস্থির ভেতরের মজ্জায় মজে গেছি। আর মাংসও বেশ নরম হয়ে উঠেছে বহুক্ষণ চুলোর উপরে থাকায়।
মধুরেণ সমাপয়েৎ হয়ে এল তিরামিসু। ইতালির ত্রেভিসো শহরের লা বেশারির রবার্তো লিঙ্গুয়ানোত্তো মশাইয়ের এই আবিষ্কার সম্ভবত পৃথিবীর সবচেয়ে জনপ্রিয়তম ডেজার্ট। ম্যাস্কাপোর্ন ক্রিম আর কফিতে ডিপ করা কুকিজের লেয়ারে হারাতে হয় ক্ষণিক।
খাওয়া শেষে ঠান্ডা আমেরিকানোতে যখন চুমুক দিচ্ছি—হাজির হলেন এই ও’প্লের অন্যতম উদ্যোক্তা সামিরা হামিদ, ও’প্লের ম্যানেজিং পার্টনার। তিনি জানালেন ও’প্লের বিস্তারিত। ‘আমরা চারজনই মা। আমি ১৪ বছর দেশের বাইরে ছিলাম। আমার তিনজন পার্টনার এখানে—নাভিন আহমেদ মেকআপ আর্টিস্ট, আজরিন আলম স্থপতি, সুজান মঈন খান ইভেন্ট প্ল্যানার। আমাদের আরও একটি ভেঞ্চার আছে ফ্যান্টাসিয়াম, যখন সেখানে যা-ই দেখি সেটা পুরো ভর্তি থাকে, নিজের বাচ্চাদের নিয়েই যাওয়া যায় না। বার্থডে পার্টি লেগেই আছে। তখন আমরা ভাবলাম, একটা প্লে এরিয়া করব, সঙ্গে থাকবে ক্যাফে।
আর খাবারের অপশন হিসেবে ইতালিয়ান রাখলাম। কারণ, সব বাচ্চাই পিৎজা-পাস্তা পছন্দ করে; তাদের সঙ্গে আসা বাবা-মায়েরাও করে। আর আমাদের ইতালিয়ান শেফও ২০ বছরের বেশি ইতালিতেই ছিলেন। উনাকে পাওয়ার পরেই আমরা ইতালিয়ান ফুডে ফোকাস করি, শুধু পিৎজা-পাস্তা নয়, আরও বেশি কিছু। এভাবেই শুরু। এমনকি অনেকগুলো জায়গা ঘুরে এটা পছন্দ হয় আমাদের। কারণ, এর সঙ্গে একটা লন আছে, এখানে ওরা খেলে আবার ইভেন্টের সময়ও কাজে দেয়। উপরে খেলার জায়গা, নিচে ক্যাফে আর সামনে লন—আমার মনে হয় এটা পারফেক্ট ফ্যামিলি প্লেস। এমনকি আমাদের লন অনেকেই ব্যবহারের জন্য নিতে চায় বিভিন্ন কারণে। বেশির ভাগ সময়ে আমরা কোনো চার্জও নিই না। যেমন এখানে একটা ফটোগ্রাফি এক্সিবিশন হয়েছে। ২১ ফেব্রুয়ারি হয়েছে বইমেলা। আমরা শিশুদের সুকুমারবৃত্তির সঙ্গে জড়িত যেকোনো উদ্যোগেই পাশে থাকতে চাই।’
ঠিকানা: বাড়ি ১৬, সড়ক ৩২, গুলশান ১, ঢাকা ১২১২। রিজার্ভেশন: ০১৩০৯০০৯৮৮৯। ওয়েবসাইট: oplaybistro.com
আল মারুফ রাসেল
ছবি: লেখক