সি-শার্প I হোম স্টুডিও সেটআপ
মিউজিক স্টুডিও কেমন হওয়া চাই? শব্দ ধারণে তো বিশ্বস্ত হতেই হবে। কম বাজেটে কেমন করে নিজের বাড়িতে এটি সম্ভব? এ নিয়ে দ্বিতীয় কিস্তির কথা জানিয়েছেন ইফতেখার ইনান
রিক্যাপ
গত পর্বে সহজে এবং অপেক্ষাকৃত স্বল্প খরচে হোম স্টুডিও তৈরির জন্য কী কী লাগবে, তা লেখা হয়েছিল। আরেকবার দেখে নেওয়া যাক হোম স্টুডিওর জন্য ন্যূনতম প্রয়োজনীয় যা কিছু লাগে সেই তালিকা
স্টুডিও সেটআপ উপযোগী একটি রুম
অ্যাকুস্টিক ফোম প্যানেল
ডেস্কটপ পিসি
কনডেনসার মাইক্রোফোন
অ্যাকসেসরিজ, এক্সএলআর ক্যাবল, শক মাউন্ট, স্ট্যান্ড, পপ ফিল্টার
কার্ভ ফোম
সাউন্ড কনভার্টার
দুটি মনিটর স্পিকার কিংবা হেডফোন
এগুলো ছাড়াও চেয়ারসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় আসবাব, ক্যাবল, দরজা জানালার ফাঁকা স্থান বন্ধ করার জন্য ফোম বা রাবারের স্ট্রিপ ইত্যাদি তো লাগবেই।
এবার আসা যাক কীভাবে একটি রুমকে স্টুডিও হিসেবে ব্যবহারের উপযোগী করে তোলা যায়, সেই বর্ণনায়।
ধরে নেওয়া যাক, স্ট্যান্ড বা টেবিলের ওপর বসানো সম্ভব—এমন মনিটর স্পিকার ব্যবহারের ক্ষেত্রেই এই নির্দেশনা প্রযোজ্য।
স্টেপ ১: লিসেনিং পজিশন
স্পিকার বসানোর আগে রুমের যেখানে বসে শব্দ শোনা ও অন্যান্য কাজ করা হবে, সেটি ঠিক করে নেওয়া জরুরি। ঘরের অপেক্ষাকৃত ছোট আয়তনের দেয়াল থেকে শুরু করে রুমের দৈর্ঘ্যরে ৩৮% পর্যন্ত পিছিয়ে গিয়ে সেই পয়েন্টটা চিহ্নিত করে নেওয়া জরুরি। এই পরামর্শ স্টুডিও ডিজাইনার ওয়েস ল্যানশটের। চৌকো রুমে এটিকে শব্দ শোনার সবচেয়ে ভালো অবস্থান হিসেবে ধরা হয়। এ উদ্দেশ্যে ঘরটিকে ঠিকঠাকভাবে সাউন্ডপ্রুফ করার পাশাপাশি স্পিকার যথাস্থানে স্থাপন করতে হয়। যদি পেছনের দেয়ালে ডিফিউশন ব্যবহারের আগ্রহ থাকে, সে ক্ষেত্রে ছড়িয়ে পড়া শব্দতরঙ্গের মিলিয়ে যাওয়ার জন্য বেশ কিছুটা জায়গা প্রয়োজন হবে। এ জন্যও দৈর্ঘ্যরে বাকি ৬২% কাজের জায়গার পেছনে রাখা ভালো।
৩৮% এর এই নিয়ম মেনে প্রত্যাশিত সাউন্ড কোয়ালিটি পাওয়া না গেলে ৩৫% থেকে ৪৩% পর্যন্ত বিভিন্ন পয়েন্টে লিসেনিং পজিশন ঠিক করে দেখা যেতে পারে যে পজিশন ভালো হচ্ছে কি না। কোনোভাবেই ৫০% বা তার বেশি অথবা ২৫% বা তার কম দৈর্ঘ্যরে পয়েন্টে লিসেনিং পজিশন নেওয়া ঠিক হবে না। বিভিন্ন পয়েন্টের ফ্রিকোয়েন্সি রেসপন্স মেপে কোনটা সবচেয়ে ভালো, তা বোঝা যায়। রুম ইকিউ উইজার্ড নামের একটি ফ্রি সফটওয়্যার ব্যবহার করে এ ধরনের পরীক্ষাগুলো করা যেতে পারে।
স্টেপ ২ স্পিকার ও মনিটর স্থাপন
লিসেনিং পজিশনের সাপেক্ষে জায়গামতো স্পিকার বসানো হোম স্টুডিওর জন্য আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সহজ সূত্র হলো, শ্রোতা এবং দুটি স্পিকার একটি সমবাহু ত্রিভুজের তিন কৌণিক বিন্দুতে থাকতে হয়। তবে শ্রোতার অবস্থানের কৌণিক বিন্দুটি (যা ‘রেফারেন্স পয়েন্ট’ হিসেবে বিবেচ্য) সেটি মাথার একটু পেছনে ধরতে হয়। অভিজ্ঞরা তা মাথার ১৬ ইঞ্চি পেছনে রেফারেন্স পয়েন্ট হিসাব করার পরামর্শ দিয়েছেন। রেফারেন্স পয়েন্ট থেকে সোজা সামনে তাকিয়ে দুই পাশে দুটি রেখা কল্পনা করতে হয়। নাক বরাবর সরলরেখার সাপেক্ষে ডানে ও বামে ৩০ ডিগ্রিতে এই রেখা দুটি থাকবে। ডান ও বাম স্পিকার এই সরলরেখা দুটির ওপর স্থাপন করতে হয়, যেন সে দুটির অবস্থানবিন্দু ও রেফারেন্স পয়েন্ট মিলে একটি সমবাহু ত্রিভুজ হয়। দুয়ের বেশি স্পিকার স্থাপনের ক্ষেত্রে রেফারেন্স পয়েন্টকে কেন্দ্রবিন্দু ধরে একটি বৃত্ত কল্পনা করে তার পরিধি বরাবর স্পিকারগুলো এমনভাবে বসাতে হয়, যেন একটি আরেকটি থেকে ৬০ ডিগ্রি কৌণিক অবস্থানে থাকে।
স্টুডিও মনিটরটির ফ্লোর থেকে কমপক্ষে ৪৭ ইঞ্চি উপরে থাকতে হবে (মনিটরের উচ্চতাসহ)। আরেকটা ব্যাপার মনে রাখা জরুরি, স্পিকারের টুইটার যেন ঘরের দেয়ালের উচ্চতা বরাবর মাঝখানের বিন্দুতে না থাকে। এ ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ ফ্লয়েড টুল বসে থাকা অবস্থায় শ্রোতার কান যে অবস্থানে থাকে, তার থেকে দুই ফুট ওপরে স্পিকারের অবস্থান ফিক্স করতে পরামর্শ দিয়েছেন।
স্টেপ ৩: রুম সাউন্ডপ্রুফ করা
গত পর্বে রুম সাউন্ডপ্রুফ করার জন্য কী করতে হবে, তা বলা হয়েছিল। সহজ কথা, রুমে যেন বাইরে থেকে শব্দ ঢুকতে না পারে, সে জন্য দরজা জানালার ফাঁকা অংশ ও অন্য যে যে দিক দিয়ে শব্দ ঢুকতে পারে, সেগুলো বন্ধ করতে হবে। ফোমের টুকরো বা রাবারের স্ট্রিপ ফাঁকা স্থানগুলোর উপর লাগিয়ে শব্দের প্রবেশ বন্ধ করা যেতে পারে। অপেক্ষাকৃত কম কোলাহলময় রুম হোম স্টুডিওর জন্য বেছে নেওয়াটাই ভালো হবে।
স্টেপ ৪: শব্দের প্রতিফলন রোধ
রুমের ভেতরে যদি শব্দের প্রতিফলন হতে থাকে, তাহলে ভালো মানের রেকর্ডিং কখনোই সম্ভব হবে না। প্রতিফলন ঠেকাতে ৪ থেকে ৬টি অ্যাকুস্টিক ফোম প্যানেল লাগবে, যে প্যানেলগুলো দিয়ে রেকর্ডিংয়ের মান নিশ্চিত করার এবজর্বশন প্যানেল তৈরি হবে। তবে আরও ভালো রুম অ্যাকুস্টিকের জন্য লাগবে বেজ ট্র্যাপ ও ডিফিউজার।
রুমের যেখানে তিনটি দেয়াল মিলিত হয়েছে, সে কোণগুলোকে বলা হয় ফার্স্ট রিফ্লেকশন পয়েন্ট। সেখানে অ্যাকুস্টিক প্যানেল বসাতে হয়। মিনিমাম ২ ইঞ্চি পুরু করে, তবে ৪-৬ ইঞ্চি পুরুত্ব হলে সবচেয়ে ভালো কাজ করবে। প্যানেল বসানোর সময় দেয়াল থেকে সামান্য একটু ফাঁকা রাখা অর্থাৎ এয়ার গ্যাপ রাখা ভালো। যদি সম্ভব হয় তাহলে রুমের প্রতি কোণেই সিলিং থেকে ফ্লোর পর্যন্ত অ্যাকুস্টিক প্যানেল বসালে ভালো ফল পাওয়া যাবে। এরপরের কাজ হচ্ছে রুমের সিলিং যেন শব্দ প্রতিফলন না করে, সে ব্যবস্থা করা। এ উদ্দেশ্যে লিসেনিং পজিশনের ঠিক উপরে যতখানি সম্ভব জায়গাজুড়ে এবজর্বশন প্যানেল যুক্ত করতে হবে। এটাকে বলা হয় এবজর্বটিক সিলিং ক্লাউড। তা বসানো হয়ে গেলে ওয়ার্ক স্টেশন বা ডেস্ক বরাবর দুই পাশের দেয়ালে একই রকম অবস্থানে ফোম প্যানেল স্থাপন করতে হয়। এই তিন স্থানের প্যানেল রুমের ভেতরের শব্দের প্রতিফলন বেশ ভালোভাবেই রোধ করবে। এটা ঠিক যে রুমের দেয়ালের যত বেশি অংশের ওপর এবজর্বশন প্যানেল বসানো যাবে, শব্দের প্রতিধ্বণি না হওয়া তত বেশি ভালোভাবে নিশ্চিত হবে। কিন্তু ওপরের তিনটি অবস্থানে প্যানেল থাকাটা শুরুর জন্য যথেষ্ট।
কিন্তু তারপরেও একটা সমস্যা থেকে যেতে পারে। শুধু এবজর্বশন প্যানেল থাকলে, স্পিকারে কিছু শোনার সময়, সেই শব্দ নিষ্প্রাণ মনে হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়। এই সমস্যা এড়াতে বেজ ট্র্যাপ আর ডিফিউজার ব্যবহার করা যেতে পারে। লিসেনিং পয়েন্টের পেছনের দিকের দেয়ালের মাঝামাঝি জায়গাতে বেজ ট্র্যাপ ইনস্টল করা যেতে পারে। লিসেনিং পজিশন থেকে পেছনের দেয়াল যদি ১০ ফুট বা ৩ মিটারের বেশি দূরে হয়, তাহলে সেই দেয়াল বরাবর সিলিংয়ে ডিফিউজার লাগানোর প্রয়োজন হবে। আরও ভালো আউটপুট পেতে বাড়তি হিসেবে সামনের দিকের দেয়ালের ডান ও বাম কোণসংলগ্ন সিলিংয়ে ডিফিউজার বসানো যেতে পারে।
নিচে তিনটি রুম অ্যাকুস্টিক ট্রিটমেন্ট লে আউট দেওয়া হলো। প্রথমটিতে আছে ন্যূনতম দরকারি এবজর্বশন প্যানেল ও বেজ ট্র্যাপ, মাঝের লেআউটে মোটামুটি ভালো অ্যাকুস্টিকের জন্য প্রয়োজনীয় এবজর্বশন প্যানেল ও বেজ ট্র্যাপ আর শেষ লে আউটে আছে এবজর্বশন প্যানেল, ডিফিউজার ও বেজ ট্র্যাপ (পেছনের দেয়ালের সঙ্গে সিলিংয়ে লাগানো ডিফিউজারের নিচে থাকায় লে আউটে দৃশ্যমান নয়), যা একদম প্রফেশনাল কোয়ালিটির রুম অ্যাকুস্টিক নিশ্চিত করে।
ভালো রুম অ্যাকুস্টিক রক্ষা করার জন্য দরকারি কিছু টিপস এখানে দেওয়া হলো।
ফার্স্ট রিফ্লেকশন পয়েন্টে এবজর্বার লাগিয়ে রুম অ্যাকুস্টিক ট্রিটমেন্ট শুরু করা জরুরি।
সিলিং ও চার দিকের দেয়ালেই কিছুটা হলেও ট্রিটমেন্ট রাখা ভালো।
দেয়াল বা সিলিংয়ের বিশাল জায়গা যেন খালি না থাকে, সেদিকে খেয়াল রাখা দরকার।
প্যানেল বসানোর ক্ষেত্রে ডান ও বাম দিকের দেয়ালে সিমেট্রি রক্ষা করতে হবে, মানে একদিকের দেয়ালে যেখানে প্যানেল বসানো হবে, তার বিপরীত দিকের দেয়ালেও একই অবস্থানে প্যানেল বসাতে হবে।
মেঝেতে কার্পেট ব্যবহার না করাই ভালো। তবে লিসেনিং পজিশনের নিচে গোল মাদুর রাখা যেতে পারে। এটি ফ্লোরের রিফ্লেকশন রোধ করতে সহায়তা করবে।
ছবি: লেখক