ফিচার I বিশেষায়িত অর্থসেবা
নারী উদ্যোক্তাদের জন্য এগিয়ে এসেছে দেশের বিভিন্ন ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠান। সহজ শর্তে ঋণ নিয়ে। শহুরেদের জন্য যেমন, প্রান্তিক নারীর উন্নয়নেও
সিটি ব্যাংকের ‘সিটি আলো’
নারীদের জন্য সিটি ব্যাংক এনেছে বিশেষায়িত ব্যাংক সেবা ‘সিটি আলো’। এর আওতায় নারীরা সহজেই সব ধরনের আর্থিক সুবিধা পাবেন। পাশাপাশি মিলবে বাড়তি কিছু সুযোগ। নারীদের মধ্যে যারা উদ্যোক্তা, চাকুরে, গৃহবধূ ও পেশাজীবী—তারা সিটি আলোয় নানান সেবা গ্রহণ করতে পারবেন। এগুলো বিনা মূল্যে বিমাকৃত। একই সঙ্গে থাকবে একটি হেলথ কার্ড, যার মাধ্যমে বাংলাদেশের বিভিন্ন ক্লিনিক ও হাসপাতালে বিশেষ ছাড় পাওয়া যাবে।
সিটি আলোতে নারী গ্রাহকেরা সহজ শর্তে ডিপিএস অ্যাকাউন্ট করতে পারেন। এর ফলে স্বল্পসুদে ও নামমাত্র প্রসেসিং ফির মাধ্যমে নেওয়া যায় পারসোনাল লোন, অটো লোন, মোটরসাইকেল লোন, হোম লোন অথবা এসএমই লোন। মোটরসাইকেল লোনের সঙ্গে ফ্রি ড্রাইভিং প্রশিক্ষণের সুবিধাও রয়েছে। এ ছাড়া নারী উদ্যোক্তাদের আর্থিক বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিতে এর আওতায় রয়েছে ‘সিটি আলো সার্টিফিকেশন প্রোগ্রাম’। এই উদ্যোগের সহযোগী নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় ও ইন্টারন্যাশনাল ফিন্যান্সিয়াল করপোরেশন (আইএফসি)। এই সেবার পাশাপাশি নারী গ্রাহকদের জন্য সিটি ব্যাংকে রয়েছে বিশেষ ওয়েবসাইট। এর মাধ্যমে গ্রাহকেরা বিভিন্ন সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান, নারী উদ্যোক্তা ও বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন।
ব্র্যাক ব্যাংকের প্রথম ব্যাংকিং অ্যাপ
শুধু নারী গ্রাহকদের জন্য ‘তারা মোবাইল ব্যাংকিং অ্যাপ্লিকেশন’ নামে একটি ডিজিটাল ব্যাংকিং ব্যবস্থা রয়েছে ব্র্যাক ব্যাংক লিমিটেডের। অ্যাপটি ব্যবহার করে নারী গ্রাহকেরা পার্টনার আউটলেট থেকে ২৪ ঘণ্টা বিশেষ ব্যাংকিং সুবিধা উপভোগ করতে পারেন। তা ছাড়া এর মাধ্যমে তারা সেভিংস অ্যাকাউন্ট ও লোন প্রোডাক্টের আবেদনের সুযোগ রয়েছে। পাশাপাশি গ্রাহকেরা ব্যাংকিং সংশ্লিষ্ট সেবার জন্য ২৪ ঘণ্টা যেকোনো অনুসন্ধান করতে পারেন। এমনকি নারী গ্রাহকেরা পার্টনার রেস্টুরেন্ট, স্বাস্থ্য, সৌন্দর্য ও লাইফস্টাইল ব্র্যান্ডের ডিসকাউন্ট অফারের নোটিফিকেশনও পাচ্ছেন। এটিএম ও ব্রাঞ্চ লোকেশনের সন্ধান, তারা ডিপোজিট ও লোন প্রোডাক্ট সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য এবং তারা ইভেন্টে আমন্ত্রণসহ আরও অনেক তথ্যই এই অ্যাপের মাধ্যমে জানিয়ে দেওয়া হয় গ্রাহকদের। এই অ্যাপ্লিকেশনের প্রধান একটি সুবিধা হলো, এর সাহায্যে গ্রাহকেরা নিকটস্থ আউটলেটের অবস্থান সম্পর্কে জানতে পারেন।
এবি ব্যাংকের ‘সম্পূর্ণা’
বাংলাদেশের নারীরা এখন নিজ যোগ্যতায় চিকিৎসক, প্রকৌশলী, ব্যাংকার, আইনজীবী, পাইলটসহ সব পেশায় সাফল্যের প্রমাণ রেখে চলেছেন। সাহসী এসব নারীর জন্য ‘সম্পূর্ণা’ নামের একটি বিশেষ সঞ্চয়ী হিসাব রয়েছে এবি ব্যাংকে। গৃহিণী, নারী উদ্যোক্তা, চাকরিজীবী কিংবা স্বনিয়োজিত যেকোনো পেশার নারীর এ বিশেষ হিসাব খুলতে পারেন। এতে সর্বোচ্চ ৭ শতাংশ পর্যন্ত লভ্যাংশ দেওয়া হয়। এতে রয়েছে আরও বেশ কিছু সুবিধা। যেমন এই অ্যাকাউন্টধারীরা ফ্রি ডেবিট কার্ড, ১ লাখ ৮৫ হাজার টাকা পর্যন্ত ফ্রি বিমা সুবিধা পাবেন। এ ছাড়া এই হিসাব পরিচালনায় নেই কোনো খরচ।
নারী উদ্যোক্তাদের পাশে
নারী উদ্যোক্তাদের সহায়তা করছে দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো। তাদের সহায়তা করতে বিশেষ ঋণ প্রকল্পও তৈরি করা হয়েছে। যদিও ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে উদ্যোক্তাদের অনেক হয়রানির শিকার হতে হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। তবে নারীরা ঋণ নিতে পারছেন। তাদের জন্য বেশ কিছু ব্যাংকের রয়েছে বিশেষ প্রকল্প।
অগ্রণী ব্যাংক
নারী উদ্যোক্তাদের জন্য অগ্রণী ব্যাংকে দুটি ঋণ কর্মসূচি চালু আছে। নারী অগ্রণী ও মহিলাদের ঋণদান কর্মসূচি। এসএমই ঋণ প্রকল্পের আওতায় রয়েছে নারী অগ্রণী। এতে কোনো প্রকল্প স্থাপন করতে নারীদের মোট ব্যয়ের ৭৫ শতাংশ পর্যন্ত ব্যাংকঋণ দিয়ে থাকে। বাকি ২৫ শতাংশ উদ্যোক্তাদের দিতে হয়। এতে সুদের হার ৯ শতাংশ। ১ লাখ টাকা থেকে ১ কোটি টাকা ঋণ দেওয়া হয়। এ ক্ষেত্রে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণ নিতে কোনো প্রকার জামানত দিতে হয় না।
সোনালী ব্যাংক
সোনালী ব্যাংকে রয়েছে এসএমই স্কিম ‘নিপুণা’। এতে ৯ শতাংশ সুদে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত জামানতবিহীন ঋণ দেওয়া হয়। এ ছাড়া ব্যাংকটির আরও ৫টি ঋণ প্রকল্প রয়েছে। সেগুলোর একটি শহরের ক্ষুুদ্র নারী উদ্যোক্তাদের জন্য। এতে সর্বোচ্চ ১২ লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণ দেওয়া হয়। সুদের হার ১২ শতাংশ। বাকি ৪টি পল্লী উন্নয়ন ঋণ কর্মসূচির আওতায় পরিচালিত হয়। যেমন, জাগো নারী ঋণ কর্মসূচিতে ১১ শতাংশ সুদে সর্বোচ্চ ২৫ হাজার টাকা পর্যন্ত জামানতবিহীন ঋণ দেওয়া হয়। বাকি প্রকল্পগুলোতে ১০ হাজার থেকে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত ঋণ দেওয়া হয়। সুদের হার ৯ থেকে ১২ শতাংশ।
মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক
নারী উদ্যোক্তাদের জন্য ব্যাংকটির একটি প্রকল্প রয়েছে। এমটিবি গুণবতী নামে এর ব্র্যান্ডিং হয়েছে। ৯ শতাংশ সুদে এর আওতায় ঋণ দেওয়া হয়। ঋণের পরিমাণ ৫০ হাজার থেকে ১৫ লাখ। তা পাওয়ার জন্য কমপক্ষে ১ বছরের ব্যবসায়িক অভিজ্ঞতা প্রযোজ্য।
মার্কেন্টাইল ব্যাংক
অনন্যা নামে নারী উদ্যোক্তাদের জন্য একটি এসএমই ঋণ প্রকল্প রয়েছে ব্যাংকটির। ৫০ হাজার থেকে ৫০ লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণ দেওয়া হয়। সুদের হার ৯ শতাংশ। এর মধ্যে ৮ লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণের বিপরীতে কোনো জামানতের প্রয়োজন নেই।
ইস্টার্ন ব্যাংক
নারীদের জন্য ইস্টার্ন ব্যাংকে বহুবিধ প্রকল্প রয়েছে। সঞ্চয়, ঋণ, কার্ডসহ নানা ধরনের বিশেষ সেবা দেওয়া হচ্ছে নারীদের। এগুলোতে বিশেষ ছাড়ও পাচ্ছে। নারী উদ্যোক্তাদের জন্য ২ লাখ থেকে ২৫ লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণ দেওয়া হয়। সুদের হার ১০ শতাংশ। নারী উদ্যোক্তারা যেকোনো ধরনের ব্যবসার জন্য এ ঋণ নিতে পারেন। আমানতের ক্ষেত্রেও তারা বাড়তি সুবিধা পেয়ে থাকেন।
যমুনা ব্যাংক
যমুনা নারী উদ্যোগ নামে ব্যাংকটির একটি ঋণ প্রকল্প রয়েছে। এর আওতায় ৩ লাখ থেকে ৫০ লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণ দেওয়া হয়। সুদের হার ৯ শতাংশ।
ব্র্যাক ব্যাংক
ব্যাংকটির একাধিক প্রকল্প রয়েছে নারী উদ্যোক্তাদের জন্য। এসব প্রকল্পে সর্বোচ্চ ১০ লাখ টাকা ঋণ দেওয়া হচ্ছে। সব ধরনের ব্যবসার জন্য। সুদের হার ৯ থেকে ১০ শতাংশ। কোনো জামানতের প্রয়োজন হয় না।
ট্রাস্ট ব্যাংক
এই ব্যাংক ছোট পরিসরের ব্যবসার জন্য নারীদের দিচ্ছে ১ লাখ থেকে ২৫ লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণ। মাঝারি ও বড় ব্যবসার জন্য দিচ্ছে ৫০ লাখ থেকে দেড় কোটি টাকা পর্যন্ত ঋণ। সুদের হার ৯ থেকে ১০ শতাংশ। ঋণের পরিমাণ ২৫ লাখের কম হলে জামানত লাগবে না। তবে এর বেশি হলে লাগবে।
ব্যাংক এশিয়া
সুবর্ণ নামে নারী উদ্যোক্তাদের জন্য একটি ঋণ প্রকল্প রয়েছে ব্যাংকটির। এতে জামানত ছাড়া ২ লাখ থেকে ৮ লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণ দেওয়া হয়। ৮ লাখ থেকে ৫০ লাখ পর্যন্ত নিলে জামানত দিতে হয়। সুদের হার নির্ভর করে ঋণের পরিমাণের ওপর।
এবি ব্যাংক
নারী উদ্যোক্তাদের জন্য অপরাজিতা ঋণ নামের প্রকল্প রয়েছে এই ব্যাংকের। এ প্রকল্পের আওতায় ২৫ লাখ টাকা পর্যন্ত জামানতবিহীন ঋণ পাবেন নারী উদ্যোক্তারা। সর্বোচ্চ ৫০ লাখ টাকা ঋণ দিচ্ছে ব্যাংকটি। পরিমাণ নির্ভর করে ব্যবসার ওপর। সুদের হার ১০ শতাংশ।
আইএফআইসি ব্যাংক
প্রত্যাশা এবং প্রান্ত নারী নামে বিশেষ দুটি প্রকল্প নিয়ে এসেছে ব্যাংকটি। প্রত্যাশা প্রকল্পে ২৫ লাখ টাকা পর্যন্ত জামানতবিহীন ঋণ দেওয়া হয়। এ ছাড়া সর্বোচ্চ ৫০ লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণ দেওয়া হয় এ প্রকল্পের আওতায়। সুদের হার ৯ শতাংশ। প্রান্ত নারী প্রকল্পের আওতায় গ্রামীণ প্রান্তিক নারীদের ১ লাখ থেকে ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত জামানতবিহীন ঋণ দেওয়া হয়। এ ছাড়া ২০ লাখ টাকা পর্যন্ত জামানতযুক্ত ঋণ দেওয়া হয় এ প্রকল্পে।
মাইডাস ফাইন্যান্সিং লিমিটেড
দীপ্ত নামে নারী উদ্যোক্তাদের বিশেষ ঋণ কর্মসূচি নিয়ে এসেছে মাইডাস ফাইন্যান্সিং লিমিটেড। এতে ৯ শতাংশ সুদে ৫০ হাজার থেকে ৫০ লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণ দেওয়া হয়। ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত তা জামানতবিহীন। ঋণপ্রাপ্তির জন্য কমপক্ষে ২ বছরের ব্যবসায়িক অভিজ্ঞতার প্রয়োজন হয়।
বিআইএফএফএল
শৈলী নামে ঋণ প্রকল্প নিয়ে হাজির হয়েছে বাংলাদেশ ইনফ্রাস্ট্রাকচার ফাইন্যান্স ফান্ড লিমিটেড। ব্যবসায়ের আকারের ওপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠানটি ৭ থেকে ৮.৫ শতাংশ সুদে ক্ষুদ্র, মাঝারি এবং বৃহৎ বিনিয়োগ করে থাকে।
আইআইডিএফসি
ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট ফাইন্যান্স কোম্পানি লিমিটেড মহিলা উদ্যোক্তা ঋণ নামে প্রকল্প নিয়ে এসেছে। এতে বিভিন্ন মেয়াদে ৫ লাখ থেকে ২ কোটি টাকা পর্যন্ত ঋণ দেওয়া হয়। সুদের হার মেয়াদ এবং ঋণের পরিমাণের ওপর নির্ভর করে।
আব্দুল্লাহ মামুন
ছবি: ইন্টারনেট