এডিটরস কলাম I নারীবাদ ও কিছু কথা
আজকাল লক্ষ করছি, নারীর সামগ্রিক ও মূল ইস্যুকে পাশ কাটিয়ে প্রাধান্য পাচ্ছে গৌণ বিষয়গুলো। জৈবিক এমন কিছুতে জোর দেওয়া হচ্ছে, যেগুলো মানুষ হিসেবে নারীর বিকাশের উপযুক্ত নয়, তাদের জন্য নিরাপদও নয়। পাশ্চাত্য এটা ইতিমধ্যে বুঝতে পেরেছে। পারিবারিক মূল্যবোধে ফিরে যাচ্ছে সবাই। কেননা মানুষকে শেষ পর্যন্ত নিজের কাছেই আসতে হয়
১.
‘দ্য ফেমিনিন মিস্টিক (১৯৬৩) গ্রন্থে বেটি ফ্রাইডেন সে সময়ের শিক্ষিত নারীর অসন্তোষ ও স্বপ্নভঙ্গ সম্পর্কে নিজের বক্তব্য উপস্থাপন করেন। লেখেন, যেসব শিক্ষিত নারী আশানুরূপ চাকরি পাননি, তাদের গার্হস্থ্যকর্মে (রান্না ও ঘর গোছানো) বাধ্য করা হয়েছে। নারীর জীবনে পূর্ণতা আসে ‘সন্তান প্রতিপালনে এবং গৃহকর্ম সম্পাদনে’, এই ধারণার তীব্র সমালোচনা করেন তিনি। ওই গ্রন্থে তার বক্তব্য, নারী একটি ভ্রান্ত বিশ্বাস ও ব্যবস্থার শিকার, যা তাদের স্বামী ও সন্তানের মধ্যে নিজেদের পরিচয় ও অর্থ খুঁজতে বাধ্য করে। ফলে আত্মপরিচিতি বলে তার কিছু থাকে না। সমাজে নারীর অবস্থাসম্পর্কিত নতুন এই ব্যাখ্যা নারীমুক্তি আন্দোলনের পথ দেখিয়েছিল গত শতাব্দীর ষাটের দশকে। তাতে নারী-পুরুষ সমতার প্রশ্নে কিছু দাবি উত্থাপিত হয়। সেগুলোর মধ্যে ছিল পুরুষের সমান পারিশ্রমিক, আইনগত অধিকার, পরিবার পরিকল্পনা গ্রহণের স্বাধীনতা ইত্যাদি। নারীমুক্তির প্রশ্নে দৈহিক স্বাধীনতা ও চলাফেরার অধিকার, ভোটাধিকার, সরকারি পদলাভের সুযোগ, কাজ করার অধিকার, ন্যায্য ও সমান বেতন, সম্পত্তির মালিকানা, শিক্ষা, সামরিক বাহিনীতে অংশগ্রহণের অধিকার, আইনগত চুক্তি; সর্বোপরি, বৈবাহিক, পিতৃত্ব-মাতৃত্ব ও ধর্মীয় অধিকার—এই বিষয়গুলো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।
২.
এটা খুব আশাব্যঞ্জক যে, নারীবাদী সংবেদনশীলতার প্রতি সমর্থন জানিয়েছে জাতিসংঘ। বেশ আগেই, ১৯৪৮ সালে। তবে তা বাস্তবে রূপ নেয় ১৯৭৫ সালে। ওই বছর থেকে জাতিসংঘ নারীর বিভিন্ন বিষয়ে ধারাবাহিক আন্তর্জাতিক সম্মেলন আহ্বান করেছে। মেক্সিকো সিটিতে অনুষ্ঠিত প্রথম বিশ্ব সম্মেলনে আন্তর্জাতিক নারী দিবস ঘোষণা করা হয় এবং ১৯৭৫ থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত নারী উন্নয়নের দশক হিসেবে পালন করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এই দশ বছরে বিভিন্ন কাজের মধ্য দিয়ে বিশ্বব্যাপী নারীরা উপলব্ধি করতে সক্ষম হন যে, নারীবাদ একটি অভিন্ন ও স্থির কোনো মতবাদ নয়; এই মতবাদে বিভিন্ন অঞ্চল, শ্রেণি, জাতি ও দেশের নারীর ভিন্ন ভিন্ন স্বার্থ ও উদ্বেগকে স্বীকার করতে হবে এবং মূল্য দিতে হবে। তাদের বিভিন্ন চাহিদায় সাড়া দিতে হবে।
৩.
এবার বাংলাদেশের কথা বলি। সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির দিক থেকে এ দেশের নারী পাশ্চাত্যের চেয়ে ভিন্ন। তত্ত্বীয় নয়, সহজাত নারীবাদের সৃষ্টি হয়েছে এ দেশে, যা পাশ্চাত্যের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন মনে করতেন, নারী সামাজিক জীব; তাকে নিজের স্বরে কথা বলতে হবে, অন্য কেউ নারীর হয়ে বলবে না। রোকেয়া পাশ্চাত্য নারীবাদ সম্পর্কে সচেতন ছিলেন না; ‘সুলতানার স্বপ্ন’ (১৯২৪) বইয়ে তিনি নারী পরিচালিত সমতাভিত্তিক ও শোষণমুক্ত কাল্পনিক নারীবিশ্বের চিত্র তুলে ধরেছেন। তার বিভিন্ন রচনার মধ্য দিয়ে সমাজের কুসংস্কার, অবরোধ প্রথা, বাল্যবিবাহ ও বহুবিবাহ, ধর্মীয় রক্ষণশীলতা, নারীর প্রতি সামাজিক অবমাননা ইত্যাদির বিরোধিতা ব্যক্ত হয়েছে।
৪.
বেটি ফ্রাইডেনের প্রসঙ্গ দিয়ে লেখাটি শুরু করেছিলাম। বলা দরকার, তার চিন্তা থেকে এখনকার নারীবাদীরা অনেকখানি সরে এসেছেন। হয়তো এই কারণে যে, দাবিগুলোর অধিকাংশই মিটে গেছে বা সমাজে এমন বদল ঘটেছে যে, সেগুলোর কোনো কোনোটি আজ আর প্রাসঙ্গিক নয়। কিন্তু অবস্থা কি পাল্টেছে সত্যিকার অর্থে? এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, পৃথিবীর সব কাজের ৬৬ শতাংশ নারীই করে, কিন্তু মোট বৈশ্বিক আয়ের মাত্র ১০ শতাংশ তারা পায়। তাদের সম্পত্তির পরিমাণ আরও করুণ, মাত্র ১ শতাংশ। কেননা তাদের আয়ের প্রায় পুরোটাই চলে যায় পরিবারের পেছনে। অর্থনৈতিক মুক্তি স্বাধীনতার প্রধান শর্ত—সেটা আজও নারীর অগম্য রয়ে গেছে।
৫.
ফেমিনিজম বা নারীবাদের ১৪০ বছর হলো। এই সংবেদনশীলতা থেকে জন্ম নিয়েছেন অনেক লেখক, চিত্রকর, দার্শনিক ও বুদ্ধিজীবী। ভার্জিনিয়া উলফ, সিমন দ্য ব্যেভোয়া, ফ্রিদা কাহলো, নাওমি উলফ প্রমুখ। এ রকম বহু আলোকিত দিক নারীবাদের রয়েছে। কিন্তু এই মতবাদের নামে একধরনের চর্চা আজকাল লক্ষ করছি, যাতে নারীর সামগ্রিক ও মূল ইস্যুকে পাশ কাটিয়ে প্রাধান্য পাচ্ছে গৌণ বিষয়গুলো। জৈবিক এমন কিছুতে জোর দেওয়া হচ্ছে, যেগুলো মানুষ হিসেবে নারীর বিকাশের উপযুক্ত নয়, তাদের জন্য নিরাপদও নয়। পাশ্চাত্য এটা ইতিমধ্যে বুঝতে পেরেছে। পারিবারিক মূল্যবোধে ফিরে যাচ্ছে সবাই। কেননা মানুষকে শেষ পর্যন্ত নিজের কাছেই আসতে হয়। সেই ঠিকানার নাম পরিবার।
ছবি: ইন্টারনেট