ফিচার I ভর্তা
সাধারণ খাবারও উপভোগ্য হয়ে উঠতে পারে। ভর্তা করে, মসলাযোগে। লতাপাতা থেকে মাছ-মাংস, বীজ, এমনকি খোসাও ভর্তা করা যায়। বাঙালি এসবের স্বাদ নিচ্ছে বহু আগে থেকেই
বাংলা অভিধানে ভর্তা শব্দের দুটি অর্থ। প্রথমটি, সাধারণত ভাতের সঙ্গে মেখে খাওয়া হয় এমন তেল-মসলা সহযোগে প্রস্তুত সেদ্ধ বা পোড়ানো আলু, বেগুন প্রভৃতির মন্ড। দ্বিতীয়টি, যে প্রতিপালন করে; স্বামী, পত্নী। অন্তর্জালের বিভিন্ন ফিচারে ভর্তার মানে লেখা আছে ‘দলাইমলাই’, চিড়েচ্যাপ্টা করা। অর্থ যা-ই হোক, এটি আহার্য তৈরির ধরন। বাঙালির খাদ্যাভ্যাসে এর উপস্থিতি পুরোনো। তবে ভর্তার পূর্ণ বিকাশ ঘটেছে এই জাতির রন্ধনশৈলীতে। বঙ্গে এর চল শুরুর সময়টি অজানা। বাংলা অভিধানসূত্রে ভর্তার মানে যদি আলু ও বেগুনের ম-ই হয়, তাহলে এই সবজিজোড়া প্রচলনের সময় নির্ণয় করে খাদ্যতালিকায় এটির যুক্ত হওয়ার দিনক্ষণ পাওয়া যাবে।
আলু শব্দটি এসেছে দক্ষিণ পেরু থেকে। সেখানে, ইনকা সভ্যতায় চাষের জমিকে ‘আলু’ বলা হতো। ষোড়শ শতাব্দীর প্রথম দিকে স্প্যানিশরা আন্দিজ পর্বত অঞ্চলে পৌঁছায়। সেখানে এই সবজি ইউরোপীয়রা প্রথম দেখে। তাদের মাধ্যমে পরবর্তীকালে সেটি বিশ্বে ছড়িয়েছে। কলম্বাসের আবিষ্কৃত সমুদ্রপথে আলু ইউরোপের বাজারে আসে। ভারত উপমহাদেশে নবাবি আমলের সময়ে এটির প্রবেশ ঘটে ডাচ ব্যবসায়ীদের বদৌলতে। ধারণা করা হয়, তখন থেকে এ অঞ্চলে আলু ভর্তার প্রচলন।
বেগুন নতুন সবজি নয়। এটি অস্ট্রিকদের থেকে এসেছে। আনুমানিক পাঁচ হাজার বছর ধরে এটি খাচ্ছে বাঙালি। হতে পারে বেগুন ভর্তার সূচনা তখন থেকে। তবে এটিই বাঙালির সর্বপ্রথম ভর্তা নয়। অনুমান করা হয়, এই জাতি প্রথম ভর্তা করেছিল শুঁটকি। নদীবিধৌত অঞ্চল বলে এখানে মাছের প্রাচুর্য ছিল। রোদে শুকিয়ে তা সংরক্ষণ করা হতো। মাছের বিভিন্ন পদ খেত বাঙালিরা। হয়তো ভর্তা করেও। আনুমানিক পাঁচ হাজার বছর আগে। নীহাররঞ্জন রায়ও বাঙালীর ইতিহাস বইয়ে এ জাতির ‘টাটকা ও শুকনা মৎস্যাহারের অনুরাগে’র উৎপত্তি দ্রাবিড়দের মাধ্যমে শুরু হয়েছে বলে মনে করেন।
ভর্তার সঙ্গে শ্রেণিবৈষম্যের প্রশ্ন জড়িত। এটিকে অপেক্ষাকৃত দরিদ্র লোকদের খাবার হিসেবে বিবেচনা করা হতো। বাংলার চাষিরা অসচ্ছলতার কারণে ভাতের সঙ্গে কিছু একটা সবজি ভর্তা সহপদ হিসেবে খেতেন। এই বাস্তবতা আজও রয়েছে। তবে এখন এটি ধনী-গরিব সবারই প্রিয়। খাদ্যসংস্কৃতির অংশ হয়ে উঠেছে।
বাঙালির আহার্যের তালিকায় ভর্তার কতটি প্রকরণ আছে, হিসাব নেই। সাম্প্রতিক এক উৎসবে ভর্তার ১০৬টি পদ দেখা গেছে। ‘১০১ ভর্তা’ নামের একটি বইও প্রকাশিত হয়েছে। এটির প্রকরণ দিন দিন বাড়িয়েই চলেছে বাঙালি। বাদ যাচ্ছে না সবজির খোসাও। মিষ্টিকুমড়া থেকে শুরু করে পটোল ও লাউয়ের খোসাও যুক্ত হয়েছে। খাওয়া যায় শিমের ফুলও। মাছ ও শুঁটকি ভর্তা এখনো বাঙালির প্রাত্যহিক খাবার। আমিষ কিংবা নিরামিষ- সব ধরনের ভর্তাই খায় বাংলার ভোজনরসিকেরা। শুধু এটির জন্যই বিখ্যাত হয়েছে ঢাকার বেশ কিছু রেস্তোরাঁ। রাঁধুনিরা এখন অন্যান্য পদের মতোই এটিকে গুরুত্ব দেন। ভর্তার কিছু রেসিপি-
চালতার ভর্তা
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ফল। এটি দিয়ে রান্না ডাল রুচি বাড়ায়। আচার হিসেবেও খাওয়া হয়। খুব সহজেই করা যায় চালতার ভর্তা।
উপকরণ: চালতা, লবণ, চিনি, কাঁচা মরিচ কুচি, ধনেপাতা কুচি ও সরিষার তেল। সব পরিমাণমতো নিতে হবে।
প্রণালি: চালতাগুলো ফালি করে কেটে ছিলে নিতে হবে। পাটায় টুকরাগুলো কিছুটা থেঁতলে নিন। এরপর সামান্য ধুয়ে নিতে হবে। উপকরণগুলো ভালোভাবে মেশালেই তৈরি হবে চালতার ভর্তা।
বরই ভর্তা
আদি নিবাস আফ্রিকায়। এখন এশিয়াজুড়েই বরইয়ের উপস্থিতি। শুকিয়েও খাওয়া যায়। তাতে পুষ্টিগুণের পার্থক্য ঘটে না। এ ঋতুতে বরই মিলবে হাতের কাছে। কাঁচা-পাকা সবই উপাদেয়। স্বাদে বৈচিত্র্য আনতে ভর্তা করে খাওয়া যেতে পারে।
উপকরণ: বরই ১ কেজি, চিনি স্বাদমতো, হলুদগুঁড়া সামান্য, মরিচগুঁড়া প্রয়োজনমতো, টালা মৌরিগুঁড়া ১ টেবিল চামচ, টালা মেথিগুঁড়া ১ চা-চামচ, টালা কালোজিরা গুঁড়া আধা চা-চামচ, লবণ পরিমাণমতো, সরিষার তেল ২৫০ গ্রাম।
প্রণালি: বরই ধুয়ে পানি ঝরিয়ে নিতে হবে। তারপর বোঁটা ছাড়িয়ে রোদে এক দিন শুকাতে হবে। এবার হাত দিয়ে চেপে ফাটিয়ে নিন। চাইলে হামানদিস্তায় থেঁতলেও নিতে পারেন। হলুদগুঁড়া, মরিচগুঁড়া ও লবণ মেখে আরও এক দিন রোদে শুকিয়ে নিতে হবে। চিনি মেশান। মৌরি, মেথি, কালোজিরা ও সরিষার তেল ভালোভাবে মিশিয়ে নিলেই হয়ে যাবে বরই ভর্তা।
জলপাই ভর্তা
সুস্বাদু ও পুষ্টিকর ফল। এটির আচারের স্বাদ অনন্য। জলপাই দিয়ে টক ডাল রান্না করা যায়। কাঁচা খেতে খুব টক। তাই একটু মসলাযোগে ভর্তা করে খাওয়া চলে।
উপকরণ: জলপাই ৪টি, রসুনকুচি ১ চা-চামচ, শুকনা মরিচ, লবণ, চিনি, পাঁচফোড়ন ও সরিষার তেল প্রয়োজনমতো।
প্রণালি: সামান্য হলুদ মেশানো পানিতে জলপাই সেদ্ধ করে নিতে হবে। পানি ঝরিয়ে বীজ ছাড়িয়ে চটকে নিন। এবার তাতে চিনি ও লবণ মেশাতে হবে। সামান্য তেলে পাঁচফোড়ন ও রসুনকুচি ভুনা করে নিন। শুকনা মরিচ তাওয়ায় টেলে গুঁড়া করে নিতে হবে। সব উপকরণ জলপাইয়ের সঙ্গে ভালোভাবে মিশিয়ে নিন। শেষে সামান্য সরিষার তেল মেশাতে হবে।
কাঁচকলা ভর্তা
বাঙালির খাদ্যতালিকায় এই ফলের উপস্থিতি প্রাচীন। কাঁচা অবস্থায় এটি সবজি। তরকারি ছাড়াও এর ভর্তা মুখরোচক। তবে সে জন্য মসলাপাতি খুব ভালোভাবে মেশাতে হয়।
উপাদান: কাঁচা কলা কুচি ১ কাপ, কাঁচা মরিচ ৫টি, পেঁয়াজ ২ টেবিল-চামচ, রসুন ২ টুকরা, ধনেপাতা ২ টেবিল-চামচ, তেল ২ টেবিল-চামচ।
প্রণালি: কাঁচকলার সঙ্গে আধা চা-চামচ লবণ ও কাঁচা মরিচ মিশিয়ে সেদ্ধ করে নিতে হবে। সেদ্ধ কলা অল্প তেলে ভেজে নিন। তাতে সব উপকরণ মিশিয়ে বেটে নিতে হবে। হয়ে গেল কাঁচকলা ভর্তা।
কতবেল ভর্তা
খাদ্যশক্তিতে ফলটি কাঁঠাল ও পেয়ারার সমতুল্য। কতবেলে আমিষ আমের সাড়ে তিন গুণ, কাঁঠালের দ্বিগুণ, লিচুর তিন গুণ, আমলকী ও আনারসের চেয়ে চার গুণ বেশি।
উপকরণ: কতবেল ১টি, গুঁড়া মরিচ ১ চা-চামচ, রসুনকুচি ২ কোয়া, সরিষার তেল ১ চা-চামচ, লবণ স্বাদমতো, চিনি ১ চা-চামচ, ধনেপাতাকুচি ১ চা-চামচ।
প্রণালি: সব উপকরণ একসঙ্গে মিশিয়ে নিলেই হয়ে যাবে কতবেল ভর্তা।
ফুড ডেস্ক
ছবি: ইন্টারনেট