বিশেষ ফিচার I বাংলার নৌকা : মধ্যযুগ
একসময় নদীমাতৃক বাংলায় নৌকাই ছিল প্রধান বাহন। এই জলযানের একটা ইতিহাস নিশ্চয় রয়েছে। তবে অষ্টাদশ শতাব্দীর আগে সে সম্পর্কে খোঁজ নিতে গেলে বাংলা গীতিকবিতা, মঙ্গলকাব্য, পুঁথির আশ্রয় নিতে হয়। বাংলা সাহিত্যের প্রাচীন নিদর্শন চর্যাপদে নৌকার প্রসঙ্গ আছে, তবে রূপক অর্থে। পদকর্তা বলেছেন, সোনায় ভরে গেছে করুণা- নৌকা। রুপা রাখার সংকুলান হচ্ছে না। দাঁড় বেয়ে নৌকা মাঝগাঙে এগিয়ে গেল। আবার ডোম্বীপাদ রচিত চর্যাপদে পাটনী মেয়ের এটি চালানোর কথা প্রকাশ পাচ্ছে। ‘পারানী’ বা কড়ির বিনিময়ে নৌকা পারাপারের ইঙ্গিত স্পষ্ট। অন্য একটা চর্যায় বাণিজ্যতরীর ওপর জলদস্যুর আক্রমণের উল্লেখ থেকে স্পষ্ট, মধ্যযুগের বাংলায় নদীপথ কতটা গুরুত্ব পেত।
চর্যার সময়কাল পাল-সেন আমলেই। বিভিন্ন শিলালিপিতেও সেই সময়ের নৌকাকেন্দ্রিক বার্তা উঠে এসেছে। যেমন- নৌযোগ, নৌবাটক, নৌবাট, নৌদন্ডক, নৌবিতান শব্দগুলো। মধ্যযুগের সাহিত্যে বাংলার জলবায়ু, নদ-নদী ও নৌকার প্রসঙ্গ বর্ণিত হয়েছে মঙ্গলকাব্য, পদাবলী সাহিত্য, অনুবাদ সাহিত্য, চরিতকাব্য, নাথ সাহিত্য প্রভৃতি একাধিক ধারায়।
‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ কাব্যে কবি নৌকাখন্ডের শুরুতে এর নির্মাণকৌশল বর্ণনা করেছেন। কৃষ্ণ বিবিধ বিধানে কাঠ কেটে নিয়ে ‘দান্ডার পাতনে’র মাধ্যমে নৌকার শিরদাঁড়া স্থাপন করেন। তারপর ‘চারটি’ কাঠ চিরে এটি তৈরি হয়। ছিদ্র রোধের জন্য পাতলা কাঠ এবং দুই তক্তার মাঝের ফাঁক বন্ধে ব্যবহৃত হতো পাটজাতীয় বস্তু। নৌকাকে বানানো হতো কেবল দুজনের বহনক্ষমতা মাথায় রেখে।
মধ্যযুগে রচিত মঙ্গলকাব্যে বাংলার নদ-নদী গ্রামের সঙ্গে নৌকার বর্ণনা এসেছে। নৌবাণিজ্য, নৌবহর, নৌনির্মাণের কথাও আছে। যেমন বিজয়গুপ্তের ‘পদ্মপুরাণ’, বিপ্রদাস পিপলাইয়ের ‘মনসাবিজয়’, নারায়ণদেবের ‘পদ্মপুরাণ’, কেতকাদাস ক্ষেমানন্দের ‘মনসামঙ্গল’, জগজ্জীবন ঘোষালের ‘মনসামঙ্গল’, মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর ‘চন্ডীমঙ্গল’ ইত্যাদি।
চন্ডীমঙ্গলে বর্ণিত হয়েছে ধনপতির বাণিজ্যযাত্রা। বিজয়গুপ্তের মনসামঙ্গলে চৌদ্দ ডিঙায় বাণিজ্য ফাল্গুন মাসে হয়েছিল। নৌকার প্রথমেই ছিল মঙ্গলা তারপর চন্দ্রপাট, গঙ্গার চরণ, সিন্দুর কৌটা, হাসমাড়া, মগর, গৌরাঙ্গ, সমুদ্র উথাল, সুমন্ত বহাল, সঙ্কুচর, গরুড়, সিংহমুখ, চন্দ্ররেখা এবং সবশেষে চাঁদ সওদাগরের মধুকর।
এসব কাব্যের উদ্দেশ্যই ছিল লৌকিক দেবী মনসা, চন্ডী, ধর্মঠাকুরের মাহাত্ম্য বর্ণনা। মনসামঙ্গল ও চন্ডীমঙ্গলে নৌবাণিজ্য, চাঁদ সওদাগর, ধনপতি ও তার পুত্র শ্রীমন্তের কাহিনি উপস্থাপিত হয়েছে। মঙ্গলকাব্যে নৌকার নিজস্ব নামের সঙ্গে সঙ্গে নির্মাণকৌশলও বর্ণিত হয়েছে।
মঙ্গলকাব্যে দুই ধরনের জলযানের কথা আছে- ডিঙ্গা আর নৌকা। এ ছাড়া ‘জঙ্গা’ নামক নৌকার কথা আছে, তা সম্ভবত চীনের ‘জাঙ্ক’। চাঁদ সওদাগরের যে নৌবহর, সেখানে চৌদ্দ ডিঙার নাম পাওয়া যায়। নৌকাতে কী দ্রব্য বহন হতো, তারও কিছু কিছু উল্লেখ আছে। যেমন অজয়শালপাট- সূক্ষ্ম হস্তশিল্প, ধবল-ভেড়া, টিয়াঠুটি-কাপড়, পক্ষিরাজ-কাঠ, যাত্রাভর-পান পাতা, সুপারি, শঙ্খচূড়-শাঁখ ও সিঁদুর, রত্নমালা-হলুদ, দুর্গভর-নারকেল, কড়াশন-মৃৎপাত্র। জগজ্জীবন ঘোষাল ও মুকুন্দরাম চক্রবর্তী নৌকা নির্মাণের কাঠ শরল অর্থাৎ শাল, পিয়াল, খেজুর, পিয়ালী, সিমালি, চম্পা, বকুল, কাঁঠাল, নিম, নারকেল, জলপাই, তাল, গামার প্রভৃতির উল্লেখ করেছেন। বিচার্য হলো, উল্লিখিত কাঠের প্রতিটিতে কি নৌকা নির্মাণ সম্ভব? এখন এসব কাঠ প্রায় ব্যবহৃত হয় না। শাল সেগুন ছাড়া অর্জুন, ক্ষিরিশ, বাবলার ব্যবহার আছে। নৌকা বানাবার প্রক্রিয়া হিসেবে এর নির্মাণস্থল তৈরির ইঙ্গিত পাওয়া যায়। নির্মাণের পর গাবের আঠার ব্যবহার ও ধুনো দিয়ে দুই তক্তার মাঝের গর্তকে ভরাট করার প্রক্রিয়ার কথা এখানে বর্ণিত হয়েছে। এখন একই প্রক্রিয়ায় ধুনো ব্যবহৃত হলেও গাবের আঠা দিয়ে নৌকার বাইরের অংশের প্রলেপ দেওয়ার চল নেই। তার পরিবর্তে আলকাতরা বা সিনথেটিক রঙ ব্যবহৃত হচ্ছে।
পশ্চিমবঙ্গের মনসামঙ্গল রচয়িতাদের মধ্যে বিশিষ্ট কবি কেতকাদাস ক্ষেমানন্দ। তিনি বিশ্বকর্মাকে দিয়েই সমুদ্রযাত্রার উপযুক্ত সপ্তডিঙা বানিয়ে ছিলেন। হনুমান শত শত শাল, পিয়াশাল কাঠ জোগাড় করলেন। বিভিন্ন দ্রব্য বহনে তৈরি হলো ২৬৪ গজ লম্বা ডিঙা। দ্রব্যের মধ্যে তেল, ঘি, বস্ত্র, অস্ত্র অন্যতম। উত্তরবঙ্গের দিনাজপুরের কবি জগজ্জীবন ঘোষালের মনসামঙ্গলে চৌদ্দ ডিঙা নির্মাণ করেছেন কুন্দাই ছুতোর। কাঠ হিসেবে শাল, পিয়াল, পিপুল, বকুল, কাঁঠাল, নিম, জলপাই দিয়ে জাহাজ তৈরি করে তাতে কোশা, পানসই নামক নৌকা বেঁধে রাখা হলো। কোশা ও পানসই এখনকার কোশা ও পানসি। উত্তরবঙ্গে কোশা ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। এর তলদেশ চ্যাপ্টা, মাথা সুচালো।
মধ্যযুগের সাহিত্যে নৌকার উল্লেখ অল্পবিস্তর বর্ণিত হলেও তার ব্যাপক পরিচয় মন্দিরের দেয়ালের অলংকরণে দৃশ্যমান। বাংলার ঐতিহ্যবাহী চালাবিশিষ্ট এই মন্দিরে পোড়ামাটির অলংকরণে কখনো কখনো নৌকা বা জাহাজের অবয়ব ধরা দিয়েছে। ষোলো শতকের বাঁকুড়া, বীরভূম, বর্ধমান, হুগলি, হাওড়া, পূর্ব এবং পশ্চিম মেদিনীপুর, মুরশিদাবাদ, উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনায় এসব মন্দিরের উপস্থিতি দেখা যায়। বাংলাদেশের অনেক এলাকায় মন্দির গাত্রে নৌকার অলংকরণ দেখতে পাওয়া যায়। তবে ডিঙি জাতীয় নৌকার আধিক্য থাকলেও তা গড়নের বৈচিত্র্য ছিল (চিত্র ১, ২, ৩, ৪, ৫)। কখনো তা গেরস্থালি, কখনো প্রমোদতরণী, বা যুদ্ধের জন্য নিয়োজিত। এসব নৌকাতে যে অংশগুলো বিশেষভাবে চোখে পড়ে তা হলো, এগুলোর গা বরাবর উপর থেকে নিচ পর্যন্ত একটা বিশেষ দাগ। অনেকে এটিকে অলংকরণ বলেছেন। কিন্তু সম্ভবত এগুলো নৌকার গজালজাতীয় পেরেকের চিহ্ন (চিত্র ৪), গোছা এবং বাঁক হলো ভিতরের কাঠ। এই কাঠ খোলের সঙ্গে আটকে রাখার জন্য গজাল লাগানো এখনো রেওয়াজ। মন্দির গাত্রের নৌকোতে পাল বা মাস্তুলের উল্লেখ চোখে পড়ে না। বৈঠার ব্যবহার দেখা যায়। রয়েছে নৌকোয় সুদৃশ্য ঘর। অনেক নৌকার মাথা ও পেছনের দিকে বিশেষ আকৃতির কিছু মুখাবয়ব- সিংহ, মকর এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য (চিত্র ৬, ৭)। এখনকার নৌকায় এ-জাতীয় মুখাবয়বের উপস্থিতি নেই। এফ বি সলভেন্সের ময়ূরমুখো নৌকাও এখন অচল।
নৌকা ছাড়াও বিশেষ কিছু মন্দির গাত্রে জাহাজের অস্তিত্ব লক্ষণীয় (চিত্র ৮)। সেসবে দৃশ্যমান লোকজন ভারতের বলে বোধ হয় না। বিদেশি জাহাজকেই হয়তো মন্দিরের দেয়ালে স্থান দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু পোড়ামাটিতে নৌকা বা জাহাজ ফুটিয়ে তুললেন কারা, কোথা থেকে তারা এই এসবের কথা জানলেন? জবাব সহজ নয়। অধ্যাপক সোমনাথ মুখার্জির মতে শিল্পী নিজের শিল্পকর্মের মধ্য দিয়ে চিন্তা প্রকাশ করেন। আমরা জানি যেসব শিল্পী পোড়ামাটির কাজ করতেন, তারাই হয়তো বিভিন্ন এলাকায় ওই কাজে যেতেন। তারা কোনো এক সূত্র থেকে নৌকার যে অবয়ব মনে গেঁথে নিয়েছিলেন, সেগুলোর প্রকাশ ঘটেছিল এসব শিল্পকর্মের মধ্য দিয়ে। সুতরাং অনুমান করা যেতে পারে, শিল্পীরা তাদের আশপাশে দেখা নৌকার রূপ দিয়েছিলেন। জাহাজগুলোর আকার কেমন হয়, তার সম্যক ধারণা হয়তো তাদের ছিল। সেই সঙ্গে জাহাজের লোকজনের পোশাক কী হতে পারে তা জানতেন (চিত্র ৩)। কিন্তু নৌকার গঠন-বৈচিত্র্য সম্পর্কে তাদের ধারণা ও বাস্তবের মধ্যে আকাশ-পাতাল ফারাক ছিল। ফলে কয়েক ধরনের নৌকাই তাদের হাতে অঙ্কিত হয়েছে।
আজকের সঙ্গে পাথুরে নৌকার মিল কোথায়, সেটি দেখা যাক। উড়িষ্যার জাজপুর থেকে প্রাপ্ত ১২ শতকের একটা নৌকার প্রতিকৃতি লন্ডনের ভিক্টোরিয়া অ্যালবার্ট মিউজিয়ামে আছে (চিত্র ৯)। একই রকম একটা প্রতিকৃতি আছে কলকাতা জাদুঘরেও। পুরীর জগন্নাথ দেবের মন্দির গাত্রেও অভিন্ন চিত্র দৃশ্যমান। অর্থাৎ ১২ শতকে ওই জাতীয় নৌকার উপস্থিতি ছিল। প্রতিকৃতি থেকে পরিষ্কার যে ওই নৌকার তক্তার জোড়া দেওয়ার পদ্ধতি একটু অন্য রকমের। একটার ওপর অন্য তক্তা বসিয়ে খোল গড়ন। পশ্চাৎ প্রান্ত অনেক বেশি উঁচুতে। এটি যেহেতু পাওয়া গেছে উড়িষ্যা অঞ্চলের মন্দিরে, তাই অবশ্যই তা এই অঞ্চলের। দীঘা থেকে ধামড়া পর্যন্ত একটা নৌকা অনেকটা এই মন্দির গাত্রের মতো দেখতে, যা এখনো সমুদ্রে মাছ ধরতে দেখা যায়। নাম ‘পাটিয়া’ (চিত্র ১০)। এরই প্রতিরূপ মন্দির গাত্রে। কিন্তু আজকের এবং ১২ শতকের পাটিয়ার কিছু প্রভেদ আছে। ওই পাটিয়ার ওপরের দিকে আরও কিছু তক্তা জোড়া দেওয়া হয়েছে পরবর্তী সময়ে। অর্থাৎ বিগত হাজার বছরে সেই নতুন তক্তার সংযোজন ঘটেছে। এফ বি সলভেন্স ১৭৯৯ সালে আঁকা পাটিয়াতেই সেই নতুন রূপের পরিচয় পাওয়া যায়। নতুন যে তক্তাগুলো জোড়া দেওয়া হয়েছে, তা আগের অংশের গড়নের মতো নয়। বরং উল্টো। জোড়া দেওয়ার এই পদ্ধতি হলো খোলের বাইরের দিকে একটার ওপরে অন্য তক্তার উপস্থিতি। নৌগড়নের ভাষায় ক্লিঙ্কার টেকনোলজি। ভাইকিংদের নৌকার মতো। আর এর নিচের পুরোনো অংশের তক্তা গড়ন কৌশল হলো রিভার্স ক্লিঙ্কার। নৌকার ইতিহাসে ভাইকিংরা যে পদ্ধতিতে স্ক্যান্ডিনেভিয়াতে এটি গড়েছিল, তা অনুসরণ করে দীঘা অঞ্চলে এই পাটিয়া তৈরি হতো। ভাইকিংদের ঠিক বিপরীত পদ্ধতিতে তক্তা জোড়া দিয়ে। তাদের ওই বিখ্যাত নৌকার নির্মাণকৌশল ১২ শতাব্দীর পর আর চলেনি। কেননা সেটিকে আরও বড় করা যাচ্ছিল না তক্তাজুড়ে। অন্যদিকে পাটিয়ার মিস্তিরিরা সে সময়েই অন্য পদ্ধতিতে কয়েকটা তক্তা জুড়ে নৌকাকে আরও বড় করতে সমর্থ হলো। ভাইকিং নৌকা হারিয়ে গেল কিন্তু পাটিয়া বেঁচে রইল। আজও পাটিয়া সমুদ্রের বুকে মাছ ধরতে যায়।
▌স্বরুপ ভট্টাচার্য
সাবেক কিউরেটর, মওলানা আজাদ জাদুঘর,
মওলানা আবুল কালাম আজাদ ইন্সটিটিউশন আব এশিয়া স্টাডিজ
ছবি: ইন্টারনেট