কভারস্টোরি I ভেতো বাঙালি
ভাতের সঙ্গে বাঙালির সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে। কেবল খাবার নয় এটি, এখানকার সংস্কৃতির মৌল উপাদান। চালিকাশক্তিও বটে। লিখেছেন শিবলী আহমেদ
ভাত খাওয়ার সূচনা কোথায়? কখন? আদিমকালে ঝলসানো মাংস খাওয়ার অভ্যাসের একপর্যায়ে মানুষ ভাতখেকো হয়ে উঠেছে- এটি শুধু একটি ধারণা। এই ধারণা ধোপে টেকে না। দাবানলের আগুনে ঝলসে যাওয়া প্রাণীর মাংস সংগ্রহ করে খাওয়া শুরু হয়েছিল ২০ লাখ বছর আগে। তখনো ধান চাষ ও ভাত রান্নার কৌশল মানুষের আয়ত্তে আসেনি। পরিকল্পিত কায়দায় মাংস ঝলসে খাওয়ার ইতিহাস তিন লাখ বছরের পুরোনো। সেই কাজ করেছিল হোমো ইরেক্টাসরা। তত দিনে মানুষের বুদ্ধি যতটা পেকেছে, তা চাষবাসের জন্য পর্যাপ্ত নয়; ভাত রান্নার তো নয়-ই।
ভাতের ইতিহাস ১২ হাজার বছরের পুরোনো, এটা প্রত্নতাত্ত্বিকদের বক্তব্য। তখন নব্য প্রস্তরযুগ। মানুষ সবে কৃষিকাজ আরম্ভ করেছে। প্রসেডিং অব দ্য ন্যাশনাল একাডেমি অব সায়েন্স অব ইউনাইটেড স্টেট অব আমেরিকার (পিএনএস) গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী, ভাত রান্নার উপযোগী চাল উৎপাদনকারী ধানের ইতিহাস ৮ হাজার থেকে ১৩ হাজার বছরের পুরোনো। মানে, কৃষি আবিষ্কারের সমকালীন। কিন্তু ধান চাষের শুরু কোথায়? জার্নাল নেচারে প্রকাশিত একটি প্রবন্ধ অনুযায়ী, চীনের পার্ল উপত্যকা থেকে শুরু করে পূর্ব এশিয়া হয়ে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ভাতের বিস্তার ঘটেছিল।
এই খাবার বাঙালি সংস্কৃতির অপরিহার্য অংশ। অনুমান করা হয়, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া থেকে প্রাচীনবঙ্গে ধান আমদানি হতো। তা প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগে। উৎপাদনস্থলের পাহাড়ি ঢালে চাষ হতো। ধীরে ধীরে এর আবাদ সমতলে আসে। পানিতে ডোবা জমিতে ধান চাষ প্রথম শুরু হয়েছিল ভারতবর্ষে। তবে এখানকার সব অঞ্চলে নয়। পানিপ্রতুল আসাম, বাংলাদেশ, ওড়িয়া এবং দক্ষিণ ভারতের নদী তীরবর্তী ও সমুদ্রসন্নিহিত সমতল অঞ্চলগুলোতে এই শস্য ফলত। এখনো জন্মে। চাষোপযোগী জলবায়ু ও জমি থাকায় ধানই হয়ে ওঠে এই অঞ্চলের বাসিন্দাদের মূল শস্য। ভাত হয় প্রধান খাদ্য। কিন্তু ভারতবর্ষে যেসব স্থানে পানির প্রাচুর্য ছিল না, সেখানকার আবাদি শস্য ছিল যব ও গম। এই ফসলজোড়া চাষের প্রচলন করেছিল দ্রাবিড় জনগোষ্ঠী। ভারতবর্ষে যাদের আবির্ভাব আনুমানিক পাঁচ হাজার বছর আগে। এই অঞ্চলের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত থেকে বিহার পর্যন্ত প্রধান শস্য হয়ে ওঠে যব ও গম। এ কারণেই খুব অল্প ভূমি ব্যবধানের মধ্যে থেকেও ভারতবর্ষের কারও প্রধান খাবার ভাত, কেউবা রুটিভুক। কিন্তু এই অঞ্চলে ধান চাষের সূচনা করেছিল কারা? কোন জাতিই-বা ভাত খাওয়ার অভ্যাস ধরিয়ে দিল? এই যে বাঙালির সংস্কৃতিতে ধান ও চালের এত ছড়াছড়ি, এসব আচারের উৎপত্তি কোথায়?
বাঙালির ভাত খাওয়ার অভ্যাস এবং ধানকেন্দ্রিক সংস্কৃতি মূলত অস্ট্রিক ভাষাভাষী আদি-অস্ট্রেলীয় জনগোষ্ঠীর সভ্যতার দান। তারা আর্য আগমনের আগেই ভারতবর্ষে বাস করত। দ্রাবিড়দের সমকালীন বা কিছু সময় আগে ইন্দোচীন থেকে আসাম হয়ে বঙ্গে প্রবেশ করেছিল অস্ট্রিকরা। এই অঞ্চল দখল করতে তারা আদিবাসী ‘নেগ্রিটো’দের হটিয়েছিল। বিতাড়িতরা কৃষিকাজ জানত না। অস্ট্রিকরা চাষকৌশল সঙ্গে করে এনেছিল। ধারণা করা হয়, ভারতবর্ষে কৃষিকাজ চালু করেছিল তারাই। পরবর্তী আর্য ভাষাজাতিও এটা জানত না। এই অনুমানের কারণ, আর্যরা ‘লাঙ্গল’ শব্দটি অস্ট্রিক ভাষা থেকে গ্রহণ করেছিল। যার অর্থ ‘চাষ করা’ কিংবা ‘চাষ করার যন্ত্র’। পন্ডিতদের বক্তব্য অনুসারে, কৃষিনির্ভর হওয়ার আগে আর্যরা ছিল পশুপালক।
ভাত উৎপত্তির ইতিহাস ভারতবর্ষের কিছু প্রত্নতাত্ত্বিক লিপি-উপাত্ত থেকেও মেলে। প্রাচীনবঙ্গে সর্বপ্রথম যে লিপিখন্ড পাওয়া গেছে, সেখানে ধানের উল্লেখ আছে। সেটির হদিস পাওয়া গেছে খ্রিস্টজন্মের ৩০০ থেকে ২০০ বছর আগে। প্রাচীন করতোয়া তীরবর্তী মহাস্থানে। রচনাটি ছিল একটি রাজাদেশ। তবে কোন রাজা কোথা থেকে এই আদেশ দিয়েছেন, তা অজ্ঞাত। দেবদত্ত রামকৃষ্ণ ভান্ডারকরের ধারণা, সেটি ছিল মৌর্য সম্রাটের আদেশনামা। যাদের সাম্রাজ্য ৩২১-১৮৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত টিকে ছিল। আদেশনামাটি ঠিক কোন মৌর্য রাজা প্রেরিত, তা জানা যায়নি। ধারণা করা হয়, পুন্ড্রনগরের ‘মহামাত্র’ নামের কাউকে নির্দেশটি দেওয়া হয়েছিল। সেই স্থানে দুর্যোগকবলিত মানুষদের সাহায্যার্থে রাজা ধান বিতরণের হুকুম দিয়েছিলেন। ভারতের বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক খনন থেকেও এই শস্যের নমুনা পাওয়া গেছে। বোলপুরের কাছে কোপাই তীরবর্তী মহিষদল গ্রাম খুঁড়ে কিছু ধান-চালের অঙ্গার মিলেছে। তেজস্ক্রিয় পরীক্ষায় এর সময়কাল নির্ণয় করা হয়েছে খ্রিস্টপূর্ব ১৩৮০ থেকে ৮৫৫-এর ভেতর। এ রকম আরও ফসিল থেকে অনুমেয়, তিন হাজার থেকে পাঁচ হাজার বছর আগে ভারতবর্ষে ভাত রান্নার উপযোগী ধান চাষ শুরু হয়েছিল, যা অস্ট্রিকদের আগমনের সময়কালের সঙ্গে মিলে যায়।
প্রাচীন ভারতবর্ষের মানুষ শুধু চাল সেদ্ধ করে খেয়েই সন্তুষ্ট থাকেনি, বরং নিজেরা ভাতের বিভিন্ন প্রকরণ তৈরি করেছে; কিছু রন্ধনশৈলী পার্শ্ববর্তী সংস্কৃতি থেকে গ্রহণ করেছে। পদে পদ মিশিয়ে ভাতের সংকরও হয়েছে। যেমন খিচুড়ি। আলেকজান্ডার আমল (৩৫৬-৩২৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) থেকেই এই অঞ্চলের মানুষ তা খায়। বলা হয় মিসরীয় ‘কুশারি’ খাবারটি থেকেই এই অঞ্চলের খিচুড়ির উৎপত্তি। এটা না-ও হতে পারে। কেননা, খাদ্যবিশারদেরা মতামত দেন, পদটি বিভিন্ন নামে বিশ্বের একাধিক অঞ্চলে একই সময়ে ছিল। অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান ‘কিজোরি’র পরিবর্তিত পদ হিসেবেও ভাবা হয় খিচুড়িকে। তাদের ‘কেডজ্রি’ নামের খাবার থেকে এর উৎপত্তি হতে পারে। রাতে বেঁচে যাওয়া ভাতের সঙ্গে সকালে ডাল যোগ করে খাবারটি তৈরি হতো। ইংল্যান্ডে এখনো প্রাতরাশে কেডজ্রি খাওয়া হয়। তবে খিচুড়ির ইতিহাসে স্কটরাও ভাগ বসিয়েছে। তাদের সৈন্যবাহিনীর সঙ্গে কেডজ্রি ভারতবর্ষে এসেছিল এবং তারপর তা ইংল্যান্ডে ফেরত গেছে- এমন দাবি করেছে তারা। বাংলায় খিচুড়ি শব্দটি ভারতীয় ‘খিচড়ি’ থেকে এসেছে। খিচড়ি সংস্কৃত ‘খিচ্চা’ থেকে আগত। চতুর্দশ শতাব্দীর মাঝামাঝি ইবনে বতুতা ভারতবর্ষে মুগ ডাল ও চাল দিয়ে এই পদ রান্না হতে দেখেছেন। নিজের ভ্রমণকাহিনিতে ‘খিশ্রি’ নামে খাবারটির উল্লেখ করেছেন। রুশ পর্যটক নিকিতিনও এই অঞ্চলের খিচুড়ির কথা বর্ণনা করেছেন।
ভাতের সম্ভ্রান্ত পদ পোলাও। কেন উচ্চমার্গীয় তা অনুমান করা যায় নবাব সালার জঙ্গ-এর রসুইঘরের দায়িত্বে থাকা খাস বাবুর্চির মাসিক বেতন থেকে। পোলাও রান্নার জন্য তিনি মাসে ১২০০ টাকা মাইনে পেতেন। তা-ও আবার ১৮ শতকে। তবে সেই পোলাও রান্নার ধকল কম ছিল না। বিরিয়ানির চেয়েও জটিল প্রক্রিয়ায় তৈরি হতো। ভারতবর্ষ, পশ্চিম এশিয়া, মধ্য এশিয়া, পূর্ব আফ্রিকা কিংবা দক্ষিণ আমেরিকা- সব জায়গাতে একই সময়ে পোলাওয়ের উপস্থিতি ছিল; তবে ভিন্ন ভিন্ন নামে। তাই ভাতের এই পদের ইতিহাস গোলমেলে। ভারতবর্ষের পোলাও কিংবা ইংল্যান্ডের ‘পিলাফ’-এর আঁতুড়ঘর পারস্য। সে অঞ্চলে ভাতকে বিভিন্ন কায়দায় রান্না করে মুখরোচক খাবার তৈরি হয়। সেসব পদের একটি হচ্ছে ‘পোলো’। সারা বিশ্বে সেটিই পিলাভ, পিলাফি, পালোভ নামে পরিচিত। পোলাওয়ের কাছাকাছি আরেকটি পদ বিরিয়ানি। এর উৎপত্তিস্থল নিয়ে মতভেদ আছে। হাজার বছর আগে আরব যাযাবররা হাঁড়িতে চাল, মাংস ও মসলা মিশিয়ে মাটিতে গর্ত করে রান্না করত। হতে পারে সেটিই বিরিয়ানির আদি পদ। তৈমুর লংয়ের বদৌলতে যাযাবরদের সেই খাবার কাজাখস্তান ও আফগানিস্তান পেরিয়ে ভারতবর্ষে পৌঁছে। ১৪ শতকে। কিন্তু এই ইতিহাস হালে পানি পায়নি। দ্বিতীয় খ্রিস্টাব্দে তামিল সাহিত্যে ‘উনসুরু’ নামের এক খাবারের হদিস মেলে। তৈমুর ভারতে পৌঁছানোরও হাজার বছর আগে সৈন্যদের জন্য চাল, ঘি, মাংস, হলুদ, ধনে, গোলমরিচ ও তেজপাতা দিয়ে রান্না হতো পদটি। সেটিও বিরিয়ানির আদি পদের দাবিদার। তবে এর উৎপত্তিবিষয়ক প্রচলিত ইতিহাস সম্রাট শাহজাহানের স্ত্রী মমতাজের সঙ্গে যুক্ত। একবার সৈন্য ব্যারাকে গিয়ে সম্রাজ্ঞী দেখলেন, যোদ্ধারা অপুষ্টিতে ভুগছে। রণক্ষেত্রে এই বিপুল সেনাসদস্যকে স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার মতো পর্যাপ্ত চিকিৎসক ছিল না। তাই প্রধান রসুইকরকে বিশেষ একটি পদ রান্নার নির্দেশ দিয়েছিলেন মমতাজ। তা ছিল বিরিয়ানি। ভিন্ন একটি মতামত ভাতের এই পদের উৎপত্তিস্থল হিসেবে ভারতবর্ষকে কৃতিত্ব দেয়। বলা হয়, তা এই অঞ্চলের আদি খাবার খিচুড়িরই সংকরজাত। মোগলেরা এসে তাদের খানদানি পোলাওয়ের সঙ্গে খিচুড়ি মিশিয়ে যে পদ রান্না করেছিল, তা-ই বিরিয়ানি।
পান্তাও কি ভাতের পদ? না, এটি একটি সংরক্ষণ পদ্ধতি। সংস্কৃতে এভাবে সংরক্ষিত ভাতকে ‘কাঞ্জিকা’ বলে। স্থানভেদে এর আরও নাম আছে। যেমন পাখাল ভাত, পাখালা, পোখালো ইত্যাদি। ১৭ শতকের কিছু নথিতে পান্তাভাতের কথা উল্লেখ আছে। মোগল আমলে যখন মুক্তাঙ্গনে সংগীত পরিবেশন হতো, শ্রোতারা তা উপভোগ করার সময় কিছু ঐতিহ্যবাহী খাবার খেতেন। সেগুলোর মধ্যে পান্তাভাতও ছিল। ভারতবর্ষে জ্যৈষ্ঠ মাসজুড়ে পান্তাভাত, দই, চিনি, কলমিশাক ভাজা আর দুই রকমের ব্যঞ্জনসহযোগে যে ভোগ দেওয়া হয়, তা ‘পাকাল ভাত’ নামে পরিচিত। বঙ্গের নারীরা গর্ভাবস্থায় সাধভক্ষণ অনুষ্ঠানে যেসব মুখরোচক পদ রাখতেন, সেগুলোর মধ্যে এটিও ছিল।
ভাত দিয়ে মদও হয়। চীনা পরিব্রাজক ‘মা-হুয়ান’ ধান দিয়ে তা তৈরি হতে দেখেছেন। ১৪০৫ সালে তিনি বঙ্গে ঘুরে যান এবং বলেন, ‘এই দেশে নারকেল, ধান, তাল ও কাজঙ্গ হইতে মদ তৈরি করা হয়, এবং সেই মদ প্রকাশ্যভাবে বিক্রয় করা হয়।’ বাংলাদেশে এখনো ভাত থেকে দুই ধরনের মদ হয়। ‘দো-চোয়ানী’ ও ‘কাঞ্জি’। চাকমারা বিজু উৎসবে এ পানীয় দুটি তৈরি করে।
কলকাতার পিনাকী ভট্টাচার্য তার ‘খানা তল্লাশি’ বইয়ের ক্ষীর-পায়েস অনুচ্ছেদে ‘শির বিরিঞ্জ’ নামের এক প্রকার খাদ্যের কথা লিখেছেন। ফারসি ভাষায় ‘বিরিঞ্জ’ শব্দের অর্থ চাল বা ভাত। বইটির ওই অনুচ্ছেদ থেকে আরও জানা যায়, পারস্যে দুধকে ‘শির’ বলা হয়। চালের গুঁড়া, গোলাপজল ও পেস্তাবাদাম যোগে ফিরনি তৈরি হয় সেখানে। এই রেসিপি হাজার বছরের পুরোনো। ধারণা করা হয়, পারস্য থেকেই ফিরনি ও ক্ষীরের রন্ধনকৌশল সারা বিশ্বে ছড়িয়েছে। তবে দুধ ও চালের সঙ্গে অন্যান্য অনুষঙ্গ মিশিয়ে শেষ পাতে পরিবেশনের এই পদটি ভারতবর্ষে বৈদিক আমল থেকেই প্রচলিত। কালপর্বটি খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০ থেকে ৫০০ অব্দ পর্যন্ত দীর্ঘ। চাল ও দুধের তৈরি খাবারটি ঘনরূপে পরিবেশন করলে বলা হয় ক্ষীর। পাতলা হলে ফিরনি। ক্ষীর সম্বন্ধে একটি লোককথা মিশে আছে দক্ষিণ ভারতের আম্বালাপ্পুজা মন্দিরের সঙ্গে। অনেক দিন আগে সেই স্থানে দুর্ভিক্ষ হয়েছিল। সেখানকার রাজা ছিলেন প্রজাদের দুর্দশার ব্যাপারে উদাসীন। তিনি দাবা খেলায় মত্ত থাকতেন। তাই মর্ত্যে নেমে এসেছিলেন ভগবান কৃষ্ণ। গরিব ব্রাহ্মণের বেশে। তিনি রাজাকে দাবা খেলায় চ্যালেঞ্জ জানালেন। শর্ত দিলেন, পরাজিত হলে তাকে চাল দিতে হবে। দেওয়ার নিয়ম এই যে দাবার এক ঘরে যে পরিমাণ চাল দেওয়া হবে, পরের ঘরে তা দিতে হবে দ্বিগুণ। রাজা এই প্রস্তাবে রাজি হলেন এবং হেরে গেলেন। শর্তমতে ব্রাহ্মণকে চাল প্রদান করতে লাগলেন। কিন্তু দাবি মেটাতে গিয়ে দাবার ৪০ ঘর পূর্ণ করার পর রাজগোলা খালি হয়ে গেল! শেষ বর্গে পৌঁছাতে ব্রাহ্মণকে বর্তমানের হিসাবে দিতে হতো ১ কোটি ৮৪ লাখ ৪৭ হাজার ৭৪৪ ট্রিলিয়ন টন চাল! রাজা বুঝতে পারলেন যে এই ব্রাহ্মণ সাধারণ কেউ নন। তিনি সঙ্গে সঙ্গে তার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করলেন। ভগবান কৃষ্ণ তাকে এক শর্তে মাফ করেছিলেন। বলেছিলেন, আম্বালাপ্পুজা মন্দিরে ক্ষুধার্ত কেউ এলে তাকে যেন এক বাটি ক্ষীর দেওয়া হয়। ভারতবর্ষের ইতিহাসে ভাত এবং এর বিভিন্ন পদ নিয়ে এমন আরও লোককথা ছড়িয়ে আছে।
বাংলাদেশে ভাতের সংস্কৃতিতে বিচিত্র পদের সন্ধান মেলে। যেমন পাচৈ। আউশ ধান ২৪ ঘণ্টা ভিজিয়ে রেখে পানি ছেঁকে, বাঁশের চালুনে কলাপাতা বিছিয়ে, দিন পাঁচেক ঢেকে রাখতে হয়। ফলে অঙ্কুর গজায়। তারপর তা রোদে শুকিয়ে ঢেঁকিতে ছেঁটে চালসহ ধানের শিকড় গুঁড়া করে আরেক দফা পানিতে ভিজিয়ে রাখা হয়। এবারে আতপ চালের ভাত রেঁধে তাতে মেশাতে হয় গুড়, লবণ ও ভেজানো চালগুলো। পাচৈ তৈরির প্রকরণ এটাই। এই পদ এখন প্রায় বিলুপ্ত। গ্রামাঞ্চলে গত রাতে বেঁচে যাওয়া ভাতের সঙ্গে কাঁচা মরিচ, রসুন, সরিষার তেল ও লবণ মিশিয়ে সকালে ভাজা হয়; যাকে ‘কর্করা ভাত’ বলে। শীতকালে এই পদের নাম বদলে হয় ‘ভাজি ভাত’। তাতে অবশ্য পেঁয়াজ, হলুদ, ধনেপাতাসহ বাড়তি উপকরণ যোগ হয়। এসব পদও হারিয়ে যাওয়ার পথে। ইতিমধ্যে গমের ভাত, যবের ভাত, কাউন চাল, লাল চাল, ঢেঁকিছাঁটা চাল ও চীনা চালের ভাত হারিয়ে গেছে।
‘ভাত’ শব্দটি কীভাবে এল? বঙ্গীয় শব্দকোষে হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, ‘ভাত’ শব্দের উৎস বিশ্লেষণে সংস্কৃত ‘ভক্ত’ ও প্রাকৃত ‘ভত্ত’ শব্দের যোগসূত্র আছে। সেখান থেকেই শব্দটি এসেছে। ঋগ্বেদের ঋক্গুলোতে এই খাবারের প্রায় ১৪টি প্রতিশব্দ পাওয়া যায়। অন্ন, অন্ধস্, ইষ, বাজ, পৃক্ষ, পিতু, ভক্ত, শ্রবস্, স্বধা, ঊর্জ, ইলা, চন, নমস্ ও বয়স্।
ভাত বাঙালি সংস্কৃতির অন্যতম উপাদান; বিভিন্ন নামে চিহ্নিত ক্ষুদ্র এ দানার সঙ্গে মিশে আছে হাজার বছরের বঙ্গীয় সংস্কৃতি। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত খাবারটি এই অঞ্চলের কৃষ্টির রন্ধ্রে রন্ধ্রে মিশে আছে। এখনো কৃষিভিত্তিক সমাজে শস্য-প্রাচুর্যের প্রার্থনায় ‘নবান্ন’ উৎসব উদযাপিত হয়। এই শব্দের অর্থ ‘নতুন অন্ন’। ঘরে ধান ওঠার আনন্দের সঙ্গে উৎসবটি মিশে আছে। হেমন্তে আমন কাটার পর অগ্রহায়ণ কিংবা পৌষে এটি উদ্্যাপিত হয়। উৎসবের প্রধান অংশ হচ্ছে নতুন চালে পিতৃপুরুষের শ্রাদ্ধ করা। তারপর দেবতা, অগ্নি, কাক, ব্রাহ্মণ ও আত্মীয়স্বজনকে নিবেদন করে গৃহকর্তা ও তার পরিবারের সদস্যরা নতুন গুড়সহ এই অন্ন গ্রহণ করে। উৎসবটি বেশ পুরোনো। এর প্রচলন ঘটিয়েছিল অস্ট্রিক ভাষাভাষী জনগোষ্ঠী। বাংলাদেশের নানা আচার-অনুষ্ঠানে আজও ধানের ব্যবহার আছে। যেগুলো অস্ট্রিকদের বিশ্বাস থেকেই বিবর্তিত হয়েছে। ধান্যশীর্ষপূর্ণ লক্ষ্মীর ঘটের যে পূজা ভারতবর্ষে প্রচলিত ছিল, (হয়তো বর্তমানেও অব্যাহত) তা এখনো ওঁরাও-মুন্ডা আদিবাসীদের মধ্যে চালু আছে। সাঁওতালেরা শীতকালীন ফসল ঘরে তুলে সারা রাত গান-বাজনার মধ্য দিয়ে নবান্ন উদ্যাপন করে। জুমচাষি ম্রো ‘চামোইনাত’ উৎসবে নতুন ভাত দিয়ে আপ্যায়ন করা হয়। গারোরা ধান তুলে সৃষ্টিকর্তার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশে ‘ওয়ানগাল্লা’ করে। বৌদ্ধচাষিরা অম্বুবাচীপূজায় যে কয়টি পদ রাঁধে, ভাত সেগুলোর মধ্যে একটি। শিশুর মুখে প্রথম শক্ত খাবার তুলে দেওয়ার দিনটিকে ‘মুখে ভাত’ কিংবা ‘অন্নপ্রাশন’ বলে। উৎসবটি ‘ভাত ছোঁয়ানী’ নামেও পরিচিত। বিয়েতেও ধান-চালের উপস্থিতি আছে। প্রাচীনবঙ্গে ধোঁয়া ওঠা ভাতে ঘি দিয়ে অতিথি আপ্যায়নের রীতি ছিল। নতুন বউ দেখাকে কেন্দ্র করে বউভাতের আয়োজন হয় এখনো। সেদিন কনেকে রাঁধতে দেওয়া হয়। তিনি স্বামী, শ্বশুর, দেবর, ভাশুরসহ গুরুজনদের পাতে ভাত পরিবেশন করেন। বাংলাদেশের কোথাও কোথাও ‘আইবুড়ো ভাত’ নামের অনুষ্ঠান প্রচলিত আছে। পাত্র-পাত্রীর অবিবাহিত অবস্থার শেষ খাবার খাওয়াকে কেন্দ্র করে এই উৎসব উদ্্যাপিত হয়। আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধব বর-কনেকে আইবুড়ো ভাত খাইয়ে ধান-দূর্বা দিয়ে আশীর্বাদ করে।
বাঙালি বিয়ের রীতির সঙ্গে ধান, চাল ও ভাত আরও বিশদভাবে যুক্ত। সেসব প্রথার কিছু কিছু বিলুপ্ত, কিছু আবার ক্ষয়িষ্ণু। যেমন ‘চাল খেলা’ নামের একটি অনুষ্ঠান ছিল। এতে বর-কনে ‘মঙ্গল হাঁড়ি’ নিয়ে খেলে। এটি ‘মুঙ্গলী হাঁড়ি’ নামেও পরিচিত। কথিত আছে, আয়ু বাড়ানোর উদ্দেশ্যে পাত্র-পাত্রীকে তা নিয়ে খেলা করতে হতো। এর ভেতর অন্যান্য অনুষঙ্গের সঙ্গে হলুদ মাখানো সেদ্ধ চাল থাকত। সেগুলো তিনবার মাটিতে ফেলে দিত বর; কনে বারবার তা তুলে হাঁড়িতে রাখত। সবশেষে বর তার হবু স্ত্রীর নাম মুখে নিয়ে পাত্রের মুখ ঢেকে দিত। অতীতে বাঙালি বিয়েতে নববধূর গলায় যে ‘নবপত্রিকা’ তথা নয়টি পাতার কবজ পরানো হতো, সেগুলোর একটি ছিল ধান। ‘বরভোজনের চাল’ নামে একটি রীতি ছিল। তাতে বিয়ের দিন পিঁড়ির উপর বরের পরিত্যক্ত কোনো একটি পোশাক রেখে তাতে চাল বেঁধে দেওয়া হতো। কন্যাকে সেটির উপর বসাত। বরযাত্রীর মহাজেও দেওয়া হতো চাল। পাত্রপক্ষ বিয়ের সাত দিন আগে কনের বাড়িতে যেত। এর নামই ‘বর মহাজ’। তাদের তুষ্ট করতে চাল দেওয়ার প্রথা ছিল। অনেক স্থানে বিয়ের আগের রাতে বর হবু স্ত্রীর বাবার বাড়িতে থাকত; কিন্তু সেই পরিবারের খাবার গ্রহণ করত না। তাই বরের বাড়ি থেকে চালসমেত অন্যান্য আহার্য পাঠিয়ে দেওয়া হতো। পাত্রপক্ষের কেউ তা রান্না করে বরকে খাওয়াত। এই রীতির নাম ছিল ‘বরের অন্নগ্রহণ’। বিয়েতে অতিথিদের সামনে যে পানের বাটা দেওয়া হতো, সেখানেও সহপদ হিসেবে থাকত চাল। পাকা কথা হয়ে গেলে কনের বাড়িতে ‘পাকা পত্র’ পাঠানোর রীতি ছিল। তাতে ধানের প্রয়োজন হতো। চিঠি পাঠানোর জন্য যে খিলি, তার একটি অনুষঙ্গ ছিল ধান।
ধর্মীয় বিষয়াদিতেও ধান, চাল ও ভাতের ব্যবহার আছে। সেগুলোর কিছু কিছু এখনো বিদ্যমান। মুসলমান চাষিরা নতুন ধান দিয়ে রান্না করা ভাত প্রথমে নিজেরা না খেয়ে মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন বা কোনো মুসলিম ধার্মিক লোককে খাওয়ায়। সৃষ্টিকর্তা যেন সহায় হন এবং ফসল আরও বাড়িয়ে দেন, এ উদ্দেশ্যেই তারা এটি করে। এ ছাড়া গ্রামের বধূরা প্রতিবার রান্নার সময় একমুঠ চাল আলাদা পাত্রে রাখে। মাস শেষে তা মক্তবের শিক্ষকের সম্মানী বাবদ দেওয়া হয়। অসাবধানতাবশত মুসলমানদের ধর্মগ্রন্থ হাত থেকে পড়ে গেলে সেটির সমান ওজনের চাল দান করার রীতিও দীর্ঘদিনের। মৃত ব্যক্তির কুলখানি ও চল্লিশাতে বিরিয়ানি খাওয়ায় অনেকে।
নির্দিষ্ট কিছু খাবারের সঙ্গে উচ্চ শ্রেণি ও উচ্চ পদমর্যাদার যোগসূত্র থাকে। কিছু সমাজের নিম্নবিত্ত এবং নিম্নশ্রেণির মানুষের জন্য। অতীতে ভাতের প্রকারের মধ্যে এমন শ্রেণিবৈষম্য ছিল। অর্থনৈতিকভাবে অসচ্ছল শ্রেণির লোকেরা সামান্য ফেনফেনে ভাত খেত। সেসব চাল হতো মোটা। বর্তমানেও সব ধরনের চাল কেনার সাধ্য সবার থাকে না। জাত-বর্ণব্যবস্থায়ও ভাতের বৈষম্য ছিল। চন্ডালরা যে চাল স্পর্শ করত কিংবা অন্ত্যজ ও নর্তকীশ্রেণির লোকদের রান্না করা ভাত খাওয়া উচ্চবর্ণের মানুষের জন্য নিষেধ ছিল। তবে তাদের অন্ন খেলে ব্রাহ্মণদের জাত যেত না। প্রায়শ্চিত্ত করে শুদ্ধ হওয়ার সুযোগ ছিল। কিন্তু ব্রাহ্মণেরা যদি বৈশ্যদের ভাত গ্রহণ করত, সে ক্ষেত্রে প্রায়শ্চিত্তের সম্ভাবনা কমে যেত। ক্ষত্রিয়দের অন্ন গ্রহণ করলে তা হতো অর্ধেক। ক্ষত্রিয়রা শূদ্রের ভাত খেলেও প্রায়শ্চিত্তের সম্ভাবনা একই মাত্রায় কমে যেত। বৈশ্যের অন্ন গ্রহণে তা অর্ধেক। আবার বৈশ্য যদি শূদ্রের ভাত গ্রহণ করত, সে ক্ষেত্রেও প্রায়শ্চিত্তের সম্ভাবনা অর্ধেক হয়ে যেত। কিন্তু আপদকালে ব্রাহ্মণেরা যদি শূদ্রের ভাত খেত, তাহলে শুধু মনস্তাপের মাধ্যমেই শুদ্ধ হওয়া যেত।
বাঙালি তিন বেলা ভাত পেলেই খুশি। এ জাতি যেন চালের পূজারি। এটি ছাড়া তাদের ভোজ পূর্ণ হয় না। চালের প্রাচুর্যে বাঙালি যেমন উল্লাসে মাতে, এর অভাবে ভোগে অনাহারে-মঙ্গায়। ভাত খাওয়ায় বাঙালি সারা বিশ্বে চতুর্থ। দেশের মানুষের দৈনিক মাথাপিছু ৪৩৮ গ্রাম চাল লাগে। বাঙালির এমন বিপুল ও নিরবচ্ছিন্ন আসক্তিই এ জাতিকে ‘ভেতো বাঙালি’ তকমা জুটিয়েছে। আর্য, সেন, আফগান, তুর্কি, মোগল ইংরেজ- কত জাতিই তো বঙ্গ শাসন করেছে; নিজেদের খাদ্যাভ্যাস চাপিয়ে দিয়েছে বাঙালির ওপর। তবু ভাতপ্রীতি থেকে বাঙালির মুখ ফেরানো সম্ভব হয়নি। কোনো রাজাই তা পারেনি। এই অদম্য আসক্তির সুযোগ নিয়েছে কিছু দুর্বৃত্ত। বৈশাখের ‘পান্তা-ইলিশ’ সংস্কৃতিকে অনেকে পুঁজিবাদী আগ্রাসন বলেন। চালের বিপুল চাহিদা দেখে অসৎ ব্যবসায়ীরা মোটা চাল মেশিনে কেটি চিকন করে ধোঁকা দিচ্ছে! তবু এই জাতি ভাত ছাড়েনি।
তথ্যসূত্র:
বাঙ্গালীর ইতিহাস (আদি পর্ব), নীহাররঞ্জন রায়।
খানা তল্লাশি, পিনাকী ভট্টাচার্য।
বিয়ের শব্দকোষ, হরিপদ ভৌমিক।
অন্তর্জাল।
ছবি: ইন্টারনেট