ইন্টারন্যাশনাল ফ্যাশন I মিলান ফ্যাশন উইক ফল ২০২০
করোনাভাইরাস সংক্রমণের আশঙ্কাকে উপেক্ষা করে মিলানে অনুষ্ঠিত হলো ফ্যাশন উৎসব। সমকালীন বিশ্বপরিস্থিতি থেকে ডিজাইনাররা প্রেরণা নিয়েছেন, দেখা গেল এবারও
ফ্যাশন ক্যাপিটাল মিলানে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল ‘মিলান ফ্যাশন উইক ফল ২০২০’। ১৮-২৪ ফেব্রুয়ারি প্রদর্শিত হয় বিখ্যাত ডিজাইনারদের নজরকাড়া সব কালেকশন। শোগুলোতে অতিথিদের উপস্থিতি ছিল অন্য সময়ের চেয়ে অনেক কম। শোগুলো থেকে উঠে এসেছে আগামী বছরের সম্ভাব্য ট্রেন্ড।
জর্জিও আরমানি
ডিজাইনার হিসেবে যথেষ্ট প্রসিদ্ধি থাকলেও জর্জিও আরমানির শো ছিল জনশূন্য। অবশ্য সেটা করোনাভাইরাসের আতঙ্কের জন্য। কিন্তু থেমে থাকেনি আরমানির মনমাতানো কালেকশনের প্রদর্শনী। পুরো অনুষ্ঠানটির লাইভ স্ট্রিমিং হয়। কালেকশনে প্রাধান্য পেয়েছে কালো ভেলভেট ও ফ্লোরাল গ্রাফিক প্রিন্ট ও গ্লিটার। আরমানির শেষ বারোটি পোশাক ২০০৯ সালের তাঁরই স্প্রিং/সামার এবং ২০১৯ সালের কতুরের আর্কাইভ থেকে নেওয়া। দুটি কালেকশনের অনুপ্রেরণা ছিল চীন। মূলত এর মধ্য দিয়ে দেশটির জনগণের প্রতি সমবেদনা ও ভালোবাসার বার্তা পাঠিয়েছেন আরমানি।
ডলশে অ্যান্ড গ্যাবানা
স্টেফানো গ্যাবানা আর ডমিনিকো ডলশে এবার তাদের শোর মাধ্যমে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন সেই সব কারিগরকে, যারা অক্লান্ত পরিশ্রম করে ডিজাইনারদের নকশাকে মূর্ত করে তোলেন। শোর ব্যাকড্রপে ছিল বিভিন্ন সেক্টর যেমন জুতার কারিগর, বুননশিল্পী, দর্জি, টাই প্রস্তুতকারকদের নিয়ে তৈরি ভিডিওচিত্র। এর ভেতর দিয়ে মঞ্চে মডেলরা ক্যাটওয়াক করে। চাঙ্কি নিট, স্ট্রাকচার্ড ব্ল্যাক ড্রেস আর ওভারসাইজড টেডি বিয়ার কোট বেশি দেখা গেছে এবারের ডলশে অ্যান্ড গ্যাবানার সংগ্রহে।
ভারসাচি
প্রথমবারের মতো একই সঙ্গে প্রদর্শিত হলো ভারসাচির মেনস ও ওমেনস ওয়্যার। জেন্ডার ফ্লুইডিটি থেকে বেশ দূরেই ছিলেন ডোনাটেলা ভারসাচি। তার ডিজাইন করা ছেলেদের পোশাকে হাইপার ম্যাসকুলিনিটি আর মেয়েদের পোশাকে হাইপার ফেমিনিটি থাকে অনেক বেশি। তবে এবারের সংগ্রহে ফ্লোরাল প্রিন্ট, অ্যানিমেল প্রিন্ট, সিকুইন, মেটালিক পিনস্ট্রাইপ আর ট্র্র্যাডিশনাল চেক ছেলে-মেয়ে উভয়ের পোশাকেই ছিল সমানভাবে। আপাতদৃষ্টিতে যে পোশাকগুলো জেন্ডার নিউট্রাল, ছোট ছোট ডিটেইল দিয়ে তাকে আলাদা করা হয়েছে। যেমন একই রকমের প্যান্ট স্যুটে মেয়েদের কোট ছিল ডাবল ব্রেস্টেড আর ছেলেদেরটা সিঙ্গেল ব্রেস্টেড। মেয়েদের পোশাকের কালেকশনে কালো ড্রেসের প্রাধান্য ছিল লক্ষ করার মতো, সেই সঙ্গে নজর কেড়েছে বেলা, জিজি, কেন্ডলের মতো সুপারমডেলদের পরা টাইনি ড্রেস।
ফেন্ডি
এই ডিজাইনারের রেডি টু ওয়্যার কালেকশনগুলো ছিল সফট পাওয়ারফুল। লেদার, কাশ্মীর, লেসের তৈরি বাহারি সব জ্যাকেট, লং কোট, ব্লেজার, ড্রেস, স্কার্টের পাশাপাশি মুগ্ধ করেছে পাফি জুলিয়েট স্লিভ। কালেকশনগুলোতে ধূসর, নিউট্রাল, প্যাস্টেল আর ফেন্ডির সিগনেচার হলুদ রঙের ব্যবহার ছিল বেশি। এবারেই প্রথম দুজন প্লাস সাইজ মডেল তার শোতে হাঁটেন। তারা হলেন জিল কোর্টলেভ ও পালোমা এলসেসার।
প্রাদা
এ শোর অতিথিদের বসানো হয়েছিল ব্যালকনির ওপর আর রানওয়েকে বানানো হয়েছিল ইতালির কোনো ব্যস্ত পিয়াজ্জার আদলে। চল্লিশের দশকের টেইলরিং অনুপ্রাণিত কালেকশনে ছিল প্লিটেড ফ্রিঞ্জ স্কার্ট, কোট, ড্রেস। তবে সবচেয়ে বেশি নজর কেড়েছে এই কালেকশনের স্লিভলেস প্যাটেন্ট লেদার কোট, বক্সি বেল্ট আর রঙবেরঙের স্টকিং।
মসকিনো
সমকালীন বিশ্বরাজনীতির কথা ভেবেই জেরেমি স্কট এবারের পোশাকগুলোর ডিজাইন করছেন। ১৭৮৯ সালের ফরাসি বিপ্লব আর এখনকার হংকং, চিলি প্রোটেস্ট, ব্রেক্সিট- সবকিছু একসূত্রে গেঁথেছেন। কালেকশনে দেখা গেছে, মেরি অ্যানটনিয়েট স্টাইল গাউন আর ষাটের দশকের মিনি স্কার্টের হাইব্রিড ড্রেস। কিছু পোশাকের ডিজাইন ছিল বিশাল কেকের মতো। আরও ছিল ডেনিমে সোনালি সুতার এমব্রয়ডারি, লেদার, কালারফুল সাটিন কাপড়ের বাহার। মেরি অ্যানটনিয়েটের হেয়ারস্টাইলের আদলে সাজানো হয়েছিল মডেলদের চুল।
প্যারিস ফ্যাশন উইক ফল/উইন্টার ২০২০
করোনাভাইরাসের আতঙ্কের মধ্যেও ২৪ ফেব্রুয়ারি থেকে ৩ মার্চ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হয় প্যারিস ফ্যাশন উইক ফল/উইন্টার ২০২০। শোতে সাধারণ অতিথির উপস্থিতি ছিল কম, তবে সেলিব্রিটিদের সংখ্যা ছিল চোখে পড়ার মতো। অনেককেই দেখা গেছে বিচিত্র ডিজাইনের মাস্ক পরে অনুষ্ঠানস্থলে উপস্থিত হতে। নামী ডিজাইনারদের পাশাপাশি প্রদর্শিত হয় নবীনদের কালেকশন।
শ্যানেল
বিশ্বের সব ফ্যাশনবোদ্ধা অপেক্ষায় থাকে শ্যানেলের শোর জন্য। কার্ল লেগারফেল্ড গত হয়েছেন প্রায় এক বছর। তবু শোর সব জায়গাজুড়ে তিনি আছেন। এবারের কালেকশনের অনুপ্রেরণা ছিল লেগারফেল্ডের ১৯৮০ সালের একটি ফটোগ্রাফ, যেখানে তাকে দেখা যায় স্ট্রাইপ প্যান্টের সঙ্গে রাইডিং বুট পরিহিত অবস্থায়। এ ছাড়া অনুপ্রেরণা ছিল ১৯৬৮ সালের বিখ্যাত চলচ্চিত্র ‘লে বিশ’। কালেকশনে দেখা গেছে হর্স রাইডিং প্যান্টের ব্যতিক্রমী ও আরামদায়ক সংস্করণ, নানা ডিজাইনের ক্ল্যাসিক শ্যানেল স্যুট স্কার্ট আর লং কোট। সেই সঙ্গে ছিল হাইব্রিড রাইডিং/পাইরেট বুট, যেগুলো সব ধরনের পোশাকের সঙ্গে দারুণ মানিয়ে যায়।
এলি সাব
বিখ্যাত কতুর ডিজাইনার এলি সাবের রেডি টু ওয়্যার কালেকশন কেমন হবে, এই কৌতূহল প্রায় সবারই। তার এবারের কালেকশনগুলো ছিল কতুরের মতোই জমকালো। নি লেন্থ ড্রেস, রাফল আর লেস সমৃদ্ধ ব্লাউজ, লং ড্রেস কোট, টুইল স্কার্ট, পেনসিল কাট ও ওয়াইড প্যান্টে ভরা সংগ্রহের অনুপ্রেরণা ছিল স্পেনের শহর আন্দালুসিয়া। রং হিসেবে বেছে নিয়েছেন সব সময় এলিগেন্ট ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট, এমারেল্ড গ্রিন, স্কারলেট রেড আর এমবেলিশড ব্লু।
সেইন্ট লরেন্ট
অ্যান্থনি ভাকারেল্লোর সংগ্রহ আশি ও নব্বই দশকের ট্রেন্ডি আমেজ সমৃদ্ধ। আলট্রা গ্লসি লেটেক্স লেগিংস আর বডি হাগিং পেনসিল স্কার্টের সঙ্গে কাশ্মীর ও লেসের টপ, গিল্ডেড বাটনের ডাবল ব্রেস্টেড ব্লেজার, ভেলভেট, লেটেক্স গাউন পরে রানওয়ে উজ্জ্বল করে মডেলরা। লেপার্ড প্রিন্ট, পোলকা ডট, হাউন্ডসটুথ প্যাটার্নের উপস্থিতি ছিল বেশ, তবে নজর কেড়েছে। সঙ্গে মুগ্ধ করেছে ল্যাটেক্সের বহুল ব্যবহার।
ডিওর
ডিওরের ক্রিয়েটিভ ডিজাইনার মারিয়া গ্রাজিয়া চিয়ুরি যখন তরুণ, সত্তর দশকের দিকে ফেমিনিজমের চর্চা শুরু করেন। সেই সময়ের অনুপ্রেরণায় তিনি কালেকশনগুলো সাজিয়েছেন। কালো পোশাকের প্রাধান্য ছিল, আর অনেক রকমের চেক প্যাটার্ন। বোহো স্টাইলের গাউন, জ্যাকেট, ম্যাসকুলিন কাট প্যান্ট, সোয়েটার, ডেনিম জ্যাকেট, জিনস- সবকিছুতেই ছিল সত্তরের ছোঁয়া। নজর কেড়েছে মডেলদের মাথায় পরা নানা প্যাটার্নের ব্যান্ডানা।
ট্রেন্ড
দুটি ফ্যাশন উইক থেকেই কিছু ট্রেন্ড আসছে বছর খুব দেখা যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এসবের মধ্যে এগিয়ে রাখতে হবে পোশাকে ফ্রিঞ্জ, ফেদার, স্টেটমেন্ট পাফি স্লিভ ও রাফল কলারের ব্যবহার। ল্যাটেক্স হতে চলেছে ‘নিউ লেদার’। ভেলভেট নতুন করে জনপ্রিয় হবে। শীতের ফ্যাশনে বুট থাকেই, তবে আগামী শীতে রাইডিং ও চাঙ্কি বুটের হাইব্রিড দেখা যেতে পারে। অ্যাকসেসরিজে এগিয়ে থাকবে বড় নেকলেস। প্রায়ই সব পোশাকের সঙ্গে গ্লাভস পরা হবে। করোনাভাইরাসের জন্য রকমারি সব মাস্কও হতে পারে বিগেস্ট অ্যাকসেসরিজ ট্রেন্ড।
ফাহমিদা শিকদার
ছবি: ইন্টারনেট