skip to Main Content

স্বাদশেকড় I লেডি ক্যানিংয়ের নামে লেডিকেনি!

এটি কেবল মিষ্টি নয়, মিথও। ব্রিটিশ রাজপরিবার থেকে তা ছড়িয়ে পড়েছিল অভিজাত মহলে। তারপর বিচিত্র হাতে অপভ্রংশ হতে হতে হারিয়ে গেল এর মৌলিকতা। লিখেছেন সামীউর রহমান

ছানার ছোট ছোট কোলবালিশকে বিশাল কড়াইয়ে গরম তেলে হালকা আঁচে ভেজে তুলে নেওয়ার পর রাতভর এলাচিগন্ধী রসের পুকুরে ডুবিয়ে রাখলে যে অমৃত তৈরি হয়, তাকে কী বলে? উত্তর ভারতীয়রা বলবেন গুলাবজামুন, বাংলাদেশে পানতোয়া অথবা গোলাপজাম। ঠিক এ রকমই একটি মিষ্টি ছিল লেডিকেনি। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে
প্রকৃতির বৈচিত্র্য যেমন হারিয়ে যাচ্ছে, তেমনি ভীমচন্দ্র নাগের পরবর্তী প্রজšে§র ক্রমহ্রাসমান হাতযশ, ব্যবসার প্রসার আর সেই সঙ্গে বাড়তে থাকা ভাগীদারের দাপটে হারিয়ে গেছে লেডিকেনি। যে মিষ্টি ভীমনাগ বানিয়েছিলেন ভারতবর্ষের ইতিহাসের সন্ধিক্ষণে।
১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহের পর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনের অবসান হলো, ভারত চলে গেল সরাসরি ব্রিটিশ রাজত্বের অধীনে। সিপাহিদের বিদ্রোহ দমনের (পড়ুন ভারতবর্ষের প্রথম সশস্ত্র স্বাধীনতাসংগ্রামের মুখে ব্রিটিশ শাসনকে টিকিয়ে রাখার) পুরস্কার হিসেবে চার্লস জন ক্যানিংকে দেওয়া হয়েছিল বড়লাট বা ভাইসরয়ের পদ। এই জন ক্যানিংয়েরই জীবনসঙ্গিনী, কাউন্টেস শার্লট ক্যানিং বা লেডি ক্যানিংয়ের জন্যই কলকাতার বিখ্যাত ময়রা ভীমনাগ বানিয়েছিলেন বিশেষ এক ধরনের মিষ্টি। এই মিষ্টির নামই হয়ে ওঠে ‘লেডিকেনি’!
নির্ভুল তথ্য না পাওয়া গেলেও এটা জানা যায় যে, লেডি ক্যানিংয়ের সঙ্গে এই মিষ্টির উৎপত্তির একটা জোরালো সম্পর্ক আছে। কেউ কেউ বলেন, বড়লাট হিসেবে লর্ড ক্যানিংয়ের অভিষেকের অনুষ্ঠানে অতিথিদের আপ্যায়নের জন্য এই মিষ্টি তৈরি করা হয়েছিল। কেউ বলেন, লেডি ক্যানিংয়ের জš§দিন উপলক্ষে সেখান থেকে খাবারটি ছড়িয়ে পড়ে অভিজাত মহলেও। সঙ্গে লেডি কেনিংয়ের সুনাম এবং ভীমনাগের প্রসিদ্ধিও। একটা সময় কলকাতার নেমন্তন্ন বাড়িতে শেষ পাতে মিষ্টি হিসেবে লেডিকেনি ছিল বাঁধা আইটেম! এখন অবশ্য ক্যাটারারদের বদৌলতে বিলুপ্তপ্রায়!
ভাজা মিষ্টি হিসেবে কালোজাম, পানতোয়া কিংবা আমিত্তির সঙ্গে লেডিকেনির পার্থক্যটা কোথায়? কলকাতার বিশিষ্ট সাংবাদিক রূপায়ণ ভট্টাচার্য একবার এই নিয়ে খানাতল্লাশি চালিয়েছেন। খুঁজে দেখেছেন পুরোনো মিষ্টির দোকানগুলো, আলাপ করেছেন প্রবীণ দোকানি, বিখ্যাত মিষ্টি বিক্রেতা দ্বারিক ঘোষের বংশধর গোপিনাথ ঘোষ থেকে শুরু করে ভীমনাগের উত্তরসূরিদের সঙ্গেও। তার অনুধাবন, পানতোয়া হয় ক্ষীর দিয়ে আর লেডিকেনি ছানা দিয়ে। দ্বিতীয়টি একটু লালচে, কালোজামের মতো কালো নয়। রসটাও পাতলা। চাপেরও একটা পার্থক্য আছে। লেডিকেনির ভেতরটা ফাঁপা, ছানার তৈরি, রসে টইটম্বুর; সেখানে একটা এলাচিও দেওয়া হয়। ঠিক যেন শিল্পের মতো! ইমপ্রেশনিজম, এক্সপ্রেশনিজম, রোমান্টিসিজম- এসব নানান ঘরানার চিত্রকলার ভেতর যে সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম পার্থক্য, মিষ্টির জগতেও তেমনি। শুধু পার্থক্য হচ্ছে, এখানে রংতুলির বদলে ছানা আর রসের খেলা।
লেডি ক্যানিংয়ের জীবনটাও কিন্তু কম মিষ্টি নয়! ইংরেজ হলেও শার্লট স্টুয়ার্ট ক্যানিংয়ের জš§ ফ্রান্সে। কারণ, তার বাবা চার্লস স্টুয়ার্ট ছিলেন ফ্রান্সে ইংল্যান্ডের রাষ্ট্রদূত। একটা সময় স্টুয়ার্টের মেয়াদ ফুরাল প্যারিসে, ফিরলেন ইংল্যান্ডে। সামাজিক অনুষ্ঠানে মেয়েকে পরিচিত করলেন, এ রকমই এক অনুষ্ঠানে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী জর্জ ক্যানিংয়ের ছেলে চার্লসের সঙ্গে পরিচয়। শুরুতে একটু বাধা, দুই পরিবারের রাজনৈতিক মতাদর্শের ভিন্নতা; তবে অবশেষে পরিণয়। বড়লাট হিসেবে লর্ড ক্যানিং ভারতে আসার পর লেডি ক্যানিংও আসেন তাঁর সঙ্গে। চিত্রকলায় পারদর্শী লেডি ক্যানিং ভারতবর্ষের বিভিন্ন জায়গার ও বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষের ছবি এঁকেছেন। বিভিন্ন জায়গা থেকে সংগ্রহ করেছেন নানান রকম ফুলের চারা। গভর্নরের বাংলোয় তার বাগানটা ছিল দেখবার মতো!
ইংরেজ হলেও জন্মেছিলেন ফ্রান্সে আর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন ভারতের মাটিতে। ইংল্যান্ডে ফিরে যাবার আগে, শেষবারের মতো দার্জিলিংয়ের পাহাড় দেখতে যেতে চেয়েছিলেন লেডি ক্যানিং। কিন্তু যাত্রাপথেই ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হন, এরপর গভর্নর হাউসে স্বামীর বাহুডোরেই তার মৃত্যু হয়। তখন তার বয়স মাত্র ৪৪ বছর। কলকাতার বুকেই সেন্ট জন’স চার্চে আছে লেডি ক্যানিংয়ের সমাধি।
খুবই ছোট্ট আয়ু নিয়ে এসেও অমর হয়ে আছেন লেডি ক্যানিং। তার আঁকা অনেক ছবি এখনো সংরক্ষিত আছে লন্ডনের ভিক্টোরিয়া অ্যান্ড অ্যালবার্ট মিউজিয়ামে। আর তার নাম বহন করে চলছে বাঙালি কারিগরের সুস্বাদু সৃষ্টি ‘লেডিকেনি’।

লেখক: কালের কণ্ঠের সিনিয়র স্পোর্টস রিপোর্টার ও রসনালিখিয়ে
ছবি: ইন্টারনেট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top