রসনাবিলাস I মাচানের মোহনতা
সন্ধ্যা থেকে মধ্যরাত অব্দি ভোজনসমেত আড্ডা। উপাদেয় ও স্বাস্থ্যসম্মত খাবারের আয়োজন। বাহির দৃশ্যের মতো অভ্যন্তরও মনোরম
এই বসন্তেই খুলেছে লেট নাইট রেস্টুরেন্ট মাচান। লেকের পাড়ে আলোর রোশনাই। পুরো দোতলা বাঁশ দিয়ে মোড়া, চৌকো জানালা, নিয়ন বাতির হাতছানি। বহিঃসজ্জা দেখে ভেতরে দুদন্ড বসার ইচ্ছে হতে পারে।
কাঠের সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতেই খোলামেলা বসার জায়গা। হাতের ডানে কাউন্টার। চারজনে বসার মতো বেশ কটা টেবিল। অনেকের একসঙ্গে বসবার মতো ব্যবস্থাও রয়েছে। এক কোণে রাখা সোফা। মাথার উপরে টিনের চালা। পিলারগুলো বাঁশে মোড়ানো। দেয়ালে সিমেন্ট লেপে দেওয়া। মাটির ঘরের আদলে। কথা হলো উদ্যোক্তা তাসমিয়া আহমেদের সঙ্গে।
কীভাবে শুরু এই রেস্টুরেন্টের? গল্পের সূচনাটা লুকিয়ে আছে শৈশবে। তাসমিয়ার বেড়ে ওঠা বৈচিত্র্যময় খাবারের স্বাদ নিয়েই। বাবা উত্তর ভারতীয়, আগ্রার মানুষ, মা কোচবিহারের। দুই অঞ্চলের খাবারের মধ্যে তফাত অনেক। কেবল তা-ই নয়, বাবা নিরামিষাশী। মায়ের রুচি মাছ-মাংসে। বাবা পাঁচ তারকা হোটেলের চাকুরে ছিলেন, রান্নার হাতও ছিল অসাধারণ। তাই খাবারের গল্প আর গভীর রাতে বাবার হাতে বানানো পরোটা ছিল রুটিনমাফিক। এরপর প্রেম, বিয়ে, দেশান্তর। সংসার শুরুর দিকে চিন্তা ছিল আর কিছু না হোক; ব্রেড-ওমলেট দিয়েও তো কামাই করা যাবে!
কপাল ভালোই বলতে হয়। বাংলাদেশে এসে বিজ্ঞাপনী সংস্থার চাকরি, সংসার- সব গুছিয়ে নিয়েছিলেন। বাদ সাধল শৈশব-কৈশোরের স্মৃতি- খাবার। পিতলের তৈজসপত্রে সাবেকি কেতায় খাবার সাজাতে ভালোবাসতেন। তাতে ব্যবহৃত মসলা নিজের হাতে বেটে বা গুঁড়া করে নিতেন। রান্নার খুঁটিনাটি আর স্বাদের ব্যাপারে তার কোনো ছাড় নেই। সোশ্যাল মিডিয়ায় সেগুলো পোস্ট দিলেই আশপাশের বন্ধু-সহকর্মীরাও ভাগ পেতে চাইত। সবার আগ্রহ দেখে হাতে তৈরি ঘি, মসলা, তেল নিয়ে শুরু করেন পিওর শপের। চাকরিটা ছেড়ে দিলেন। রাতারাতি খ্যাতিও পেলেন। প্রয়োজন হলো আরও বড় আয়োজনের। তাই কিছুদিনের বিরতি।
এরই মধ্যে মেয়ের স্কুলের মেলায় ঘরে রান্না করা খাবারের পসরা নিয়ে বসলেন তিনি। ভালো সাড়া পেলেন। তখন মাথায় এল রেস্টুরেন্ট খোলার পরিকল্পনা। প্রায় এক বছরের প্রস্তুতি নিয়ে খুললেন মাচান। ঢাকা শহরের সবচেয়ে রসালো আর নরম মাংসের কাবাবের আস্তানা। যাকে বলে জ্যুসিয়েস্ট অ্যান্ড টেন্ডার মিট। রাজধানীর একমাত্র রেস্টুরেন্টও এটা, যেখানে নিয়মিত মেলে কাকোরি কাবাব।
মাচানের খাবারের তালিকাটা বেশ মজার। গভীর রাত পর্যন্ত খোলা
থাকলেও ক্রমেই এটাকে ভোর অব্দি টেনে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। তাই মেনু বুকে সারা রাত ও ভোরের খাবারের বিভিন্ন পদ। শুরুতেই রয়েছে কাবাব কা বাপ! কলকাতার পথে-ঘাটে খেয়ে বেড়ানো লোকজন নবাব ওয়াজিদ আলী শাহর বুড়ো বয়সের অবদানকে কীভাবে ভুলবেন? কাকোরি কাবাব! নবাবের দাঁত যখন কাবাবের মাংস ছিঁড়তে অক্ষম হয়ে গিয়েছিল, তখন মেটিয়াবুর্জের মহলের বাবুর্চি তৈরি করেছিল এই মাংসের কিমার অনবদ্য খাবার। এর ভেতরে রয়েছে শিকে বোনা বিফ (বিফ বটি কাবাব), শিকে বোনা চিকেন (চিকেন শিক কাবাব), শিকে বোনা মাটন (খাসির শিক কাবাব), চিকেন ভাংড়ি-টাংরি (তন্দুর চিকেন লেগস), চিজ মাস্ত মাস্ত (পনির টিক্কা), সবুজে বোনা চিকেন (চিকেন হরিয়ালি কাবাব), ভাজা মাছ উল্টা কাবাব (ফিশ টিক্কা) আর মাছে গাছে গোল মরিচ (ব্ল্যাক পেপার ফিশ টিক্কা)।
আরও রয়েছে ভাজা ডিম তাজা (ওমলেট), তাজা ডিম পোচ, জাতের বিফ কালা ভালো (বিফ কালাভুনা), বিফ কষা, চিকেন কষা, সুড়ুৎ বিফ (বিফ স্ট্যু), সুড়ুৎ মাটন (খাসির স্ট্যু), মাটন রোগান খুব জোশ (মাটন রোগান জোশ), পায়ার মায়া (বিফ নেহারি), পাঁচফোড়নে আলুর দম, মিলমিশে সবজি।
এসবের সঙ্গে প্লেইন নান, নানে মাখনে (বাটার নান), নানে রসুনে (গার্লিক নান), ভাজখোলা রুটি (রুমালি রুটি), প্যাচালি পরোটা (লাচ্ছা পরোটা) আর কচি লুচি। সাইডস হিসেবে ধনে মাখানি আর রাইতা রগড়।
কাবাব রুটিতে না পোষালে মাটন মাখা আদরে মাটস বিরিয়ানি আর বিফ মাখা সোহাগে তেহারি। পানীয়র তালিকায় লেম্বু পুদিনা (মিন্ট লেমনেড), লেম্বু চিপা (ফ্রেশ লেমনেড), মৌসুমি ভালোবাসা (সিজনাল ফ্রুট জুস), খাচ্ছি লাচ্ছি, বিমোহিত মোহিতো, বাঘ সামলান (বাদাম শরবত), ঝাকানাকা মিল্ক (মিল্ক শেক), মোলায়েম পানীয় (সফট ড্রিংকস)। চায়ের তালিকায় রয়েছে রঙ চা, ঢং চা (দুধ চা), মালাই চা, জংলি চা (মসলা চা), অবুঝ চা (গ্রিন টি)। রাতের আড্ডা বসানোর জন্য ঘুমজাগানিয়া কফি (ডিক্যাফ)। দিলঠান্ডা কফিও আছে- ফ্লেভারড কোল্ড কফি। ব্ল্যাক কফি, আমেরিকানো, এসপ্রেসো, ক্যাপাচিনো, লাতে আর মোকা।
লম্বা তালিকায় চোখ বোলানোর পর কষ্টকর হয়ে ওঠে খাবার বেছে নেওয়া। সহযোগিতা করলেন রেস্টুরেন্টের কর্ণধার তাসমিয়া আহমেদ। বললেন, ‘বিফ তেহারি তো খাবেনই, গার্লিক নান, গার্লিক পরোটা আর কাবাবে বাছবিচার করতে নেই। কাবাব প্ল্যাটারটাই বরং নিয়ে নিন। পাঁচ পদের কাবাবের টেস্ট পেয়ে যাবেন। আমাদের রোগান জোশ অবশ্যই ট্রাই করার আইটেম!’
প্রথমেই এক টুকরো চিকেন ভাংড়ি-টাংরি। চামচ ছোঁয়াতেই যেন গলে গেল। এতটাই নরম আর সুপক্ব। ব্যতিক্রমী স¦াদ। টুইস্ট আছে একটু। হালকা টক। গার্লিক নানে প্রচুর রসুনের কুচি দেওয়া। সবুজে বোনা চিকেন যথারীতি রসের ভান্ডার। পারফেক্ট মেরিনেশনের জন্য ভেতর পর্যন্ত মসলার স¦াদ চলে গেছে। একদম তুলতুলে। মুরগির স্বাদ ভোলার জন্য আছে চিজ মাস্ত মাস্ত। পনির বানানো হয়েছে তাসমিয়া আহমেদের নিজস্ব রেসিপিতে। ধনে মাখানির সহযোগে অসাধারণ। এবারে শিকে বোনা বিফ! অন্য কাবাবগুলোর মতো এটাও সফট ও জুসি। পারফেক্টলি চারকোল্ড। অতঃপর পালা মাছে গাছে গোলমরিচ। কয়লার আগুনে সেদ্ধ মাছ! আর রইল কাবাব কা বাপ। জাফরানের নবাবি স¦াদ ও সুঘ্রাণ বাড়িয়ে দিয়েছে কয়েক গুণ।
শেষে এলো বিফ মাখা সোহাগ। মাংসের ছোট ছোট টুকরোয় ভরপুর, আর মাইক্রো সাইজের আলু। সরিষার তেলের আকুল করা সুগন্ধি তেহারি। ভ্যানিলার স্বাদে ঘন দইয়ের লাচ্ছিও রয়েছে।
ভোজনের সূত্রে গভীর রাতে এখানেও আড্ডা জমতে পারে। খোলা থাকে সন্ধ্যা সাতটা থেকে রাত দুইটা অব্দি। কিছুদিন পরই সকালের নাশতাও পাওয়া যাবে লেকের ধারের এই বাড়িতে।
ঠিকানা: খ-৬৬/৫, শাহজাদপুর, গুলশান লেক ড্রাইভ রোড, ঢাকা ১২১২।
ফোন: ০১৩১১-৩৩৯১৩৯
আল মারুফ রাসেল
ছবি: মাচান