আলাপন I আমি বিশুদ্ধ সাধনার ভেতর আছি – সাইমন জাকারিয়া
গৎবাঁধা পথ থেকে স্বেচ্ছায় সরে গেছেন। ছোটবেলাতেই নিজের ভেতর বাউল-সাধকদের প্রতি টান অনুভব করেন। তাদের সঙ্গে মিশতে মিশতে চালিয়ে গেছেন গবেষণা। স্বীকৃতি হিসেবে সম্প্রতি পেয়েছেন বাংলা একাডেমি পুরস্কার। কেমন ছিল তার পথচলা, দেশের বর্তমান বাউল-সাধকেরা কী হালে আছেন- এমন কিছু প্রশ্ন নিয়ে তার সঙ্গে আলাপে বসেছিলেন শিবলী আহমেদ
ক্যানভাস: বাউল-সাধকদের নিয়ে দীর্ঘকাল ধরে গবেষণা করে চলেছেন। স্বীকৃতিও পেয়েছেন। এই পথচলায় আপনার গল্পটা শুনতে চাই।
সাইমন জাকারিয়া: ছোটবেলা থেকেই আমার স্বপ্নটা অন্যভাবে, অন্যদিকে নিয়েছি। সেটা সাধনার জীবনের দিকেই। আমার অন্যান্য বন্ধুর স্বপ্ন ছিল বাড়ি-গাড়ি থাকবে, সমাজে অনেক বড় অবস্থানে যাবে। আমার ওসব স্বপ্ন কখনোই ছিল না। আমার সবচেয়ে বড় স্বপ্ন হচ্ছে- আমি মানুষ, সংস্কৃতি ও দেশের জন্য কিছু করব। আমার দেশাত্মবোধের মূল উৎস আমাদের দেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। বিশেষ করে ছোটবেলা থেকে যে গানগুলো শুনেছি- বাউলগান; যেটা লালন ফকির, দুদ্দু সাঁই, পাঞ্জু শাহ, খোদাবক্স সাঁই বা অন্য সাধকেরা গাইতেন। তাদের গান শুনতে শুনতে বড় হয়েছি। একদল ত্যাগী মানুষ যারা সাদা পোশাক পরেন, যারা সাধনা করেন, তাদের দেখেছি। অবশ্যই এটি একটি ত্যাগের জীবন। ব্যক্তিগতভাবে যারা আমাকে চেনেন, তারা জানেন যে আমার কোনো উচ্চ বাসনা নেই। এই কাজ করতে গিয়ে অনেক বাধার সম্মুখীন হয়েছি। আমি যখন স্কুলে পড়তাম, খুব ভালো ছাত্র ছিলাম। কিন্তু যখন আমার ভেতরের স্বপ্নটা খুব বড় আকারে দানা বাঁধল, তখন আমি তান্ত্রিক-উপাসকদের সঙ্গে মেশা শুরু করি। কবিতা, গান ও নাটক লেখা শুরু করি। নাটকও করি। প্রথম বাধা এসেছিল পরিবার থেকেই। বলা হয়েছিল, এগুলো করলে তুমি জীবনে প্রতিষ্ঠা পাবে না। এগুলো প্রতিষ্ঠার পথ নয়। তাহলে প্রতিষ্ঠার পথ কী? ডাক্তার হও, ইঞ্জিনিয়ার হও বা সরকারি চাকরি কোরো। কিন্তু আমি সেই রকম স্বপ্ন দেখিনি। আমি স্বপ্ন দেখেছি- গতানুগতিকতার বাইরে মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার। সেটাই আসল প্রতিষ্ঠা। কারণ, পৃথিবীতে আমরা কেউই থাকব না। সেই অনুভব থেকেই ত্যাগের জীবন। বন্ধুবান্ধবের থেকেও বাধা এসেছে। পরবর্তীকালে ঢাকায় এসে যখন নিরন্তর কাজ করে যাচ্ছি, তখনো অনেকে আমার দিকে সন্দেহের চোখে তাকিয়েছে। যেন গ্রাম থেকে এসে এই কাজ করার অধিকার আমার নেই! এ কারণে অনেক ধরনের বাধা দেওয়া হয়েছে। অনেক ধরনের সমালোচনা হয়েছে। আমাকে শারীরিকভাবে নিগৃহীত করার জন্য বাইরে যত ধরনের বাধা আছে, সবই এসেছে প্রতিষ্ঠিত মানুষের কাছ থেকে। কিন্তু আমি শেষ পর্যন্ত আমার প্রত্যয় থেকে এক বিন্দুও সরিনি। কারণ, আমি জানি যে আমি বিশুদ্ধ সাধনার ভেতর আছি।
ক্যানভাস: বাংলাদেশের বাউল-সাধকেরা অবহেলিত। এটা কেন? বহির্বিশ্বেও কি তারা উপেক্ষিত?
সাইমন জাকারিয়া: যে মানুষগুলোকে আমরা বাউলগান করতে দেখি কিংবা যারা এই
সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের চর্চার সঙ্গে যুক্ত, যারা গ্রামে নৃত্য করে, গান করে, নাটক করে অথবা এমন বিচিত্র ধরনের সাধনা করে, তাদের প্রতি অবহেলার প্রধান কারণ হলো- হাজার বছর ধরে চর্চিত হওয়া এ সংস্কৃতি মূলত দেখে দেখে, শুনে শুনে শেখা হয়। গুরু ধরে শিষ্যরা শেখে; গুরু-শিষ্য পরম্পরায় এই ধারাবাহিকতা চলে। এর সঙ্গে আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার কোনো সংযোগ নেই। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় মানুষ কিছু বই-পুস্তক পড়ে, কিছু লিখে, তারপর বড় চাকরি করে সমাজে প্রতিষ্ঠা পায়। কেউ কেউ ব্যবসা করে কিংবা বিভিন্ন ধরনের কাজে যুক্ত হয়। তাদেরকেই সমাজের সবচেয়ে উচ্চ আসনে দেখা হয়। কিন্তু গ্রামের এই হাজার বছরের ঐতিহ্যের পরম্পরায় সংগীত, নৃত্য কিংবা নাটকের সাধনার সঙ্গে যারা যুক্ত, তাদের সঙ্গে তথাকথিত প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার কোনো যোগ নেই। কিন্তু তারাও একটি শিক্ষায় শিক্ষিত। সেই শিক্ষাকে আমরা বলি ‘সৃষ্টিশীল জ্ঞান’। সেই জ্ঞানের চর্চা করে বাউল থেকে শুরু করে গ্রাম্য সাধক। স্কুল-কলেজের জ্ঞানের সঙ্গে যেহেতু গ্রামের ঐতিহ্যবাহী জ্ঞানের কোনো সম্পর্ক নেই, সেহেতু আমরা শিক্ষিতরা তাদেরকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করি। মনে করি, তারা কিছুই জানেন না। ভাবি যে তারা জ্ঞানের অধিকারী নয়। কিন্তু আমরা শহরে যে বই পড়ছি, অর্থাৎ প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় যে বই-পুস্তক পড়ছি, সেই জ্ঞান কোথা থেকে এলো? সেই জ্ঞানের উৎস যদি বিশ্লেষণ করা হয়, দেখা যাবে সৃষ্টিশীল মানুষদের জ্ঞান নিয়েই বই লেখা হয়েছে। সেই বই পড়ে আবার তাদেরকেই অবহেলা করা হচ্ছে! বাউল-সাধকদের সঙ্গে যদি গভীরভাবে মেশা হয়, তাহলে বোঝা যাবে যে তারা কত বড় জ্ঞানের অধিকারী। বিজ্ঞানের আবিষ্কারের পর শরীরে কতগুলো হাড় আছে, কতগুলো নার্ভ আছে, তা শনাক্ত করা হয়েছে। কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক কোনো শিক্ষা ছাড়াই বাউল-সাধকেরা সেসব কথা বলে আসছেন। এই যে জ্ঞান, সেটিকেই কিন্তু আমরা মৌলিক জ্ঞান বলি। সারা পৃথিবীতেই এর প্রতি সম্মান দেখানো হয়। আমাদের দেশে এমনটি নেই। মৌলিক জ্ঞানকে সম্মান করার জন্য আন্তর্জাতিক একটা প্রতিষ্ঠান আছে। সারা পৃথিবী সেটিকে ‘ইউনেসকো’ বলে চেনে। তারা সব সময় বিভিন্ন দেশের সরকারকে চাপ দেয় দেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকা তৈরি করতে। সেগুলো রক্ষণাবেক্ষণের উদ্যোগ নেওয়ার জন্য। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সরকারি পর্যায় থেকে তা নেওয়া হয় না। আমাদের দেশের
সংস্কৃতির উপাদানগুলোর ঐতিহ্যবাহী তালিকা পাই না। কেননা এই তালিকা করার জন্য যে জ্ঞান, যে শ্রদ্ধাবোধ, যে সাংস্কৃতিক চর্চা থাকা দরকার, তা এখানে নেই। সারা পৃথিবীতেই এখন নিজ নিজ সংস্কৃতি নিয়ে অসংখ্য বই প্রকাশ পাচ্ছে। সেগুলোকে আন্তর্জাতিকভাবে তুলে ধরা হচ্ছে। আমরা একটু পিছিয়ে আছি।
ক্যানভাস: লোকাচারবিদ্যায় বিশেষ অবদানের জন্য আপনি বাংলা একাডেমি পুরস্কার পেয়েছেন। আপনার এই প্রাপ্তিতে বাউল-সাধকদের প্রতিক্রিয়া কী?
সাইমন জাকারিয়া: আমি ভীষণভাবে বিস্মিত ও অভিভূত হয়েছি। ফকির-সাধকদের ভেতর আমি এর আনন্দটা বেশি দেখেছি। তারা বলেছেন, আপনার পুরস্কার আপনার নয়, এ পুরস্কার আমাদের। এটা আমাকে খুব আনন্দিত করেছে। এ পুরস্কার পাওয়ার পর আমার প্রথম প্রতিক্রিয়া ছিল, এটা আমার একার নয়; কারণ, আমি যাদের নিয়ে কাজ করি, এটি দিয়ে মূলত তাদেরকেই সম্মানিত করা হলো।
ক্যানভাস: পুরস্কারপ্রাপ্তি অনেক সময় মানুষকে ভুল পথে ধাবিত করে। আবার অনেককে সঠিক পথে এগোতে প্রেরণা জোগায়। এই পুরস্কার আপনার কাজে কী প্রভাব ফেলবে?
সাইমন জাকারিয়া: বাংলা একাডেমি পুরস্কার পাওয়া গৌরবের ব্যাপার। এটিকে আমি কাজের স্বীকৃতি মনে করি। এ ধরনের গবেষণার সম্পর্কে আমার দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছিল যে আমি সঠিক পথে কাজটি করছি কি না। আমি অনেক দেশে যাচ্ছি, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াচ্ছি, আমার অনেক বই বেরোচ্ছে। সব সময় গভীরভাবে কাজ করার চেষ্টা করি। এসব কাজের প্রতি একধরনের আস্থা তৈরি হলো। আত্মপ্রত্যয় জন্মাল যে, আমি সঠিক পথে আছি। এ দেশের বুদ্ধিজীবী সমাজ এবং বাংলা একাডেমি আমাকে মূল্যায়ন করেছে। তাই এই গবেষণা আমাকে আরও গভীর, নিমগ্ন ও ত্যাগী হয়ে করতে হবে; আরও গভীরে পৌঁছাতে হবে। আগামী ১০ বছরের জন্য আমার গবেষণা-পরিকল্পনা করাই আছে। সেগুলো আরও দায়িত্বশীল হয়ে করার চেষ্টা করছি।
ক্যানভাস: আপনার গবেষণা আর কাজের ক্ষেত্রে অগ্রজ ও প্রবীণদের থেকে কী ধরনের সহায়তা পেয়েছেন? অনেক ক্ষেত্রেই অগ্রজ ও প্রবীণেরা তরুণদের কাজের মূল্যায়ন করতে চান না বলে শোনা যায়…
সাইমন জাকারিয়া: অগ্রজদের অস্বীকার করার কিছু নেই। তারা অবশ্যই উদ্দীপনা দিয়ে থাকেন। কিন্তু যেটা হয় যে, আমরা যারা নতুন, তাদের কাজগুলোকে অনেক সময় প্রবীণেরা মূল্যায়ন করতে চান না। আমি জীবনে যেভাবে মূল্যায়ন পেয়েছি, সেভাবে অপমানিত ও অসম্মানিতও হয়েছি। বাংলা একাডেমি পুরস্কার পাওয়ার পর অনেকেই এখন আমাকে সম্মানিত অবস্থানে দেখছেন। কিন্তু আমাকে অনেক ক্ষেত্রে অবর্ণনীয় নিগ্রহের শিকার হতে হয়েছে। সেগুলো আমি এখন হয়তো ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না। কিন্তু যারা ব্যক্তিগতভাবে আমাকে চেনেন, তারা জানেন যে এই ফোকলোর ও আমাদের দেশের ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি নিয়ে গবেষণার জন্য আমাকে অনেক নিগৃহীত হতে হয়েছে। আরেকটি বিষয় হচ্ছে, এই যে কাজগুলো করছি, আমার মতো আরও অনেক তরুণ করছে, তাদেরকে প্রকৃত অর্থে মূল্যায়ন করলে গবেষণায় নতুন একটি উদ্দীপনার সৃষ্টি হবে। এখনো যদি ন্যাশনাল বা ইন্টারন্যাশনাল লেভেলে ফোকলোর বিষয়ে কোনো গবেষণার উদ্দীপনার সৃষ্টি হয়, তখন কিছু ক্ষেত্রে যারা প্রকৃত গবেষক, তাদের বাদ দেওয়া হয়। বরং যাদের এ বিষয়ে কোনো আগ্রহ নেই, তাদেরকেই বেশি মূল্যায়ন করা হয়। ব্যক্তিগত সম্পর্কের কারণে এমনটা হয়। এটা খুব দুঃখজনক। সেটা অনেক ক্ষেত্রেই দেখি।
ক্যানভাস: আপনি ‘ফোক ডান্স’ নিয়েও কাজ শুরু করেছেন। কিন্তু বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান সেই অর্থে প্রতুল নয়। তথ্য-উপাত্তের এই ঘাটতির মধ্যে কাজ ও গবেষণা কীভাবে করবেন?
সাইমন জাকারিয়া: ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতির মূল উৎস হলো জনগণ। যারা তা চর্চা করেন, তাদের ভেতরেই সেটা আছে। কিন্তু আমি যদি টেবিলে কিংবা লাইব্রেরিতে বসে চিন্তা করি যে আমি সাংস্কৃতিক বিষয়ে গবেষণা করে ফেলব, সেটাও হতে পারে; বই কেটে বই লেখা, এ-ই তো চলছে বাংলাদেশে। কিন্তু মৌলিক গবেষণা করতে হলে সাধারণ মানুষের ভেতরে যেতে হবে। আমি ৩০ বছর ধরে তাদের মধ্যে আছি। আমার স্বপ্ন হচ্ছে বাংলাদেশের সব গ্রামে যাওয়া, তাদের সংস্কৃতি দেখা, তাদের সঙ্গে আন্তরিক সম্পর্ক তৈরির পাশাপাশি তাদের প্রতি ভক্তি ও শ্রদ্ধাশীল হওয়া এবং তাদের সংস্কৃতি নিয়ে কাজ করা। সেই কাজ কিন্তু এখনো চলমান। এখনো বাংলাদেশের প্রতিটি অঞ্চলে অনেক অনাবিষ্কৃত নৃত্যরীতি, সংগীতরীতি, কৃত্য বা ধর্ম অনুশীলনের বিষয়, ভাষাবৈচিত্র্য, নাট্যবৈচিত্র্য আছে। আমাদের সাংস্কৃতিক কত বৈচিত্র্য যে আছে সেটা অকল্পনীয়। আমি সিলেটে গিয়ে দেখেছি, ৯১ বছর বয়সী একজন সাধক, তিনি একুশে পদকপ্রাপ্ত, নাম সুষমা দাস। তিনি এখনো মুখে মুখে নিজে নিজে গান বাঁধেন। কত যে গান তার স্মৃতিতে আছে! হিসাব নেই। তাদের কাছে যদি যাওয়া যায়, তাহলে তথ্য-উপাত্তের কোনো অভাব হবে না।
ক্যানভাস: বাংলাদেশের কালচারাল সাইকোলজিতে একটা বড় পরিবর্তন এসেছে। এই ধারায় ফোক কীভাবে পরিবর্তিত হয়েছে?
সাইমন জাকারিয়া: ফোকের বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে, তা সব সময় পরিবর্তিত হয়। খোদাবক্স শাহের শিষ্যদের কাছে শুনেছি, তিনি যখন গান শেখাতেন, বলতেন- একটি গান অন্তত পাঁচটি সুরে গাইতে জানতে হবে। একটি গান সকালে ভৈরবী রাগে গাইলে সেটি দুপুরে বা সন্ধ্যায় অন্য রাগে গাইতে বলতেন। এই ঐতিহ্যের কথা কিন্তু আমরা জানি না। আমরা একটা সুর শুনে মনে করি যে সেটাই ফিক্সড। কিন্তু আমাদের ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতিতে পরিবর্তনশীলতা আছে। লোকসংস্কৃতির একটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে যে আত্তীকরণ ঘটতে পারে। অন্যের জিনিস নিজের করে নিতে পারে। নিজের ব্যবহার উপযোগী করে নেওয়া যায়।
ক্যানভাস: সাধক-কবিরা দেশের অগ্রযাত্রায় কিংবা সংকট নিরসনে কীভাবে ভূমিকা রাখেন?
সাইমন জাকারিয়া: বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধ এবং এখনকার ক্রাইসিসগুলোর দিকে তাকালেই আমরা বুঝতে পারব যে আমাদের লোক-সাধকেরা কী অসামান্য অবদান রেখেছেন। ভাষা আন্দোলনের সময় অসংখ্য গান লিখেছেন এ দেশের লোক-কবিরা। এ সম্পর্কে নাগরিক পরিমন্ডলে লোকেরা অতটা জানেন না। ভাষা আন্দোলন নিয়ে হালিম বয়াতির গান আছে। শাহ আবদুল করিমের গান আছে। সাধকেরা মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে গিয়ে গিয়ে তাদের উদ্দীপ্ত করেছেন। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে যেসব শিল্পী যুক্ত ছিলেন, তাদের মধ্যে বাউল-ফকিরেরাও ছিলেন। যেমন মকছেদ আলী সাঁই। ‘সোনায় মোড়ানো বাংলা মোদের শ্মশান করেছে কে, ইয়াহিয়া তোমায় আসামীর মত জবাব দিতেই হবে’ তার লেখা ও সুর করা গান। এটি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে প্রচারিত হয়েছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ওপর প্রথম গানটি লিখেছেন কিন্তু বাউল-ফকিরেরাই। শাহ আবদুল করিম ১৯৫৪ সালে গানটি লিখেছেন। বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতিতে সেটি গেয়ে শুনিয়েছেন। ‘চৌদিকে নক্ষত্রঘেরা, জনগণের নয়নতারা, শেখ মুজিবুর রহমান…’। গান শুনে বঙ্গবন্ধু তাকে আলিঙ্গন করেছিলেন। তাকে সে সময় ১০০ টাকা পুরস্কার দিয়েছিলেন। পরবর্তী সময়েও কিন্তু অনেক সাধক বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে গান লিখেছেন। বিশেষ করে ৬ দফা প্রস্তাব উত্থাপনের পরে সারা দেশের সাধকেরা তার ওপর গান লিখেছেন। সেসব গান নিয়ে সেভাবে আলোচনা-বিশ্লেষণ হয়নি। সেই তাগাদা থেকেই আমি ‘সাধক কবিদের রচনায় বঙ্গবন্ধুর জীবন ও রাজনীতি’ বইটি লিখেছি। তাতে দেখিয়েছি যে আমাদের সাধুগুরুরা কেবল ভাবুক নন, শুধু অধ্যাত্ম জ্ঞানের সাধনা করেন না, তারা রাজনীতিসচেতন, সমাজসচেতন, দেশপ্রেমী।
ক্যানভাস: গবেষণার কাজে আপনাকে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে গিয়ে বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী সাধকের সঙ্গে মিশতে হয়েছে। তাদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি কতটা?
সাইমন জাকারিয়া: আমি তাদের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি দেখে অভিভূত হয়ে গেছি। আমি দেখেছি যে মুসলিম সংস্কৃতির সঙ্গে হিন্দুরা এসে যুক্ত হচ্ছে। খ্রিস্টান সংস্কৃতির সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে সবাই মিলে। হিন্দুদের অনুষ্ঠানে মুসলমানরা যাচ্ছে। সেখানে ধর্মের কোনো বিধিনিষেধ তারা মানে না। সংস্কৃতির প্রশ্নে তারা পরস্পরের সঙ্গে সম্প্রীতির সম্পর্ক তৈরি করেছে। এর মধ্যে আমি লালমনিরহাটে গিয়েছিলাম। সেখানে নতুন ধরনের অভিজ্ঞতা হলো। দেখলাম ‘পাগলা পীর’ নামে একধরনের সংস্কৃতির চর্চা হয়। সেখানকার অনুষ্ঠানে হিন্দুরা এসে ভক্তি দিচ্ছে। মুসলমানরাও দিচ্ছে। সবাই সেখানে এক। এই যে সম্প্রীতি যেটা দেখলাম, তা অচিন্তনীয়।
ক্যানভাস: মসলিন কাপড়ের ঐতিহ্য নিয়ে আপনার লেখা ‘হাওয়াই ইন্দ্রজাল’ নাটকটি সম্পর্কে জানতে চাচ্ছি…
সাইমন জাকারিয়া: আমাদের দেশের বস্ত্রশিল্পের বিশাল সমৃদ্ধ একটা ইতিহাস আছে। খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয়-তৃতীয় অব্দে এই ভূখন্ডে বস্ত্র তৈরি হতো। সেটির নাম মসলিন। ঢাকার পার্শ্ববর্তী যে নদীগুলো আছে, সেসব এলাকায় এ ধরনের কার্পাস তুলা উৎপন্ন হতো। তা থেকে গ্রামের সাধারণ মানুষ হাতে সুতা তৈরি করত। তা দিয়ে মসলিন বানাত। সারা বিশ্বে এর সুখ্যাতি ছিল। এ দেশ থেকে মসলিন রপ্তানি হতো। রাজা-রানিরা পরতেন। তা ছাড়া রোম ও গ্রিসে ফ্যাশন হিসেবে মসলিনের কদর ছিল। এটি পরলে পুরো শরীরটা দেখা যেত। সেটা নিয়ে সেখানকার তৎকালীন কবিরা বিভিন্ন ধরনের তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে কবিতাও লিখেছেন। এই ইতিহাসগুলো আমি আমার হাওয়াই ইন্দ্রজাল নাটকের বইতে নতুন করে তুলে নিয়ে এসেছি।
ক্যানভাস: আপনার অবসর যাপন নিয়ে জানতে চাই…
সাইমন জাকারিয়া: অবসর বলে পৃথিবীতে মানুষের কিছু নেই। আমার তো নেই-ই। আমি যে ধারায় কাজ করি, সেখানে নিরবচ্ছিন্নভাবে ছুটে চলতে হয়। গভীরভাবে একটি বিষয়ের প্রতি অভিনিবেশ করতে হয়। তবে অবসর একদিন আসবে। আমি মনে করি, সেটি আসবে আমার মৃত্যুর ভেতর দিয়ে।
ছবি: সৈয়দ অয়ন