বিশেষ ফিচার I চ্যাপাকথন
এই বিশেষ শুঁটকি বাংলাদেশে বেশ জনপ্রিয়। বিশেষত সিলেটে, হাওর অঞ্চলে আর উত্তরবঙ্গে। কিন্তু এটি তৈরির প্রক্রিয়া অঞ্চলভেদে একেক রকম। লিখেছেন আবুল বাশার লিটন আমার ছেলেবেলার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু পরের গলিতে থাকত। একেবারে মানিকজোড় আমরা। সব সময় দুজনে একসঙ্গে চলতাম। মাঝেমধ্যে রাতে সে থেকে যেত আমাদের বাসায়। তার বাসা আমার বাসা থেকে খুব বেশি হলে দশ মিনিটের দূরত্ব, সেখানে গিয়েছি কতবার তা আঙুলে গুনে বলতে পারব। কেন আমি সেই বাসায় যেতাম না, আজ এত বছর পর সেই সত্যটা বলি। বন্ধুর গ্রামের বাড়ি ছিল হবিগঞ্জে। অর্থ, প্রতিপত্তি, কৌলীন্য- সবকিছু নিয়েই অনেক বছর আগে বন্ধুর বাবা সপরিবারে ঢাকায় চলে আসেন। পৃথিবীর প্রায় সব সিলেটির মতো তারা নিজেদের দেহটুকুই শুধু সিলেট বা হবিগঞ্জ অঞ্চলের বাইরে নিয়ে আসেন না, সেখানকার মন-প্রাণ, ভাষা, খাদ্য থেকে শুরু করে মূল্যবোধও তাদের সঙ্গী হয় এবং তা নিঃশর্ত ও অবিচ্ছেদ্য। আমার এই বন্ধু পরিবার একই শর্তে সিলেটের সাতকড়া, জামির আদা, বিরুই চাল যেমন এত বছর ঢাকা বাসের পরও প্রতি মাসে নিয়ে আসে গ্রাম থেকে, ঠিক তেমনি প্রতি মাসে হিদল বা সিদলের একটা বড়সড় চালান আনতে কখনো ভুল করে না। এই হিদল বা সিদল যা আমার নিজের গ্রামে চ্যাপা নামে পরিচিত, তা প্রায় নিত্য রান্না হতো বন্ধু পরিবারে। সিদলের সেই গন্ধ বন্ধুর বাড়ির কয়েক শ মিটার পর্যন্ত ঘিরে থাকত। এদিকে জগতে অনেক কিছুর প্রতি আমার উদাস ভাব থাকলেও সমস্যা সৃষ্টি করে চ্যাপার গন্ধের তীব্রতা। কোনো এক জটিল কারণে আমি খুব সূক্ষ্ম কটু গন্ধও তীব্রভাবে অনুভব করি। আমার ঘ্রাণযন্ত্রের এই সুতীব্র সংবেদনশীলতার কারণে বন্ধুর বাড়ি গিয়ে নাড়িভুঁড়ি উল্টে বিচ্ছিরি কান্ড রোধ করতেই হাতে গোনা কয়েকবার গিয়েছি মাত্র। যে কয়েকবার গিয়েছি, থেকেছি খুব অল্প সময়। এই থাকাটা ভদ্রতার সীমার মধ্যে রাখতে আমাকে ছলনার আশ্রয় নিতে হতো। আমার নাকের সমস্যার জন্যই হোক আর সিদল বা চ্যাপা প্রস্তুত প্রণালির জন্যই হোক, গন্ধটা শুধু আমারই সমস্যা। অথচ বাংলাদেশের একটা বিশাল জনগোষ্ঠীর অতি প্রিয় খাদ্য এই চ্যাপা বা সিদল। কোথায় এর উৎপত্তি, কীভাবে এর উদ্ভাবন, এর ইতিহাসই-বা কী- এখনো এটা নিয়ে বাংলাদেশে তেমন কোনো গবেষণা হয়নি বললেই চলে। তবে জার্নাল অব এথনিক ফুডস (বর্ষ ৩, সংখ্যা ৪, ডিসেম্বর ২০১৬) ভারত সরকারের অনুদানে এই ব্যাপারে কিছু কাজ করে। তাদের কাজের সীমা ছিল উত্তর-পূর্ব ভারতের রাজ্যগুলো। তবে এটা বলা যায়, বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চলকে বাদ দিয়ে এই চ্যাপা বা সিদলের ইতিহাস সম্পূর্ণ খন্ডিত। একটি কথা বলে রাখা ভালো, সিদল বললে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে প্রচলিত পুঁটি বা ছোট দেশি মাছের শুঁটকি আর কচুর ডাঁটা দিয়ে বানানো গোল গোল মন্ডজাতীয় খাবারকেও বোঝায়। বাংলাদেশের উত্তরবঙ্গে এটি খুবই জনপ্রিয় খাবার। সে বিষয়েও কিছু আলোচনা করব। কিন্তু এই লেখায় ‘সিদল’ বলতে মূলত চ্যাপা শুঁটকিকেই বোঝানো হচ্ছে। চ্যাপা বা সিদলের আরও মূলে যাওয়ার আগে এই প্রক্রিয়ায় মাছকে সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা কেন পড়ল, তা আগে জানা দরকার। সিলেটসহ উত্তর-পূর্ব ভারতের পাহাড়ঘেরা অঞ্চলগুলো ব্রহ্মপুত্র অববাহিকায় মিঠাপানির নদী, খালবিল, জলা, হাওরে পূর্ণ। এসব জলাধার নানা রকম মাছে পরিপূর্ণ, সেই প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে। এই অঞ্চলের মানুষ মাছের ওপর সব সময় নির্ভরশীল ছিল। বছরের একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত হাওর-বাঁওড়ে পানি যখন থাকত, এই অঞ্চলের মানুষ মাছ ধরে তা বিক্রি করে জীবন চালাত। যেহেতু এই হাওর-বাঁওড় বা জলাশয়ে পানি সারা বছর থাকত না, তাই বছরের অন্য সময়ের জন্য মাছ সংরক্ষণের সবচেয়ে সুবিধাজনক উপায় ছিল শুঁটকি বা রোদে শুকানো মাছ। সমস্যা হলো, পৃথিবীর সবচেয়ে বৃষ্টিবহুল এলাকা হওয়ায় মাছ শুকিয়ে সংরক্ষণের জন্য পর্যাপ্ত সূর্যালোক এবং আর্দ্রতা বছরের একটা সময়ে পাওয়া দুষ্কর হয়ে দাঁড়ায়। বিশেষ করে ছোট পুঁটি, মলা, ঢ্যালা বা দারকানা জাতীয় মাছ, যা প্রচুর পরিমাণে ধরা পড়ত, তা সংরক্ষণের জন্য বিভিন্ন পন্থার দরকার হয়ে পড়ে। এ কারণেই ইতিহাসের কোনো এক সময় উদ্ভাবিত হয় এই ফার্মেন্টেড ফিশ পদ্ধতি, যা দিয়ে পুঁটি, পাবদা, মলা, দারকানার মতো ছোট ও দ্রুত পচনশীল মাছকে চ্যাপায় রূপান্তর করা যায় খুব সহজে। সাধারণত পৃথিবীর অন্যান্য, এমনকি আমাদের পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতেও ফার্মেন্টেড ফিশ প্রসেস করতে লবণ ব্যবহার করা হয়। আমাদের দেশে নোনা ইলিশও একই প্রক্রিয়ায় সংরক্ষিত হয়। কিন্তু চ্যাপায় আমরা লবণের ব্যবহার দেখি না। এর কারণ অনুসন্ধান করে আর জি পোল্টার তার প্রসেসিং অ্যান্ড স্টোরেজ অব ট্র্যাডিশনাল ড্রাইড অ্যান্ড স্মোকড ফিশ প্রডাক্টস বইতে বলেছেন, খুব সম্ভবত এই অঞ্চলের মানুষ লবণের ব্যবহার শেখার আগেই চ্যাপা বা সিদলের ক্ষেত্রে ফার্মেন্টেড ফিশ প্রসেস করার উপায় রপ্ত করেছেন। বরাক উপত্যকায় মনসামঙ্গল রচয়িতা একজন কবির নাম রামচন্দ্র চৌধুরী। তাঁর কাব্যের চাঁদ সওদাগর বাণিজ্যের জন্য ‘সিদল’ (শুকনো মাছ) সঙ্গে নিয়ে সমুদ্রে পাড়ি দিয়েছিলেন এবং সিংহলের রাজার কাছে ‘আশ্চর্য বস্তু’ তথা ‘সিদলপুড়া’ তৈরির প্রণালিও বর্ণনা করেছেন- ‘অগ্নিমধ্যে সিদলকে কিঞ্চিৎ জ্বালাইয়া কাঁচা মরিচ আদা লবণ মিশাইয়া মিশ্রিত করিয়া যদি করহ ভক্ষণ তবে সিদলের মর্ম জানিবা আপন।’ হালখাতার লেখক এম এ মালিক তাঁর বইতে অহমীয় এবং টিপারাদের চ্যাপা বা সিদল খাওয়ার কথা উল্লেখ করেছেন এভাবে, অহমীরা কাঁচা সুপারি মাটির নিচে পুঁতে রেখে খোসা পচে গেলে পান দিয়ে চিবিয়ে খায়। এই সুপারি থেকে বিশ্রী রকমের পচা গন্ধ বের হলেও তা অহমীদের খুব প্রিয়। যেমন আমরা পচানো পুঁটি মাছের সিদল খাই। সিদল ম্যালেরিয়া নাশক। এটি কোষ্ঠ পরিষ্কার রাখে, সে জন্য নাকি টিপারারা সিদল খায়। অবশ্য ওরা যেভাবে খায় আমরা সেভাবে খাই না। সিদল শুঁটকির মতো তরকারির সঙ্গে রান্না করে আমরা খাই এবং মরিচ-পেঁয়াজ দিয়ে ভর্তা করেও খাই। টিপারারা নাকি খায় কাঁচা। লবণ, কাঁচা মরিচ আর কয়েকটা সিদল কেজি খানেক পানিতে মাঠা তৈরির মতো ঘুঁটে সুরা তৈরি করে ভাতের সঙ্গে মিশিয়ে খায় নাগারা। আমরা ছোটবেলায় সিদল বড়শিতে গেঁথে কৈ মাছ ধরতাম। বাংলাদেশ ও ভারত ছাড়াও হুবহু একই প্রক্রিয়ায় চ্যাপা বা সিদল বানানো হয় পূর্ব থাইল্যান্ডে। ওই অঞ্চলের মানুষের খুবই প্রিয় খাবার এটি। এ ছাড়া ফার্মেন্টেড প্রক্রিয়ায় পৃথিবীর আরও অনেক দেশে মাছ সংরক্ষণ করা হয়। ফিলিপাইনের বেগংকে কুচো চিংড়ির চ্যাপা বলা যায়। যদিও এই প্রক্রিয়ায় লবণ ব্যবহৃত হয়। জাপান, শ্রীলঙ্কা, সেনেগাল, সুদান, আইসল্যান্ড, কোরিয়া, ঘানা থেকে শুরু করে গ্রিসেও পাওয়া যায় প্রায় কাছাকাছি পদ্ধতিতে মাছ সংরক্ষণ করার ইতিহাস। এত কিছুর পরেও বলা যায়, বাংলাদেশের চ্যাপা বা সিদল তার প্রস্তুত প্রণালির কারণে স¦াদে ও গন্ধে অন্য অনেক দেশের চেয়ে বেশি ইউনিক। চ্যাপা বা সিদল বাংলাদেশের মানুষের গান, গল্পকথায় নানাভাবে উঠে এসেছে। গোপী চন্দ্রের গানে পাওয়া যায়, ‘জবতে হাড়ি সিদল নড়ে আর চড়ে। তবতে বসমাতা কোড়ত কোড়ত করে।’ শুধু বাংলায় নয়, অহমিয়াতেও আছে। ‘পাটানী নাপিন্ধা আপী গিলানক মোর ভাল না লাগে। উমিরা ঘুমের পারি উঠিয়া চোতালত গবর চান নেদে। উমিরা ঘরত গুষ্টি আসিলে শুটকা-সিদল-ছেকা দিয়া ভাত খাবা দিবা লাজ পায়।’ এহেন চ্যাপা নানাভাবে খাওয়া হয়, তবে সবচেয়ে জনপ্রিয় খাদ্যপ্রণালি সম্ভবত শুকনো মরিচ, পেঁয়াজ রসুনের সঙ্গে শিলনোড়ায় পিষে ভর্তা করে খাওয়া। চ্যাপার ভুনাও খুব জনপ্রিয় বাংলাদেশ ও ভারতের উত্তর-পূর্ব প্রদেশগুলোতে। লিজি কলিংহামের ‘কারি’ বইতে সিলেট এবং চ্যাপার বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে, ‘The most distinctive specialty from Sylhet is rotten punti fish. The fish, which abound in the lakes that cover the region, is put into earthen wear pots and covered with mustard oil, and then the pots are sealed and buried in the ground. By the time they are dug up again, the fish has fermented into an oily paste..’ সিলেটি সিদল তৈরির প্রক্রিয়ায় পুঁটি, ফাইস্যা বা যেকোনো ছোট মাছ ভালো করে পরিষ্কার করে ধুয়ে, মাটির বড় হাঁড়ি, কলসি, মটকার ভেতর বাইরের মাছের তেল মাখিয়ে ৭/১০ দিন রোদে শুকিয়ে নিতে হয়। লিজি কলিংহামসহ অনেকেই মাছের তেলের বদলে সরিষার তেলের ব্যবহারের কথা উল্লেখ করেছেন। শুকানো মাছ বড় ঝুড়ি, টুকরিতে নিয়ে একবার ধুয়ে সারা রাত পানি ঝরানোর জন্য রেখে দিতে হয়। সকালে সে মাছ মাটির পাত্রে ভালো করে বিছিয়ে ভরে নিলেই হলো। ঠেসে ঠেসে ভরতে হয়, যাতে ভেতরে কোনো ফাঁকা জায়গা না থাকে। ছোট মাটির মটকা হলে তাতে হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চেপে চেপে ভরা হয়। আর যদি বড় মটকা হয়, সে ক্ষেত্রে মটকায় দেহের অর্ধেক প্রবেশ করিয়ে পা দিয়ে চেপে ফাঁকা পূর্ণ করা হয়। খুব সম্ভবত এই চেপে চেপে মাছ মাটির পাত্রে ভরার প্রক্রিয়া থেকেই ‘চ্যাপা’ শব্দটি এসেছে। মাছ ভরার পর মটকার মুখ প্রথমে কলাপাতা, তেঁতুলপাতা দিয়ে ভালো করে বন্ধ করে দেওয়া হয়। তারপর কাদা মাটি দিয়ে তা বন্ধ করে দেওয়া হয় ভালো করে, যাতে ভেতরে বাতাস ঢুকতে না পারে। পরে মটকার গলা পর্যন্ত মাটির নিচে পুঁতে রাখা হয় ৪০ দিন থেকে ৪/৫ মাস। জার্নাল অব এথনিক ফুডসে বলা হয়েছে, কলাপাতা বা তেঁতুলপাতা দিয়ে ঢেকে দেওয়ার আগে শুকনো শুঁটকি গুঁড়া করে বিছিয়ে দিয়ে তার উপর পাতা দিয়ে ঢেকে কাদা মাটি লেপে দেওয়া হতো। প্রথম এক সপ্তাহ প্রায় প্রতিদিন সেই মাটির প্রলেপ পরীক্ষা করা হতো, কোনো ধরনের ফাটল বা ছিদ্র তাতে হয়েছে কি না সেটা দেখার জন্য। যদি ফাটল বা ছিদ্র পাওয়া যেত, তবে আবার মাটির প্রলেপ দেওয়া হতো। চ্যাপা বা সিদল তৈরির ক্ষেত্রে এই বায়ুনিরোধ প্রক্রিয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, মটকার ভেতরে বাতাস ঢুকলে তাতে ফার্মেন্টেশনের পরিবর্তে মাছ পচে যেত। যেহেতু দীর্ঘ সময় সেই মটকা মাটির নিচে রাখতে হয়, তাই অনেকে মটকার উপরে লাউ, কুমড়া, সিমের গাছ লাগিয়ে দেন মটকায় ছায়া দেবার জন্য। সুপারিগাছের ডোগলা দিয়ে বা টিন দিয়েও অনেকে ঢেকে দেন। চ্যাপা তৈরির এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের জনপ্রিয় খাবার সিদল তৈরির প্রক্রিয়াগত পার্থক্য আছে। উত্তরবঙ্গের সিদল বানানোর প্রক্রিয়া হচ্ছে, ছোট মাছ ভালো করে ধুয়ে রোদে শুকিয়ে শুঁটকি করে নিতে হবে। তারপর ঢেঁকি বা উদুখলে মিহি গুঁড়া করে নিতে হবে। কচুর ডাঁটা ধুয়ে, ছিলে ২/৩ ঘণ্টা রোদে রেখে পানি শুকিয়ে মিহি পেস্ট তৈরি করতে হবে। শুঁটকির গুঁড়া আর কচুর ডাঁটার মন্ড একসঙ্গে মিশিয়ে নিয়ে হাতের তালুতে চাপ দিয়ে গোল গোল মন্ড তৈরি করে কড়া রোদে কয়েক দিন ধরে শুকাতে হবে। এই মন্ড বানাতে কোথাও কোথাও পেঁয়াজবাটা, হলুদ, মরিচ, ধনে, আদা, রসুনবাটা, তেল, লবণ একসঙ্গে ব্যবহার করার প্রচলনও দেখা যায়। চট্টগ্রাম এবং সংলগ্ন পাহাড়ি এলাকায় চ্যাপা বা সিদল নাপ্পি নামে পরিচিত। সাধারণত কুচো চিংড়ি বা অন্য পাহাড়ি মাছ দিয়ে নাপ্পি তৈরি হয়। নাপ্পি তৈরির প্রক্রিয়া চ্যাপা থেকে ভিন্ন। স¦াদ ও গন্ধও অন্য রকম। চ্যাপা অনেকভাবে খাওয়া যায়, তবে সবচেয়ে জনপ্রিয় হচ্ছে চ্যাপার ভর্তা। দ্বিতীয় স্থানে অবশ্যই চ্যাপার ভুনা। আসুন, দেখা যাক এই দুই প্রক্রিয়ার প্রস্তুত প্রণালি। উল্লেখ্য, ভর্তা ও ভুনার এই তৈরি প্রণালি অঞ্চল ও ব্যক্তিভেদে বিচিত্র। সিদল শুঁটকি ভর্তা উপকরণ: সিদল শুঁটকি ৪/৫টি, রসুন কোয়া ১০টি, কাঁচা মরিচ ৮/১০টি (অনেক অঞ্চলেই কাঁচা মরিচের পরিবর্তে শুকনো মরিচ বেশি জনপ্রিয়, বিশেষ করে কিশোরগঞ্জ), পেঁয়াজকুচি ১ টেবিল চামচ, লবণ স¦াদমতো। প্রণালি: সব উপকরণ একটি প্যানে নিয়ে ১ কাপ পানি দিয়ে চুলার আঁচে রেখে ঢেকে দিন। পানি একেবারে শুকিয়ে গেলে বেটে নিন। ব্লেন্ডারও ব্যবহার করতে পারেন। মনে রাখবেন, শিলনোড়ার ভর্তাই বাংলার ঐতিহ্য। যেহেতু আমাদের বিশাল জনগোষ্ঠীর একটা বড় অংশ প্রবাসে থাকে, তাই তাদের সুবিধার কথা ভেবে ব্লেন্ডারের উল্লেখ করা হলো। চ্যাপা শুঁটকির ভুনা চ্যাপার কানকো ও ফুলকা এবং পিঠের বড় কাঁটা ফেলে দিতে হবে। পানিতে ভিজিয়ে রেখে লবণ দিয়ে বেশ কচলে, যতক্ষণ উপরে তেলটা থাকে, ধুতে হবে। তারপর চালুনিতে নিয়ে ট্যাপের বা যেকোনো উৎসের রানিং ওয়াটারে আস্তে আস্তে ধুয়ে মাছের আঁশ ভালো করে পরিষ্কার করতে হবে। তারপর কড়াইতে দেওয়া তেল গরম হলে শুঁটকির পরিমাণ অনুযায়ী বেশ কিছু পেঁয়াজকুচি, পেঁয়াজকুচির তিন ভাগের এক ভাগ রসুনকুচি দিয়ে নাড়তে থাকুন। পেঁয়াজ, রসুন হালকা বাদামি হলে শুঁটকি ও লবণ দিয়ে নাড়তে হবে। হলুদগুঁড়া, মরিচগুঁড়া, সামান্য ধনিয়াগুঁড়া আর একটু রসুনের পেস্ট দেওয়ার পর সামান্য পানি দিয়ে নাড়তে থাকুন। শুকিয়ে তেল বেরিয়ে এলে নামিয়ে পরিবেশন করুন। চ্যাপার ভর্তা বা ভুনা সাধারণত গরম ভাত, খুদের ভাত, কাঁজির ভাত (অনেক অঞ্চলে কাঞ্জির ভাত বলা হয়) দিয়ে খাওয়ার চল থাকলেও ইদানীং চিতই পিঠা, চাপাতি দিয়েও এর প্রচলন শুরু হয়েছে। এর বাইরে অনেক অঞ্চলে চ্যাপা বা সিদলের পাতুরি পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে। চ্যাপা বা সিদল খনিজ লবণের একটি বড় উৎস এবং এটি সুষম অ্যামাইনো অ্যাসিড বহন করে, যা মানবদেহের জন্য খুবই উপকারী। চ্যাপায় কমবেশি স্থিতিশীল লিপিড রয়েছে, যার কোনো মিউটেজেনিক ক্রিয়া নেই এবং তা মানবদেহের জন্য নিরাপদ বিবেচিত হয়। চ্যাপা বা সিদল মটকার আবদ্ধ আর্দ্রতা ও উত্তাপ থেকে মুক্ত হয়ে আসার পর কমবেশি উনচল্লিশ দিন পর থেকেই এর পুষ্টিমান কমতে থাকে। তাই বলা যায়, মটকা থেকে চ্যাপা বা সিদল বের করার পর যত দ্রুত সম্ভব খেয়ে নেওয়া উচিত। চ্যাপা বা সিদলের ক্ষতিকর দিক হলো, এটি খাওয়া হয় ভর্তা বা ভুনা করে, যাতে প্রচুর পরিমাণে ঝাল, বিশেষ করে শুকনো মরিচ ব্যবহার করা হয়, যা অন্ত্রে ঘায়ের জন্য সরাসরি দায়ী। অনেক পুরোনো চ্যাপা বা সিদল যদি সেমি ফার্মেন্টেড পর্যায় অতিক্রম করে পচনের উপক্রম হয়, তা পেটের পীড়াসহ বিভিন্ন ধরনের অসুখ সৃষ্টি করতে পারে। এক সমীক্ষায় দেখা যায়, আমেরিকার আলাস্কার মানুষ কিছুটা খাটো হয়ে যাচ্ছে। তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে বিশেষজ্ঞরা জানান, এর কারণ সম্ভবত আলাস্কার মানুষ ফার্মেন্টেড মাছ, সিল, ভোঁদড় ইত্যাদি খাওয়া। যদিও এই তত্ত্বের অনেক বিরুদ্ধ মতও আছে। বাংলাদেশে যদিও সে রকম কোনো পরীক্ষা-নিরীক্ষা বা উপাত্ত সংগ্রহ করা হয়নি, তাই নিশ্চিতভাবে বলতে পারা যায় না যে এই চ্যাপা বা সিদল বা ফার্মেন্টেড ফিশ আমাদের দেহে কী ধরনের ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। বাংলাদেশে চ্যাপার রাজধানী বলা যায় সিলেটকে। এই জেলার বুক বেয়ে বয়ে চলছে সুরমা নদী। এমনিতেই আমাদের অত্যাচারে বাংলাদেশের প্রায় সব নদী মৃত, এর সঙ্গে সিলেটে ইদানীং যোগ হয়েছে এই চ্যাপা শিল্পের কিছু লোভী মানুষ। সুরমার পারেই সিলেটের চ্যাপা বা সিদলের সবচেয়ে বড় বাজার। সেখানকার প্রায় সব ব্যবসায়ী নিজেদের দোকান বা গুদামে চ্যাপা তৈরির বন্দোবস্ত থাকার পরেও নদীর তীরে মাটি খুঁড়ে মটকা স্থাপন করে অবৈধভাবে চ্যাপা তৈরি করছে। যত্রতত্র খোঁড়াখুঁড়ি করে এবং মটকা উঠিয়ে নিয়ে মাটি ভরাট না করায় নদীর তীর ভেঙে পড়ার উপক্রম হচ্ছে। নানা আবর্জনায় নদীর পানি দূষিতও হচ্ছে। এ ছাড়া চ্যাপা বাজারের গন্ধ জনস¦াস্থ্যের জন্য একটা হুমকিও বটে। এত কিছুর পরেও বলা যায়, বাংলাদেশের মানুষকে যদি দুই ভাগে ভাগ করা হয়- কে চ্যাপা বা সিদল পছন্দ করে, আর কে করে না, প্রথম দল খুব সহজেই সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে। এমন জনপ্রিয় চ্যাপা সম্পর্কিত ছোট্ট একটা অভিজ্ঞতা দিয়েই রচনাটি শেষ করছি। ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে আমার মা আমাদের কাছে বেড়াতে আসেন চেক রিপাবলিকে। আমার মায়ের স¦ভাব হলো, তিনি যেখানে যাবেন তার প্রিয় সবকিছুই সঙ্গে করে সেখানে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করবেন। এ ক্ষেত্রে তার প্রিয় সন্তান বা নাতি-নাতনি তো অবশ্যই, বালিশ চাদরও তালিকা থেকে বাদ যায় না। মা এসেছেন তখন সপ্তাহখানেক হয়। ব্যবসার কাজে হাঙ্গেরিতে রয়েছি। দুই দিন পর ফিরে দেখি আমার বাড়িতে বিশ্রী রকমের গন্ধ। গন্ধ চেনা চেনা লাগলেও চিনতে পারছিলাম না। আমার স্ত্রীকে চেপে ধরলাম ব্যাপার জানার জন্য। সে নানা গাঁইগুঁই করে জানাল, মা দেশ থেকে এক রকম ছোট মাছ এনেছে এবং সেটা রান্না করেছে। এ তারই গন্ধ। বুঝে গেলাম আমি, কী ঘটেছে। আমার মায়ের চ্যাপা-প্রীতি যেমন আমি জানি, আবার আমার মা জানেন আমার চ্যাপা-ভীতির কথা। এই দুই জানাজানির ফল হচ্ছে, আমার মা তিন মাসের জন্য তার সাধের চ্যাপা খাওয়া বন্ধ রাখতে নারাজ; তাই শিলনোড়া থেকে শুরু করে চ্যাপার ভর্তা বানানোর সব সরঞ্জাম নিয়ে হাজির। অপেক্ষায় ছিলেন কখন আমি বাইরে কোথাও যাব, সেই সুযোগের। তার মনের আরেক গোপন ইচ্ছা ছিল, একমাত্র বিদেশি পুত্রবধূকে প্রিয় চ্যাপার ভক্ত করে যাবেন। কিন্তু বিধি বাম! তথ্যসূত্র এবং কৃতজ্ঞতা Lizzie Collingham, Curry. R.G. Poulter, `Processing and storage of traditional dried and smoked fish products’, Journal of Ethnic Foods, Volume 3, Issue 4, December 2016. মুকুন্দ দাস, চন্ডীমঙ্গল এম. এ. মালিক, হালখাতা নুনেতে ভাতেতে খাদ্যবিষয়ক ফেসবুক গ্রুপ এবং এর সদস্য সুরঞ্জনা মায়া, কাজী সোহেল, সানাউল্লাহ নুরী হিমেল, শায়লা তৃণা প্রমুখ।